দলিত নির্যাতন: প্রেমিকের 'সাহসী' সিদ্ধান্ত, যে ভাবে মাশুল দিল প্রেমিকের বোন

Dalits Woman Stripped: আঠাশ বছরের মেয়েটির বুকে বসে তাঁর ঘাড়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে অভিযুক্ত। এর পর টানতে টানতে পাঁচশো মিটার দূরে তাঁদের বাড়িতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় দলিত মা-মেয়েকে।

বাজারে খুঁজলে এমন অনেক খেলনা মিলবে, যাদের মেরে ধরে নিংড়ে পিটিয়ে আপনি আপনার রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন সহজেই। 'অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট টয়' নামে বাজারে পরিচিত সেসব খেলনা। তবে শুধু অনলাইন স্টোরে বা বাজারের খেলনার দোকানে নয়, এমন 'অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট টয়' আমাদের সমাজেও ছড়িয়ে রয়েছে দেদার। নিজেদের প্রয়োজন মতো যাদের পিটিয়ে দেওয়া যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন করা যায়। তাতে তেমন দোষের দোষ কিছু হয় না। কাঠগড়া কি আর জানে না দুর্বল, গরিব আর দলিতে তেমন দোষ নাই। তাই হাতে তুলে নাও লাঠিসোঁটা, নিজের রাগ ফুটিয়ে তোলো কোনও দুর্বল, কোনও দলিতের শরীরে। দেখবে কেমন ফুরফুরে লাগছে! আর এমনটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান থেকে উত্তরপ্রদেশ, এমন দলিত নিগ্রহের মতো এমন 'ছোটো' ঘটনা আখছার ঘটে এ ভূখণ্ডে। আর তেমন 'ছোট' ঘটনাই এবার আরও একবার ঘটল অন্ধ্রপ্রদেশে।

আরও পড়ুন: “দলিত এখন একটা ফ্যাশন”! আম্বেদকরের আর প্রয়োজন কোথায়?

উচ্চবর্ণের মেয়ের সঙ্গে দলিত যুবকের প্রেম। ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে। এর পরেই মার্চ মাসে ছেলেটি পালিয়ে গিয়েছিল এলাকারই ওই মেয়েটির সঙ্গে। ছেলেটি তাঁদের মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে এমন অভিযোগ করে ছেলেটির পরিবারের উপরে গিয়ে চড়াও হলেন মেয়ের পরিবার। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রকাশম জেলার ঘটনা। ২৮ বছরের ওই দলিত তরুণীর উপরে ছুরি নিয়ে হামলা করেন পরিবারটি। নগ্ন করে চলে অত্যাচার। এখানেই শেষ নয়। মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারারও চক্রান্ত এঁটেছিল পরিবারটি। শুধু বোনই নয়, যুবকের মায়ের উপরেও চলে অত্যাচার। কোনও মতে হাত ফস্কে পালিয়ে তিনি পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ যতক্ষণে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয়, ততক্ষণে মেয়েটির গায়ে কেরোসিন ঢালা হয়ে গিয়েছে। আগুনে পুড়িয়ে মারার সব প্রস্তুতি সারা। ঠিক সময়ে পুলিশ এসে পৌঁছনোয় প্রাণে বেঁচে যান তরুণী।

পেশায় একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্স ওই তরুণী। দিন কয়েক আগে বাড়ির সামনে মিউনিসিপ্যালিটির জলের কল থেকে বাড়ির জন্য জল ভরছিলেন তিনি ও তাঁর মা। সে সময় হঠাৎ করেই তাঁদের চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ছেটায় অভিযুক্ত পরিবারটি। শুরু হয় মারধর। আঠাশ বছরের মেয়েটির বুকে বসে তাঁর ঘাড়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে ব্রহ্মা রেড্ডি নামে এক অভিযুক্ত। এর পর টানতে টানতে পাঁচশো মিটার দূরে তাঁদের বাড়িতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় দলিত মা-মেয়েকে। তরুণীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারা শরীরে কেরোসিন ঢেলে জিজ্ঞেস করা হয় তাঁদের মেয়ের খোঁজ। উত্তর দিতে না পারায় চলে অত্যাচার, মারধর।

ঘটনায় গাঙ্গিরেড্ডি ব্রহ্মা রেড্ডি নামে ৫২ বছরের এক ব্যক্তি ও তাঁর স্ত্রী ৪৮ বছরের পুলাম্মাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আদালতে তোলা হলে তাদের দু সপ্তাহের বিচারবিভাগীয় হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। খুনের চেষ্টা-সহ একাধিক ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছেন, স্থানীয় যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরেই ডারসি থানায় গিয়ে মেয়ের নিখোঁজ ডায়েরি লিখিয়েছিলেন ওই দম্পতি। তার কিছুক্ষণ পরে মেয়ে থানায় এসে নিরাপত্তা চেয়ে জানান, তিনি স্বামীর সঙ্গেই থাকতে চান। আর সেই ক্ষোভ থেকেই ছেলেটির বাড়ির উপর চড়াও হয় পরিবারটি।

আরও পড়ুন:মন্দিরে ঢোকায় চ্যালাকাঠ দিয়ে ছ্যাঁকা! ‘দেবভূমি’তে কেন বারেবারে নির্যাতিত দলিতরা?

তবে এই সব প্রেম, সম্পর্কের অশান্তি, সমীকরণের নেপথ্যে যেটা কাজ করেছে, সেটা আদতে দলিত-ইস্যু। এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেই রাজস্থানে এক শিক্ষকের মারে মৃত্যু হয়েছিল এক বছর আটেকের দলিত পড়ুয়ার। কী তার অপরাধ? না সে উচ্চবর্ণের জন্য রাখা জলের কলসি থেকে ভুল করে একটু জল খেয়ে ফেলেছিল। আর সেই কারণেই ছেলেটিকে বেদম পেটান ওই শিক্ষক। কয়েকদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝে মারা যায় ছেলেটি। প্রায়শই খবর মেলে, দলিত হওয়ার অপরাধে অ্যাম্বুল্যান্স মেলেনি। বাবার কাঁধে চেপে শ্মশানে পৌঁছেছে মেয়ের মৃতদেহ। সেখানেও শান্তি নেই। উচ্চবর্ণের শ্মশানে দলিতদের সৎকারকাজ কীভাবে সম্ভব! তাই সেখান থেকেও দুঃছাই, 'হঠ হঠ'। এসব ঘটে। ঘটতেই থাকে। ভোট এলে নেতামন্ত্রীদের মনে পড়ে দলিত-ভোটের কথা। তখন মঞ্চে ডেকে ক্যামেরার সামনে তাঁদের পা ধুইয়ে দেন গদিতে থাকা কর্তাব্যক্তিটি। কিংবা দলিতের বাড়িতে গিয়ে পাত পেড়ে বসেন মন্ত্রী। ছবি ওঠে। তার পর ভোট গেলেই মলাট ছেড়ে বেরিয়ে আসে আসল অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান। দলিত মার খায়, দলিত মরে। আরও পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ে সরকারের। সংবিধান লুটোপুটি খায়। ক্যালেন্ডারে দোলেন অম্বেদকর। দুলতেই থাকেন...

More Articles