বাঙালিয়ানার টইটম্বুর দুই রাজধানী, স্বাধীনতার আগে থেকেই পালিত হয় দিল্লির বাঙালিদের দুর্গাপুজো
Delhi Durgapuja 2022: পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বিভিন্ন শহরেই ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর উদযাপন শুরু হয়েছে
দুর্গাপুজোর আমেজ যেমনটা কলকাতায় দেখতে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে হয়তো ঠিক কোনও তুলনা সম্ভব নয়, তবুও রাজধানী দিল্লির দুর্গোৎসবেও কিন্তু জাঁকজমকের কোনও কমতি দেখা যায় না। গত দুই বছর ধরে মহামারির কারণে এই শহরে দুর্গাপুজো প্রায় নিঃশব্দেই উদযাপন করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ এর দুর্গাপুজো উদযাপনে যেন জাঁকজমকে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায়- এমনটাই প্রস্তুতি রয়েছে বিভিন্ন দুর্গাপুজোর আয়োজকদের।
আসলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বিভিন্ন শহরেই ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর উদযাপন শুরু হয়েছে, আর বেঙ্গালুরু থেকে হায়দরাবাদ, জয়পুর থেকে লখনউ- সর্বত্রই প্রতি বছর পুজোর সংখ্যাও বাড়ছে। যথারীতি দিল্লিও তার ব্যতিক্রম নয়। তার পাশাপাশি এই শহরে করোলবাগ বা রাজিন্দর নগরের মতো এলাকায় বাঙালিরা কিন্তু দুর্গাপুজো করে আসছেন স্বাধীনতারও অনেক আগে থেকেই।
আর দিল্লির সিআর পার্ক তথা চিত্তরঞ্জন পার্ক হল এমনই একটি এলাকা যেখানে পুজো উদযাপন এমনই, যাতে যে কোনও বাঙালিই অনুভব করেন তারা যেন ‘মিনি কলকাতা’য় রয়েছেন। চিত্তরঞ্জন পার্ক কালীমন্দির ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত, দিল্লিতে বসবাসকারী বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য এখন এটি একটি প্রধান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বিশেষ করে পুজোর সময় এই মন্দিরকে ঘিরে পুরো এলাকাটিই দিল্লির বাঙালির মিলনমেলায় পরিণত হয়।
শারদীয়া উৎসবের সময় দূর দূরান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক ভক্ত ও দর্শনার্থী এই মন্দির ও এলাকায় আসেন মহাউদযাপনের অংশ হতে। নানা রঙের রঙিন আলো, নান্দনিকভাবে সাজানো প্যান্ডেল এবং সংস্কৃত মন্ত্রের শুদ্ধ উচ্চারণ যে কাউকে মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। এবারেও সিআর পার্কে সেই আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে পুরো দমে।
আরও পড়ুন- বাগানের মাটিতে শিশুকন্যার অলীক পায়ের ছাপ! যেভাবে শুরু হল শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো
দুর্গার অনেকগুলো নামের মধ্যে একটি হল অনন্যা। ভারতে সমস্ত নারীর মধ্যে যেন সেই অনন্যা দুর্গারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়, সেই ভাবনা থেকেই দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে শালিমার গার্ডেন মহিলা সেবা সমিতি এবারে একটি সম্পূর্ণ নারীশক্তি দ্বারা পরিচালিত দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছে। দিল্লি এনসিআর এবং উত্তরভারতেও এই প্রথম পুরোহিত থেকে শুরু করে ঢাকি, প্রসাদ ও ভোগ বিতরণ এবং অন্যান্য সব কাজে মহিলাদেরই দেখা যাবে। প্রতিমাকে বরণ করে নেবেন মহিলারা। এই সম্পূর্ণ নারীশক্তির উদ্যোগকে বলা হচ্ছে ‘মায়ের পুজো, মায়েদের দিয়েই’। পুজোর আয়োজন থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত প্রতিটি কাজ সম্পূর্ণরূপে এলাকার মহিলা কার্যনিবাহী সদস্যরাই সম্পন্ন করবেন।
‘অনন্যা’ নারী দুর্গার আবির্ভাব উপলক্ষ্যে মূলত সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্যই এই পদক্ষেপ। প্রতিমা এসেছে কলকাতার কুমোরটুলি থেকে। উৎসবের দিনগুলোতে সারাদিনব্যাপী নানা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। অংশগ্রহণ করবেন কলকাতা এবং আশেপাশের এলাকার পেশাদার শিল্পীরা। কোভিডের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বনে সমিতির পক্ষ থেকে মিষ্টি ইত্যাদির সঙ্গে এবারে প্রসাদ হিসেবে গোটা ফল বিতরণ করা হবে, কাটা ফল নয়। সব দিক থেকেই অনন্যা এই দুর্গোৎসব দিল্লির এনসিআরে নারীদের হাতে পুজোর এক নতুন যুগের সূচনা করবে।
অন্যদিকে, আশ্বিনের ৪ তারিখে দিল্লির আকাশে সন্ধ্যা তারারা গেয়ে উঠেছে ‘নারায়ণী নমস্তুতে’। বছর পাঁচেক আগে শুরু হওয়া এই অভিনব উদ্যোগটিতে দিল্লিসহ দেশবিদেশের সেরা পুজোগুলোকে কিছু বিশেষ মাপকাঠির ভিত্তিতে পুরস্কৃত করা হয়ে থাকে। গ্লিটজ আর আড়ম্বরের নিখুঁত মিশেলে এই প্রকল্পটির অবতারণা করছেন ‘ড্রিম নারচারিস্টস অ্যাভিনিউ’ বা ডিএনএ। মহামারিতে সাময়িক নীরবতার পর এবছর তারা আবার ফিরে এসেছে মহাসমারোহে।
গত ২১ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায় দিল্লির ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া’তে কর্ণধার মিঠু চট্টোপাধ্যায় এবং সংস্থার অনুপ্রেরণামূলক গুরু তথা অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কৌশিক গুহ রায় ‘নারায়ণী নমস্তুতে’র জুরি বোর্ডের সকল সদস্যদের স্বাগত জানান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ বিমানবিহারী দাস, পদ্মশ্রী শ্রী উদয়শঙ্কর, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, অনুজ চক্রবর্তী, বিশ্বজিত দেব, বাবলু বসাক, ইন্দ্রাণী দত্ত ও প্রিয়াঙ্কা দেব সহ আরও অনেকে।
‘নারায়ণী নমস্তুতে’ যে সব মাপকাঠির ভিত্তিতে সেরা পুজো বাছাই করে থাকে তার মধ্যে রয়েছে, পুজোর থিম বা মূল কেন্দ্রীয় ভাবনা, সেরা মূর্তি (বিভিন্ন জোন থেকে), ইকো-ফ্রেন্ডলিনেস বা পুজোর আয়োজন কতটা পরিবেশবান্ধব ইত্যাদি। সংস্থার কর্ণধার কৌশিক চ্যাটার্জি জানান, এবার ভারতের বিভিন্ন শহর ছাড়াও সুদূর লন্ডন, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৬০০ পুজোকমিটি এই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করছে। ২০২০ এবং ২০২১-এর করোনা রক্তচক্ষুও ‘নারায়ণী নমস্তুতে’র দলকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। লকডাউনের সময় থেকে আনলকিং পর্যন্ত প্রতিনিয়ত নিজেদের কাজের পরিকল্পনা চালিয়ে গেছেন তাঁরা, যার পরিণতিই এবারে তাঁদের এই পূর্ণশক্তির উদ্যোগ।
আরও পড়ুন- তারকাদের মেলা! মুম্বইয়ের যে যে দুর্গাপুজোর গ্ল্যামার চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আজও
দক্ষিণ দিল্লিতে আর একটি বিখ্যাত ও মর্যাদাবাহী দুর্গাপুজোর আসর হল অভিজাত সফদরজং এনক্লেভের ‘মাতৃ মন্দিরে’র দুর্গা আবাহন। এবারে ৫৬তম বর্ষে পড়ল এই দুর্গাপুজো। সমস্ত শাস্ত্রীয় রীতিনীতি মেনে আগামী ১ অক্টোবর (মহাষষ্ঠী) থেকে ৫ অক্টোবর (দশমী ও বিসর্জন) পর্যন্ত এবারের দুর্গোৎসব পালন হতে চলেছে। এই পুজোর প্রধান পুরোহিত রজত চট্টোপাধ্যায় আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী, এই পুজো সম্পন্নেও নিখুঁত ভূমিকা তাঁর!
মাতৃ মন্দির দুর্গাপুজো অভিনব মণ্ডপসজ্জা, বর্ণময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আকর্ষণীয় খাবার দাবার, প্রদর্শনীমূলক স্টল এবং সামগ্রিক সুশৃঙ্খলা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনার কারণে বরাবরই প্রচারের আলোয় থেকেছে। ২০০৫ সাল থেকেই এই পুজোর থিমের প্যান্ডেলগুলি সাধারণ দর্শকের বিপুল প্রশংসা অর্জন করে আসছে। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, আজ তক নিউজ চ্যানেলের বাছাইতে যেমন, তেমনই দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারেও তারা বহুবার ভূষিত হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে মাতৃ মন্দিরের পুজো কলকাতা, মুম্বই এবং বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটি পরম্পরাও ধরে রেখেছে। বহু মর্যাদাপূর্ণ কর্পোরেট হাউজ– বহুজাতিক সংস্থা, ভারতের বেশ কিছু নবরত্ন বা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাও এখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সে কারণেই দিল্লির এই পুজো এত দীর্ঘ সময় ধরে সফলভাবে মানুষের মন জয় করে নিতে পারছে।