দিল্লিবাসীর নাভিশ্বাস! পরিবেশ ধ্বংসের পরিণাম ফলছে, বাসের অযোগ্য হবে রাজধানী?
প্রতি বছর শীতের আগমন ঘটলেই দিল্লির বায়ু আরও দূষিত হয়ে যায়। প্রায় বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে দিল্লির বাতাস। প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয় পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে চাষিদের ফসলের গোড়া পোড়ানো।
ডিসেম্বর ৩, ২০১৭। ফিরোজ শাহ কোটলা-য় তখন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৪০ রানে ব্যাট করছেন বিরাট কোহলি। সিরিজের তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন। হঠাৎই খেলা বন্ধ হয়ে গেল। ঘন কুয়াশায় কমে গেল দৃশ্যমান্যতা। অসুস্থ হয়ে পড়লেন শ্রীলঙ্কার পেস বোলার লাহিরু গামাগে। তার কিছুক্ষণের মধ্যে আরও তিনজন শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাঝে খেলা শুরু হয়, ভারত বিরাট কোহলি এবং অশ্বিন, দু'জনের উইকেটই হারায়। খেলায় কিছুটা ফিরে এলেও শারীরিকভাবে মাঠে ফেরার অবস্থায় ছিল না ভারতের প্রতিপক্ষ দলের অনেকেই। কারণ? সেদিন ফিরোজ শাহ কোটলা তথা সেই পুরো অঞ্চলের Air Quality Index ছিল ৩৩৮। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য চূড়ান্ত ক্ষতিকারক। Very Poor হিসেবে ধরা হয়, ৩০১-৪০০ যদি AQI হয়।
এবার ফিরে আসা যাক নিকট অতীতে। ন্যাশনাল হেরাল্ডে প্রকাশিত ৫ জুন, অর্থাৎ পরিবেশ দিবসের একটি রিপোর্ট বলছে দেশের রাজধানীর পারদের মাত্রা কিছু জায়গায় ৪৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে, কিছু জায়গায় তা পৌঁছে গেছে প্রায় ৪৯ ডিগ্রিতে। মুঙ্গেশওয়ার এবং নজফগড়েই এই ঘটনা ঘটেছে।
২০১৭ সালের দূষণের কারণে টেস্ট ম্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং ২০২২ সালে দিল্লির কোনো এলাকায় তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রিতে পৌঁছে যাওয়া কিন্তু দু'টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ কিছু দিন আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের ফলে ভারতে তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে একশো শতাংশ।
আরও পড়ুন: পরিবেশ রক্ষার মার্কশিটে ডাহা ফেল, কেন এই অবস্থা ভারতের?
এবার আসা যাক দিল্লির প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যেই প্রায় ৭৯,০০০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে এই সংখ্যাটা সরকারি এবং সরকারি অনুমতি নিয়ে এই গাছগুলি কেটে ফেলা হয়েছে। এখানে বেআইনিভাবে কাটা গাছের হদিশ নেই, সেই পরিসংখ্যান পাওয়াও যাবে না। সেই রিপোর্টের পর কেটে গেছে আরও চার বছর।
সেই সঙ্গে যোগ করতে হবে ঝড়বৃষ্টির কারণে উপড়ে পড়া গাছের সংখ্যাও। দিল্লিতে বেশিরভাগ গাছের গোড়া একেবারে অপরিকল্পিতভাবে কংক্রিট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া। স্বাভাবিকভাবেই গাছের গোড়াগুলি এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সামান্য ঝড়বৃষ্টি হলেই দিল্লিতে গাছ ভেঙে পড়ে। যে সংখ্যাটা বেশ চিন্তার। গত ১ জুন, দিল্লিতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়। ৭৭টি গাছ উপড়ে পড়েছে। ৭৭টি বড়, ২০-৩০ বছর বয়সি সব গাছ, যা আমাদের পরিবেশের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা ভেঙে পড়েছে সরকারি অপদার্থতায়।
কিন্তু চিন্তা কার? কে চিন্তা করছে? কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ করছে কি? ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে তাদের চিন্তার নমুনা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট অবধি তিন কিলোমিটারের একটি রাস্তা আছে। দেশের সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তার নাম হল সেন্ট্রাল ভিস্তা। কেন্দ্রীয় সরকার এখানে বিশাল বড় এক প্রকল্প নিয়েছেন, যেখানে তারা নতুন সংসদ, নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং আরও কিছু প্রশাসনিক ভবন বানাবে। বহু কোটি টাকার প্রকল্প। সেই প্রকল্পের জন্য তারা উপড়ে ফেলেছে এক হাজারেরও বেশি বহু মূল্যবান গাছ। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই গাছগুলিকে প্রতিস্থাপন করার। কিন্তু সরকারের প্রদত্ত তথ্যই বলছে, যে মাত্র ২২টি গাছ পুনরায় রোপণ করা হয়েছে এবং বাকি গাছগুলি নিয়ে তাদের কোনও পরিকল্পনাই নেই।
প্রতি বছর শীতের আগমন ঘটলেই দিল্লির বায়ু আরও দূষিত হয়ে যায়। প্রায় বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে দিল্লির বাতাস। প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয় পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে চাষিদের ফসলের গোড়া পোড়ানো। কিন্তু ইসরো-র স্যাটেলাইট অন্য কথা বলছে। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, দিল্লির দূষণের জন্য ফসলের গোড়া পোড়ানো মাত্র কুড়ি শতাংশ দায়ী। বাকি আশি শতাংশের কারণ হলো জঞ্জালের সমস্যা এবং যথেষ্ট সবুজের আচ্ছাদন না থাকা।
উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সেন্ট্রাল ভিস্তার। আরও কয়েকটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। অতুল খটরিয়া চকে একইভাবে সরকারি প্রকল্পের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। নয়ডা দিল্লির একদম পাশেই। সেখানকার আইটি হাবের প্রসারণ উড়িয়ে দিচ্ছে সব গাছের আচ্ছাদন। দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ের জন্য কাটা হবে আরও হাজারতিনেক গাছ। দ্বারকারই ভারত বন্দনা ভার্জিন ফরেস্টের দুশো একর জমি এতদিন সংরক্ষিত ছিল। সরকার সেখানে থিম পার্ক বানাতে চলেছে।
দিল্লিকে যদি এই ভয়াবহ দূষণ এবং তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে হয়, তাহলে বেছে নিতে হবে নিউ ইয়র্ক শহরের মতো উদাহরণ। তারাও দিল্লির মতো পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, শুধুমাত্র গাছ লাগিয়ে। প্রায় তেরো লক্ষ গাছ। দিল্লিকেও এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথা, দিল্লিতে কোনও শিশুর পক্ষে আর সুস্থ ভাবে বড় হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।