পৃথিবীতে প্রথম লৌহযুগের শুরু তামিলনাড়ুতে! যে রিপোর্ট বদলে দিতে পারে ইতিহাস

Tamil Nadu Iron Age: ৩৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে অঙ্কের বিচারে সাড়ে পাঁচ হজার বছর আগে তামিলভূমে লোহার উৎপাদন (iron smelting) এবং ব্যবহার ছিল।

সম্প্রতি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন কর্তৃক প্রকাশিত একটি রিপোর্ট ইতিহাস চর্চার দুনিয়ায় ঝড় তুলেছে। তামিলনাড়ু স্টেট ডিপার্টমেন্ট অফ আর্কিওলজি এই রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছে যার শিরোনাম 'অ্যান্টিকুইটি অফ আয়রন: রিসেন্ট রেডিওমেট্রিক ডেটস ফ্রম তামিলনাড়ু'। এই রিপোর্টের মূল বিষয়বস্তু হলো, ৩৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে অঙ্কের বিচারে সাড়ে পাঁচ হজার বছর আগে তামিলভূমে লোহার উৎপাদন (iron smelting) এবং ব্যবহার ছিল। এই দাবি যদি সত্যি হয়, তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে এতদিন পর্যন্ত লোহার আবিষ্কার ও ব্যবহার সংক্রান্ত যে ধারণা ইতিহাস চর্চায় আছে তার সংশোধন আবশ্যক। স্ট্যালিন যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এই আবিষ্কার সত্য হলে পৃথিবীতে প্রথম তামিলনাড়ুতেই লোহার ব্যবহার শুরু হয় বা লৌহযুগের সূচনা হয় এই রাজ্যে। এই দাবি নতুনভাবে প্রশ্ন তুলেছে ধাতু ব্যবহারের নিরিখে যুগ বিভাজনের ভাবনাটিকে যাতে বলা হয়েছে প্রস্তর যুগ থেকে তাম্র ও ব্রোঞ্জযুগ এবং তারপরে লৌহযুগ— এ ভাবেই সভ্যতা এগিয়েছে। কিন্তু তামিলনাড়ুর আবিষ্কার দেখাচ্ছে যে দাক্ষিণাত্যে যখন লোহার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে তখন উত্তর ভারতে তাম্রযুগ। তামিলনাড়ুতে তাম্রযুগের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ সেভাবে না থাকায়, এ প্রশ্নও উঠছে যে তাহলে কি তামিলনাড়ুতে নিওলিথিক যুগ থেকে লৌহযুগে সরাসরি উলম্ফন ঘটেছিল?

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে, আর শিবনন্থন ও অধ্যাপক কে রাজন লিখিত এই প্রতিবেদনটির মূল ভিত্তি হলো তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন জেলার শিবগালাই, মাঙ্গাদু, কিলনমান্ডি, থেলুঙ্গানুর এবং আদিচানাল্লুর থেকে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত বেশ কিছু শবাধার যাতে পাথরের কফিন ও নানা ধরনের অতিপ্রাচীন লোহার সামগ্রী আছে। এর মধ্যে শিবগালাইয়ের নিদর্শনগুলোর মধ্যে কোনও কোনওটি ২ হাজার ৯৫৩ থেকে ৩ হাজার ৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। এই প্রসঙ্গে এও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এতদিন পর্যন্ত কোনও নমুনার বয়স নির্ণয় করার ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিকরা কার্বন ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। কিন্তু সেই পদ্ধতিএকশ শতাংশ সঠিক কিনা তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বহু প্রশ্ন ছিল। কিন্তু তামিলনাড়ুর নিদর্শনগুলোর ক্ষেত্রে কার্বন ডেটিংয়ের পরিবর্তে অ্যাক্সিলারেটর মাস স্পেকটোমেট্রি (এএমএস) এবং অপটিক্যালি স্টিমুলেটেড লুমিনসেন্স (ওএসএল) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে যা সারা পৃথিবীতে এই বিষয়ে সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃত। এই আধুনিক রেডিওকার্বন ডেটিং বিশেষ করে এএমএস শবাধারের পাত্রগুলো এবং খননকার্যের এলাকা থেকে প্রাপ্ত চারকোল ও অন্যান্য অর্গানিক বস্তুগুলোর সঠিক বিশ্লেষণ করতে অপরিহার্য।

আরও পড়ুন-মানুষ মরে গেলে কবর দিতে হয়, কবে শিখল আদিম মানুষ?

আজকাল যেমন ইতিহাসের আলোচনা থেকে শত গুণ দূরে থাকা মানুষেরা নিজের এবং কোনও সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর কল্পনাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাস বলে পেশ করেন, তামিলনাড়ুর এই দাবিগুলোর ক্ষেত্রে সেটা বলা যাবে না। ইতিহাস চর্চার নিয়ম মেনে, অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে গোটা বিষয়টা সম্পাদন করেছে তামিলনাড়ুর আর্কিওলজি মন্ত্রক। এই নিদর্শনগুলোর ফলাফল প্রথম বিশ্লেষণ করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির বেটা অ্যানালেটিক টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা সেই বিশ্লেষণের ফলাফল ২০২১, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তামিলনাড়ু সরকারের হাতে আসে। ভারতের দু'টি অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান, যথাক্রমে বীরবল সাইনি ইন্সটিটিউট অব প্যালিওসায়েন্স (লখনউ) এবং ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (আমেদাবাদ) শিবাগালাই সমাধিস্থল থেকে প্রাপ্ত নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করেছে। এই প্রতিবেদনটিকে পাঠানো হয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের কাছে যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দিলীপ কুমার চক্রবর্তী, ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের প্রফেসর ওসমুন্ড বোপেরাচ্চি, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন অধিকর্তা ডাঃ রাকেশ তিওয়ারি প্রমুখ। এই বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত দিয়েছেন যা এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

তামিলনাড়ুর খননকার্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে আমাদের ইতিহাস চর্চায় লৌহযুগের সূচনা সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণাটিকে আরেকবার ফিরে দেখতে হবে। মনে করা হয়, হিটাইটরা যারা ছিল প্রাচীন অ্যানাতোলিয়ান সভ্যতার (১৬০০-১১৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), আজকের দিনের তুরস্কে প্রথম লোহা আবিষ্কার ও তার থেকে যন্ত্রপাতি তৈরি করা শুরু করে। এর কারণ শুধু লোহার যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র বা অলঙ্কার তৈরি নয়, একই সঙ্গে হিটাইট কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে লোহা (an.bar or iron) শব্দটির উল্লেখও আছে। প্রাচীন যুগে লোহা দু'ভাবে পাওয়া যেত— উল্কাপাতের ফলে ও আকরিক গলনের মাধ্যমে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, আকরিক গলিয়ে তার থেকে লোহা বার করার জ্ঞানের মধ্যে দিয়েই লৌহযুগের সূচনা। লোহার নমুনা হিসাবে প্রাচীন যুগে যে নয়টি জপমালা পাওয়া গিয়েছিল, মনে করা হয় সেটা উল্কাপাতের ফলে প্রাপ্ত লোহা থেকে তৈরি। এক্ষেত্রে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো, লোহা আছে এমন শিলা চিহ্নিত করা। তারপর ফার্নেসে উচ্চ তাপমাত্রায় তাকে গলানো এবং পরে দক্ষ কারিগর (ironsmiths) দ্বারা সেই লোহা থেকে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি।

কোন লোহা উল্কা থেকে পাওয়া গেছে তা বোঝার উপায় হলো, তাতে নিকেলের পরিমাণ বেশি থাকবে। তুতেনখামেনের পিরামিডে শবাধারের পাশে (মৃত্যু ১৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রাপ্ত ছুরিকার লোহা বিশ্লেষণ করে তাতে নিকেলের পরিমাণ পাওয়া গেছে দশ শতাংশের বেশি যা প্রমাণ করে ওই ছুরিকা উল্কাপাত থেকে প্রাপ্ত লোহা থেকে তৈরি। এই হিটাইটরা যে লোহা উৎপাদন করত, তার যে ব্যাপক চাহিদা ছিল, তা জানা যায় ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আসিরীয় বণিকদের বিবরণী থেকে। এখানে এই ফার্নেসে গলন প্রক্রিয়াটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তরযুগের থেকে তাম্রযুগে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধাতু সম্পর্কে জ্ঞানের অগ্রগতি। আকরিক থেকে তামা নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজন অন্তত ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফার্নেসে গলন যার ফলে গলিত তামা পাওয়া যাবে। পরবর্তীকালে এই তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জ তৈরি হলো যা ধাতু বিদ্যার আরও অগ্রগতি ঘটিয়ে ব্রোঞ্জযুগ শুরু করল। লোহার গলন আরও জটিল প্রক্রিয়া কারণ লোহার গলনাঙ্ক প্রায় ১৫০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি। এক্ষেত্রে প্রচলিত ধারণা হলো, লৌহ আকরিক গলনের দক্ষতা অর্জনের ন্যূনতম শর্ত হলো তামা গলানোর কৌশল জানা। তাই তাম্রযুগ থেকে ব্রোঞ্জযুগ হয়ে লৌহযুগে প্রবেশ করা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি।

ইতিহাস চর্চায় হিটাইটরা লোহা আবিষ্কারের কৃতিত্ব লাভ করলেও দীর্ঘ দিন ধরে পৃথিবীর নানা জায়গায় চলা খননকার্য এই স্বীকৃতির বিরোধ করছিল। এক্ষেত্রে বলা যায় তামিলনাড়ুতে গত ৫ বছর ধরে চলা খননকার্যের কথা। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিবাগালাইয়ের নমুনাটি ৩৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। কিন্তু এটা কোনও ব্যতিক্রমী উদাহরণ নয়। এখানকার দুটো সেরামিক নমুনায় যে লোহা পাওয়া গেছে তার বয়স যথাক্রমে ২১৯৯ এবং ২১৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আদিচানালুর ট্রেঞ্চে কালো ও লাল দুটো পাত্র পাওয়া গেছে যাদের বয়স ২০৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মাইলাদুরাইতে প্রাপ্ত লৌহ শবাধারের বয়স যথাক্রমে ২১৭২ ও ১৬১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সালেম জেলার মেট্টুর তালুকের মানগাডুতে একটা তরবারি পাওয়া গেছে যা হাই কার্বন স্টিলের, যার বয়স ১৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এছাড়া কোডুমানালে একটা ফার্নেস পাওয়া গেছে যার গভীরতা ৬৫ সেমি এবং ব্যাস ১১১ সেমি। এগুলো সূচনামাত্র কারণ প্রত্নতাত্ত্বিকরা যে বিশাল ক্ষেত্র চিহ্নিত করছেন, তার মাত্র দশ শতাংশ এলাকায় খনন কার্য শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন-আদিম মানুষের ক্যালেন্ডার আবিষ্কার হলো যেভাবে…

তামিলনাড়ুর এই প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনাগুলোর বয়স নির্ণয় অবশ্যই ইতিহাসের চূড়ান্ত কথা নয়, সূচনামাত্র। এই আবিষ্কারগুলো একাধিক প্রশ্ন ও সম্ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। প্রথম কথা হলো ৩৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হচ্ছে উত্তর ভারতের বিচারে প্রথমদিকের হরপ্পা সভ্যতা যা কিন্তু তখন ছিল তাম্রযুগের সভ্যতা। তাহলে এখনও পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতায় লোহার নমুনা পাওয়া গেল না কেন? আবার যেহেতু নিম্ন তাপমাত্রায় তামা গলানো সহজ পদ্ধতি, তাহলে তামিলনাড়ুতে তাম্রযুগের সেরকম প্রমাণ মেলেনি কেন? অথচ সেখানে লোহা গলানোর আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ঘটল কীভাবে? এক্ষেত্রে একটা তত্ত্ব হলো, যেহেতু রাজস্থানের ক্ষেত্রি সহ বহু জায়গায় তামার আকরিক সুলভ ছিল তাই সেখানে তাম্রযুগ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে পরিযায়ী মানুষ যখন দক্ষিণ ভারতে পৌঁছয় তখন তারা তামা না পেয়ে সুলভ লৌহ আকরিক দিয়ে বিগলন প্রক্রিয়া শুরু করে এবং সেখানে তাম্রযুগের সমসাময়িক হিসাবে লৌহযুগের বিকাশ হয়। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় জট হলো, সিন্ধু লিপির অর্থ উদঘাটনে আমাদের ব্যর্থতা। সেই লিপির অর্থ প্রকাশিত হলে হয়তো ধাতু বিষয়ক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু ধাতুর যুগ বিকাশের সাধারণ ধারণাটি যে সরলরৈখিকভাবে সব জায়গায় প্রযুক্ত হয় না তা আজ স্পষ্ট।

তামিলনাড়ু থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো থেকে সম্পূর্ণ তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব না হলেও কতগুলো সাধারণ বিষয় সম্পূর্ণ স্পষ্ট। পৃথিবী বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক ডেভিড কিলিক তাঁর সাম্প্রতিক রচনায় (ফ্রন্টলাইন, ১৭ মার্চ, ২০২৫) বিষয়টি নির্দিষ্ট করে উপস্থিত করেছেন। প্রথম বিষয়টি হলো, এই সামগ্রিক খননকার্য স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তামিলনাড়ুতে লোহার ব্যবহার ছিল। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো মাইলাদুমপারাইয়ের চারকোল নমুনার বয়স ১৮৫০-১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তৃতীয় বিষয়টি হলো শিবাগালাই থেকে প্রাপ্ত নমুনাগুলোর বয়স ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হওয়া সম্ভব। এই পর্যবেক্ষণ হিটাইটরাই লোহার আবিষ্কারক — এই সিদ্ধান্তকে অনেকাংশেই ভুল প্রমাণ করে। একইসঙ্গে এ দেশের ক্ষেত্রেও এই আবিষ্কার নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা এক সুপ্রাচীন ও সমৃদ্ধ সভ্যতা হিসাবে আর্যাবর্তের সভ্যতার বিকাশের বহু আগেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আজকের ভারতের শাসকদের ইতিহাসবোধের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার তাই খুব স্বস্তির নয়। স্ট্যালিনের সাংবাদিক সম্মেলন ও রিপোর্ট প্রকাশের পর দিল্লির শাসকদের নীরবতা তাই ভীষণই অর্থবহ।

More Articles