ধামাচাপা দেওয়া হলো মৃত্যুর সংবাদ! কাদম্বরীর মৃত্যুতে লুকিয়ে কোন রহস্য?

চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর একান্ন বছর বয়সে বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু সম্পর্কে লিখতে গিয়ে উপরোক্ত কথাগুলি লিখেছিলেন 'জীবনস্মৃতি'-তে।প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনই বারংবার ছন্নছাড়া হয়ে উঠেছিল প্রিয়জনদের মৃত্যুশোকে।কিন্তু যুবক বয়সে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু রবিমনে যে ভাবে রেখাপাত করে যায় তা হয়তো অন্য কোন ক্ষেত্রে চোখে পড়ে না।কাদম্বরী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। কাদম্বরীর বয়স যখন মাত্র নয় তখনই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় দশ বছরের। এ প্রসঙ্গে ঠাকুরবাড়ির একটি ধারার কথা বলা চলে - সেই সময় ঠাকুরবাড়ির মতো নামজাদা পরিবারের ঘরনী হতেন তুলনায় অখ্যাত পরিবারের মেয়েরা। এমনকী বিয়ের পর তাদের নামও পালটে ফেলা হতো।এমন অদ্ভুত নিয়মের প্রকৃত কারণ কি তা জানা যায় না,তবে অনেকে মনে করেন ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা ছিলেন পিরালী গোত্রের বামুন, যারা তৎকালীন সময়েও ছিলেন বেশ গোঁড়া। ফলে আত্মীয়তার ক্ষেত্রে তাঁরা অন্যান্য পিরালী গোষ্ঠীর মানুষদেরই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতেন।

অন্য দিকে পিরালী গোষ্ঠীর মানুষ তখন ছিল হাতেগোনা,এজন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে ঠাকুরবাড়ির অধস্থন কর্মচারীদের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা। কাদম্বরীও ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে। যদিও এই বিয়ে নিয়েও তুমুল মতবিরোধ হয় ঠাকুর পরিবারের মধ্যেই।বিশেষত সত্যেন্দ্রনাথ কোনোভাবেই অধস্তন কর্মচারীর মেয়ের সঙ্গে জ্যোতির বিয়ে মেনে নিতে পারেননি।পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় মানভঞ্জন হয় সকল পক্ষের। বিয়ের আগে কাদম্বরীর নাম ছিল মাতঙ্গিনী। ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী বিয়ের পর তার নাম পাল্টে রাখা হল কাদম্বরী।

আরও পড়ুন- স্টেশন মাস্টার থেকে শৌচাগারের রক্ষণাবেক্ষণ, রাজ্যের প্রথম মহিলা পরিচালিত স্টেশনের খোঁজ

ঠাকুরবাড়িতে এসে মাতঙ্গিনী তথা কাদম্বরী ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে।অনদ্যিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন হয়ে উঠেছেন কলকাতার বাবু। তাঁর ইচ্ছেয় ঘোড়ায় চাপা শিখলেন কাদম্বরী।কলকাতার কোনো বাড়ির বউ ঘোড়ায় চাপার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে,কলকাতার রক্ষনশীল সমাজের কাছে তখন তা ছিল ভাবনার বাইরে।তবে এখানেই শেষ নয় কাদম্বরীর কীর্তি।কাদম্বরী ছিলেন প্রকৃতঅর্থে ' বইপোকা।' বিহারীলালের লেখার ভক্ত ছিলেন তিনি, বইয়ের মধ্যেই কেটে যেত দিনের বেশিরভাগ সময় তাছাড়াও তার ছিল বাগান তৈরির ইচ্ছে।নিজের হাতে তৈরি বাগানে নিত্যদিন গানবাজনার আসর জমাতেন রবির বৌঠান যে আসরে উপস্থিত থাকতেন রবীন্দ্রনাথও। এমনকী কাদম্বরী ছিলেন সুঅভিনেত্রী। ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠিত একের পর এক নাটকে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেন তিনি।রবীন্দ্রনাথ বিরচিত ' ছেলেবেলা ' বইটিতে বারংবার ফিরে ফিরে এসেছে বৌঠানের কথা।রবীন্দ্রনাথের লেখার সবথেকে বড় বিচারক ছিলেন কাদম্বরী, রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন সে কথা। বিহারীলালের সঙ্গে তুলনা টেনে কাদম্বরী কিভাবে নির্ভেজাল মজা করতেন যুবক রবির সঙ্গে ' ছেলেবেলা '-র পাতায় উঠে এসেছে সে কথাও।

কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও কি ধীরে ধীরে একা হয়ে পড়ছিলেন কাদম্বরী? সুখ - দুঃখে সঙ্গ দেবার মতো একটা উপযুক্ত কাঁধের অভাব বোধহয় দেখা যেতে শুরু করেছিল কাদম্বরীর জীবনে।সকলের অজান্তে কাদম্বরী হয়তো পৌঁছে যাচ্ছিলেন ডিপ্রেশনের চরম সীমায়।কিন্তু কেন এই অবসাদ?যার জন্য আত্মহত্যার মতো চরম পন্থা অবলম্বন করতে হলো এই বাঙালি নারীকে?

অন্যান্য রাতের মতোই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেদিনও ফিরেছেন দেরি করে। কাদম্বরী বুঁদ হয়ে আছেন বইয়ের মধ্যে। রবির পর বইই ছিল তাঁর একমাত্র বন্ধু। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফেরার পর তার পোষাক গুছিয়ে রাখার সময় কাদম্বরী হঠাৎ পকেটে আবিষ্কার করে বসলেন এক বাইজীর চিঠি।স্বভাবতই ভেঙে পড়লেন কাদম্বরী, সূত্রপাত প্রবল মানসিক টানাপোড়েনের। যদিও এ সমস্ত সমালোচকদের অনুমান বিতর্কের অবকাশ শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়।

অন্য আর একদল সমালোচকের মতে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে ঊর্মিলা মারা গেলে বাড়ির সমস্ত সদস্যই আঙুল তোলেন কাদম্বরীর দিকে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় তাকেই।যার ফলে আকস্মিকভাবে কাদম্বরী ঠাকুর পরিবারের মধ্যে একা হয়ে পড়েন কাদম্বরী একইসাথে জ্ঞানদানন্দিনীর সাথে কাদম্বরীর মনোমালিন্যের গ্রাফ ছিল ঊর্ধ্বমুখী যার ফলশ্রুতি এই মৃত্যু।

তবে মৃত্যুর পরেও কাদম্বরীকে নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। আফিং সেবন করে মৃত্যুর খবর জানাজানি হতেই পুলিশ পৌঁছে যায় ঠাকুরবাড়িতে।কিন্তু অনেকের ধারণা তাদের যথেচ্ছ পরিমাণ উৎকোচে বশীভূত করা হয় ফলে বন্ধ হয়ে যায় কাদম্বরী দেবীর দেহের ময়নাতদন্ত।আবার ঠাকুরবাড়ির বউয়ের মৃত্যুর খবর যেন তৎকালীন সময়ের সংবাদপত্রগুলি প্রকাশ না করে তার জন্যও যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়। পারিবারিক সম্মান বাঁচাতে এক্ষেত্রে দেবেন্দ্রনাথই চাণক্যের ভূমিকায় নেমেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের বিয়ের মাত্র দু - মাসের মাথায় কাদম্বরীর আত্মহত্যা হয়তো নেহাতই কাকতালীয়। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের আচরণ যে কাদম্বরী মন থেকে মেনে নিতে পারেননি তা স্পষ্ট। ফলে যুবক রবির সঙ্গে কাদম্বরীর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে যে গুঞ্জন শোনা যায় তা অনেকাংশেই গুজব।

বর্তমানে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় গর্জে উঠেছে দেশবাসী।কিন্তু কাদম্বরীর অকাল মৃত্যুর এতদিন পরেও প্রশ্ন ওঠে কোথাও কি পুরুষতন্ত্রের শিকার নন রবিঠাকুরের বৌঠান?জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পকেট থেকে পাওয়া বাইজীর চিঠি ছিল কাদম্বরীর মৃত্যু অভিমুখে যাত্রার প্রথম ধাপ যার শেষ অধ্যায় নিহিত ছিল ক্ষমতা এবং আভিজাত্যের দম্ভে কাদম্বরীর আত্মহত্যার খবর ধামাচাপা দেওয়ার মধ্যে। ঊনবিংশ শতকের রেনেসাঁর আঁতুড়ঘরে এভাবেই চাপা পড়েছিল নিতান্ত একা হয়ে পড়া এক বাঙালি গৃহবধূর কান্না।

More Articles