গৌতম দেবকে মনে পড়ে মিথ্যে আর দুর্নীতির পচা শামুকে পা কাটা রাজ্যবাসীর?
সমূলে সব হারিয়ে পথে বসা রাজ্যবাসী আজ বেশি করে মনে করছে আর এক নেতার কথা। তিনি গৌতম দেব। সিপিএম নেতা, রাজ্য রাজনীতির পরিচিত মুখ, প্রাক্তন মন্ত্রী।
৩৪ বছরের বাম জমানার পতন। নতুন দিশা দেখিয়ে তৃণমূল দুর্গের অভ্যুদয়। পর পর ভোটে সাফল্য। তারপরেই টানা দুর্নীতি। সারদা, নারদা, সিন্ডিকেট এবং শেষ ঝটকা এসএসসি নিয়োগ কাণ্ড। এই সবের মূলে ছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা-র সরে যাওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় আবার উঠে এল সেই ইতিহাস। এবার তিনি সরাসরি দাবি করলেন, টাটা সিঙ্গুর থেকে সরে গিয়েছিল সিপিএমের জন্য। সিপিএম সমর্থকরা মনে করছেন গৌতম দেবের সেই কথা, 'প্যাথোলজিক্যাল লায়ার'।
এসএসসি-র চাকরিপ্রার্থীরা পথে বসে। অন্যদিকে দিনের পর দিন দুর্নীতির পর্দা ফাঁস হচ্ছে। মোদ্দা কথা হলো, আজ বেশি করে আলোচনায় আসছে আড়ম্বরহীন বামপন্থী নেতাদের জীবনধারার কথা। সেই সঙ্গে সমূলে সব হারিয়ে পথে বসা রাজ্যবাসী আজ বেশি করে মনে করছে আর এক নেতার কথা। তিনি গৌতম দেব। সিপিএম নেতা, রাজ্য রাজনীতির পরিচিত মুখ, প্রাক্তন মন্ত্রী। ২০১২ সালে তিনি সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন।
অসুখে শরীর নুইয়ে পড়লেও বারবার তাঁকে মঞ্চে দেখা গেছে স্বীয় মেজাজে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর মেজাজটাই আসল রাজা। তাঁর আক্রমণের ঝাঁজে ফালাফালা হয়েছেন কখনও তৃণমূল নেত্রী, কিংবা বিজেপি। কখনও আবার আরএসএস-এর উদাহরণ টেনে খোদ দলের আত্মসমালোচনা করেছেন। তাই আজ তিনি আগের ফর্মে থাকলে হয়ত খানিকটা গলা তুলে আক্রমণের মেজাজে আসরে নামতে পারত সব হারানো বামফ্রন্ট। রাজ্যকে আজ পাতালঘরের অন্ধকারে টেনে নামাল যে সরকার, তাকে পথ দেখিয়ে দিতে আজ কি বেশি করে প্রয়োজন ছিল না গৌতম দেবের মতো নেতার?
আরও পড়ুন: ৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে জীবন কাটল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, সততার সহজপাঠ ছিল হাতের কাছেই
স্নায়ুর অসুখে বহুদিন ধরে একরকম ঘরবন্দি তিনি। এখন খুব একটা কোথাও যান না। সকালবিকেল চলে ফিজিওথেরাপি। এ-ঘর থেকে ও-ঘর যেতেও মাঝে মধ্যে সাহায্যের দরকার হয়। এই বছরের ১৪ মে দীর্ঘদিন পর দলের কোনও কর্মসূচিতে দেখা যায় সিপিএম নেতা গৌতম দেবকে। দলের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-এর সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। দলের বর্ষীয়ান নেতা গৌতমবাবু হঠাৎ করে প্রকাশ্যে কোনও দলীয় কর্মসূচিতে যাওয়ায় জল্পনা শুরু হয়। তাহলে তিনি কি সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরছেন? বোধহয় আর সেটা সম্ভব নয়। কারণ শরীর সায় দিচ্ছে না। অশক্ত শরীর নিয়ে আগেও তাঁকে দেখা গেছে নিজস্ব মেজাজে।
২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল- অসুখ উড়িয়ে চেনা মেজাজে ঝোড়ো ব্যাট করেন গৌতম দেব। কথার তোড়ে উড়িয়ে দেন বিরোধীদের। হাবড়ায় জোটপ্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে হাজির হন তিনি। মঞ্চে তাঁকে দেখা যায়, সেই পুরনো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। পাক্কা ৪০ মিনিট ধরে একদিকে বিজেপিকে বেঁধেন এই বলে যে, "বিজেপিতে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনও নেতা নেই।" অন্যদিকে সরাসরি বলেন, "মমতাকে না সরালে রাজ্যের ক্ষতি হয়ে যাবে। তৃণমূল দলটাকে পেট্রল-ওয়াশ করতে হবে। মমতা সত্যি কথা খুব কম বলে। সাধারণত ছেলেরা গুল মারে। মেয়েরা গুল মারে ভাবতে পারি না।" জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে তিনি 'পশ্চাৎপক্ক’ বলে কটাক্ষ করেন। আবার অনুব্রত মণ্ডলের নাম না করে তাঁকে 'ষাঁড়’ বলেও টিপ্পনি কেটেছেন। এভাবেই তিনি নানা শ্লেষাত্মক, তির্যক মন্তব্য করে শ্রোতাদের মাত করেন। মুহুর্মূহু হাততালি। তাঁর রাজনৈতিক স্টাইলাইজেশন নিয়ে আলোচনা উঠলে বলতেই হয়, এভাবেই তাঁকে মনে রাখবে রাজ্যবাসী।
তাঁর শব্দচয়ন নিয়ে অনেক সময় বিতর্ক হয়েছে। তবে সেই সবের ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। কারণ তিনি বহুদিন আগেই তৃণমূল নেত্রীর অনশন এবং সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে ফালা ফালা করেছিলেন। ২০১৭ সালের এপ্রিলে এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তর স্মরণে নেতাজিনগরে এক অনুষ্ঠানে গৌতম দেব ছিলেন আগাগোড়া আক্রমণাত্মক। বিস্ফোরক অভিযোগ এনে তৃণমূল নেত্রীকে কথা দিয়ে শূলে চড়ান। তৃণমূল নেত্রীর সততার দাবি গোটাটাই মিথ্যাচারের রাজনীতি- এই অভিযোগ করতে গিয়ে তিনি এক সময়ে বলেন, "অনশনের সময় খিদে পেলে নেত্রী পিছনে চলে যেতেন। ফিশফ্রাই খেতেন। আর কথা বলতেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বুঝুন কেমন মাল! কী যন্তর!" ঘন ঘন মমতা মোবাইল ফোন নম্বর বদলান। এই দাবি করে গৌতমবাবুর আরও মন্তব্য, "ক্রিমিনাল বেন্ট অফ মাইন্ড! নইলে কেউ এরকম করে?"
তৃণমূলের মহিলা সংগঠন পরে 'মাল’ শব্দ নিয়ে আসরে নামলেও তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ ঝাঁঝালো আক্রমণ আর আপসহীন চরিত্রের জন্য তিনি রাজনীতিতে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। আজ রাজ্য দুর্নীতির পাতালঘরে মুখ লুকিয়েছে। এই অবস্থায় বিজেপি যে এই হাতে-গরম ইস্যু নিয়ে ছেড়ে কথা বলবে না, তা বলাই বাহুল্য। খুব স্বাভাবিকভাবে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক 'অপা' আছে, তারা কাস্টোডিয়ান ছিলেন। কালেক্টর অনেক ছিলেন, যেমন গোঘাটের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক মানস মজুমদার, বলাগড়ের তৃণমূল নেতা শান্তনু ব্যানার্জি। ভাইপোর কালেক্টর, চোর পার্থর কালেক্টর। প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যাম মুখার্জী বিনয় মিশ্রর মাধ্যমে ১২ কোটি টাকা তুলে দিয়েছিলেন। রাজ্যজুড়ে এত পাপ! বন্দ্যোপাধ্যায় আর চট্টোপাধ্যায় জয়েন্ট ভেঞ্চার চলছে- ইত্যাদি দাবি করেন তিনি। এইসব অভিযোগ যে বিস্ফোরক, তা বলাই বাহুল্য়। একথাও ঠিক যে রাজ্যের হাওয়া গরম করার জন্য কম উত্তেজনাকর নয়। তবে নিন্দুকরা এমনও বলছেন, তৃণমূলের লাভের গুড় কি তিনি খাননি? তাঁর বিরুদ্ধে তো আবার সারদার টাকা হজম করার অভিযোগ রয়েছে।
সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন বিস্ফোরক দাবি করেন সংবাদমাধ্যমের সামনে যে, শুভেন্দু অধিকারী একাধিকবার তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তাঁকে ব্ল্যাকমেল করতেন। সারদায় শুভেন্দুর ভূমিকা কী ছিল, সেই বিষয়ে সিবিআইকে পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। এদিকে নারদা মামলায় নাম জড়ায় শুভেন্দুর। তবে ইডির চার্জশিটে তাঁর নাম না থাকায় আওয়াজ তোলেন কুণাল ঘোষ। সে যাই হোক, পাঁকে পড়া রাজ্যকে সুযোগ বুঝে বিজেপি যে আক্রমণ করবে, তা বলাই বাহুল্য। এই ব্যাপারে শুভেন্দু যে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন, সেটাও স্বাভাবিক। তবে তাঁর ক্লিন ইমেজ নিয়েই এত প্রশ্ন। তাও আবার ঘুঘুর বাসায় তিনিও তো ঘর করেছিলেন! আর সময়বিশেষে তাঁর সাম্প্রদায়িক সত্তা যেভাবে প্রকট হয়ে ওঠে, তা নজর এড়ায় না রাজ্যবাসীর।
এই অবস্থায় গৌতম দেবের মতো নেতাকে তো আজ রাজ্যের দরকার। দুর্নীতির পাঁকে রাজ্যকে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারের দিকে চোখে চোখ রেখে তাকানো এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বিমান বসুর মতো নেতাদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কথা আজ বুক বাজিয়ে তো বলতে পারতেন একজনই, যিনি স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে রাজনীতির পাতায় অনন্য, গৌতম দেব।