পরবের খুশিতে মিশে থাকে মটর ডাল, বেগুনভাজার সুবাস

নাসিমার আব্বু ঘুমে ঢুলে পড়া নাসিমাকে দলা করে করে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আজ। দেবে নাই-ই বা কেন! পরবের খুশি এ বাড়ির আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে না বুঝি!

উফ, পাড়ায় পাড়ায় আবার ইদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে বেদম। হাটফেরতা মানুষের গেঁজে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বেমালুম। এমনই তো হয় এ গাঁয়ে! খুশি খুশি মুখে নাসিমা তাই ওর ছাগলছানাকে বুকে চেপে ধরে চুমো খাচ্ছে মুখ নামিয়ে। ওর মা ঘরদোর সাফ করছে, বড় বড় পরাত ধুয়েমুছে খাড়া করে রাখছে পাকশালের ওপাশে। এনামেলের থালায় শেষ আষাঢ়ের মেঘছেঁড়া রোদ্দুর এসে পড়েছে কেমন দ্যাখো! সেই আলোর মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নাসিমার আব্বা। ওই হলুদ ফুলে ভরা বাবলাগাছের ওপারে মেঘের শামিয়ানার মধ্যে আব্বা আর কিছুক্ষণে হারিয়ে যাবে। আব্বার দিদি, ওপাড়ার নতুন বউদিদির ঘরে নইলে একগোছা বাসকের পাতা কে পৌঁছে দেবে বলো? ইদের বেদম তোড়জোড় ফেলেও মানুষকে তাই হাঁটা দিতে হয় মাঠের পানে।

নাসিমা এসব দেখে বসে বসে। ওর নরমসরম ছাগলছানার বুকখানা ওর বুকের ওমে আগলে রাখতে চায় আব্বুর মেয়ে নাসিমা। ওর আব্বু ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ঘোষপাড়ার মাঝামাঝি। ওপাড়া ফুরোলে পর মানুষের ঘরবসতি খানিক কমে আসে। সেই বিরান মাঠের ধারে নাসিমার আব্বুর বউদিদির বাড়ি। তার ছোট খোকার ভারি অসুখ করেছে কিনা! জ্বরের গন্ধ থমকে আছে বন্ধ ঘরের চৌকাঠে। আজ অনেকদিন পর ছেলেটা খানিক উঠে বসেছে তবু। এখন ঘরে ঘরে এই জ্বর-সর্দিকাশি চলতেই আছে। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে বেচারির, আহা রে!

নাসিমার আব্বু খোকার বিছানার পাশটিতে গিয়ে বসেছে। দাওয়ার পাশটিতে ওই নামিয়ে রেখেছে বাসকের পাতা। বউদিদি বলছে, চা বসাই, বোসো ভাই। এখন কি চা খাওয়ার সময় আছে! আজ বাদে কাল পরব। তবু, নাসিমার আব্বু না করতে পারে না। বলে, করুন তাহলে! চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে খানিক লেড়ো বিস্কুটও খায়। বউদিদি বলে, নাসিমার জন্য রঙিন চুড়ি এনেছি খানিক, নিয়ে যেও। নরম চোখে হাসতে হাসতে সাদা চিকচিকিতে কাচের চুড়ি দুলিয়ে নাসিমার আব্বু চলে যাচ্ছে ওই। আর আব্বুর বউদিদি চান করে পাটভাঙা শাড়ি পরে ঘুঁটের উনুন ধরাচ্ছেন এবারে। এতদিন বাদে ছেলে পথ্যি খাবে, তার খানিক নিয়ম না মানলে কি হয়! কেমন মা তুমি বাপু? এই রান্নায় কয়লা চলবে না, পোড়াকাঠের আঁচ চলবে না, ঘুঁটোই চাই গো। মেটে হাঁড়িখান ধুয়ে-মেজে উনুনে চড়িয়ে দিতে দিতে মা টের পাচ্ছেন ছোট খোকা বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে ওই। চৌকাঠে বসে বসে খোকা এখন পোড়ের ভাত রান্না দেখবে আর পুটুরপুটুর প্রশ্ন করবে। আতপ চাল ফুটছে ওই, নরম ভাতের মধ্যে মিশে যাচ্ছে ঝিঙেসেদ্ধ আর পটলসেদ্ধর গন্ধ। সেই গন্ধের মধ্যে সব শেষে মিশে যাবে সোনালি ঘিয়ের স্পর্শ। খোকা আমাদের হাত ছোঁয়া গরম জলে চান করে পোড়ের ভাত খাবে, মায়ের কোলের কাছটিতে ঘুমোবে, তবে না!

আরও পড়ুন: রথের মেলায় জিলিপি, পাঁপড়, ডালের বড়া, ঘরে শুঁটকিমাছের তেতোচচ্চড়ি

খোকা ঘুমোলে মা তখন আস্তে করে আঁচলখানা টেনে নিয়ে উঠে পড়বেন। বাড়ির সকলে তো আর পোড়ের ভাত খাবে না! খোকার বাবা-কাকা-ঠাকুরদা এই তো মাঠ থেকে এসেই চান সেরে নেবে এখন। ভাসা মানিকের ভাতে কচু দে, পুঁই দে হাত-পিছলানো ডাল মেখে নেবে ওরা। খোকার মায়ে গাঁদালপাতার বড়া ভেজেছে ক'খান। এমন ভেজা মেঘের দিনে গায়ে-হাতের ব্যথা কমে ওর পাতায়। ভাজা শেষ হলে আমড়া দিয়ে চুনোমাছের টক বেড়ে দেয় এই বাড়ির বউ। আর ক'দিন বাদে পাকা কদমের চাটনি হবে এখন। নাহ! হাতের কাজ সারতে সারতে বেলা গড়িয়ে কোন সে মেঘের দেশে মেশে, তার খোঁজ রাখে কি কেউ?

যদি সে খবরে কারও গরজ থাকত, তবে তারা টের পেত খোকার মায়ে এতক্ষণে চুল এলিয়ে দিয়ে খেতে বসেছেন। দু'-দলা পোড়ের ভাত আর বাটিভরে আমড়ার টক খেতে খেতে বৃষ্টি নামছে ওই। মা তখন ভাত ফেলে কাপড় তুলতে ছুটছেন, জানলায় আগল দিতে ছুটছেন। পাতের ভাত ততক্ষণে জুড়িয়ে জল। তবু, ভাত কি আর ফেলতে আছে! জুড়িয়ে যাওয়া ভাত তাই কোনওরকমে খেয়ে পাত খালি করে খোকার মা। বিকেল বিকেল আজ গা ধুয়ে কাপড় ছেড়ে তুলসীতলায় হরির লুঠ দেবে 'খন। এমন বিকেলে মগরিবের আজান ফুরোলে ঘরে ঘরে টেমি, কুপি আর লম্ফ জ্বলত আগে আগে। এখন বিজলিবাতির ছড়াছড়ি, তবে সে বেয়াক্কেলে বিজলি আলো থাকলি তো! সন্ধ্যার আঁধারে প্রদীপ জ্বেলে পোড়ের ভাত-খাওয়া ছেলের জন্য মা গড় করে তুলসীতলায়। তালি দিয়ে দিয়ে গান গায়। সেই গানে সুরের ছোঁয়া না থাক, মাটির মায়া আছে কিছু।

পাড়ার গেঁড়িগুগলির দল তাই ভিড় করেছে দ্যাখো কেমন! গুড়ের বাতাসা কুড়িয়ে মানুষের এমন আনন্দও হতে আছে? আছে নিশ্চয়ই, নইলে আর ওরা অমন খুশি কেন! দুধে-ভাতে, চাঁপাকলায় মেখে খোকাকে খাইয়ে দেবে আর খানিক পরেই। আজ আর রানতে ইচ্ছে করছে না। তবু কালো জিরে, শুকনো লঙ্কার বাগাড়ে মটরের ডাল রাঁধছে বউ, খোকার মা। চাক চাক করে বেগুন ভাজছে সর্ষের তেলে। ঘানিভাঙানো তেলের গন্ধ ওর তালু ছুঁয়ে বাহুলতায় মিশে যাচ্ছে। খোকা এবারে ঘ্যানঘ্যান করছে আবার। খোকার গা কি আবার ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে অল্প? বাসকের রস ধরতে খানিক সময় লাগবে হয়তো, কী জানি!

খোকা ঘুমোয়, পাড়া জুড়োয়। নরম চাঁদের আলোয় ওই বিরাণ মাঠের দিকে চেয়ে থাকে মায়ে। নাসিমার আব্বু ঘুমে ঢুলে পড়া নাসিমাকে দলা করে করে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আজ। দেবে নাই-ই বা কেন! পরবের খুশি এ বাড়ির আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে না বুঝি! আব্বুর কোল ঘেঁষে ভরপেটে নাসিমা ঘুমোচ্ছে ওই, ওপাড়ায় মায়ের খোকাও ঘুমোচ্ছে অঘোরে।

সকালের আলোয় নাসিমার আব্বু একমুঠো বাসক পাতা নিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে। নাসিমার এসব ভালো লাগছে না মোটেও। পরবের দিনে আব্বু যে কি করে না! বাসকের রস না খেলে কী হয় মানষের? বাড়িভর্তি লোকের খুশি ফেলে বিদঘুটের তিতা রসের জোগান আব্বুর কাছে বড় হলো? নাসিমার আব্বু জানে, এই ছেমড়ি ঠিক বুঝবে একদিন, বুঝবেই।

More Articles