"যতদিন না মমতা...", আদালতে বসেই মাথা কামানো, কেন এমন 'ভীষণ প্রতিজ্ঞা' কৌস্তভের?

Koustav Bagchi Shaving his Head Mamata : তড়িঘড়ি নাপিত ডেকে এনে তাঁর সামনে বসে পড়েন কৌস্তভ বাগচী। তাঁর মাথার চুল পুরোটাই কামিয়ে ফেলা হয়!

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘সোনার কেল্লা’র একটি দৃশ্য মনে আছে? লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ুকে অপমান করার পর মগনলাল মেঘরাজকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল ফেলুদা। কাশীর ঘাটে বসে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, “হয় এর প্রতিশোধ নেব, নয়তো গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব।” কিংবা ধরুন, ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ (Gangs of Wasseypur) সিনেমাটির কথা। বিখ্যাত এই সিনেমাটির কথা কে না জানে! সেখানে শাহিদ খানের খুনের কথা তার ছেলে সর্দার খান জেনে ফেলে। কৈশোরেই সে মাথার পুরো চুলই কামিয়ে ফেলে। তারপরই প্রতিজ্ঞা নেয়, যে ওর বাবাকে খুন করেছে (পড়ুন রামাধীর সিং), তাকে ও ছাড়বে না। মনোজ বাজপেয়ীর সেই ডায়লগ, “হামারে জিন্দেগি কা এক হি মকসদ হ্যায়, বদলা।”

কেন এমন কথা বলা? কারণ এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি এই চ্যালেঞ্জ আর বদলার দৃশ্যই দেখল। তখন সন্ধের আলো গোটা শহরে। ব্যাঙ্কশাল আদালতের সামনে প্রবল ভিড়। শনিবার, ৪ মার্চ সকালেই নিজের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে কংগ্রেসের মুখপাত্র তথা আইনজীবী কৌস্তভ বাগচীকে। তারই মামলা চলছে ভেতরে। সন্ধে নাগাদ ব্যাঙ্কশাল কোর্ট তাঁকে জামিন দিয়ে দেয়। তারপরই আদালত চত্বর দেখে সেই ‘দৃশ্য’। তড়িঘড়ি নাপিত ডেকে এনে তাঁর সামনে বসে পড়েন কৌস্তভ বাগচী। তাঁর মাথার চুল পুরোটাই কামিয়ে ফেলা হয়!

কেন? সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলকে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস। তারপরই নবান্ন থেকে কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীকে আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পাল্টা প্রতিবাদ করেন কৌস্তভ বাগচী। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ‘কুরুচিকর মন্তব্য’ করেছেন তিনি, এই অভিযোগে ভোররাতে তাঁর ব্যারাকপুরের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। তারপর কৌস্তভকে গ্রেফতার করা হয়। তখনই নাকি তিনি বলেছিলেন, জামিন পেলে মাথার চুল কামিয়ে ফেলবেন। এটাই তাঁর ‘প্রতিবাদ’।

ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর সেই প্রতিবাদই দেখা গিয়েছে সেখানে। মাথার চুল কামিয়ে সোজা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন কৌস্তভ। তাঁর মুখে তখন প্রতিজ্ঞার মন্ত্র, ‘যতদিন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উৎখাত করতে পারব, ততদিন মাথার চুল রাখব না’। এই গ্রেফতারির প্রতিবাদেই এরপর চুল পুরোপুরি কামিয়ে ফেলেন তিনি।

অবশ্য বাংলার রাজনীতিতে এমন দৃশ্য এর আগেও ঘটেছে। তখন ছিল ইন্দিরা গান্ধীর রাজত্ব। ৬ অক্টোবর, ১৯৭৫। এরকমই এক ভোররাতে কলকাতার একটি বাড়িতে টোকা পড়েছিল। সেখানে থাকতেন লেখক, সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ। নতুন করে তাঁর পরিচয় দেওয়া ধৃষ্টতা। দরজা খোলার পর দেখা গেল, বাইরে পুলিশ। ভেতরে গৌরকিশোরের ঝোলার ভেতর ‘কলকাতা’ পত্রিকার নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংখ্যা। পুলিশের সেটাই দরকার ছিল। সোজা তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। এই ব্যাঙ্কশাল আদালতের বিচারকই তাঁর মামলা খারিজ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লির ‘বিশেষ নির্দেশে’ পরে গৌরকিশোর ঘোষকে জেলে যেতে হয়।

ঠিক তার কয়েকমাস আগের কথা। ৩০ জুন, ১৯৭৫। পাঁচদিন আগে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। প্রেস সেন্সরশিপও জারি হল। সরকারের বিরুদ্ধে কোনওরকম কিছু লেখা যাবে না। এটা তো স্বাধীনতা হরণ! প্রতিবাদ করলেন গৌরকিশোর ঘোষ। কী সেই প্রতিবাদ? রাতারাতি মাথা কামিয়ে ফেললেন তিনি! মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়ার অর্থ অস্তিত্বকেই হত্যা করা – এমনটাই বলেছিলেন তিনি। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা বছর। ঘটনা পরম্পরা আর প্রতিবাদের রাস্তা এখনও যে খুব একটা বদলায়নি, তা বলাই বাহুল্য।

More Articles