শাকভাতের পাতে পুঁটি মাছভাজা, ভুলে যাওয়া দেশের রান্নার স্বাদ
...আস্ত আরেকটা দেশ! আস্ত আরেকটা ভাষা। জিহ্বার স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ নিয়ে সে দেশ তো হারিয়েই গেছে কবে। মেঘমল্লারের বিপ্রলম্ভ আলাপে সে কি আর ফিরবে কখনও?
তোমার দেশ কোথায় গো?
এমন প্রশ্ন কেবলই ঘুরপাক খায়। এ দেশ তো আর আলাদা ভূখণ্ডের দাবি নিয়ে মিছিলে নেমে পড়তে পারে না! এদেশের কথায় বুকের ভেতর একখান তারের বাঁশি বেজে ওঠে। সে বাঁশির সুরে অবয়ব পেতে থাকে আস্ত একখানা গাঁওঘর, খেতখামার। সেই খেতখামারের দেশে এই এরকম শ্রাবণ দিনে রাস্তায় ঢেলে ঢেলে কাডুল বিক্কিরি হয়। মানষে উবু হয়ে বসে টিপে টুপে সে কাডুল কিনে নেয় ভারি সোহাগে। কাডুলের রস দিয়ে ক্ষীর দিয়ে লাল মুড়ি খেতে যা সুখ! লালি গরু ওই দ্যাখেন কাডুলের ভুতুরি কেমন মন দিয়ে খাচ্ছে। কাডুলরে কাঁঠাল কইলে কি আর স্বাদ লাগে?
স্বাদের জিহ্বাখান মগজের মধ্যে কে যে গঁদের আঁঠা দে সেঁটে দেছে, কে জানে! বরষার জলে আমে ক্যামন ঝাঁজ ঝাঁজ ভাব ওঠে না? উঠবই তো, জলের ছোঁয়ায় অমন হয় বইকি। দ্যাখেন না, শোকেতাপে তেতেপুড়ে মানুষ পুকুরঘাটের পাশটিতে ক্যামন আদুর গায়ে বসে থাকে। জলের সে ক্ষমতা আছে তো! আমের ভেতরে শোকতাপ না থাক, শেষবেলার খানিক অভিমান থাকে হয়তো। তা সেই ঝাঁজ ওঠা আমে খানিক কাসুন্দি মেখে খাও না কেন! মরিচ ডলে ডলে এমন পাকা আমমাখা যারা খেত, তারা ওই চলে যাচ্ছে ওই দূরে। আরও দূরে। আরেকটা দেশ ওই কেমন হেঁশেলের তল্পি নিয়ে মুখ উঁচিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে দেখো।
আরও পড়ুন: মুরগির সালন, কলিজার ভুনা, চিংড়ির টক… রান্নার গন্ধে মিশে থাকা গল্প
তা মানুষের স্বাদ-আহ্লাদ নিয়ে একখান দেশ বুঝি হারিয়ে যেতে পারে? পারেই তো। পারছেই তো। প্রতিদিন সে কেবলই ঘুরে মরছে শহরের আনাচকানাচে। তাকে বুঝি তুমি উদ্বাস্তু জীবন বলবে না? সেই দেশঘরের মেটে উনোন, নিভু আঁচে দুধের কড়া, সেই সমস্ত নিয়ে আস্ত একখান রান্নাঘর পড়ে রইল জীবনের কোন প্রান্তে। সে জীবন কি আসলেই ফেলে আসা আরেকখান দেশের মতো মাথার ভিতরে অবিরাম জেগে উঠতে চায় না? চায় চায়। আপসের জীবন ঠেলে সে জীবন এখনও তিসি বাটা দিয়ে আমড়ার অম্বল খেতে চায়। সেই অম্বলে এক মুঠো ভাত তুলে নাও না কেন ফুলকাটা বাটিতে! আওয়াজ করে চুমুক দাও ! উফ! এমন বিচ্ছিরি আওয়াজ করে যে মানুষ খায়, সে খাক না বাপু। অমন আওয়াজ করে খেলে ওর ঠাকমা মুখ টিপে হাসতেন। বলতেন, আর এক মুঠো ভাত আর আমড়ার ঝোল নিবি দিদিভাই?
বেলাগাম পেট চুক্তি সেইসব জীবন বর্ষার শহরে ঘুরেফিরে আসতে চায়। অফিসফেরতা মানুষের তখন কাটিং চায়ে প্রজাপতি বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে বড় ভালো লাগে। ভাললাগারও তো অভ্যাস বদলায়! ঘিয়ের চাঁছি দিয়ে চিনি দিয়ে এমন বিকেলে কে মুড়ি মেখে দেবে বলো তোমায়? যে দিত, সে তো আসলে আস্ত আরেকটা দেশ। সে দেশ হারিয়ে গেছে জিহ্বার মানচিত্র থেকে। সে দেশে শাপলার ভেলা ভাজা ছিল, মাছের তেল পোটা আর তরিতরকারির খোসা দিয়ে বাটিচচ্চড়ি ছিল, বিয়েবাড়ির ভোজে মাসকলাইয়ের ডাল ছিল। সেই জীবনটা ভালো কি মন্দ, সে নিয়ে কি বিচার চলে? তবে সে একটা অন্য দেশ। সে একটা অন্য ভাষা। সেই ভাষা গাঁ-গঞ্জ, মফসসল পেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি।
আপনারা কি ভাবেন, মান্য চলিত ভাষা কেবল মানুষের মুখে মুখে ফেরে? তা নয়, তা নয়। ভাতের থাল থেকে মুদির দোকানের ভাঁড়ার, ভাষার আগ্রাসন চলতেই থাকে, দিনে দিনে, রাতে রাতে। সে আগ্রাসনে কাডুলের রস দিয়ে মাখা ক্ষীরের বাটি পড়ে থাকে সেই কোথায়! কত দূরে! সে তো আসলে আরেকটা হারিয়ে যাওয়া দেশ, আরেকটা হারিয়ে যাওয়া ভাষা। সেই হারিয়ে যাওয়া ভাষায় একেকদিন পদ্য লিখতে ইচ্ছে করে বেদম। জামবাটিখানা নামিয়ে নিয়ে তখন যবের ছাতু দিয়ে আখের গুড় মেখে খেতে ইচ্ছে জাগে। এসব ইচ্ছে আষাঢ়ের পূর্ণিমার মতো ভারি নাজুক, ভারি ব্যক্তিগত!
চাঁদের আলোয় চন্দ্রাহত মানুষের মতো একটা বেপথু জিহ্বা তখন এই ঘরবাড়ি, দোকানপাট, অফিসকাছারি- সমস্তকিছু পেরিয়ে আস্ত একখানা গোলরুটির মতো চাঁদকে পিছনে ফেলে ভাতের গন্ধের মধ্যে তলিয়ে যেতে চায়। সেই আশ্চর্য ভাতের গন্ধে উদ্বাস্তু মনের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কি মেঘমল্লার বেজে ওঠে না? একখান ওস্তাদ বীণকর যেমন করে আলাপ করেন! তেমন করে ভাতের গন্ধ ফিরিয়ে আনতে পারেন কি কেউ?
শেষ রাত্তিরের পূর্ণিমার চাঁদ আরও মোলায়েম হয়ে এলে এমন সব মানুষি ইচ্ছে পেয়ে বসে। শহর খুঁজে তখন নোনা কিনতে সাধ যায়, বঁটি পেতে ঢেঁকিশাক কুটে নিতে ইচ্ছে করে। অসুখে ভুগে ভুগে হাড়মাস কালি হয়ে গেছে যে মেয়ের, সে মেয়েরে তুমি ডুমুরের ঝোল খাওয়াবে না? এমন বর্ষার জলে বউনুটি শাক ভরে গেছে এদিকসেদিকে। আহা! শাকভাতের পাতে একখান সরল পুঁটি ভাজা খেতে ইচ্ছে হয় না কি তোমার? হামানদিস্তেয় মুড়ির ছাতু খানিক খানিক গুড় আর কাঁচা মরিচ দিয়ে খেতেও সাধ যায় না!
হয়তো যায়, হয়তো যায় না। সে জীবনে ছাইগাদা ছিল, আস্তাকুঁড় ছিল। সেসব আস্তাকুঁড়ে শ্রাবণ জলে লাউকুমড়োর চারা মাথা তুলে দাঁড়াত নিজের খেয়ালেই। কুমড়োর ডগা সেদ্ধ দিয়ে ভাত খাবে মাণিক? ফ্যানসা ভাতে সরবাটা ঘি দিই খানিক? পূর্ণিমার আলোয় এমন কত কত যে বর্ণ-গন্ধ পথ খুঁজে বাড়ি ফিরতে চায়! চাইলেই কি আর ফেরা যায়!
সে তো আস্ত আরেকটা দেশ! আস্ত আরেকটা ভাষা। জিহ্বার স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ নিয়ে সে দেশ তো হারিয়েই গেছে কবে। মেঘমল্লারের বিপ্রলম্ভ আলাপে সে কি আর ফিরবে কখনও?
(সমাপ্ত)