বন্যার মাঝে কার্নিভালে মুখ্যমন্ত্রী! অমানবিক রাজনীতির কৈফিয়ত কী?

Darjeeling-Dooars Floods: রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং মুখ্যমন্ত্রী ৬ অক্টোবর উত্তরবঙ্গ যাবেন সেই ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু এই সমস্ত কথা কি উঠবে? তখন কি কোনো একজন সাংবাদিকের সাহস হবে এই প্রশ্নগুলো করার?

দার্জিলিং ডুয়ার্সে ভয়াবহ বন্যা। তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক-সহ সমস্ত নদী বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। এখনও অবধি ২৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। লাফিয়ে বাড়বে এই সংখ্যা তা বলাই বাহুল্য। গত ৩ দশকের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর বন্যা হয়নি। দার্জিলিং, মিরিক থেকে বিজনবাড়ি সর্বত্র ভূমিধস, বাড়ি ভেঙে মৃত্যু। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। মানুষ থেকে শুরু করে নানান বন্যপ্রাণী প্রাণভয়ে ছুটছে। বন্যার জলে দোকান থেকে গাড়ি, সব ভেসে যাওয়ার ছবি দেখা যাচ্ছে। শুধু মিরিক, বিজনবাড়তেই ১১ জনের বেশি মারা গিয়েছেন। বহু পর্যটকও নিখোঁজ। ভেঙেছে একাধিক সেতু। প্রধান সড়ক। হাজার হাজার পর্যটক আটকে। ভুটানের ওয়াং নদীর উপরে জলবিদ্যুৎ উৎপন্নকারী নদী বাঁধের গেট খুলছে না। বাঁধ উপচে জলের স্রোত পড়ছে। ভুটান ইতিমধ্যেই সতর্ক-বার্তা দিয়ে সেই কথা জানিয়েছে। বাঁধ যদি কোনো কারণে ভেঙে যায়, ডুয়ার্সের অনেক জনপদ ভেসে যাবে। কত মানুষ যে প্রাণ হারাবে, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে তার হিসেবে নেই।

এই দৃশ্য যেমন আমাদের আতঙ্কিত করছে, তেমনই মনে করিয়ে দিচ্ছে— কিছুদিন আগেই কলকাতার এক রাতের বৃষ্টির পর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাটি। অথচ একই সময়ে দেখা যাচ্ছে, কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পুজোর বিসর্জনের কার্নিভালের আয়োজন। কলকাতার সেই কার্নিভালে স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত, সঙ্গে রয়েছেন দেশ-বিদেশের নানা প্রতিনিধি এবং রূপোলি পর্দার তারকারা। এই দৃশ্য যেন চোখে পীড়া দেয়, অস্বস্তি জাগায়। মনে হয়, আমরা কি তবে এতটাই অমানবিক হয়ে গেছি? হয়ত অনুষ্ঠানটি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, হয়ত শেষ মুহূর্তে বাতিল করা সম্ভব হয়নি— কিন্তু অন্তত কিছুটা কাটছাঁট করা যেত না? এই আয়োজন থেকেও তো মানবিকতার একটি বার্তা দেওয়া যেত।

লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন কংগ্রেসের কর্মীদের, বলেছেন এই দুঃসময়ে তিনি এবং তাঁর দল উত্তরবঙ্গের মানুষের পাশে আছেন। বাংলার বিরোধী দলনেতা কিংবা দেশের প্রধানমন্ত্রীর কিন্তু সময়ই হয়নি। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উত্তরবঙ্গের বন্যার কথা। প্রাথমিকভাবে মানুষের পাশে যে দাঁড়াতে হয়, সেই কথাটাই হয়ত অনেকে ভুলে গেছেন। প্রধান বাম দলের রাজ্য সম্পাদক টুইট করে রেড ভলেন্টিয়ারদের ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছেন এবং পাশাপাশি কার্নিভাল কেন, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এখনও অবধি বাম দলগুলোর মধ্যে একমাত্র সিপিআইএমএল লিবারেশন ছাড়া কেউই কিন্তু আসল কারণের কথা বলেনি।

আরও পড়ুন

বৃষ্টি, ধসে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গ, কার্নিভাল স্থগিত করা গেল না কেন?

পাহাড় ও সমতলে কর্পোরেট "উন্নয়ন" যে মূল কারণ এবং সেইজন্যেই অকাতরে বৃক্ষচ্ছেদন, খরস্রোতা তিস্তা নদীতে ৩২টির বেশি সংখ্যায় বাঁধ নির্মাণ, পাহাড় খুঁড়ে রেলপথ নির্মাণ, সীমান্তরক্ষার নামে পাহাড়ি রাস্তা কেটে প্রশস্ত করে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাছ কেটে ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত করা ও অস্ত্রসম্বলিত ভারী মালবাহী আর্মি গাড়ি চলাচলে বৃদ্ধি, সমতলের শহরগুলিতে নিকাশী নালার সংস্কারের অভাব- সব মিলিয়ে এই বিপর্যয়ের মূল কারণগুলির বিন্দুমাত্র কোনো দায় নিতে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার রাজী নয়। রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং মুখ্যমন্ত্রী ৬ অক্টোবর উত্তরবঙ্গ যাবেন সেই ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু এই সমস্ত কথা কি উঠবে? তখন কি কোনো একজন সাংবাদিকের সাহস হবে এই প্রশ্নগুলো করার?

আরও বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে, সেইগুলোও এই সময়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। এই বছর টালা প্রত্যয় তাদের মণ্ডপ শয্যায় ভাবনা রেখেছিল- মানুষই একমাত্র জীব যে নিজের খাবারে বিষ মেশায়। তাঁদের ভাবনা ছিল ‘বীজ অঙ্গন’। যে কথাটা তাঁরা লেখেনি, তা হলো মানুষই একমাত্র জীব, যে শুধু নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারে না, তাঁর জন্যেই আজ এই অবস্থা হয়েছে উত্তরবঙ্গের। যে কথাটা তাঁরা লেখেনি, তা হলো, তাঁদের জন্যেই আজ অসংখ্য বন্যপ্রাণী ভেসে গেছে, অসংখ্য অবলা প্রাণ মারা গিয়েছে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে নিজের কথা, নিজের উন্নয়নের কথা ভাবতে গিয়ে সবার ক্ষতি করে চলেছে। আজ উত্তরবঙ্গের এই পরিণতির জন্য একমাত্র দায়ী আমরা কিছু দু-পায়ের শয়তান। কিছুদিন পরে আবার যখন সব স্বাভাবিক হবে, আবার কিছু শয়তান গিয়ে গাছ কাটবে, আবার কিছু হোটেল হবে, আবার কিছু চকচকে চোখ গিয়ে লাভ করার জন্য, ব্যবসা করার জন্য ওই অঞ্চলে জমি কিনে উন্নয়ন করার চেষ্টা করবে আর আবারও এই প্রাণীদের জায়গা কেড়ে নেবে। উন্নয়ন আর বিকাশের নীচে আজ শুধু মানুষ মারা যায়নি, মারা গেছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এই প্রশ্ন করবেন না? এই প্রশ্ন কে করবে?

তুলনা আসছে এবং তা আসাটা খুব স্বাভাবিক। এই যে নতুন করে আবার আলোচনায় আসছে, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে রাজ্যের অর্থনীতি নাকি নতুন করে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, এইবার দুর্গাপুজোয় নাকি ৬৫০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। পুজোর ঠিক আগে কলকাতা একদিনের জন্য ভেসে গেলেও এই তথ্য দেখে অনেকেই হয়ত উৎসাহিত হবেন, কিন্তু তার মধ্যেও বেশ কিছু ছোট তথ্য আছে, যা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়। এই টাকার ৭০ শতাংশই কলকাতা কেন্দ্রিক এবং ছোট ব্যবসা থেকে নয়, বরং বড় বড় শপিং মল থেকে পায় ৯০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। ২০১৯ সালে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে, ব্যবসা হয়েছিল ৩৩,০০০ কোটি টাকার, গত বছরে এই ব্যবসা ছিল ৫৭,০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি, এবছর আশা করা গিয়েছিল ৭০,০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে, কিন্তু নানান কারণে তা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী বেশ কিছু পুজো কমিটির জন্য আর্থিক অনুদানের ঘোষণাও করেছিলেন। সারা রাজ্যের তুলনায় কলকাতার পুজো কমিটিগুলো একাই ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই এত টাকা, এই এত ব্যবসার একটা অংশ কি কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া বইয়ের জন্য দেওয়া যেত না? কিংবা এখন কি মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই বড় পুজো কমিটিগুলোকে বলতে পারতেন না, উত্তরবঙ্গের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে? এই উন্নয়ন, এই ব্যবসা কতটা শেষতম মানুষের কাছে পৌঁছেছে, সেই প্রশ্ন করারও এটাই সময়।

আরও পড়ুন

সুনামির ‘ T’ কেন উচ্চারিত হয় না?

বারবার কথা উঠছে যে সময়ে উত্তরবঙ্গ ভাসছে, যে সময়ে এত মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে, এত বন্যপ্রাণী ভেসে যাওয়ার খবর আসছে ঠিক সেই সময়ে যদি রাজ্যের প্রধানের নৃত্যরতছবি কিংবা ভিডিও দেখা যায়, তখন সমালোচনা হবে নাই বা কেন? কেউ বলতেই পারেন, দুর্গাপুজোর কার্নিভাল আগে থেকে ঠিক করে রাখা অনুষ্ঠান, কিন্তু তা সত্ত্বেও যে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে আমরা ‘মা-মাটি-মানুষ’ শব্দবন্ধ পেয়েছি, সেই মুখ্যমন্ত্রীর থেকে একটু মানবিকতা বোধহয়, সারা রাজ্য আশা করেছিল। তিনি কাটছাঁট করতেই পারতেন, দুর্গাপুজোর কার্নিভালকে এবং বলতেই পারতেন, এটা উৎসবের সময় নয়। আমরা চিরকাল শুনেছি, ‘আপনি আচরি ধর্ম, পরেরে শেখাও’। তিনি যদি তাঁর মানবিক মুখটা দেখাতেন, তিনি যদি আরও একটু সংবেদনশীলতা দেখাতেন তাহলে তাঁর দলের নিচু তলার কর্মীরাও একটু সংবেদনশীলতা দেখাতে পারত, অন্তত ভানটুকু তো করতে পারত।

এই উন্নয়ন আসলে মানুষকে শুধু শেষ করে না, এই উন্নয়ন পুরো বাস্তুতন্ত্রকেই শেষ করে। এই উন্নয়নের মুখ হয়ত কলকাতার মতো চকচকে, কিন্তু এই উন্নয়নের পিছনেই আছে অন্ধকার। যা দেখা যাচ্ছে এখন উত্তরবঙ্গের বন্যায়। শুধু মানুষ নয়, মারা যাচ্ছে অসংখ্য পশুপাখি। এই সময়টা দোষারোপের সময় নয়, এই সময়টা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, এই সময়টা বিপন্ন পশুপাখির পাশে দাঁড়ানোর। এই সময়টা সংবেদনশীলতার এই সময়টা মানবিকতা প্রদর্শনের। এই সময়টা আজকে উত্তরবঙ্গে ঘটলেও, আগামীতে আমরাও যে এই বিপদে পড়ব না কে বলতে পারে? শুধু মুখে বললেই হবে না আমরা পরিবেশ সচেতন, কাজে করে দেখানোটাই এখন কাজ। এই পৃথিবীকে বাঁচাতে গেলে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে, না হলে সামনে সমূহ বিপদ সবার। পরিবেশের প্রতি মানবিক হওয়াটাই এখন একমাত্র কাজ। উন্নয়নের নামে যথেচ্ছ বৃক্ষছেদন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, কর্পোরেটের উন্নয়ন আর বাস্তুতন্ত্রের উন্নয়ন, দুটো কখনোই পাশাপাশি চলতে পারে না।

(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)

More Articles