অম্বুবাচীর বিকেলে খিচুড়ি আর মাছের চচ্চড়ির গন্ধ
অম্বুবাচীর বৃষ্টিভেজা মাঠের মধ্যে ওই দ্যাখো একখান বাউনের ঘরের বেধবা কেমন উনোকুঁজো হয়ে শুয়ে আছে। ওর বুঝি বা খিদে লেগেছে খুব। ওর মায়ে এমন দিনে মাছের তেল, মাছের পোটা ভেজে মরিচ ডলে ভাত মেখে খাইয়ে দিত কেমন যত্নে!
প্রতিটা দিনের শুরুই ভারি অন্যরকমের। এই ধরো না এমন আষাঢ় দিনে, সেই কোন সকাল থেকে আকাশে আকাশে মেঘেদের চলাচল। মেদুর সকালে তাই মাঠে মাঠে মেঘের ছায়া এলিয়ে পড়েছে। এক একটা বীজতলা আবার নরম সবুজ মখমলি ধানের রঙে ভরে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে অপলক চেয়ে থাকে ওই যে ফকির সাহেব, ওরে কি আপনি কবি বলবেন না? কাদায় গোড়ালি ডুবিয়ে নুয়ে পড়ে ধানের রঙে ওর মনখানা ভরে উঠছে ওই। দু'-একখানা কাস্তেচেরা এদিকওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাদা খুঁটে খুঁটে কী খাচ্ছে, কে জানে! ওদের যেন ব্যস্ততা নেই কোনও। তবে তিলে মুনিয়া আর বাবুইদের অবিশ্যি এক দণ্ড বসে থাকার জো নেই। ওরা বেনা ঘাসের পাতায় পাতায় দোল খাচ্ছে অকারণেই। মানুষের পা পড়ে না ওদিকে বড়। অমন ঝাড় হয়ে আছে, ওই যে বেনা ঘাসের ঝাড়! বোড়া সাপেদের ভারি পছন্দ ওসব। কেজো মানুষেরা তাই ওপথ এড়িয়ে চলে এমন ব্যস্ত সকালেও। তবে ব্যস্ততারও তো রকমফের আছে! খুকুর ঠাকুমা তাই ওই দ্যাখো না কেমন আল পেরিয়ে চলেছে ওই। ভোরের হাওয়ায় হাড় জিরজিরে শরীরখানা বেআব্রু হয়ে পড়তে চাইছে বারবার, তবু মানুষের সংকোচের সঙ্গে সে পারবে কেন! ওর চলে যাওয়ার দিকে আঙুল তুলে ও পাড়ার বউ ওর বরেরে বলতেছে, চক্কোত্তিবাড়ির ঠাকুমা কই চললেন গো? কই চললেন সে জেনে মানুষের কিছু যাবে-আসবে না, তবু মানুষের স্বভাব তো! সে সবকিছুর সুলুক সন্ধান চায়।
মাঠ পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা বরাবর ঠাকুমা চলেছেন ওই বিশেদের বাড়ি। চলেছে অম্বুবাচীর তদ্বির করতে। একথা-সেকথার পর বুড়ি কাজের কথা পাড়ছে ভারি সংকোচে। খানিক জড়সড় হয়ে বসেছে দ্যাখো কেমন! বলতেছে, বিশুরে, তোর বাপ থাকতি তো সিধে পাটিয়ে দিত, তাই ভাবলাম তোরে বলি! সকাল সকাল বিশুর রাজ্যির কাজ। সিধের কথায় বিশু খানিক সতর্ক হয়ে বসে। আতপ চালের কেজি দিনে দিনে বাড়ছে, দানা আকের গুড় কিনতে গেলে এখন নগদা কড়ি লাগে। সেদিন তো আর নেই, এ পাড়ায় ছ'টা শাল হতো আখের মরশুমে। বুড়ি বলে চলেছে নিজের মতো। বেশি কিছু চাইনি রে বাপ, ক'খান গাছের আম-কাঁঠাল-নারকেল দিস বাপ। বউমারে আমি বলব এখন, এক পোয়া করে দুধ যদি পাটিয়ে দিতে পারিস। মুখ ফুটে আর কার কাছে চাইব বল! বিধবা মানুষ। জানিস তো, ছেলেরা আমার জন্মশত্তুর, চাইলেই কি দেবে ওরা?
বিশু খানিক বিরক্ত হয়েই বলে, এসব আজকাল কেউ করে না কি? এসব উঠে গেছে ঠাক্মা। বুড়ি কিন্তু ছাড়বার পাত্রী নয়। খুনখুনে গলায় বলে, বলেই চলে... তা বললে হবে কেন বাপ! শাস্তরের বিধেন হল এই। এসব বলে, বুড়ি খানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিশে আর কী করে! মানুষ কি আর কেবল শাস্তর পালবে বলে আম-কাঁঠালের সওদা করতে আসে? তার জীবনেও যে এখনও কিছু ঘটে, এটুকুই তো যাচাই করে নিতে চায়, তাই না? মা-বউরে বলে-কয়ে বিশু তাই আষাঢ়ের সকালে গোটা দশের গাছপাকা আম, একখানা আস্ত গলা কাঁঠাল, এক মুঠো গোলাপজাম পাঠিয়ে দিচ্ছে ওই। ইচ্ছে না থাকলেও একখানা ঝুনো নারকেলও দিয়েছে শেষ পর্যন্ত। কাঁচা দুধ খেলে বুড়ির যদি পেট ছাড়ে তো ছাড়ুক, অত ভাবতে পারবে না বিশু।
আরও পড়ুন: আষাঢ়ের মেঘ আর সরষে বাটা দিয়ে খয়রার ঝাল
রজঃস্বলা পৃথিবীর বৃষ্টিমুখরতা নিয়ে ভাবতে ভারি বয়েই গেছে ওর। ধানের বিছন ফুটল কি না সেসব দেখে লাভ কি বাপু? বিশু তাই বসে বসে ডিম-টোস্ট আর দুধ চা খাচ্ছে ওই। বর্ষার সকালে ওর বউ বেশি করে পেঁয়াজ আর মরিচ কুচিয়ে বেশ কড়া করে ডিম টোস্ট ভেজে দেয়। চাটুপোড়া গন্ধে বিশুর আরও খানিক খিদে পায়, বিশু তাই বেশ আওয়াজ করে চায়ে চুমুক দেয় এবার।
এবারে অম্বুবাচী লেগেছে বিকেল বিকেল, ঠাক্মা কিন্তু তার আগেই ফলপাকুড় ধুয়ে-মুছে তুলে রেখেছে। বিধবার জন্মটা এমন করে কাটিয়ে দিতে পারলে হয় এবারের মতো। এমন আষাঢ়ের দিনে কাসুন্দি দিয়ে পাকা আম খেতে কী ভালোই না লাগত! গরম দুধে দু'মুঠো ভাত মেখে, খানিক খানিক আম চটকে নিলেই হলো, আহা! এমন ঠান্ডা কাঁচা দুধে চুমুক দিতে কেমন ঘিন্না ঘিন্না করে। সেকথা ক্যামনে বুজাই বলো দেখি! তবু, এ গাঁয়ে মানুষের মন বড় নিচ গো, এরা মানুষরে মানুষ ভাবে না। বিয়ে হয়ে এসে তক দেখচে এদের। এর জল চলে না, ওর হাতে ভাত চলে না এই নিয়েই তো বেঁচে আছে মানুষ! চক্কোত্তিবাড়ির ঠাক্মা তাই ইচ্ছে না হলেও অম্বুবাচী পালে মন দিয়ে। পালতে পালতে বুড়া মানুষের খিদা লাগে। লাগবেই তো, লাগবে না? ভাতের খিদে মানুষ স্বগ্গে গেলেও টের পায়। বগবগ করে ভাত ফুটলি পর ন্যাজঝোলা পাখি ইলেকটিরির তারে এসে দোল খায়। বুড়ি তখন কী করে? বুড়ি বসে বসে ভাবার চেষ্টা করে, লাল পুঁই দে কুমড়োর ছ্যাঁচড়ার গন্ধ যেন কেমন! চোখ বুজে মনে মনে গন্ধের পিছনে পিছনে ছোটে তখন ও। বর্ষার সন্ধ্যায় কাদের বাড়িতে বুঝি খিচুড়ি বসাল! আহা, গোটা গোটা ছাঁচি প্যাঁজ দে মুসুরির ডালের পাদলা খিচুড়ি খেতে যা সুখ! অম্বুবাচীর ফলপাকুড়ের গন্ধ পেরিয়ে বুড়ি চলেছে ওই, গন্ধের পিছে পিছে। বামুনপাড়া পেরিয়ে ওই যে,আরও দূরে। ঘোষেদের বাড়িগুলো ছাড়িয়ে ক্যানেলের পাড়ে বাউরিপাড়া বরাবর চলে যাচ্ছে ওই। বাউরিদের মেয়েরা যেমন রাস্তায় বসে বসে আমড়া ছ্যাঁচা খাচ্ছিল সেদিন, অমন ইচ্ছে করে বুড়ির। এসব ইচ্ছে কেমন পেটের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওই। কী আর করে বুড়ি মানুষ! ভেজা হাওয়ায় কাঁথাখান গায়ে দিয়ে পাশ ফিরে শোয় কেবল।
তোমরা ভাব, বুড়ির গল্প গাঁজাখুরি মালমশলায় ভরপুর? না গো না! অম্বুবাচীর বৃষ্টিভেজা মাঠের মধ্যে ওই দ্যাখো একখান বাউনের ঘরের বেধবা কেমন উনোকুঁজো হয়ে শুয়ে আছে। ওর বুঝি বা খিদে লেগেছে খুব। ওর মায়ে এমন দিনে মাছের তেল, মাছের পোটা ভেজে মরিচ ডলে ভাত মেখে খাইয়ে দিত কেমন যত্নে! সেসবই ভাবছে বুঝি বুড়ি। ভাবুক ভাবুক, গুপ্তপ্রেশ ফুলপঞ্জিকাখান কোলের ওপর খুলে মাছের পোটা চচ্চড়ির গন্ধে হারিয়ে যাচ্ছে ওই, ওই আমাদের বুড়ি। যাক যাক। এই গাঁয়ের মানুষেরা না-হোক, স্মৃতিরা অন্তত সময় সময় না চাইতেই সিধে পাঠিয়ে দিতে জানে। কী ! ঠিক বললুম তো?