ধোলাভিরা : ভারতের ৪০ তম হেরিটেজ সাইট; হরপ্পার মেট্রোপলিটন

ভারতের জন্য আরো একটি গর্বের সময়। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আরকিওলজিক্যাল সাইটের তালিকায় যুক্ত হলো ভারতের আরো একটি জায়গার নাম। এই জায়গাটিকে বলা হতো হরপ্পা যুগের মেট্রোপলিটন । গুজরাতের কচ্ছের রণের থেকে মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গাটি বর্তমানে হয়ে উঠেছে ভারতের ৪০ তম বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান, গুজরাটের মধ্যে চতুর্থ। ইতিমধ্যেই অনেকে হয়তো বুঝতে পারছেন, কোন জায়গার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, জায়গাটি হল গুজরাটের ভুজ শহরের  মধ্যে অবস্থিত ধোলাভিরা (Dholavira)।

এই জায়গাটি ৪৫০০ বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার বহু কাহিনী আমাদের জানায়। তাদের জীবনযাপন, তাদের সমাজ ব্যবস্থার ধারণা আমাদের মধ্যে জাগরিত করতে পারে ধোলাভিরা (Dholavira)। ১৯৬৮ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ জগৎপতি জোশী এই জায়গাটিকে প্রথমবার আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে প্রত্নতত্ত্ববিদ রবীন্দ্র সিং বিষ্ট এই জায়গাটির খননকার্য করেন।

ধোলাভিরা : ভারতের ৪০ তম হেরিটেজ সাইট; হরপ্পার মেট্রোপলিটন

ধোলাভিরা ধ্বংসাবশেষ | ছবি সৌজন্যে: Google

এই খননকার্যের পরে উঠে আসে এই জায়গার ব্যাপারে আরো কিছু অত্যাশ্চর্য তথ্য যা এই জায়গার মান এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। খননকার্যের ফলে এখানে যে সমস্ত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সব থেকে আশ্চর্যজনক হল কিছু সাদা রঙের পাথর। সাধারণ সাদা রঙের পাথর হলেও এগুলি যে ভাবে সাজানো ছিল, তা দেখে অবশ্যই বলতে হয়, এই পাথরগুলি ছিল  একটি বৃহৎ সাইনবোর্ডের অংশ। এরকম ১০টি সাইনবোর্ড মিলেছে এই ধোলাভিরায়। সমস্ত সাইনবোর্ড লেখা হয়েছিল হরপ্পা সভ্যতার লিপিতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হরপ্পা সভ্যতার কোন লেখা এখনো পর্যন্ত পড়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তাই এখানে আসলে কি লেখা ছিল, তা আজ অবধি অজানা।

বিশ্বের প্রথম সাইন বোর্ড, তাও আবার ভারতে! বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরেই  প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রধান পছন্দের স্থান হয়ে ওঠে গুজরাটের এই ধোলাভিরা। খননকার্যের ফলে জানা যায়, এই জায়গায় নাকি আগে সিন্ধু সভ্যতার একটি বড় শিল্প নগরী ছিল, যা সময়ের বিবর্তনের ফলে কোথাও হারিয়ে যায়।

এই জায়গার মানুষ সেই যুগেও ছিলেন যুগের থেকে এগিয়ে। হরপ্পা সভ্যতার এই জায়গাটির গঠন এবং এই সম্পূর্ণ শহরের মানচিত্র দেখলেই বোঝা যায়, শুধুমাত্র যে এই শহর ব্যবসার দিকে এগিয়ে ছিল তা কিন্তু নয়, বরং এই শহরের মানুষেরা বিজ্ঞানের দিক থেকেও সমসাময়িক সভ্যতার মানুষের থেকে এগিয়ে ছিল।

তাদের কাছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে জলের সংরক্ষণ, সবকিছুর জ্ঞান ছিল তুখোড়। খননকার্যের ফলে জানা গিয়েছে, ধোলাভিরা (Dholavira) শহরটিতে ছিল একটি সুরক্ষিত দুর্গ। সেটি ছাড়া ছিল দুটি শহর, অর্থাৎ ধোলাভিরা তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল। এই জায়গাটিতে মিলেছে বেলে পাথর এবং চুনা পাথরের তৈরি বাড়ি, যেগুলি হরপ্পা সভ্যতার অন্যান্য জায়গার থেকে বেশ উন্নত।

এছাড়াও, এই জায়গাটিতে উদ্ধার হয়েছে কিছু ট্যাঙ্ক এবং জল সংরক্ষণের চেম্বার, কিছু সুন্দর দরজা, বৌদ্ধ স্তুপের মতো কিছু হেমিস্ফিয়ার আকৃতির মন্দির এবং অত্যাধুনিক মানের কিছু স্থাপত্য। এছাড়াও পাওয়া গেছে দুটি খেলার মাঠ। এদের মধ্যে একটি মাঠ ব্যবহার করা হতো পূজো পার্বণ এবং অনুষ্ঠানের জন্য এবং অন্য মাঠ ব্যবহৃত হতো বাজার এবং বিক্রয়কেন্দ্র হিসেবে।

তবে এই শহরের সব থেকে নজরকাড়া বিষয়টি হলো এর জলনিকাশি ব্যবস্থা। সেই যুগে জল নিকাশি ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না কোনো জায়গাতেই। কিন্তু ধোলাভিরা শহরের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল অন্যরকম। এই জায়গাটিকে দুদিকে দুটো নদী ঘিরে রাখে। দুটি নদীর নাম যথাক্রমে – মনসার, এবং মানহার। ৯টি জল সংরক্ষণকারী ট্যাঙ্কের মাধ্যমে এই দুটি নদীর জল সংরক্ষিত রাখা হতো।

ধোলাভিরা : ভারতের ৪০ তম হেরিটেজ সাইট; হরপ্পার মেট্রোপলিটন

ধোলাভিরা ধ্বংসাবশেষ | ছবি সৌজন্যে: Google

৩০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করা এই হরপ্পান শহরটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবথেকে আকর্ষনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে উঠে এসেছে। একটি দুর্দান্ত জল নিকাশি ব্যবস্থা, তার সাথে সাথেই জলের ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা প্রমাণ করে ধোলাভিরার উন্নতির চিত্র। তার পাশাপাশি এই জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় একটি অদ্ভুত কবরস্থান। তবে কবরস্থান থাকলেও, অন্যান্য সিন্ধু সভ্যতার শহরের মতো এখানে কিন্তু মৃতদেহর নিদর্শন তেমন একটা মেলেনি। এই বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে এখনো একটি বিস্ময়। এই জায়গাটি মিশরের গ্রেট পিরামিডের থেকেও পুরনো। হরপ্পা সভ্যতার পাঁচটি সবথেকে বড় মেট্রোপলিটনের মধ্যে অন্যতম ছিল ধোলাভিরা।

তবে শুধুমাত্র যে, সভ্যতার স্থাপত্যের দিক থেকে ধোলাভিরা উন্নত তা কিন্তু নয়। এখানে তৈরি হতো বেশ কিছু উন্নত মানের গয়না। রুক্ষ জলবায়ু এবং সমুদ্রতীরবর্তী অবস্থানের কারণে এই জায়গায় সিন্ধু সভ্যতার সবথেকে বড় বন্দরগুলির মধ্যে একটি অবস্থিত ছিল। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা জীবনধারণের জন্য ব্যবসা এবং চাষাবাদ ছাড়াও তৈরি করতেন বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় গহনা এবং উন্নত মানের কারুকার্য।

ধোলাভিরার তৈরি  বিডস (এক ধরনের পুঁতি যা দিয়ে মালা তৈরি হয়) সিন্ধু সভ্যতার  সবথেকে আকর্ষনীয় জিনিসের মধ্যে একটি ছিল। তার সঙ্গেই তামা, ঝিনুক, এবং বিভিন্ন ধরনের রকমারি পাথর দিয়ে তৈরি গহনা বিক্রি হতো দেদার। তামার জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, অর্থাৎ এই অঞ্চলের মানুষ ধাতু শংকর তৈরি করতে পারতেন, যা সেই যুগে একেবারেই বিরল। মনে করা হচ্ছে বর্তমানের রাজস্থান, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে তামার তৈরি জিনিস বিক্রি করা হতো।

এছাড়া তৈরি হতো টেরাকোটার বিভিন্ন ধরনের কারুকার্য। সোনা এবং রুপা জাতীয় বেশ কিছু জিনিস এই জায়গা থেকে মিলেছে। হরপ্পার শহরগুলির মধ্যে যোগসুত্র গড়ে দিত এই ধোলাভিরা। এই এলাকার বিভিন্ন জিনিস মেসোপটেমিয়া, কিংবা বর্তমান ইরাকেও মিলেছে। এই সমস্ত বিষয় থেকে প্রমাণিত হয়, হরপ্পা সভ্যতার এবং অর্থনীতির উন্নতির পিছনে অনেক বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল গুজরাটের ধোলাভিরা।

ধোলাভিরা : ভারতের ৪০ তম হেরিটেজ সাইট; হরপ্পার মেট্রোপলিটন

ধোলাভিরা ধ্বংসাবশেষ | ছবি সৌজন্যে: Google

কিন্তু, কালের পরিবর্তনে, সিন্ধু সভ্যতার বড় আকর্ষণ ধোলাভিরাও কোথাও একটা হারিয়ে যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, ধোলাভিরার হারিয়ে যাবার পিছনে মূলত কারণ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা অনুযায়ী, ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধোলাভিরা শহরে এবং আশেপাশের অঞ্চলে ভয়ানক খরা পরিস্থিতি দেখা যায়। নদীগুলি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ধোলাভিরা শহরে চাষাবাদের সমস্যা শুরু হয়। প্রাণ বাঁচাতে ওই অঞ্চলের মানুষ গঙ্গা নদীর তীরে অথবা মহারাষ্ট্রে পাড়ি দিতে শুরু করে।

তবে এই নিয়ে মতান্তর রয়েছে। একদল যেমন মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ধোলাভিরার পতন হয়েছে, সেখানেই অন্যদলের ধারণা মেসোপটেমিয়ার পতনের জন্য ধোলাভিরার পতন হয়েছে। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার মেলবন্ধনের ইতিহাস বহুদিনের। হরপ্পা অঞ্চলের বাসিন্দারা যেহেতু সমুদ্র দিয়ে বেশি যাতায়াত করতেন তাই তাদের মূল গন্তব্য ছিল  মেসোপটেমিয়া। হরপ্পা সভ্যতায় যা যা জিনিস তৈরি হতো সব জিনিস বিক্রি হতো মেসোপটেমিয়ার বাজারে। কিন্তু মেসোপটেমিয়া সভ্যতার হঠাৎ পতন হওয়ায় হরপ্পা সভ্যতার ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। হরপ্পা সভ্যতার ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যেহেতু ধোলাভিরা, তাই এই শহরটির অস্তিত্ব ধীরে ধীরে শেষ হতে শুরু করে। আসতে আসতে কালের পরিবর্তনের সাক্ষী থেকে ইতিহাসের পাতায় কোথাও একটা হারিয়ে যায় হরপ্পার মেট্রোপলিটন তথা ভারতের গর্ব ধোলাভিরা।

More Articles