এই ভারতীয়র নামে রয়েছে খুনের বিশ্বরেকর্ড, যার কারণে আজও ভুক্তভুগী ৬ কোটি মানুষ

Thug Amir Ali: আমির আলির বয়ানে কী এমন ছিল, যা পড়ে রানি ভিক্টোরিয়া বিষম খেয়েছিলেন?

১৮৩৯ সালের গ্রীষ্মকাল। রানি নিজের বারান্দায় বসে আরাম করে একটি বই পড়ছেন। বই বলা ভুল হবে, বলা উচিত, বইয়ের প্রথম দু'টি অধ্যায়ের পাণ্ডুলিপি পড়ছেন। বইটি ভারতকে নিয়ে। কিন্তু এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় কিছু দূর পড়তেই জোর বিষম খেলেন তিনি। এই রানি ছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া এবং বইটি ছিল ফিলিপ মেডোজ টেলারের লেখা ‘Confessions of a Thug’। সেই বছরেরই অক্টোবর মাসে সম্পূর্ণ বইটি প্রকাশিত হয়। বিশ্ববাজারে এটিই ছিল প্রথম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বেস্টসেলার। এই বইটি আরও একটি কাজ করেছিল। এই বইটির দৌলতেই 'ঠগ' শব্দটি ইংরেজিতে রূপান্তরিত হয়ে 'thug' হয় এবং ইংরেজি শব্দকোষে জুড়ে যায়। রানি ভিক্টোরিয়া বরাবরই নিজের সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা দেশগুলি সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী ছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ বিভিন্ন দেশকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখা পড়তেন তিনি। যাই হোক, এখন কথা হচ্ছে, বইতে কী এমন ছিল, যা পড়ে রানি ভিক্টোরিয়া বিষম খেলেন? আসলে এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ ছিল এক নৃশংস খুনির, যে পেশায় ছিল একজন ঠগী, এমন এক অপরাধী, যে ৯৩১ জনকে খুন করেছিল। ওই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ ছিল ঠগী বেহরাম বা বেহরাম খানের।

১৮১০ সালে মাদ্রাসের গভর্নর ছিলেন উইলিয়াম বেন্টিক। প্রায় দিনই তাঁর কাছে খবর আসছিল যে নিকটবর্তী এলাকাগুলিতে লুটপাট হচ্ছে রাতের অন্ধকারে। লুটপাট তাও একরকম, কিন্তু যাদের লুঠ করা হচ্ছে তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। অসংখ্য মানুষ গায়েব হয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজের সৈনিকদের উদ্দেশ্যে অ্যাডভাইসারি জারি করে যে, রাত্রিবেলা ডাকাতদের থেকে সাবধানে থাকতে এবং ডাকাতিপ্রবণ এলাকাগুলি এড়িয়ে চলতে। এতে বিশেষ লাভ হচ্ছিল না কেননা ডাকাতি কোনো এলাকা জুড়ে নয়, গোটা প্রদেশ জুড়ে হচ্ছিল। সেই সময় বম্বে, সুরাট, নাসিক প্রভৃতি অঞ্চল গুলি আফিম ব্যবসার কারণে বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এই ব্যবসার থেকে যে লভ্যাংশ উঠে আসতো তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জমিদার মহাজনদের কাছে পৌঁছতে হত। অনেক দূরে এরকম টাকা-পয়সা, সোনাদানা নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের একটি রেজিমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। এই রেজিমেন্টের লোকেরা সাধারণত গরিব মুটে সেজে কাজ করতেন। সময়ের সাথে রাতের অন্ধকারে এই মুটেরাও গায়েব হতে শুরু করল, গায়েব হতে থাকলো ব্যবসার যাবতীয় লভ্যাংশ। এর ফলে রাজা, সামন্ত, জমিদাররা চেপে ধরলেন সরকার বাহাদুরকে‌।

 

এর ফলে ১৮২৮ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল বানানো হলো উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে। দায়িত্ব পেয়েই তিনি প্রথম যে কাজটি করলেন, তা হলো সতীদাহ প্রথা রদ। এই কাজটি সম্পূর্ণ করেই তিনি উইলিয়াম স্লিম্যান নামক ইংরেজ অফিসারকে দায়িত্ব দিলেন এই লুটপাট এবং ডাকাতি বন্ধ করতে। সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ যা খুশি ব্যবহার করে হোক বন্ধ করতে হবে এই রাতের অন্ধকারে ডাকাতি। স্লিম্যান যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। প্রথমেই তিনি ধরে নিলেন ডাকাত দলের একজনকে। আমির আলি নামক সেই অপরাধীকে ধরে স্লিম্যান ঠগীদের সম্পর্কে জানতে পারলেন। ডাকাত এবং ঠগীদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ডাকাতরা সাধারণত জিনিসপত্র হাতাতে পারলেই খুশি। তারা অহেতুক খুন-খারাপি করে না এবং শিশু এবং স্ত্রীদের গায়ে কোনভাবেই হাত তোলে না। ঠগীদের কোনও নীতির বালাই নেই। তারা লুটপাটও চালায়, খুনও করে, বাচ্চা-বুড়ো কাউকে রেয়াত করে না।

আমির আলি-র মাধ্যমে স্লিম্যান ঠগীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। আলী তাকে জানিয়েছিল ঠগীরা একসঙ্গে অনেকে মিলে একটি দল বানিয়ে থাকে, প্রত্যেক দলের সদস্য সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ জন। ঠগীদের দলে নানা ধর্মের, নানা জাতের, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ থাকত। যে যেই ধর্মেরই হোক না কেন সকলে একই দেবীকে পুজো করে, দেবী কালী। এরপর বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কিছু শুভ সংকেত দেখে তারা তাদের কাজ শুরু করত। ঠগীরা যে অভাবের দায়ে এরকম করছে তা নয়, এদের কাছে ঠগী হওয়া একটা ব্যবসা। ঠগীদের মূল নিশানা বা টার্গেট ছিল তীর্থযাত্রী, ধনী গৃহস্থ এবং ব্যবসায়ী। পথিকদের লুটপাট করতে ঠগীরা তিনটে দলে ভাগ হয়ে যেত। প্রথম দল ওই তীর্থযাত্রীদের দলের সামনে থাকতো একটি দল পথিকদের দলের সঙ্গে থাকত এবং আরেকটি দল পথিকদের দলের পিছনে থাকতো। মাঝের দলের একজন ঠগ সামনের দলকে জানান দিয়ে দিত মোট জনসংখ্যা কত এবং সেই মতো কবর খোঁড়া হত। পিছনের দলের দায়িত্ব ছিল পিছন দিয়ে কোন অতর্কিত আক্রমণ যাতে না হয় তা লক্ষ্য রাখা। সময় বুঝে ঠগীদের দলের সর্দার হুকুম দিতেন ‘হুক্কা পিলাও’। এটি সংকেত ছিল কাজ শুরু করার।

book cover

এরপর ঠগীরা পথিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পরত। একজন পথিকের দুটো হাত চেপে ধরত, একজন দুটো পা চেপে ধরত, আর আরেকজন পথিকদের গলায় রুমাল দিয়ে ফাঁস লাগাত। তাদের অস্ত্র ছিল একটি হলুদ রঙের সুতির রুমাল। এই রুমালে লাগানো থাকতো একটি মুদ্রা। পথিকদের গলায় এই রুমাল বেঁধে শ্বাসরোধ করে খুন করা হত। খুন করার পর ওই কবরগুলিতে পথিকদের দেহ একের পর এক ফেলে দেওয়া হত। কবরে একাধিক দেহ ফেলা হত বলে কবরগুলি বেশ গভীরভাবে খোঁড়া হত। নিজেদের মধ্যে কো-অর্ডিনেশনের জন্য ঠগীরা ‘রামোসি’ (Ramosy) নামক এক বিশেষ ধরণের ভাষা ব্যবহার করত।

এই ঠগীদের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস ছিল বেহরাম খান। ১৭৯০-এর দশকে বছর কুড়ি-বাইশের তরুণ বেহরাম প্রথম খুন করে। ধীরে ধীরে ঠগীদের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস হয়ে ওঠে সে। এর পরবর্তী ১৫ বছরে প্রায় ২০০০ ঠগীর একটি নেক্সাস তৈরি করে সে। দিল্লি, অওয়াধ, লখনউ থেকে জব্বলপুর পর্যন্ত নিজের সাম্রাজ্য কায়েম করে ঠগী বেহরাম। ১৮২৮ সালে উইলিয়াম বেন্টিক এবং উইলিয়ামস স্লিম্যান মিলে ঠিক করেন এই ঠগীদের ভারতবর্ষের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আগামী ৫ বছরের মধ্যে প্রায় ১৪০০ ঠগীকে ধরে ফেলেন তারা। হয় অর্থ দিয়ে হোক, নয় অনর্থ করে হোক ঠগীদের থেকে গোপনীয় তথ্য আদায় করে নিতেন তারা। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী ৪২১ জন ঠগীকে ফাঁসির শাস্তি দেওয়া হয়। বাকিদের দ্বীপান্তর, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা নির্দিষ্ট কয়েক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এত কিছু সত্বেও তখনো ধরা পরেনি ঠগী বেহরাম। তবে অবশেষে ধরা পড়লো ঠগী বেহরাম। বেহরাম খানকে ধরিয়ে দেওয়ার পিছনে অন্যতম হাত ছিল আমির আলীর। পড়ার পর নিজের জবানবন্দিতে বেহরাম জানিয়েছিল সে ৯৩১ জনকে খুন করেছে। যদিও পরবর্তীকালে বহুবার বয়ান বদল করে সে। এরপর বেহরাম খানের উপর মোকদ্দমা শুরু হয় এবং ১৮৩৯ সালের ১৭ জুন ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয় এই কুখ্যাত অপরাধীকে। ঘটনাচক্রে এই দিনেই ইহলোক ত্যাগ করেন উইলিয়াম বেন্টিক। প্রসঙ্গত আপনাদের জানিয়ে রাখি, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে বেহরাম খানের নাম রয়েছে সবচেয়ে বেশি খুন করার জন্য।

বেহরাম খানের মৃত্যুর পর ভারতে ঠগীর উৎপাত প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এর পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার চালু করলো একটি কালো আইন। আপনি গোরা আইনও বলতে পারেন, যেহেতু গোরারা এটি চালু করেছিল। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা ঠিক করে বিশেষ কিছু জাতির মানুষকে অপরাধিক জাতি বলে ঘোষণা করে দেওয়া হবে। অপরাধী নয় অপরাধিক। অর্থাৎ এদের অপরাধ করার মানসিকতা রয়েছে। ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই বিলটি পেশ হওয়ার সময় ব্রিটিশ দার্শনিক জেমস স্টিফেন্স বলেছিলেন, “যেই জাতিতে পূর্বপুরুষেরা আগে অপরাধ করেছে, সেই জাতির বর্তমান প্রজন্মও অপরাধপ্রবণ হবে। ভারতে জাতিগতভাবে পেশা নির্ধারণ করা হয়। তাই চোরের সন্তানও চোরই হবে।” তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজের তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়ালদের লজিক দেখেছেন! যাইহোক, এভাবেই ১৮৭১ সালে পাশ হয়ে গেল ক্রিমিনাল ট্রাইব অ্যাক্ট। এই আইন প্রথম উত্তর এবং মধ্য ভারতে লাগু করা হয়। প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগে ফাঁসি কাঠে ঝুলে যাওয়া ঠগীদের বংশধররাও রক্ষা পেল না এই আইন থেকে। একদম মার্ক করে করে সেই সমস্ত পরিবারগুলিকে অপরাধিক জাতির আওতায় ফেলা হল। ওই একই আইন লাগু হল মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহীদের জাতিবর্গের উপর। সরকারি হিসাব অনুযায়ী মোট ২৩৭টি জাতিকে এই আইনের আওতায় আনা হয়েছিল। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় প্রতিদিন থানায় এসে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে, পুলিশ যখন চাইবে তাদের বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করতে পারে, জমিদাররা যখন চাইবে তাদের জমি থেকে উৎখাত করে দিতে পারে। এই জাতির মানুষদের জীবন ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠল। দিনের পর দিন খেতে না পেলে মানুষ কী করবে? স্বাভাবিকভাবেই হয় চুরি করবে নয় অন্য কোন অপরাধমূলক কাজ করবে। এই অসহায় মানুষগুলিও তাই করল, ব্যাস ইংরেজ সরকার দাঁতকপাটি বের করে বলল আমরা তো আগেই বলেছিলাম এরা অপরাধপ্রবণ। আপনি ক্রোনোলজিটা বুঝলেন?

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে এই আইনটি রদ করে দেয় ভারত সরকার। এর পরিবর্তে তারা আরেকটি আইন আনে। ১৯৫২ সালে ভারত সরকার লাগু করে হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার্স অ্যাক্ট। এই আইনের আওতায় এমন অনেকগুলি জাতিকে আনা হল যারা অপরাধ করতে ‘হ্যাবিচুয়েটেড’ বা অভ্যস্ত। ইংরেজরা যাদের জন্মগতভাবে অপরাধী বলেছিল এই আইন তাদের স্বভাবগতভাবে অপরাধী বলল। অর্থাৎ আইন একই, নাম আলাদা। আইপিসি বা ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের মূল কথা হল ‘যতক্ষণ না আপনি দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন, আপনি নির্দোষ।’ সুতরাং এই হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার্স অ্যাক্ট সরাসরি আইপিসি-র বিরুদ্ধাচারণ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আইন আজও লাগু রয়েছে আমাদের দেশে। দুর্ভাগ্যবশত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোন প্রকার চিন্তাভাবনা দেখা যাচ্ছে না এই আইনকে নিরস্ত করার। এই আইনের আওতায় আসা জাতি যেমন- পারধি, রামোসিস, বাঞ্জারা, ওয়াঘারি, লোঢা সম্প্রদায়ের মানুষদের আজও দেশের বিভিন্ন জায়গায় একঘরে করে রাখা হয়। এই সম্প্রদায়ের মানুষদের সংখ্যা আজ প্রায় ৬ কোটির কাছাকাছি। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পিছিয়ে পরা জাতিদের উন্নতি সাধনের জন্য মোট আটটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার্স অ্যাক্ট-এর অধীনস্থ জাতিগুলি পিছিয়ে পরা জাতির তালিকায় না থাকায় তাদের উন্নতি সেভাবে হয়নি। অসংগঠিতভাবে থাকার কারণে রাজনীতিতে এই জাতির মানুষদের প্রতিনিধিত্ব আমরা সেরকম দেখতে পাই না। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বর্তমান সময়ে যখন পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নিয়ে আসার এত চেষ্টা হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় দলিতদের অধিকারের জন্য লড়াই হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ নামছে; তখন আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষই এই আইন সম্পর্কে জানেন না।

More Articles