দরিদ্র অন্তত ৪০ লাখ! অন্ধকার ভবিষ্যতের সামনে ইউক্রেনের একরত্তি শিশুরা

Russia Ukraine War : রাজায় রাজায় প্রাণ যায় যুদ্ধে। অন্যদিকে অন্ধকারে তলিয়ে যায় লাখ লাখ জীবন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অথৈ জলে অজস্র শৈশব।

“চলে যাব – তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ।
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

আজ থেকে বহু বছর আগে সুকান্ত ভট্টাচার্যের এমন উক্তি বারবার মনে পড়ে। করোনা পরবর্তী সময় আমাদের সবার জীবনই একপ্রকার বেলাইনে চলে এসেছে। তারও আগে খাদের ধার ঘেঁষে পড়ে আছে শৈশব। ফাঁকা মাঠ এখন কংক্রিটের জঙ্গল, হালকা রোদে পুকুরে মাছ ধরার আনন্দ নেই। সবুজ নেই, নবীন প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখার মতো চোখগুলোও বোধহয় হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রাফিক জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে ছোটাছুটি করে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। কখন মুখ থুবড়ে পড়বে, আমরা কেউ জানি না। তবুও, “প্রাণপণে সরাব পৃথিবীর জঞ্জাল।”

আরও পড়ুন : ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে কেন শীতের অপেক্ষায় রয়েছে রাশিয়া

এ শব্দ যখন উচ্চারণ করছি, কলমে কালির জোগান কমেনি এতটুকু, তখন কলকাতা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের একটি দেশে নতুন করে খোঁড়া হচ্ছে গণকবর। একরত্তি শিশুটা সকাল থেকে ঘুরছে; এখনও দেখা পায়নি মা-বাবার। কিংবা নিজের ছোট্ট সন্তানকে হারিয়ে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে পথে বসে আছেন অভিভাবক। ভাঙা বাড়ি, ভাঙা পাঁজরের মতো লোহার রড পেরিয়ে কোনও কিশোরী হয়তো খুঁজতে চাইছে প্রিয় গল্পের বই কিংবা অঙ্কের খাতা। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বসে, ইউক্রেনের ওই শিশুগুলোর মুখ আর দেখতে পাই না আমরা। আমরা, সভ্য শিক্ষিত সাংস্কৃতিক মানুষ। একের পর এক বোমার আঘাতে যারা পরিবারকে গুঁড়িয়ে যেতে দেখেনি। যুদ্ধের রক্তপিপাসু জিভের নিচে নিজের সন্তানের দেহ পড়ে থাকতে দেখেনি…

আরও পড়ুন : অবশেষে বন্ধু রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভারত! ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে কতটা কার্যকরী ভারতের অবস্থান?

ঠিক কতদিন ধরে চলছে রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধ? হিসেব রাখতে আজকাল অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। হামলা, পাল্টা মার সবকিছুর মধ্যেই চলছে কূটনৈতিক আলোচনা। ওয়াররুম, সরকারের কর্তাব্যক্তির মস্তিস্ক, যুদ্ধক্ষেত্র – সব জায়গায় চলছে দাবার ঘুঁটি সাজানোর কাজ। সুযোগ বুঝলেই ছুঁড়ে দাও ক্ষেপণাস্ত্র। রাশিয়ার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রবল বিক্রমেই যুদ্ধ করছিল ইউক্রেন। বাড়িঘর ভেঙে পড়ছে, আগুন ধরে যাচ্ছে চারিদিকে। শান্তিতে ঘুমও হচ্ছে না; এই যদি বাড়ির ওপর এসে পড়ে বোমা? তবুও লড়ছে ইউক্রেন। রুশ বাহিনীকে প্রতিহতও করছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি একটু ভিন্ন চেহারা নিয়েছে। নভেম্বর পেরিয়ে আসতে চলেছে ডিসেম্বর। আর এই সময় রাশিয়া, ইউক্রেন জুড়ে শুরু হবে শীতের মারণ কামড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে কামড়কে উপেক্ষা করে বিপদে পড়েছিলেন জার্মানির ফ্যুয়েরার অ্যাডলফ হিটলার। রুশ বাহিনী তাঁকে পর্যুদস্ত করে ছেড়েছিল।

আরও পড়ুন : আতঙ্ক বিশ্বজুড়ে! ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধর সম্ভাবনা কতটা জোরালো হচ্ছে?

সেই শীতই এবার দাঁড়িয়ে রাশিয়া আর ইউক্রেনের সামনে। তবুও প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। সম্প্রতি নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হানা হেনেছে রাশিয়া। এবার তাদের টার্গেট ইউক্রেনের পরিকাঠামোয়। বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে, জল সরবরাহ প্রণালীতে হামলা করেছে রাশিয়া। ফলে ইউক্রেনের অনেক জায়গা এখন অন্ধকারে। জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, শুধু ধ্বংসস্তূপ আর কান্না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলডাইমার জেলেনস্কি এবং ফার্স্ট লেডি ওলেনা জেলেনস্কা বারবার দেশবাসীকে সাহস যোগাচ্ছেন। বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে যাওয়ার কথা বলছেন। সেনাদের মনোবল বাড়াচ্ছেন।

আর শিশুরা? বিদ্যুৎহীন, জলহীন অবস্থায় মানুষ কোনওক্রমে বেঁচে আছে সেখানে। চারিদিকে অন্ধকার। জীবনটাই যেন লম্বা অন্ধকার কোনও রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে ইউক্রেনবাসীর। আর তারও গভীরে পড়ে রয়েছে কয়েক লাখ নিরীহ শিশু। সম্প্রতি ইউনিসেফের একটি সমীক্ষা বলছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখন তীব্র দারিদ্র্যের আঁধারে রয়েছে। অন্তত ৪০ লাখ শিশুকে এই যুদ্ধ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সেখানে তাদের সুস্থ ভবিষ্যতের সামনে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন রয়ে গিয়েছে। ইউনিসেফের আশঙ্কা, যুদ্ধ চলতে থাকলে চলতি বছরেই এক লাখ ১৭ হাজার শিশুর স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, প্রথম জন্মদিনের মোমবাতিতে ফুঁ দেওয়ার আগেই সাড়ে চার হাজার শিশু প্রাণ হারাবে। এই পৃথিবী কি আদৌ শিশুদের জন্য বাসযোগ্য থাকছে তাহলে?

আরও পড়ুন : শয়ে শয়ে পাখি, হাজার হাজার ডলফিনের মৃত্যু! যুদ্ধের মাশুল যেভাবে গুনতে হচ্ছে ইউক্রেনের প্রাণীদের

ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল আন্দ্রেই কস্টিনের গলায় শোনা যাচ্ছে আতঙ্কের সুর। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, এখনও অবধি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৪৩৭ জন শিশু। যতক্ষণে এই খবরটা লিখছি, যখন আপনি দেখবেন, তার মধ্যে এই সংখ্যাটা আরও কিছুটা বেড়ে যাবে। অবশ্য কস্টিনের কথায়, এই সংখ্যাটি নিতান্তই আনুমানিক। আসল সংখ্যা হয়তো আরও আরও বেশি। তবে এ কি কেবল দৈহিক মৃত্যু? ইউক্রেনে বসবাসকারী কত লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ খাদের নিচে চলে গেল? শৈশব শব্দটার আদৌ কোনও অস্তিত্ব রইল? কত শিশু ছোট্ট বয়স থেকেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে; হতাশা, ভয়ের কারাগারে বন্দি হয়ে থাকবে? মহামান্য রাষ্ট্রনায়করা কি তার হিসেব করেছেন? ভুলে যাচ্ছেন লিসা দিমিট্রিয়েভের কথা? মাত্র চার বছর বয়স ছিল তার। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিল একরত্তি মেয়েটি। ভিনিৎসিয়ার শপিং মলে ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের পর মারাত্মকভাবে জখম হয় সে। তাতেই প্রাণ যায় লিসার। হাজার হাজার স্কুলবাড়ি ভেঙে পড়েছে, রঙিন দেওয়ালগুলো একেবারে বিধ্বস্ত। রাষ্ট্র কি এই নষ্ট হয়ে যাওয়া শৈশবের দায়িত্ব নেবে? দায়িত্ব নেয় কোনওদিন?

আরও পড়ুন : ইউক্রেনে থেমে থাকবে না রাশিয়ার আগ্রাসন? পুতিনের হুমকিতে নয়া আশঙ্কা বিশ্বজুড়ে

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর অন্যতম বড়ো ইস্যু হল শরণার্থী সমস্যা। কখনও সিরিয়া, কখনও মেক্সিকো, রোহিঙ্গা, লাখ লাখ মানুষ মাথার ওপরের ছাদ হারিয়েছেন। সেই তালিকায় নতুন সংযোজন ইউক্রেন। অনেকেই যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কবে আবার ফিরবেন, আদৌ ফিরবেন কিনা, জানা নেই। এপার ওপারের গল্প পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাবের থেকে ভালো আর কে জানবে! ‘আমাগোও একখান দ্যাশ আছিল, শৈশব আছিল’! ইউক্রেনের শিশুরা বাংলা বোঝে না। কিন্তু আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকা ওই একরাশ আঁধার, ওরা কি আলো পেতে পারে না? নাকি কালান্তক শীত বাকি অস্তিত্বটুকুও গ্রাস করবে?

More Articles