গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে বাঁদর! জলবায়ু পরিবর্তন যে সঙ্কট ডেকে এনেছে

Climate Change: তাপপ্রবাহ যতই বাড়ছে, ততই ভেঙে পড়ছে জীবজগৎ। অস্ট্রেলিয়ায় গাছে ঝুলে থাকার শক্তি হারাচ্ছে ফ্লাইং ফক্স, কানাডার জোয়ারভাটায় কোটি কোটি বার্নাকল পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

মেক্সিকোর জঙ্গলে মাটিতে পড়ে শত শত বাঁদরের নিথর দেহ কানাডার উপকূলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে শত শত ঝলসানো শামুক। জ্বলছে পৃথিবী, নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে চারপাশের জীবজগৎ। ছিঁড়ে যাচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল। জলবায়ু বিপর্যয় এখন আর ভবিষ্যতের আতঙ্ক নয়, নির্মম বাস্তবতা।

মেক্সিকোর টেকিলুট্টিলায় তাপপ্রবাহে কাবু বিশেষ প্রজাতির বাঁদরের দল (ব্ল্যাক হাউলার)। গত বছর বসন্তে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁলে, জলশূন্য আর ক্লান্ত বাঁদরের দেহে গাছতলা ভরে গিয়েছিল। অনেককেই বরফ ও স্যালাইন দিয়ে বাঁচানো গেলেও, তাবাস্কোর জঙ্গলে অন্তত ৮৩টি বাঁদরের নিথর দেহ পাওয়া যায়। স্থানীয় পশুচিকিৎসকের ধারণা, চলতি বছর তাপপ্রবাহে প্রাণ হারিয়েছে ১০০-রও বেশি বাঁদর।

Howler Monkeys

মেক্সিকোর কোমালকালকোতে গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার পর বনের মেঝেতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে হাউলার বাঁদর। ছবি: রয়টার্স

এই দৃশ্য শুধু মেক্সিকোতে নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাপপ্রবাহ যতই বাড়ছে, ততই ভেঙে পড়ছে জীবজগৎ। অস্ট্রেলিয়ায় গাছে ঝুলে থাকার শক্তি হারাচ্ছে ফ্লাইং ফক্স, কানাডার জোয়ারভাটায় কোটি কোটি বার্নাকল পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তীব্র গরমে প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে পুরুষ পোকামাকড়। 

আরও পড়ুন- গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জিয়নকাঠি! যেভাবে পরিবেশের সর্বনাশ করছে কার্বন ডাই অক্সাইড

বিশ্বজুড়ে এই প্রাণহানির ছবি দেখে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ-এর বিজ্ঞানী ম্যাক্সিমিলিয়ান কটজ বলছেন, “দূষণ যত বাড়ছে, তাপমাত্রার পাল্লা তত ভারী হচ্ছে। শুধুই গড় তাপমাত্রায় নয়, হু হু করে বাড়ছে অস্বাভাবিক গ্রীষ্মকাল।”  

তীব্র তাপ প্রাণীদের আবাস কেড়ে নিচ্ছে, খাদ্য কমিয়ে দিচ্ছে। খাদ্য সংকটে নষ্ট হচ্ছে প্রজাতিগুলোর ভারসাম্য আর সম্পর্ক। সম্প্রতি কটজ ও তাঁর সহকর্মীরা বিশ্বজুড়ে ৩,০০০-র ও বেশি প্রজাতির পাখির ওপর গবেষণা চালান। আবহাওয়ার রেকর্ড ও তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখতে পান, পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ তাপপ্রবাহ। অন্যান্য প্রভাব বাদ দিলে দেখা যায়, তুন্দ্রা অঞ্চলের পাখিরা তুলনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু উষ্ণমণ্ডলে ছবিটা ভয়াবহ গত ৭০ বছরে সেখানে পাখির সংখ্যা ২৫% থেকে ৩৮% কমে গেছে। বিশেষ করে গান গাওয়া পাখিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

ব্রাজিলের মাতো গ্রোসোতে টোকো টোকান। ছবি: উইকিপিডিয়া 

কটজের মতে, এর কারণ স্পষ্ট উষ্ণমণ্ডলের পাখিরা যতটা গরম সহ্য করতে পারে, তাপমাত্রা তার তুলনায় বেশি। এখন তারা আগের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ভয়ংকর গরমের মুখোমুখি হচ্ছে। নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে কটজ ব্যাখ্যা করেন, এর কারণ হলো অত্যাধিক গরমে পাখির মৃত্যু, ডিম ও বাসায় তাপের চাপ আর কীটপতঙ্গের মতো খাবারের কমে যাওয়া।

আরও পড়ুন- Climate Change: আগামী দিনে খেয়ে-পরে বাঁচবে তো মানুষ? যে আশঙ্কার কথা জানালেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা

তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে, উষ্ণমণ্ডলে পাখির সংখ্যা কমার পিছনে মানুষের কর্মকাণ্ড, যেমন বনভূমি ধ্বংস, খনন বা চাষাবাদ দায়ী মানুষের অনেক কাজের জন্যেই বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। কটজ সতর্ক করে বলেন, “গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে সংরক্ষিত বন আর অক্ষত আবাসেও তাপপ্রবাহের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।”

২০২১ সালের গ্রীষ্মে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমে যখন তাপমাত্রা ৪৬° সেলসিয়াস ছাড়িয়েছিল, ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ডের সমুদ্রতটে হঠাৎ হাজার হাজার মৃত শামুক আর বার্নাকল দেখতে পান বিজ্ঞানীরা তখন ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী প্রফেসর ক্রিস্টোফার হারলে অনুমান করেছিলেন, অন্তত ১ বিলিয়ন প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে। পরে তিনি জানান, আসল সংখ্যা আরও ভয়াবহ, শুধু স্ট্রেইট অফ জর্জিয়াতেই মারা গেছে ১০ বিলিয়ন বার্নাকল আর ৩ বিলিয়ন শামুক।

Snail

২০২১ সালের তাপপ্রবাহে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় মৃত ঝিনুক। ছবি: ক্রিস্টোফার হারলে

হারলে বলেন, কোটি কোটি প্রাণীর মৃত্যু শুনতে বিলুপ্তির মতো মনে হলেও, দ্রুত বংশবিস্তারকারী প্রজাতি কিছুটা টিকে থাকতে পারছে। তারামাছ ও অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ঠান্ডা জলের দিকে সরে যাচ্ছে। যারা টিকে থাকছে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এই উষ্ণতাকেই সহ্য করতে শিখবে।

অন্যদিকে, মানুষের উপর তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হলেও, অন্য স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে তা এখনও সীমিত। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবিজ্ঞানী পি. জে. জ্যাকবস সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছেন। তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা ছোট স্তন্যপায়ীদের নিয়ে, কারণ তাদের দেহ ছোট হওয়ায় তারা দ্রুত গরমে কাবু হয়। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় তিনি আফ্রিকার দুটি ছোট ইঁদুর মেসিক ফোর-স্ট্রাইপড ফিল্ড মাউস ও নামাকুয়া রক মাউস-এর ওপর তাপপ্রবাহের প্রভাব পরীক্ষা করেছেন। জ্যাকবসের মতে, অতিরিক্ত গরম বাঁদরের মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলছে, তারা ভারসাম্য হারিয়ে গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে। প্রাণীজগত বিপন্ন হওয়ায় ভেঙে পড়ছে খাদ্যশৃঙ্খল। এক অনিশ্চিত হুমকির সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে প্রাণীজগৎ।

More Articles