আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা, অন্ধকারে ভারতে কাজুবাদাম চাষের ভবিষ্যৎ

বছরের মার্চ থেকে জুন মাসের সময়কাল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজুবাদাম চাষ করা রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে, যেমন মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, উড়িষ্যা, এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। এই বাদাম যদি অতি বৃষ্টির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বাজারে তা বিক্রি হওয়ার কো...

অনিশ্চিত বৃষ্টি এবং তাপমাত্রার কারণে কাজুবাদাম চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে ভারতে। সারা পৃথিবীর ২২ শতাংশ কাজুবাদাম উৎপাদন হয় ভারতে। এছাড়াও সর্বাধিক কাজু ভক্ষণ করে এই দেশেরই মানুষ। এই বাদাম চাষে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রয়েছে ভারত। দেশের মধ্যে ১৯টি রাজ্যে কাজু উৎপাদিত হয়। এই দেশে প্রায় ৫ লক্ষ কৃষকের জীবিকা নির্বাহ হয় এই বাদাম চাষ করে। এছাড়াও বহু মানুষ-এর রুটিরুজি জড়িয়ে আছে কাজুবাদাম চাষের সঙ্গে।

গত কয়েক বছর ধরে কাজুবাদামের উৎপাদন ক্ষতির দিকেই ঝুঁকেছে। কৃষকরা জানাচ্ছে, তাপমাত্রার বদল এবং অসময়ের বৃষ্টিপাতের ফলে তাদের লোকসান হয়ে যাচ্ছে। কাজুবাদাম চাষ বাঁচাতে কেরলের রাজ্য সরকার বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ঘরোয়া উৎপাদনকে সর্বাধিক কার্যকর করে তুলতে এবং লোকসান এড়াতেই এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। Kerala State Cashew Development Corporation (KSCDC) এবং Kerala State Cashew Workers Apex Industrial Cooperative Society (CAPEX)–এর অধীনে সমস্ত কারখানাগুলিকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে, উৎপাদিত পণ্য সরাসরি কৃষকদের থেকে সংগ্রহ করতে। কিন্তু উৎপাদনের হার কমে যাওয়ার কারণে পরিকল্পনাটি উপেক্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরালাম খামার সাধারণত চারশো টন RCN যোগান দিয়ে থাকে। কিন্তু এই বছর উৎপাদনের হার-ই দশ টনের নিচে। অন্যান্য বছরে ওনাম উৎসবের আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি মূলত স্থানীয় উৎপাদিত RCN-এর ওপরেই নির্ভর করে। এই বছর তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে।

কেরলের কন্নুর এবং কাসারাগোদ জেলায় সবথেকে বেশি পরিমাণ কাঁচা কাজুবাদাম বা Raw Cashew Nut (RCN) উৎপাদন হয়। কিন্তু ২০২২ সালে সেই পরিমাণ উৎপাদনে অক্ষম হয়েছে কৃষকরা। আবহাওয়ার এই ব্যাপক পরিবর্তন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কাজু ফুল ও ফলের চাষ। প্রখর গ্রীষ্মকাল-এর কাঠফাটা তাপে অধিকাংশ ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে এবং অনিশ্চিত বৃষ্টিতে অবশিষ্ট অংশটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় এই শস্য অত্যন্ত অরক্ষিত হয়ে উঠেছে। ভারী বৃষ্টিপাতের পর এই বাদামের বাজারি মূল্য বেশি হয় না। কৃষকদের মতে, পূর্বেও অনেক সময়ই আবহাওয়ার পরিবর্তনের মুখোমুখি তাঁদের হতে হয়েছে, কিন্তু এই বছরের মতো কষ্টকর পরিস্থিতি আগে হয়নি কখনও। যেসব কাজুবাদাম বা RCN ঘরোয়া পদ্ধতিতে চাষ করা হয়, সেগুলিকেই উৎকৃষ্ট মানের বলে ধরা হয় এবং প্রধানত এগুলিই বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয়। স্বাদে ভালো হওয়ার কারণে, আফ্রিকার ঘানা ও আইভরি কোস্ট থেকে আমদানি করা বাদামের তুলনায় বাজারে এই বাদামগুলির চাহিদা অনেক বেশি হয় সাধারণত।

আরও পড়ুন: মৎস‍্যপ্রিয় বাঙালির দুঃস্বপ্ন! ভারতে হঠাৎ লক্ষ লক্ষ মাছের মৃত্যুর নেপথ্যে কারণ কী

ভারতের মধ্যে সবথেকে বেশি পরিমাণ কাজু উৎপাদন হয় মহারাষ্ট্রে। এই রাজ্যের রত্নাগিরি জেলার এক কৃষকের ১,১০০টি কাজু গাছ আছে। এই বছর সেই গাছগুলিতে অন্য বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ কাজু কম উৎপাদিত হয়েছে। অধিকাংশ কৃষকই একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। প্রধানত রত্নাগিরি, সিন্ধুদুর্গ, রায়গড়ের মতো উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে প্রধান জীবিকা নির্বাহ হয় কাজুবাদাম চাষকে কেন্দ্র করেই। উপকূলীয় কোঙ্কণ অঞ্চলে এবার অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাস বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর এই সময়টাই কাজু ফুল ও ফল হওয়ার মূল সময়। কিন্তু বৃষ্টিপাতের কারণে পরাগযোগ হতে পারেনি, আর তারই অভাবে ফল ধরার সুযোগ হয়নি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তাপমাত্রা কিছুদিন ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল, ফলে আরও বেশি মাত্রায় ক্ষতি হয়েছে। অন্য বছরগুলিতে কোঙ্কণ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয় সাধারণত ১৫ জুনের পরে। এখন বৃষ্টি মে মাসেই শুরু হয়ে যায়। কোঙ্কণ-এর বাদাম অনেক উচ্চমানের। একটি কাজু গাছ বছরে অন্তত ১০ কেজি বাদাম সরবরাহ করে। বর্তমান সময়ে তা দু'কেজির বেশি আর হয় না। তাছাড়া আবহাওয়ার কারণে ফল ও বাদামের আকৃতি হ্রাস পেয়েছে।

বছরের মার্চ থেকে জুন মাসের সময়কাল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজুবাদাম চাষ করা রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে, যেমন মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, উড়িষ্যা, এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। এই বাদাম যদি অতি বৃষ্টির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বাজারে তা বিক্রি হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না। এই বাদাম উৎপাদনের জন্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৬-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ার প্রয়োজন আছে। যা এই বছরে হয়নি। দেশজুড়ে ২৫ শতাংশ কাজুবাদাম উৎপাদনের হার হ্রাস পেয়েছে।

এত লোকসানের কারণে খুব কম কৃষক নতুন করে কাজু গাছ রোপণ করছে। তাছাড়া সস্তা হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ সময়ই বিদেশ থেকে আমদানি করতেই পছন্দ করছে। ফলে কাজুবাদাম চাষিদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চয়তার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে।

 

More Articles