যৌনহেনস্থার প্রতিবাদ 'অপরাধ'! মধ্যপ্রদেশে দলিত নির্যাতিতার ভাইকে পিটিয়ে খুন, নগ্ন করে মার মাকেও
Madhya Pradesh Dalit Murder Case: বারবার মামলা তোলার জন্য চাপ আসলেও নতিস্বীকার করেননি তরুণী। আর এর পরেই তাঁর পরিবারের উপর চড়াও হয় একদল লোক। বেধড়ক মারা হয় তাঁর ভাইকে।
নিজের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল মেয়েটি। যৌনহেনস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে বসেছিল থানায়। কিন্তু সে যে দলিত। ফলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলার হিম্মত না থাকাটাই তাঁর সমীচিন। কিন্তু এই মেয়ে সেই 'সমীচিন'-এর পথে চলেনি। বরং ২০১৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে লিখিয়ে এসেছিল এফআইআর।
তবে তার মাশুল যে এভাবে দিতে হতে পারে, তা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি মেয়েটি। ২০১৯ সালে করা তাঁর অভিযোগের জেরে ২০২৩ সালে এসে পিটিয়ে মারা হল তাঁর ভাইকে। ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করায় মাকে নগ্ন করে ঘোরানো হল জনসমক্ষে। ভেঙে দেওয়া হল হাত। মারধরের হাত থেকে যে বাঁচেনি সে-ও, তা তো বলাই বাহুল্য। এমনই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলায়।
আরও পড়ুন: দলিত নির্যাতন: প্রেমিকের ‘সাহসী’ সিদ্ধান্ত, যে ভাবে মাশুল দিল প্রেমিকের বোন
দলিত নিগ্রহের ঘটনা অম্বেদকরের দেশে কোনও নতুন বিষয় নয়। প্রায়শই দলিতকে মার, দলিতকে খুন, দলিতকে ধর্ষণ- এসব শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে কান। সেই দলিত নিগ্রহের অন্তহীন তালিকায় ঢুকে পড়ল আরও একটা ঘটনা। গণপিটুনি দিয়ে খুনের ঘটনায় ৯ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তফসিলি জাতি-উপজাতি আইনের আওতায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে আরও তিন জনের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যেই আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সঞ্জীব উইকি।

বহু দিন ধরেই নাকি যৌনহেনস্থার অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য ১৮ বছরের ওই তরুণীটির চাপ দেওয়া হচ্ছিল। চার বছর আগে যখন তাঁকে যৌনহেনস্থা করা হয়, তখন তিনি নাবালিকা। সে সময় চার জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। গ্রেপ্তারও হয় তারা। ওই মামলাটি এখনও বিচারাধীন। তবে এর পর থেকেই বারবার মামলা তোলার জন্য চাপ আসতে থাকে। তবে নতিস্বীকার করেননি তরুণী। আর এর পরেই তাঁর পরিবারের উপর চড়াও হয় একদল লোক। বেধড়ক মারা হয় তাঁর ভাইকে। মারা হয়ে তরুণীকেও। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁর মাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হয় জনসমক্ষে। পুলিশ এসে শেষপর্যন্ত একটা তোয়ালে দিয়ে তাঁর সম্ভ্রম রক্ষা করেন। ততক্ষণ পর্যন্ত নগ্ন অবস্থায় ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল ওই মহিলাকে। ঘরদোর ভাঙচুর করা হয় এমন ভাবে, যে তার ঘরের কোনও কিছুই আস্ত নেই। ভেঙে ফেলা হয়েছে ছাদও। কাঁদতে কাঁদতে বলেন মহিলা।

একটি ছেলেকে গণপিটুনি দিয়ে মারার পরও আশ মেটেনি জনতার। এর পরে মহিলার অন্য দুই ছেলের খোঁজে আরেকটি বাড়িতে হানা দেয় দলটি। এমনকী নিগ্রীহিতার কাকিমার বাড়িতে ঢুকে পড়ে তারা। তাঁর স্বামী-সন্তানকে হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। এমনকী ফ্রিজের ভিতরও উঁকি দিয়ে দেখেছে তারা। খবর পেয়েই গ্রামে পৌঁছয় পুলিশ। পরিস্থিতি সামলানো গেলেও এখনও উত্তপ্ত গ্রামের পরিস্থিতি। এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিরাট পুলিশ বাহিনী। ময়নাতদন্তের পরে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় ওই যুবকের দেহ। তবে তা নিতে প্রাথমিক ভাবে অস্বীকার করেছিল পরিবার। পরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের তরফে আশ্বাস মেলার পরেই ওই যুবকের শেষকৃত্য করতে রাজি হয় পরিবার। পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের আওতায় সুবিধা দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছে জেলা প্রশাসক।

দোরগোরায় মধ্যপ্রদেশের ভোট। এই পরিস্থিতিতে এমন ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলেও। স্বাভাবিক ভাবেই দলিত নিগ্রহের বিষয়টি ধরেই মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারকে চাপে রাখতে চাইছে বিরোধী দল কংগ্রেস ও মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টি। বিজেপির অবশ্য দাবি, যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আজ থেকে নয়, মধ্যপ্রদেশে দলিত ও উপজাতি নিগ্রহ অনেকদিন ধরে চলে আসছে। আর তা দিন কে দিন আরও ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যাচ্ছে বলে তোপ দেগেছেন কংগ্রেস প্রধান মল্লিকার্জুন খাড়্গে। তাঁর অভিযোগ, বিজেপি মধ্যপ্রদেশকে দলিত অত্যাচারের পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত করেছে বিজেপি। এ রাজ্যেই দলিত নিগ্রহের মতো অপরাধ সবচেয়ে বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য় আর্থিক সাহায্যের দাবি তুলেছেন রাজ্যের কংগ্রেস প্রধান কমলনাথ।
আরও পড়ুন: হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
তবে শুধু মধ্যপ্রদেশই নয়। গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে দলিত, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার বেড়েছে, তার দায় অনেকেই চাপিয়েছেন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। যেভাবে জাতি, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ জুড়ে বিভাজন ও বিদ্বেষবিষ ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে দেশ জুড়ে, তা সভ্যতার সঙ্কট বলেই মনে করছে ওয়াকিমবহাল মহল। দুদিন আগেই উত্তরপ্রদেশে এক মুসলিম পড়ুয়াকে মারধর করার নির্দেশ দেন এক শিক্ষিকা। সেই নির্দেশ দেওয়া হয় হিন্দু পড়ুয়াদের। রীতিমতো ভিডিও করে ওই দাবি জানিয়েছিলেন শিক্ষিকা। ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল দেশ। শোরগোল পড়ে যায় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনেও। তবে এই সব একটা দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সার্বিক ভাবেই বিপন্ন ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতিভেদ, ধর্মভেদের উপরে উঠে যে সংবিধান রচনা করেছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বি আর অম্বেদকর, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তার অস্তিত্বের সংকট ধরা পড়ছে খালি চোখেই। আর তা আদতে দেশকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আরও পিছনে।

Whatsapp
