স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু রহস্য!?

মহাপুরুষ, মুনি, ঋষিদের মৃত্যু হয় না। তাঁদের মহাপ্রয়ান ঘটে, তাঁরা দেহ রাখেন। পৃথিবীতে যে নির্দিষ্ট কাজের জন্য তাঁদের আগমন, সেই কার্য্যিসিদ্ধির পরেই তাঁদের আত্মা দেহত্যাগ করে। আমরা যারা খুব সাধারণ মানুষ তারা মহাপুরুষদের মৃত্যু নিয়ে খুবই কৌতূহল বোধ করি। কীভাবে হয় মহাপুরুষদের মৃত্যু? আমাদেরই মতো সাধারণ ভাবে, যন্ত্রণা পেতে পেতে হঠাৎ দম ত্যাগ করেন তাঁরা নাকি কোনও দিব্যজ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটে তাঁদের মহাপ্রয়ান কালে? 

৪ঠা জুলাই ১৯০২ সালে মৃত্যু হয় স্বামী বিবেকানন্দের। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। কেন এত অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন তিঁনি? তাঁর কি কঠিন কোনও দুরারোগ্য ছিল? নাকি তিঁনি তাঁর ইচ্ছায় এই ধরাধামকে বিদায় জানান? 

৪ঠা জুলাই, ১৯০২ সাল। দিনটা ছিল শুক্রবার। আর পাঁচদিনের মতো একটা স্বাভাবিক দিন ছিলো সে'দিনটাও। স্বামীজি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে, বেলুর মঠে নিজের ধ্যানকক্ষে ধ্যানমগ্ন হয়েছেন। স্বামীজির তখন শান্ত রূপ। তাঁর ধ্যানপর্ব শেষ হলে তিঁনি শুরু করলেন গান। তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানেন, ভীষণ ভাল গানের গলা ছিল স্বামীজির।  শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবও তাঁর গান শুনে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়তেন। গানের আসর জমেছিল বেশ সেদিন। এদিকে সকালে বেলুড়ের ঘাটে জেলেদের নৌকা ভিড়েছিল। প্রচুর ইলিশ উঠেছিল। অনেকেই জানেন না স্বামীজি ছিলেন বেজায় খাদ্যরসিক। ইলিশের খবর তাঁর কান অবধি পৌঁছালে তিঁনি নির্দেশ দেন ইলিশ কিনে এনে দুপুরে জমিয়ে রান্না করার। ইলিশের ঝাল-ঝোল-অম্বলের মতো পদ দিয়ে সেদিন দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন স্বামীজি। দুপুরের খাওয়ারের পর বিশ্রাম নেওয়ার মানুষ তিনি নন। সে'দিনও নেননি। সোজা লাইব্রেরিতে ঢুকে যান, তারপর সঙ্গী প্রেমানন্দকে নিয়ে বেড়িয়ে আসেন বেলুড় বাজার পর্যন্ত। মঠে ফিরে সন্ধ্যা সাতটার আরতির পর ফের ধ্যানের ঘরে ঢুকে যান তিনি। কিছুক্ষণ পর স্বামীজির ঘর থেকে সাড়া এল, গরম লাগছিল তাঁর। জানলা খুলে দেওয়া হল। তাঁর সঙ্গী ব্রজেন্দ্র, স্বামীজির পা টিপে দিতে শুরু করলেন– তখনও কেউ জানতেন না স্বামীজির মহাক্ষণের আর বেশি দেরি ছিল না। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা এগিয়ে রাত হতেই সব কিছু বদলে যেতে শুরু করল। স্বামীজির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে শুরু করলো, ভিজে গেল তাঁর সর্বাঙ্গ, হাত পাখা দিয়ে তাঁর শিষ্যরা তাঁকে অবিরাম বাতাস দিতে লাগলেন, তারপর হঠাৎই স্বামীজির ভিতর থেকে কান্নার রোলের মতো আওয়াজ বেরিয়ে এলো, সঙ্গে জোরে জোরে শ্বাস পড়ছিল তাঁর; অথচ মুখে কোনও কথা নেই তাঁর।

রাত তখন ৯টা ১০, বালিশ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল তাঁর মাথা, দেহ স্তব্ধ; মুখে ঠোঁটে লেগে আছে হালকা হাসির রেশ। সন্ন্যাসী গুরুভাইরা মনে করলেন, ভাবসমাধি হয়েছে হয়তো তাঁর। কেউ তখনও ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে তাদের মাঝে আর স্বামীজি নেই বেশিক্ষণ। চলল শ্রীরামকৃষ্ণের নাম গান। আরও কিছুক্ষণ স্বামীজির কোনও সাড়া না মেলায় বেলুড় থেকে ডাক পাঠানো হলো ডাক্তার মহেন্দ্র মজুমদার এবং বৈকুন্ঠনাথ সান্যালকে। কিন্তু ডাক্তারের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দেহ রাখলেন ভুবনেশ্বরী দেবীর ভুবনজয়ী পুত্র। চলে গেলেন স্বামী বিবেকানন্দ। রাতটুকু কাটতেই সকাল থেকে মঠে ভিড়। খুব ভোরের দিকে চলে এলেন স্বামীজির মানসকন্যা সবথেকে প্রিয় এবং কাছের শিষ্যা সিস্টার ভগিনী নিবেদিতা। তাঁর গুরুর মৃত্যু তাঁর কাছে ছিল পৃথিবীর শেষতম দিনের মতো। তিঁনি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারেননি স্বামীজির এই এত অল্পবয়সে মহাপ্রস্থান। স্বামীজির মাথার কাছে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলেন তিঁনি। ইতিমধ্যেই খবর পাঠানো হলো স্বামীজির মা’কে। দ্রুত চলে এলেন স্বামীজির ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং স্বামীজির ভগ্নীপতি। কিছুক্ষণ পরেই এলেন ভুবনেশ্বরী দেবী সঙ্গে নাতি ব্রজমোহন ঘোষ। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ এলেন একটু পরের দিকে। 

এরপর বেলা চারটে নাগাদ মঠেই গঙ্গার ধারে দাহ করা হয় স্বামীজিকে। তাঁকে যেখানে দাহ করা হয়, ১৬ বছর আগে গঙ্গার ঠিক বিপরীত দিকে দাহ করা হয়েছিল তাঁর গুরু শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণকে। স্বামীজির শেষকৃত্যের সময় শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন নিবেদিতা। শেষকৃত্যের ঠিক আগেই তিনি একটি রুমালে গুরুর পায়ের ছাপ নিয়ে নেন। চন্দনকাঠের চিতায় স্বামীজির নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিঁনি। চিতাতে অগ্নি সমর্পণের পর নিবেদিতা নিজে স্বামীজির চিতার চারদিকে গোলগোল ঘুরতে থাকেন। গাউনে আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্রহ্মানন্দের নির্দেশে এক সন্ন্যাসী তাঁকে ধরে অন্যত্র বসান। সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ দাহকাজ সম্পন্ন হয়।

প্রখ্যাত লেখক শঙ্করের স্বামীজির আত্মজীবনী ‘দ্য মঙ্ক অ্যাজ ম্যান’ বইতে স্বামীজির স্বাস্থ্য নিয়ে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন অনিদ্রা, যকৃৎ ও কিডনির সমস্যা, মাইগ্রেন, ডায়বেটিস, হৃদরোগের মতো কমপক্ষে ৩১টি ব্যাধি ছিল স্বামীজির। দীর্ঘসময় ধরে তিঁনি এতগুলো রোগ নিয়ে জর্জরিত ছিলেন। শেষের দিকে তাঁর শরীর অধিকাংশ সময়ই খুবই খারাপ থাকতো। তাঁর শিষ্যদের মতে স্বামীজির নিজেও জানতেন তিঁনি মৃত্যুবরণ করতে চলেছেন। তিঁনি শিষ্যদের বলতেন ও যে তিনি ৪০এ পড়ার আগেই এই ধরাধামের মোহমায়া ত্যাগ করবেন। ৩৯ বছর, ৫মাস, ২৫ দিন বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। প্রসঙ্গত  মৃত্যুর ঠিক দু'দিন আগে অর্থাৎ ২রা জুলাই, ১৯০২ সালে তিঁনি তাঁর পরমশিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাকে মঠে নিমন্ত্রণ জানান। পঞ্চব্যঞ্জন এবং নানান পদ দিয়ে নিবেদিতাকে খাওয়ান। নিবেদিতার আপ্যায়ন করেন নিজের গুরুর মতো করেই। এবং খাওয়ার শেষে তিঁনি নিজে জগ থেকে জল ঢেলে নিবেদিতার হাত পা ধুইয়ে দেন। নিবেদিতা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেন, এ আপনি কী করছেন গুরুদেব, এ তো আমার করার কথা। আপনি আমার গুরুদেব, আমি আপনার শিষ্যা। 
স্বামীজি উত্তরে বলেন, কেন যীশুখ্রিস্টও তো তাঁর শিষ্যদের হাত পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। 
উত্তরে নিবেদিতা বলেন, কিন্তু সে তো তাঁর মৃত্যুর আগে। 

এরপর স্বামীজি হেসে ওঠেন আর বলেন, 'Silly Girl'

এই ঘটনার ঠিক দু'দিন পরেই স্বামীজির মৃত্যু হলে ভগিনী নিবেদিতা বুঝতে পারেন যে স্বামীজি আগে থেকেই জানতেন তাঁর মৃত্যুর কথা। ১৮৯৮ সালে শৈবতীর্থ অমরনাথে গিয়ে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন স্বামীজি। সেখানেও তাঁর সঙ্গী ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। স্বামীজির গুরু শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব বলতেন, ‘নরেন যবে বুঝতে পারবে তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তখন সে নিজেই চলে যাবে।’ 

প্রশ্ন জাগে মনে, স্বামীজি নিজের মৃত্যুদিন কি তবে নিজে নিজেই নির্ধারিত করেছিলেন? তিনি কি চাইলেই আমাদের মাঝে থেকে যেতে পারতেন আরও কিছুটা সময়? 

More Articles