ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ মোকাবিলায় কতটা তৈরি নবান্ন? যে যে প্রস্তুতির কথা শোনালেন মুখ্যমন্ত্রী
Cyclone Dana: সামনেই কালীপুজো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ডানা-র চোখরাঙানিতে কি শেষপর্যন্ত পণ্ড হতে চলেছে বাঙালির দীপাবলির উৎসব।
চলতি বছরের মাঝামাঝি রাজ্য জুড়ে ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। লোকসভা ভোটের বাজারে তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল ভালো মতোই। তবে তেমন দাপট না দেখিয়েই বাংলাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল রেমাল। তার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের লাল চোখ নিয়ে হাজির নতুন ঘূর্ণিঝড় ডানা বা দানা। নতুন এই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেছে কাতার। আবহাওয়া দফতর জানিয়ে দিয়েছিল, বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর সেই আশঙ্কা ক্রমশ সত্যি হওয়ার পথে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে কোমর বেঁধেছে প্রশাসনও।
মৌসম ভবন জানিয়েছিল, মঙ্গলবার অর্থাৎ ২২ তারিখই নিম্নচাপে পরিণত হবে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণাবর্তটি। ২৩ অক্টোবর, বুধবার ঘুর্ণিঝড়ে ঘনীভূত হতে পারে নিম্নচাপ। ২৪ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে এগোবে সেটি। সমুদ্রে ১৩৫কিমি/ঘণ্টায় হাওয়া বইবে। ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে, ওড়িশা ও দক্ষিণবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরে তার সর্বাধিক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা। হতে পারে একাধিক জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি। সেই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে আগামী ২৩ থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত রাজ্যের ন’টি জেলার সব স্কুলে ছুটি থাকবে, ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বুধবার থেকেই সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় সতর্কতা জারি করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: আয়লার মতোই দাপট দেখাবে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’? কারা দিল এমন নাম?
হাওয়া অফিস অনুমান করছে, বুধবার রাত এবং বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে ওড়িশার পুরী এবং এই রাজ্যের সাগরদ্বীপের মধ্যবর্তী কোনও অংশ দিয়ে স্থলভাগে ঢুকতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’। সেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলার উপর পড়তে পারে। বাংলার দুই ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে বেশি প্রভাব পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন আবহবিদেরা। এ ছাড়াও, এই তিন জেলার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে প্রভাব পড়তে পারে। এই ন’টি জেলাতে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ২৪ অক্টোবর রাত থেকে ২৫ অক্টোবর সকালের মধ্যে পুরী এবং সাগরদ্বীপের মাঝে ল্যান্ডফল হতে পারে। সেই সময় ঝড়ের গতি ১০০ থেকে ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় থাকতে পারে। কোথাও কোথাও ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার গতিবেগ দেখা যেতে পারে।মমতা বলেন, ‘‘দুর্যোগ মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই ইন্ট্রিগ্রেটেড কন্ট্রোলরুম চালু করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা সেই কন্ট্রোল রুম খোলা থাকছে। বুধবার থেকেই মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। মাইকিং চলছে সর্বত্র।’’
সামনেই কালীপুজো। শহরের বহু জায়গাতেই বড় করে কালীপুজোর আয়োজন করা হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ডানা-র চোখরাঙানিতে কি শেষপর্যন্ত পণ্ড হতে চলেছে বাঙালির দীপাবলির উৎসব। তেমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারছে না প্রশাসন। সোমবার কলকাতা পুরসভায় ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ নিয়ে জরুরি বৈঠক সেরেছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। নিকাশি দপ্তরের সমস্ত আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংও। মঙ্গলবার ফের একবার কলকাতার ষোলোটি বরোর সঙ্গে বৈঠকে বসন মেয়র পারিষদ। দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে সবে। শহর শুরু হয়েছে কালীপুজোর প্রস্তুতি। এখনও শহরের একাধিক জায়গায় পুজোর প্যান্ডেল খোলা হয়নি। রয়েছে বিজ্ঞাপনের ব্যানার। এই অবস্থায় ডানা-তাণ্ডবে শহরের ক্ষয়ক্ষতি আটকাতে আগেভাগেই কোমর বাঁধছে পুর-প্রশাসন।
দুর্ঘটনা ঠেকাতে একাধিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কলকাতা পুরসভার তরফে। ঝড়ের জন্য কলকাতা পুরসভা কন্ট্রোল রুম খুলেছে। কন্ট্রোল রুমের নম্বর (০৩৩) ২২৮৬-১২১২ এবং (০৩৩) ২২৮৬-১৩১৩। এখনও শহরের একাধিক জায়গায় প্যান্ডেলের বাঁশের কাঠামো খোলা হয়নি। দ্রুত তা খোলার নির্দেশ দিয়েছে পুরসভার আধিকারিকরা। আধিকারিকরা জানিয়েছেন, কলকাতায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে গেলে এই ধরনের বাঁশের কাঠামো পড়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। নজর দেওয়া হচ্ছে শহরের একাধিক বড় হোর্ডিংয়ের দিকেও। শহরের সমস্ত ব্যানার, হোর্ডিং খতিয়ে দেখছেন কলকাতা পুরসভার কর্মীরা। জোরে হাওয়া বইলে খুলতে পড়তে পারে, এমন হোর্ডিং সরিয়ে ফেলা হবে মঙ্গলবারের মধ্যেই।
নির্দেশ গিয়েছে বিল্ডিং বিভাগেও। শহরাঞ্চলের নিচু এলাকায় বস্তিতে থাকেন, এমন বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা। বিপজ্জনক বাড়িগুলি থেকেও বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে কলকাতা পুরসভা। শহরে তৈরি হয়েছে ডিজাস্টার রেসপন্স টিম। সেখানে কলকাতা পুরসভার বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মী ছাড়াও থাকবেন এনডিআরএফ বা ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স আর স্টেট এমার্জেন্সি রেসপন্স টিম।
শহরের পাশাপাশি জেলাগুলিতে দুর্যোগ মোকাবিলায় আগে যে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ বারও সেই সব ব্যবস্থা থাকছে। উপকূলবর্তী নিচু এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। মোতায়েন করা হয়েছে রাজ্য এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। বন্ধ থাকবে ফেরি চলাচল। দুর্যোগের আশঙ্কা কাটার পরই আবার ফেরি চলাচল শুরু হবে বলে জানান মমতা। পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করারও নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আগেভাগেই জেলাগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণের ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
দুর্যোগ পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দফতরের সচিবদের। কোন জেলায়, কাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা-ও জানান মুখ্যমন্ত্রী। দক্ষিণ ২৪ পরগনার দায়িত্বে মণীশ জৈন, উত্তর ২৪ পরগনার দায়িত্বে রাজেশকুমার সিংহ, হাওড়ায় রাজেশ পাণ্ডে, পশ্চিম মেদিনীপুরের সুরিন্দর গুপ্ত, হুগলিতে ওমপ্রকাশ সিংহ মিনা, পূর্ব মেদিনীপুরে পারভেজ আহমেদ সিদ্দিকি, ঝাড়গ্রামে সৌমিত্র মোহন এবং বাঁকুড়ার দায়িত্বে অবনীন্দ্র শীল। ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ ডানার মূল অভিমুখ হওয়ায় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে সৈকত শহর দীঘাতে। রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল নিয়ে তাই আগেভাগেই সতর্ক নবান্ন। সূত্রের খবর, হোটেল সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত পর্যটকদের উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার চিন্তাভাবনা করছে প্রশাসন। সমস্ত দিক থেকে ঘূর্ণিঝড় ডানার মোকাবিলায় তৈরি হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনও। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপকূলবর্তী এলাকায় সমস্ত বিডিও ও এসডিওদের সতর্ক করা হয়েছে বৈঠক ইতিমধ্যে। পাশাপাশি সাবধান করে দেওয়া হয়েছে ২৫টি ব্লককেই। আয়লা সেন্টার-সহ সমস্ত জায়গায় মজুত করা হয়েছে ত্রাণ সামগ্রী। নজরদারি করা হবে উপকূলবর্তী এলাকায় বাঁধগুলিতে। সমুদ্রে পর্যটকদের বিচরণ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তৎপর সিভিল ডিফেন্স, নুলিয়া এবং ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিমও। দিঘা উন্নয়ন পর্ষদের পক্ষ থেকেও সতর্ক করা হচ্ছে পর্যটকদের।
আবহাওয়া দফতর সূত্রে এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, সোমবারের নিম্নচাপ মঙ্গলবার গভীর নিম্নচাপ রূপে পূর্ব ও মধ্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। যা সাগর থেকে ৭৫০ কিমি দূরে রয়েছে বলে জানাচ্ছে হাওয়া অফিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তর পশ্চিম দিকে এগোনোর সম্ভাবনা। বুধবার সকালে তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। আগামী ২৪ তারিখ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার রাত থেকে ২৫ তারিখ তথা শুক্রবার সকালের মধ্যে তা পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা উপকূলের স্থলভাগে প্রবেশ করবে। সে সময় তার গতিবেগ থাকবে প্রতি ঘণ্টায় ১০০-১১০ কিলোমিটারের মধ্যে। ২৩ তারিখ সন্ধে থেকেই ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি শুরু হবে উপকূলের জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরে। ২৪ তারিখ দুই ২৪ পরগনা,হাওড়া, হুগলি,দুই মেদিনীপুর কলকাতা, ঝাড়গ্রামে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা। ২৫ তারিখ কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়াতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ২৬ তারিখের দিকে এসে দু-এক জায়গায় কমতে পারে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ।
বঙ্গোপসাগরের একটি অংশ এখন থেকেই উত্তাল হতে শুরু করেছে। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার থেকেই পূর্ব ও মধ্য বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। বৃহস্পতিবার সমুদ্র আরও উত্তাল হবে। বাংলা এবং ওড়িশা উপকূলের কাছাকাছি বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সমুদ্র উত্তাল থাকবে। মেয়র পারিষদ তারক সিং এদিন জানিয়েছেন, জোয়ারের কারণে দিনে দুবার লকগেট বন্ধ থাকে। সে সময় অতিভারী বৃষ্টি হলে জল জমবেই। তবে দ্রুত সেই জল নেমে যাবে।
আরও পড়ুন: ডানা আসছে! কবে কোন জেলায় চলবে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব?
ডানার আতঙ্কে কোমর বেঁধেছে ওড়িশা প্রশাসনও। মৎসজীবীদের সমুদ্রে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারির সঙ্গেই, পর্যটকদের সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। যাঁরা আগেই গিয়েছেন পুরী ভ্রমণে, তাঁদের বুধবারের মধ্যে ফিরে যাওয়ার নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বৃহস্পতি-শুক্রবার সমুদ্রে সৈকতে যাওয়ার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ওড়িশার উপ-মুখ্যমন্ত্রী কনক বর্ধন সিং দেও জানিয়েছেন, রাজ্যের একাধিক বিভাগকে উচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং অন্যান্যদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করেছে। বাতিল করা হয়েছে নির্দিষ্ট বিভাগের কর্মীদের ছুটি। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ২৩ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ওড়িশার ১৪ জেলার স্কুল ছুটি দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগের আবহে পুরী সফর বাতিল করেছেন দেশের রাষ্ট্রপতি।
পুজোর আগেই বেশি বৃষ্টিপাত ও ঝাড়খণ্ড থেকে ডিভিসির ছাড়া জলের কারণে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের একাধিক এলাকায়। দুর্গাপুজোর পর এবার কালীপুজোর মুখেও লাল চোখ নিয়ে হাজির ঘূর্ণিঝড় ডানা। অনেকেই মনে করছে আয়লা বা আমফানের থেকেও শক্তিশালী হতে চলেছে এই ডানা। শেষপর্যন্ত কী রয়েছে বাংলার কপালে? ওড়িশাতেই বা কী খেল দেখাবে ডানা? আতঙ্কে কাঁপছে দুই রাজ্যই।