পাপের শাস্তি, এসেছে খারাপ সময়! জলবায়ু পরিবর্তনকে যেভাবে দেখছেন হিমালয়বাসী
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল সবথেকে আগে ভোগা শুরু করেছেন হিমালয়বাসীরাই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দু'হাজার মিটার ওপরে উঠলেই শুরু হয়ে যাচ্ছে সেই 'Zone', যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে দ্রুত এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ...
"You are totally at the mercy of Mother Nature in this World, mate. It's just a fact of life."
এই কথার অর্থ উপলব্ধি করছেন উত্তর-পূর্ব নেপালের তাপলেজং জেলার ওয়ালুঙ গ্রামের মানুষ।
"আগেরদিন সকালে আকাশে লাল রঙের একটা মেঘ ছিল। কাল মনে হয় তুষারপাত হবে।" কথাটা বলছিলেন পেম্বা ভূতি শেরপা, ওয়ালুঙের এক ইয়াক প্রতিপালক। গত বছর নভেম্বরের কথা। তাঁর এক বিশেষ গুণ ছিল। গুণটি হলো, তিনি তুষারপাতের একদম অব্যর্থ পূর্বাভাস করতে পারতেন। বহু বছরের অভিজ্ঞতা তাঁর। ভুল কোনওদিনও হতো না। তার কারণও ছিল। ওয়ালুঙ গ্রাম হিমালয়ের কোলে, তামুর ভ্যালির ওপর অবস্থিত। তাঁর প্রতিপালন করা ইয়াকের দল ভ্যালির একদম ওপরের প্রান্তরে চরে বেড়ায়। তুষারপাত শুরু হওয়ার আগে যদি তাদের না নিয়ে আসেন, তাহলে অনেকটা সময়ের জন্য তিনি তাঁর পোষ্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। সেই সঙ্গে তুষারপাতের ফলে বেশিরভাগ সময়ই সম্ভাবনা থাকে ঘাসের ওপর বরফের পুরু চাদর পরে যাওয়ার। সেক্ষেত্রে ইয়াকগুলিও একেবারে না খেতে পেয়ে মারা যাবে। পেম্বা সেই লাল মেঘ দেখে আর অপেক্ষা করেননি। পুরো পালকে ধরে নিয়ে চলে এসেছিলেন। কিন্তু তুষারপাত হয়নি। তার পূর্বাভাস মেলেনি।
আরও পড়ুন: দিল্লিবাসীর নাভিশ্বাস! পরিবেশ ধ্বংসের পরিণাম ফলছে, বাসের অযোগ্য হবে রাজধানী?
ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে অবশেষে তুষারপাত হয়, এবং সেই দিনের তুষারপাত এতদিনের সব ঘাটতি একসঙ্গে মিটিয়ে দেয়। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে তিন ফুট পুরু বরফ জমে যায়। যা কষ্মিনকালেও দেখেননি পেম্বা। তিনি যখন ছোট ছিলেন, তখন এই ভাবে তুষারপাত হতো না, এবং প্রথম তুষারপাত হতো সেপ্টেম্বরে।
অতীতে শীতের মরশুম মানেই প্রায় পাঁচ থেকে ছয়বার নিজেদের মাথার ওপর ছাদ বাঁচাতে লড়াই করতে হতো পেম্বাদের। এতটাই ভারী তুষারপাত হতো। তিনি জানাচ্ছেন, এই বছর বরফ তো পড়েনি বটেই, সেই সাথে এই প্রথম একদিনে এমন অস্বাভাবিক হারে তুষারপাত হয়েছে।
এই অস্বাভাবিক তুষারপাত চরম বিপদে ফেলেছে ইয়াক প্রতিপালকদের। হঠাৎ করেই তারা আবিষ্কার করছেন যে, একদিন আগে পর্যন্তও তারা ঠাহর করতে পারছেন না, কবে তুষারপাত হবে। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে যাচ্ছে। এই ভাবে কত কয়েক মাসে ৬-৭টি ইয়াকের মৃত্যুও হয়েছে, এবং প্রতিপালকের নেপালি মুদ্রায় প্রায় নয় লক্ষ ষাট হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।
দু'বছর আগেই ঠিক এইভাবেই প্রায় ৯০টি ইয়াক হারান পেম্বা। ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় দশ হাজার মার্কিন ডলারে।
তবে জানা যাচ্ছে, শুধু নেপাল নয়, ভুটান এবং সিকিমও একইভাবে ভুক্তভোগী। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু তুষারপাতকেই অনিশ্চিত করে তোলেনি, সেই সঙ্গে হিমালয়ের কোলে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন রোগ, দেখা দিচ্ছে পানীয় জলের সমস্যা।
সবথেকে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল সবথেকে আগে ভোগা শুরু করেছেন হিমালয়বাসীরাই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দু'হাজার মিটার ওপরে উঠলেই শুরু হয়ে যাচ্ছে সেই 'Zone', যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে দ্রুত এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ওয়ালুঙের বাসিন্দারা বলছেন, 'কাওয়া ন্যায়ামপা', বা খারাপ সময় এসে গেছে।
প্রায় হিমালয়জুড়েই মানুষ বিশ্বাস করেন যে পাহাড়ে দেবতারা থাকেন এবং মানুষের কুকর্মে রুষ্ট হয়ে তারা এইভাবে শাস্তি দেন। ওয়ালুঙের মানুষই যেমন মনে করছেন, তাঁদের পাপের ফলস্বরূপ তাঁরা এই শাস্তি পাচ্ছেন।
ইয়াঙচেন শেরপা বলছেন, " আমি ঠিক জানি না কীভাবে নিজেকে ব্যক্ত করব, কিন্তু আবহাওয়া আগে এরম ছিল না। এখন বরফ পড়া কমে গেছে, আগের থেকে বহুগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।" কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "সময় পাল্টেছে, মানুষ পাল্টেছে। সব ভালো মানুষেরা আজ মৃত।"
তবে বুদ্ধের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন না এঁরা। এঁদের বিশ্বাস, কুকর্মের শাস্তি যেমন পাচ্ছেন, তেমনভাবেই নিজেদের যদি এরা শুধরে নেন, তাহলে এর থেকে মুক্তিও তাঁরা নিশ্চয়ই পাবেন।