অনুরাগ 'ঘটিয়া' না বললে যেন জানাই হত না

Bengali Cinema: অনুরাগ কাশ্যপ বলেছেন, বাংলা ছবি 'ঘটিয়া'। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন? সমস্যাটা কি তবে অনুরাগই প্রথম দেখিয়ে দিলেন?

আজ থেকে নয়, বাংলা ছবি বহুদিন ধরেই দর্শকবিচ্ছিন্ন। তথাকথিত মেইনস্ট্রিম ছবি বলে যা এতদিন বাংলা সিনেমার দুনিয়ায় পরিচিত ছিল, সেই ধারা ক্রমে অপসৃয়মান। সেই মেইনস্ট্রিম ছবিও আজকাল আর হয় না বললেই চলে। ভালো ছবি হচ্ছে না, বাংলা ছবির মান পড়ে গিয়েছে। এমন অনেক উচ্চকিত ঢক্কানিনাদই কানে আসছে ইদানীং। এমন অনেক ছবিই কিন্তু বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিক কালে তৈরি হয়েছে, যেগুলো হলে তেমন ব্যবসা করতে না পারলেও পরবর্তীকালে তা দর্শক দেখেছেন। ফলে ছবির ব্যবসা করা আর দর্শকের কাছে পৌঁছনো- এ দু'টি ব্যাপার আসলে আলাদা। কিন্তু একটা শিল্প, একটা ইন্ডাস্ট্রির বেঁচে থাকতে গেলে, প্রস্ফুটিত হতে গেলে ব্যবসা জরুরি। বাংলা ছবির এই দর্শকবিচ্ছিন্নতার নেপথ্যে রয়েছে অনেকগুলি কারণ। তার অন্যতম একটি কারণ বাংলা ছবির প্রযোজনার ধরন বদলে যাওয়া। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে প্রযোজক ছিলেন যাঁরা, তাঁদের বাংলা ছবিতে অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি। তার পরবর্তীতে বিশেষত আশির দশকে যে ধরনের প্রযোজক বাংলা ছবিতে এসেছেন, তাঁদের বাংলা ছবির প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে।  কিন্তু তার ফলে ছবি বানানোয় বা বণ্টনের ক্ষেত্রে তাঁদের রুচি, তাঁদের দর্শন বড় ভূমিকা নিয়েছে। আর বলাই বাহুল্য, সেই রুচিই বাংলা ছবিকে একটা বিশেষ দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, দর্শকের কোনও দায় নেই। তাঁরা হলমুখো হন ভালো ছবির টানে। তামিল বা মালয়লাম ছবির ক্ষেত্রে যদি দর্শকরা পাগলের মতো সিনেমাহলে যান, তাহলে বুঝতে হবে পরিচালক ও পরিবেশকরা মিলে সেই জায়গাটাকে দীর্ঘদিন ধরে লালন-পালন করেছেন। ফলে সেখানকার প্রযোজকেরা জানেন, এটা একটা লং টার্ম ইনভেসমেন্ট। একটা ছবিতে কিছু টাকা বানিয়েই পালিয়ে যাওয়া আর কুড়ি-পঁচিশ বছরের মতো দীর্ঘসময় বাজারে থাকার জন্য প্রযোজনা করা— এইটা বাংলা ছবিতে হয়নি। যেটা বর্তমানে তেলুগু-তামিল ছবিতে বা মালয়লম কিংবা মারাঠি ছবিতে দেখা যায়। ফলে যাঁরা 'ফ্লাই বাই নাইট' মানসিকতা নিয়ে বাংলা ছবিতে এসেছেন, তাঁদের ছবির সঙ্গে আসলে কোনও সম্পর্কই তৈরি হয়নি। তাঁরা তাঁদের রুচি ছবিতে ঢেলেছে। কিন্তু সেই রুচি সাধারণ বাঙালি দর্শকের রুচির সঙ্গে মেলেনি। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যাপারটা ঘটতে থাকার ফলে সাধারণ বাঙালি দর্শকের মনে হয়েছে, এই ছবিগুলো তাকে আনন্দ দিতে পারছে না বা পারবে না। তার মানে এই নয়, এই কুড়ি-তিরিশ বছরে কোনও ভালো ছবি হয়নি। আলবাত হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক ইন্ডাস্ট্রি যদি নষ্ট হয়ে যায়, সেখানে দশ বছরের ওই দশটা বা বারোটা ভালো ছবি, তারাও কিন্তু ওই একই ছাতার নীচে চলে আসে।

আরও পড়ুন: পাশে দাঁড়ানোর আর্তি নয়, নিজের জোরে এপার বা‌ংলাকে টেক্কা দিচ্ছে বাংলাদেশের সিরিজ ও সিনেমা

আসলে যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিতেই সামগ্রিক বাজারের একটা দাম আছে। আর সেই বাজারের মান এবং তার উপর ক্রেতার আস্থারও একটা বিরাট মূল্য আছে। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে দর্শকের সেই আস্থাটা গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আরও একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। ভারতবর্ষে ঢুকে পড়েছে 'মাল্টিপ্লেক্স' শব্দটি। যার প্রভাব আদতে ভয়ানক। আগে একটা লোক যখন ছবি দেখতে যেতেন শুক্র, শনি বা রবিবারে, সিঙ্গল স্ক্রিনে তাঁর কতই বা খরচ হত! সপ্তাহান্তের বিনোদন হিসেবে সেই ব্য়য়টুকু করার সামর্থ্য তাঁর ছিল। কিন্তু সেই দৃশ্যটা বদলে গেল মাল্টিপ্লেক্স আসার ফলে। এখন মাল্টিপ্লেক্সে একটা ছবি দেখতে গেলে একজন সাধারণ দর্শকের যে পরিমাণ খরচ হয়, সেটা সামলে ওঠা অনেকের পক্ষেই কঠিন। নিয়মিত সিনেমা দেখা ফলে দূরতর দ্বীপ। পাশাপাশি তাঁর অবচেতনে এটাও চলতে থাকে সবসময়ে,  যে ছবিটা তো ওটিটি-তে  সেই আসবেই। বাংলা ছবির এই হতদরিদ্র অবস্থার নেপথ্যে দাঁড়িয়ে থাকে এই দু'য়ের যোগফল। মাল্টিপ্লেক্সরা আসলেছবির ব্যবসা করে না। আপনি যে বহুমূল্য পপকর্ন বা বার্গারটি কিনে খাচ্ছেন মাল্টিপ্লেক্সের ফুডকোর্ট থেকে, ওইটাই ওদের আসল ব্যবসা। অঙ্ক কিন্তু বলছে, ছবির টাকার ব্যবসা ওদের ব্যবসার নিরিখে হয়তো ২০ শতাংশও নয়।  মাল্টিপ্লেক্স ছবি দেখাচ্ছে ওই পপকর্নটা খাওয়ানোর জন্যই। ছবি দেখানোর জন্য পপকর্ন খাওয়ানো হচ্ছে না। অর্থাৎ এমন ছবিই মাল্টিপ্লেক্স দেখাতে চাইবে, যে ছবি আপনি পপকর্ন খেতে খেতে, কোক খেতে খেতে বা ওই বহুমূল্য বার্গার খেতে খেতে দেখতে পারবেন। শাহরুখ খানদের তাই 'পাঠান'-এর মতো ছবিই বানাতে হয়। কারণ এইরকম কিছু ছাড়া মাল্টিপ্লেক্সে আর কোনও কিছুই কাজ করছে না এই মুহূর্তে। হয় 'মার্ভেল কমিকস'-এর মতো 'লার্জার দ্যান লাইফ' ছবি কিংবা 'আরআরআর' বা 'পুষ্পা'-র মতো  সিনেমা, যা আপনি দশ-কুড়ি জনের সঙ্গে হইহই করতে করতে, পপকর্ন-কোকাকোলা ছড়াতে ছড়াতে দেখতে পারবেন। তেমন ছবি ছাড়া এখন অন্য কোনও কিছু নিয়েই আর আগ্রহী নয় মাল্টিপ্লেক্স।

current-situation-of-bengali-cenema-and-anurag-kashyaps-comments-on-the-standerd-of-bengali-film-industry-by-indranil-roychowdhury

আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগে যখন মাল্টিপ্লেক্সের পথচলা শুরু হয়, তখন তাদের উদ্দেশ্য ছিল 'ইনডিপেন্ডেন্ট' ছবিকে জায়গা করে দেওয়া। সিঙ্গল স্ক্রিনে শুধুমাত্র বড় স্টারদের সিনেমা চলে বলে একটা অভিযোগ ছিল সে সময়ে। মাল্টিপ্লেক্স এসেছিল সেই সব শহুরে দর্শকদের জন্য, যারা একটু অন্যধরনের ছবি দেখতে চান। আশির দশকে যেমন এনএফডিসি-র হাত ধরে একটা বিশাল সংখ্যক পরিচালকের কেরিয়ার শুরু হয়েছিল। যাঁদেরকে আমরা পরবর্তীতে ভারতীয় ছবির অন্যতম লোকজন বলে মনে করি। কেতন মেহতা, প্রকাশ ঝাঁ, বিনোদ চোপড়া, কুন্দন শাহ, সইয়দ মির্জার মতো বহু পরিচালকই রয়েছেন সেই তালিকায়। ঠিক সেই ভাবেই, তাদের পরবর্তী প্রজন্মের পরিচালক যাঁরা অর্থাৎ অনুরাগ কাশ্যপ, বিশাল ভরদ্বাজ, হনসল মেহেতা, দিবাকর ব্যানার্জিদের মতো বহু ছবিকরিয়ের পথচলাই কিন্তু শুরু হয় মাল্টিপ্লেক্সের হাত ধরে। কিন্তু ক্রমে মাল্টিপ্লেক্স বুঝতে পারল, তাদের তৈরি ওই ছবি দেখে কেউ পপকর্ন খায় না। খাওয়া সম্ভব নয় আসলে।

এরপর কোভিড এসে কফিনের শেষ পেরেকটাও পুঁতে দিল। মানুষের সামনে খুলে গেল ওটিটি-র দরজা। এই সময় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে নীতির আরও বদল করল মাল্টিপ্লেক্স। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে 'অ্যানিমেল', 'পাঠান'- ওই জাতীয় ছবি ছাড়া অন্য কোনও ধরনের ছবিকেই তেমন ভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে না তারা। তার উপর বাংলা ছবি? গোটা ব্রহ্মাণ্ডেই বোধহয় তার নাগরিকত্ব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় মাল্টিপ্লেক্সে সকাল এগারোটার স্লটে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বাংলা সিনেমাকে। আসলে যত দিন যাচ্ছে গোটা বিষয়টাই বিপণন-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। একটা ছবি ঘিরে আপনি ঠিক কী পরিমাণ আওয়াজ তৈরি করতে পারছেন, সেটাও এখন সিনেমার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। তার পর এখন একটা নতুন নিয়ম তৈরি হয়েছে। প্রথম তিন দিনে একটা ছবিকে হিট বা ফ্লপ ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে। আর সেক্ষেত্রে এই খেলাতে জিতবে কে? অবশ্যম্ভাবী ভাবে শাহরুখ খান, সলমন খানেরা। জিতবে 'আরআরআর'-এর মতো ছবি । বাংলা ছবি তো কোনওকালেই তিন দিনে হিট করেনি। অন্ততপক্ষে তার দু'সপ্তাহ-আড়াই সপ্তাহ তো লেগেইছে। এই সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কোনও বাংলা ছবি তো কোনও মাল্টিপ্লেক্সে দু'সপ্তাহ- আড়াই সপ্তাহ থাকবেই না। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে দর্শককে 'ঘটিয়া' বলাটা বোধহয় নেহাতই একটা অলস কাজ। দর্শকের রুচি অবশ্যই বদলেছে। কিন্তু তা তো একদিন সকালে উঠে হঠাৎ করে বদলে যায়নি। প্রতিদিন একটু একটু করে গোটা সিস্টেমটাই বদলেছে। যার প্রভাব পড়েছে দর্শকের রুচিতেও।

current-situation-of-bengali-cenema-and-anurag-kashyaps-comments-on-the-standerd-of-bengali-film-industry-by-indranil-roychowdhury

একটা সময় বাংলা ছবির মূল ধারাটাই ছিল সাহিত্যধর্মী। সামাজিক গল্প, পারিবারিক নাটক উঠে আসত সেখানে। বাংলা কিন্তু কোনওকালেই তেমন ভাবে অ্যাকশন ছবি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিল না। উত্তম কুমার চলে যাওয়ার পর কার্যত রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিল বাংলা ছবি । সে সময় অঞ্জন চৌধুরীর মতো পরিচালক খেয়াল করেন, একটা নতুন দর্শক তৈরি হয়েছে গ্রামবাংলায়। প্রথম ভূমিসংস্কারের ফলে যাঁদের হাতে কিছু হলেও উদবৃত্ত টাকা এসেছে। আর উদবৃত্ত টাকা যাঁদের হাতে থাকে, তাঁদের একটা বিনোদনের খোঁজও থাকে। কিন্তু তাঁদের কাছে বিনোদন বলতে এতদিন ছিল শীতকালের ওই যাত্রাটুকু। এককথায় সেই শ্রেণিটা ছিল 'এনটারটেইনমেন্ট স্টার্ভড পপিউলেশন'। অঞ্জন চৌধুরীই প্রথম আবিষ্কার করলেন তাঁদের। 'শত্রু'-র মতো সিনেমা সে সময়ে শয়ে শয়ে হিমঘর, বিভিন্ন গোডাউনে পর্দা খাটিয়ে প্রজেক্টর দিয়ে দেখানো হয়েছিল। সেই শুরু। এরপর আশি থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত টানা বারো-তেরো বছর ধরে নিরন্তর চলেছে এই ধরনের সিনেমার আধিপত্য। বাংলা ছবির মুখ ঘুরে যায় গ্রামবাংলার দিকে। গ্রামের গৃহবধূরা হয়ে ওঠে বাংলা সিনেমার বৃহত্তম বাজার। কিন্তু এরই মধ্যে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল দূরদর্শন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যেতে থাকল গ্রামবাংলার মনটিও। সে ক্রমে বুঝতে শুরু করল, এতদিন যে বিনোদনটা তারা অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমা থেকে পেয়ে এসেছে, তা এখন তাঁকে দিয়ে দিচ্ছে বাংলা সিরিয়ালই। ফলে ক্রমে ওই ঘরানাটাও শেষ হয়ে যায়। কারণ তা দিয়ে আর ব্যবসা হচ্ছিল না। ফলে বাংলা ছবি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার প্রয়োজন পড়ল ফের।

current-situation-of-bengali-cenema-and-anurag-kashyaps-comments-on-the-standerd-of-bengali-film-industry-by-indranil-roychowdhury

আশির শুরু থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি, যে সময়টায় এই ঘরানাটার দাপট বাংলা ছবি জুড়ে, সেসময়ে শিক্ষিত বুদ্ধিমান প্রযোজকেরা সব পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই ছবিগুলো তৈরির যে পরিবেশ, তা এঁদের সঙ্গে যায় না। ফলে এই শ্রেণিটাই বিলুপ্ত হয়ে যায়। একই সঙ্গে শহরের সিঙ্গল স্ক্রিনের পরিকাঠামোও ভীষণ ভাবে দুর্বল হয়ে যায়। কারণ গ্রামবাংলার জন্য তৈরি যে ছবি, সেগুলোই দেখানো হত শহরেও। শহরের জন্য আলাদা করে কোনও সিনেমা তৈরি হয়নি নব্বইয়ের দশকে। এবার এই ধরনের ছবিগুলি শহরের মানুষকে তেমন ভাবে হলে টানবে না, তাতে আর আশ্চর্য কী! এই ছবির দর্শক ছিলেন মূলত শহরেই খেটে খাওয়া মানুষ, যারা কাজের খোঁজে শহরে এসেছিলেন গ্রাম থেকে। তাঁরাই সিনেমাহলে গিয়ে বাংলা ছবি দেখতেন। সেই ব্যবসাটুকুর খাতিরে সিঙ্গলস্ক্রিন হলগুলো টিকিটের দাম বাড়াতে পারল না। দাম বাড়ালে যে মূল দর্শকশ্রেণিটাকেই হারিয়ে ফেলবে তারা। যার জেরে ক্রমশ হলগুলোর অবস্থা জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হতে শুরু করল। সিট লড়ঝড়ে, এসি নেই, ঝুল ভর্তি, ফ্যান ঘোরে না— রক্ষণাবেক্ষণ নেই। হবে না-ই বা কেন! কুড়ি বছরের টিকিটের দাম তো ২০ শতাংশও বেড়েছে কিনা সন্দেহ। ফলে ভালো ছবি করলেও আর মধ্যবিত্তকে ফেরানো গেল না সিঙ্গল স্ক্রিনে।

আর এই ফাঁকটা গলেই বাজারে ঢুকে পড়ল মাল্টিপ্লেক্স। নব্বইয়ের শেষের দিকে গিয়ে এই সঙ্কটটা পরিষ্কার বোঝা গেল। কিন্তু এইসব প্রযোজকদের পক্ষে গ্রামবাংলার জন্য বাংলা সিনেমায় নতুন আলো আনা সম্ভব ছিল না। ফলে সহজ পথটাই বেছে নিলেন তাঁরা। তামিল-তেলুগু অর্থাৎ দক্ষিণী ছবিতে কী চলছে, তা অনুকরণ করে গোটা সিনেমাটা তৈরি করে দেওয়া। অনেকক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কপিরাইটেরও তোয়াক্কা করেনি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সেটা চলেছে। পরবর্তীতে দক্ষিণী ছবির পরিচালকেরা বুঝতে পারেন, তাঁদের ছবি নকল হচ্ছে। অনেক পরিচালক আইনি পথেও হেঁটেছিলেন। যার ফলেই একটা সময় সটান দক্ষিণী ছবি টুকে ছবি বানানোর এই ধারাটাও বন্ধ হয়ে গেল। পাশাপাশি দুরদর্শনের প্রসারের ফলে দর্শকও বুঝে যেতে শুরু করেন, তাঁরা দক্ষিণী ছবির নকল একটা ভার্সন দেখছেন, এবং বলাই বাহুল্য সেটা খুবই খারাপ একটা অনুকরণ। ফলে তাঁরা অনেক বেশি আসল ছবির হিন্দি ডাবড ভার্সনের দিকে ঝুঁকতে লাগলেন। কিন্তু এর পরে আর বাংলা ছবির পরিচালকেরা কমার্শিয়াল ছবি নিয়ে মাথা ঘামাননি।

current-situation-of-bengali-cenema-and-anurag-kashyaps-comments-on-the-standerd-of-bengali-film-industry-by-indranil-roychowdhury

হিন্দির সঙ্গে তামিল-তেলুগুর সংঘাতের ব্যাপারটা কিন্তু আলাদা। দক্ষিণী ছবির সঙ্গে বলিউডের একটা দীর্ঘদিনের এলাকা দখলের লড়াই আছে। এতদিন ধরে হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছে তারা। কার্যত তাদের সীমানায় হিন্দিকে পা পর্যন্ত রাখতে দেয়নি তারা এতদিন। এককাট্টা হয়ে হিন্দির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছে। এটা কিন্তু শুধু সিনেমার গল্প নয়। এটা ওদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভাষাগত পরিচয়, রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গেও যুক্ত। কারণ ওরা জানে, হিন্দি ছবি যদি হায়দরাবাদ, অন্ধপ্রদেশ বা তামিলনাড়ুতে ঢুকে পড়ে, সেই দখলটা শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক বা বাণিজ্যিক দখলই হবে না, সেটা রাজনৈতিক দখলও হবে। এখন যখন নিজেদের মাটিটা বেশ শক্ত, সে সময়ে দাঁড়িয়ে হিন্দিকে চ্যালেঞ্জ করছে দক্ষিণী ছবির দুনিয়া। বলিউডের ডোমেনে ঢুকতে চাইছে তারা। এ যেন অনেকটাই আমেরিকা-চিন সম্পর্কের মতো। এই মুহূর্তে দু'জনে দু'জনকে জায়গা ছাড়ছে। দক্ষিণী দর্শককে খুশি করতে বিজয় সেতুপতি ঢুকে পড়ছেন হিন্দি ছবিতে। নানা রকম সহাবস্থানের ছবি চোখে পড়ছে এখম সেখানে। আরও এখন একটা বড় খেলা শুরু হয়েছে ইদানীং। একটা বড় স্পেক্ট্যকল দিয়ে এই মাল্টিপ্লেক্স জোনকে দখল করার খেলা। আর এই যুদ্ধে বাঙালি পরিচালক বা বাঙালি দর্শক খুবই নগণ্য একটা অংশ। সর্বভারতীয় একটা বাজার সিনেমা দিয়ে দখলদারীর চেষ্টা করছে। চেষ্টা চলছে সর্বভারতীয় একটা সিনেমার ভাষা তৈরি করার।

আসলে একটা ইন্ডাস্ট্রির স্বাস্থ্য নির্ণয় করে দেয় তার বাণিজ্য। আশি-নব্বই দশকের বহু ছবিরই বাণিজ্য করার ক্ষমতা কিন্তু আজকের একটা কমার্শিয়াল বাংলা ছবির থেকে অনেক বেশি ছিল। কারণ সেসময়ের বাজার অনেক বেশি স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু সেই বাজারটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে সামগ্রিক কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। যে বাংলা ছবির মান নিয়ে আমরা গর্ব করি, অর্থাৎ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশক, যে সময়টায় সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, অজয় করেরা ছবি বানাচ্ছেন, সে সময় একটা স্বর্ণালি মেইনস্ট্রিম কিন্তু বাংলা ছবির দুনিয়ায় ছিল। ওই মেইনস্ট্রিমটা না থাকলে হয়তো সত্যজিতের পক্ষে অতগুলো ছবি করা সম্ভব হত না। আসলে একটা মেইনস্ট্রিমই তৈরি করে দেয় একটা ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক পরিকাঠামো। হল থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিবিউশন, এমনকী টেকনিশিয়ান, অভিনেতা এবং দর্শক তৈরি করার পিছনেও বড় হাত থাকে মেইনস্ট্রিমের। যা গড়ে দেয় একটা সামগ্রিক সিনেমার কালচার। যার ভিতর থেকেই অন্য ধরনের ছবিনির্মাতারা বেরিয়ে আসেন। ভারতীয় সিনেমার মানের নিরিখে গত বিশ বছরে অনেক এগিয়ে গিয়েছে মালয়লম ছবি। তাদের ইতিহাসের দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, দেখবেন, তাদের একটা খুব স্বাস্থ্যকর মেইনস্ট্রিম রয়েছে। এই মেইনস্ট্রিমটার কারণে অল্টারনেটিভ ছবিকরিয়ে যাঁরা, তারা নিজস্ব একটা দর্শক তৈরি করতে পেরেছেন। যেটা হয়তো মেইনস্ট্রিমের মতো ব্যবসা করে না। কিন্তু তারা নিজস্ব একটা অস্তিত্ব ধরে রাখতে পেরেছে।  আমাদের মেইনস্ট্রিম ব্যাপারটাই হারিয়ে গিয়েছে বলেই ইনডিপেন্ডেন্ট বলে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। কারণ মেইনস্ট্রিম থাকলে তবেই না ইনডিপেন্ডেন্ট। সামগ্রিক ইন্ডাস্ট্রির যদি ব্যবসা করার ক্ষমতা কমে যায়, তাহলে সেখান থেকে ভালো ছবি তৈরি করার জায়গাও চলে যায়। দক্ষিণী ছবির দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন, একটা বড় ছবি থেকে প্রচুর টাকা রোজগার করে, তার উদবৃত্ত অর্থ নিয়ে তুলনামূলক ঝুঁকির একটি ছবি বানাতে পারেন প্রযোজক-পরিচালকেরা। আর সেখানেই একটা বিরাট শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে বাংলা বাজারে। একজন বুদ্ধিমান প্রযোজক চেষ্টা করেন বাজারটাকে বড় করতে। ধনুষের মতো অনেক বড় প্রযোজকই তো এমন ছবি প্রযোজনা করছেন, যেখানে তিনি অভিনয়ও করছেন না। আসলে যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিকেই তো ভবিষ্যতের কথাটা মাথায় রেখেই এগোতে হয়। বাংলা ছবিতে সেই বিকল্পের জায়গাটাই নেই।

current-situation-of-bengali-cenema-and-anurag-kashyaps-comments-on-the-standerd-of-bengali-film-industry-by-indranil-roychowdhury

আরও একটা বড় সমস্যা, আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে মিডিয়া একেবারে আমাদের ঘরের ভিতর ঢুকে পড়েছে মোবাইল ও টেলিভিশনের মাধ্যমে। ফলে আমাদের বিনোদনের খিদে কোনও না কোনও ভাবে মিটে যায়ই ঠিক। যে কারণেই এত বড় বাজেটের বড় আকারের কিছু দর্শককে দেখানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে ছবির জগতে। এমন কিছু যার স্বাদ দর্শক মোবাইলে পাবেন না। কিন্তু এ সমস্যা শুধু বাংলা ছবির নয়। এই সমস্যা বিশ্ব-সিনেমা জুড়েই। গোটা পৃথিবীর 'আর্টহাউজ ফিল্মমেকার'-রাই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছেন। কারণ পুরো বাজারটাই এসে গিয়েছে নেটফ্লিক্সদের দখলে। ফলে গোটা বিশ্বের দর্শকের অভিরুচির নিয়ামক হয়ে উঠছে সেই ছ'টা, সাতটা বা আটটা সংস্থা। আগে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক বা প্রযোজকের স্বপ্ন কাজ করত একটা ছবির হয়ে ওঠার নেপথ্যে। কিন্তু সেই ছবিকে যদি নেটফ্লিক্সেই যেতে হয়, তাহলে বাজারের চাহিদা, নেটফ্লিক্সের মতো সংস্থাগুলির নিজস্ব নীতি এবং সেই মার্কেট রিসার্চের বাঁধা গতেই আপনি ছবিকে ফেলতে বাধ্য হবেন। আর তার অর্থই হল আর্টহাউজ ছবির মৃত্যু। একই ঘটনা ঘটেছে সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও। গত দশ-কুড়ি বছরের ইংরেজি পপ সঙ্গীতের দিকে যদি কান পাতেন, দেখবেন সব গানই যেন একরকম। আসলে এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা কর্পোরেট সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে। আর কর্পোরেট সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে তার বাজার-সমীক্ষাকে। বাজার-সমীক্ষাই বলে দেবে, এই মুহূর্তে কী চলছে? আর যেটা চলছে, সেটাকেই যদি আমরা অনুকরণের পর অনুকরণ করতে শুরু করি, তাহলে একটা বিশাল জঙ্গল তৈরি হয়। যেটা ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল, যেখানে সব গাছ এক।

কর্পোরেট আসলে জুতো বোঝে, টুথপেস্ট বোঝে, শ্যাম্পু বোঝে। যে জিনিসটা জানে-চেনে, সেটাকেই বিক্রি করতে চায়। প্রতিমাসে যদি টুথব্রাশ আকারে বদলে যায়, তাহলে কিন্তু সেটা নিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। ফলে কর্পোরেট সবসময়েই একটা নির্দিষ্ট মডেল খোঁজে। আর সেই মডেলের জন্য আজকের কনটেন্ট বা গল্প, সবগুলোই ভীষণ একরকম দেখতে। সঙ্গীত থেকে শুরু করে ওয়েবসিরিজ, সবেতেই সেই ছায়া। মিডিয়া, সংবাদমাধ্যম সব জায়গাতেই সেই কর্পোরেট মডেলের আধিপত্য। অর্থাৎ কিনা একটা বিজনেস মডেলে বিষয়টাকে ফেলে ডেটা বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা। আর এর একটা নিজস্ব সঙ্কট রয়েছে। যা খুব শিগগিরই হয়তো গোটা বিশ্বে প্রভাব ফেলবে। বাংলা সিনেমার এই দুরবস্থার পিছনেও রয়েছে এই সমস্ত বিষয়গুলিই। কর্পোরেটের আধিপত্য, মার্কেট রিসার্চের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া কন্টেন্ট, বাংলার মেইনস্ট্রিম হারিয়ে যাওয়া, মাল্টিপ্লেক্স নামক আরও একটি কর্পোরেট পরিকাঠামোর বিজেনেস মডেল, এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে বাংলা ছবির অস্তিত্ব এখন গভীর সঙ্কটে। 

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে; পশ্চিমবঙ্গ পারেনি : কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

অনুরাগ কাশ্যপ বলেছেন, বাংলা ছবি 'ঘটিয়া'। কিন্তু তিনি তো একজন সতন্ত্র মানুষ। হয়তো তিনি একটু রূঢ় ভাবেই বলেছেন। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন? সমস্যাটা কি তবে অনুরাগই প্রথম দেখিয়ে দিলেন। আর তা যদি হয়ে থাকে, সেটা আমাদের জন্য খুব বড় একটা দুঃসংবাদ। অনুরাগ কাশ্যপকে ঠিক বা ভুল প্রমাণ করার জন্য আমরা এত মেতে উঠেছি কেন সোশ্যাল মিডিয়ায়? একটা জাতি যদি নিজের গুরুত্ব ভুলে না-গিয়ে থাকে, তাহলে এমনটা সে করে না। অনুরাগ কাশ্যপ ঠিক হোক বা ভুল, তাতে কি সত্যিই আমাদের কিছু পাল্টাবে? সম্ভবত না। তাহলে আমরা এত উত্তেজিত কেন অনুরাগের বক্তব্য নিয়ে? কেন ঝড় তুলছি ফেসবুকে? কেনই বা এত লেখা ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে? কারণ আমরা এমন একটা জাতিতে পরিণত হয়েছি, যে জাতির সমগ্র অস্তিত্বটাই নির্ভর করে অন্য কারওর মন্তব্যের উপরে। অর্থাৎ নিজেদের অস্তিত্ব সম্মন্ধে আমাদের সন্দেহ ও সংশয়ের শেষ নেই। যার জন্য আমরা সব সময় বাইরে থেকে স্বীকৃতি খোঁজার চেষ্টা করি। অনুরাগ কাশ্যপ একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা। তাঁর মতো অজস্র ছবিকরিয়ে আছেন ভারতবর্ষে। তাদের কথার ভিত্তিতে একটা গোটা জাতি তার ভালো বা মন্দের বিতর্কে এত মত্তই বা হয়ে উঠছে কেন? এটা কি আমাদের অন্তঃসারশূন্যতারই প্রমাণ নয়। আসলে শুধু বাংলা ছবির নয়, বাঙালির নিজস্ব অস্তিত্বের সঙ্কটও  নিদারুণ গভীর। কারণ তার শুধু সিনেমা যায়নি। তার রাজনীতি, তার সংস্কৃতি, সর্বস্ব গিয়েছে। তার সামাজিক জীবনও কিনারায়। ফলে এই হাবুডুবু সময়ে অনুরাগ কাশ্যপের বাক্য ধরে বাঁচার চেষ্টা করতে হচ্ছে আমাদের।

আসলে আমরাই আমাদের নিজেদের যত্ন করতে পারিনি। অনুরাগ কাশ্যপ নন, আমাদের নিজেদের কথা নিজেদেরকেই বলতে হবে। আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি কিনা বা খুব রোগা হয়ে গিয়েছি কিনা, তা আমাদের নিজেদেরকেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে হবে। সেটা যদি পাশের বাড়ি থেকে কাউকে এসে বলে যেতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হয় আমার বাড়িতে আয়না নেই, নয় আমার চোখ নেই, নাহলে আমার বুদ্ধি নেই।

More Articles