আলোর খোঁজে বেরিয়ে কি অন্ধকারেই পা বাড়াল বাংলাদেশ?

Bangladesh Unrest: কার্যত বিরোধীশূন্য ‘গণতন্ত্র’ চালালেও বিভিন্ন সময়ে ছাত্রছাত্রীরা এই সরকারের বিরুদ্ধেই রাস্তায় নেমেছে। সেটা ২০১৮ এর প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনই হোক বা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন বা 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলন।

ঢাকার ধানমন্ডিতে এক হাসপাতালের সামনে সম্প্রতি বাংলাদেশের পর্বতারোহী শায়লা বিথীর উপরে হামলা করে এক যুবক।'প্রথম আলো' সূত্রের খবর হাসপাতালটির সামনের পদচারী-সেতু থেকে নীচে নামার সময় এক ব্যক্তি পিছন থেকে হঠাৎ তাঁর চুল মুঠি ধরে তাঁকে টেনে নীচে ফেলে মারধর করেন। শায়লা বিথীর অনুমান, তাঁর পোশাকের কারণেই তাঁর উপরে এই হামলা। তবে তিনি একা নন। বাংলাদেশের সাংবাদিক ঝর্ণা রায় তাঁর স্বামী ও পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় খাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলতে বলতে গেলেন— ‘মাথায় কাপড় না দিয়ে বেহায়ার মতো রাস্তার পাশে বসে খাচ্ছে, লজ্জা শরম নেই?’

কিছুদিন আগেই মাইশা মাহজাবীন ফেসবুকে শুধু নারীদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন— রাস্তায় ‘ক্যাটকলিং’ (বাজে মন্তব্য) বেড়েছে কি না? তাঁর সেই পোস্টে নারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁরাও পোশাক-সহ বিভিন্ন কারণে নাজেহাল হয়েছেন রাস্তাঘাটে এবং এ ধরনের ঘটনাগুলো ইদানীং বেড়েছে বলেই তাঁদের ধারণা। লামিসা জামান নামে এক মহিলা ফেসবুকে লিখেছেন, তিনি শাড়ি পরে বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। পেটের কিছু অংশ দেখা যাওয়ায় কয়েক জন তাঁকে 'তুই' করে সম্বোধন করে শাড়ি ঠিক মতো পরার উপদেশ দেন। ‘ওড়না নেই কেন’, ‘টিপ দিয়েছে কেন’, ‘চুল ছোট কেন?’— শুধু ঝর্ণা রায় বা লামিসা জামান বা শায়লা বিথী নন, এমন অনেক প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে হয় এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, নারী উদ্যোক্তা-সহ বিভিন্ন পেশার নারীকেই।

আরও পড়ুন: সেনার হাতে বড় ক্ষমতা দিল ইউনূস সরকার! কী কী করতে পারে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী?

হাসিনা সরকার পতনের পর পর, অগস্টের শেষ দিকে শ্যামলী এলাকায় নীল পাইপ দিয়ে যৌনকর্মীদের পিটিয়েছিলেন এইচ এম রাসেল সুলতান নামে এক যুবক। তার পর থেকেই বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের এই ঘটনাগুলি ক্রমবর্ধমান ভাবে সামনে আসতে শুরু করে। অথচ বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন কভার করতে চলতি বছরের জুলাই মাসে যখন বাংলাদেশ গেলাম, তখনও কিন্তু পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন।

"আমার বাপের টাকায় আমারে গুলি করব! ফাইজলামী হচ্ছে?"

রাস্তায় কেন? — প্রশ্ন করায় জবাব দিলেন এক আন্দোলনকারী ছাত্রী। সেদিনই বুঝেছিলাম, গণতন্ত্রকে নিয়ে 'ফাইজলামী' আর বরদাস্ত করবে না বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ। হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো চোখে চিৎকার করে স্লোগানে সাড়া দিচ্ছেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। জিজ্ঞেস করলে বললেন এত এত লাশ দেখে ঘরে বসে সারারাত কেঁদেছেন, তাই আজ রাস্তায় নেমেছেন কান্নার হিসাব চাইতে। বিচার চাইতে। পেশায় তিনি রিকশাচালক। ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল অধিকাংশ সাধারণ মানুষই এই মিছিলে হাঁটছেন লাশের হিসাব চাইতে, তার আগে পর্যন্ত এই সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের এত ক্ষোভ ছিল না। হাসিনা সরকার দেশে ইলেক্ট্রিসিটি থেকে শুরু করে যানবাহন, শিল্প, সমুদ্র বন্দর ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বেশ কিছু ভালো কাজ করেছেন। আর দুর্নীতি?

সর্বশেষ ভোটে, ইলেকশন কমিশনের ডেটা অনুযায়ী ভোট পড়েছিল মাত্র ২৮%। বেসরকারি হিসাব ১০-১৫%। বিরোধীদের অভিযোগ, এই ভোটও আওয়ামী লীগের কর্মীদেরই দেওয়া, ভোটের আগের দিন রাতে। সম্পূর্ণ বিরোধীশূন্য রাজনীতি, রাতের অন্ধকারে হয়ে যাওয়া ভোটও সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছিলেন। সেখানকার কৃষক যে পিঁয়াজ বিক্রি করে ১০ টাকা পান, সেই পিঁয়াজ তিনি বাজার থেকে কেনেন ২৫০ টাকায়। লঙ্কা ৬০০ টাকা কেজি। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। তা-ও মেনে নিয়ে দিব্যি চলছিলেন মানুষ। তাহলে টোকাটা লাগল কোথায়?

বাংলাদেশের সরকারই যে শুধুমাত্র দুর্নীতিপরায়ণ তা কিন্তু নয়, বাংলাদেশের সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট। পরিবহন থেকে হোটেল ব্যবসা থেকে বর্ডারে মানুষ পারাপারের কাজ- প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে রয়েছে দুর্নীতি। ভারত থেকে ফেরা বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে ৫০/১০০ টাকা চা-নাস্তার জন্য চাওয়া, উত্তরে প্রত্যেকের কাছ থেকে একই জবাব আসে ‘চিকিৎসায় সব টাকা শেষ মামা, দেওয়ার মত আর টাকা নাই‘। বোঝা যায় ইমিগ্রেশনের আরো পাঁচটা প্রক্রিয়ার মতো এটিও একটি প্রক্রিয়া, তাই এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। আর সেখানকার কতৃপক্ষও অনায়াসে নির্দ্বিধায় দিনের আলোয় সরাসরি ঘুষ চেয়ে ফেলেন। ভারতীয় নাগরিকদের কাছ থেকেও এই টাকা চাওয়া হয়, তবে সেটা অন্য উপায়ে। কোনও না কোনও খুঁত বের করা হয় ফাইন নেওয়ার ছুতো হিসেবে। অথচ সে ফাইনের রশিদ চাইলেই সাইডে অন্য কাউন্টারে নিয়ে গিয়ে কিছু প্রশ্ন করে ছেড়ে দেওয়া হয়। হোটেল ম্যানেজার হোটেল ছাড়ার সময় চা-নাস্তার জন্য ৫০ টাকা চান। সমাজে নিরাপত্তাহীনতা এতটাই যে খেটে খাওয়া মানুষও বাড়তি কিন্তু অন্যায্য রোজগারের জন্য আগ্রাসী থাকেন। যে দেশে দুর্নীতিটাই নীতি,সে দেশে দুর্নীতির জন্য কোনও সরকারকে মানুষ গদিচ্যুত করতে পারে কিনা সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, বিগত দশকে ঢাকা শহরে বোরখা পরিহিতা মহিলার সংখ্যা বেড়েছে। অনেকে বলবেন আরব ইনফ্লুয়েন্স। কালচারাল ইম্পেরিলিজম। কিছুটা ঠিকই। তবে বিষয়টা এতটা সরলরৈখিক নয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বাংলাদেশের একটা বড় অংশের মানুষ আরবে কাজে যান এবং সেখানকার কালচার নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসেন তার সঙ্গে নিয়ে আসেন কাঁচা টাকা। বোরখা মানে মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত মোড়া একটি পোশাক, যে পোশাক তৈরি করতে লাগে বেশ অনেকটা কাপড়। বোরখা নিজে কোনও স্বতন্ত্র পোশাক নয়, এটি পরা হয় অন্য একটি পোশাকের উপরে। গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে এই বাড়তি পোশাক কেনার টাকা থাকে না অনেক সময়ই। তাই নিয়মিত বোরখা পরার চলও ছিল কম। কিন্তু আরবে যাওয়ার পরে বোরখার প্রয়োজনীয়তা এবং তা কেনার টাকা দু'টোই মানুষ সঙ্গে করে নিয়ে আসে বাংলাদেশে। ফলত চল বাড়ে। এ তো গেল গ্রামের বিশ্লেষণ। শহরে আসি। তৃতীয় লিঙ্গ এবং সমকামীদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায় বোরখা পরিহিতা মেয়েদের। বিভিন্ন ক্যাফে থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডা, রাস্তার মিছিলে দেখা মেলে হিজাব কিংবা বোরখা পরিহিতা মেয়েদের।

সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী অঙ্কটা মেলে না। আমি যদি বলি বোরখাকে মেয়েরা ব্যবহার করছে সেল্ফ ডিফেন্সের উদ্দেশ্যে? এমন কাজ যা করলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তা-ই তারা করে বোরখা পরে। যাতে প্রথমেই বেশ কিছু আঙুলকে নামিয়ে দেওয়া যায়, যারা সরাসরি তাঁদের পোশাক নিয়ে, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আবার অনেক সময় বোরখা একটি ক্যাজুয়াল আউটফিট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্লাসে ছুটতে হবে, মেকআপের সময় নেই। তাই বোরখা পরে নিলাম— এমনটাও কিন্তু ঘটে। বোরখার সঙ্গে চল বেড়েছে বিভিন্ন পশ্চিমা পোশাকের, যা আগে দেখা যেত কম। সংখ্যায় কমেছে বাঙালির নিজস্ব পোশাক। মেয়েদের পোশাকের এই বিশ্লেষণ দেখলেই সমাজের একটি ধারণা আপনাদের কাছে স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধারার মানুষ মিলেমিশে রয়েছেন। সেখানে মৌলবাদের চোখরাঙানি রয়েছে, পশ্চিমের লিবারেশন রয়েছে আবার ভীষণ ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচও রয়েছে। তবে মৌলবাদের চোখরাঙানির পরিমাণ মাপলে বোঝা যায়, হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত ছিল। তা যে এতদিন পর হল সেটাই আশ্চর্যের।

কার্যত বিরোধীশূন্য ‘গণতন্ত্র’ চালালেও বিভিন্ন সময়ে ছাত্রছাত্রীরা এই সরকারের বিরুদ্ধেই রাস্তায় নেমেছে। সেটা ২০১৮ এর প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনই হোক বা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন বা 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলন। তবে তারা যে এই আন্দোলনগুলো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্য করেছে, এমনটা নয়। এমনকী সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই গণঅভ্যুত্থানেও যে সরকার গদিচ্যুত হবে, এই ধারণাও শিক্ষার্থীদের ছিল না অগস্ট পর্যন্ত। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেন ৫ অগস্ট। এই আন্দোলনেও ছিলেন বিভিন্ন ধারার মানুষ। বাংলাদেশের বামপন্থীরা যেমন এই আন্দোলনে ছিলেন তেমনই ছিলেন ইসলামিস্টরাও। এই আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক নেতা ছিল না, ছিল কিছু সমন্বয়ক। এটিই এই আন্দোলনের শক্তি, আবার দুর্বলতাও। ঢাকার রাস্তায় যখন হাঁটছি মিছিল কভার করব বলে, দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোটবড় মিছিল বেরোচ্ছে। কমবয়সীরা স্লোগান দিচ্ছে, বয়স্করা পা মেলাচ্ছেন। সেই মিছিলের নির্দিষ্ট কোনও নেতা নেই, দাবিও যে নির্দিষ্ট তেমনটাও নয়। প্রতি মুহূর্তে পটপরিবর্তন হচ্ছে। দাবি বদলাচ্ছে। ৯ দফার দাবি এসে থামল ১ দফায়। ‘দফা ১ দাবি ১, শেখ হাসিনার পদত্যাগ‘ স্লোগান উঠল কোনও একজনের কন্ঠে, বাকিরা সুর মেলাল। ক্রমেই ছাত্র আন্দোলন হয়ে গেল সরকার ফেলার আন্দোলন। এর পেছনে বিরোধীদের কী ভূমিকা রয়েছে জানি না। তবে আজ বাংলাদেশের যা অবস্থা তার জন্য হাসিনা সরকারই মূলত দায়ী। এত মৃত্যু, এত ঔদ্ধত্য মানুষ মেনে নিতে পারেননি। বাংলাদেশে আমার কাটানো শেষ রাত হাসিনা সরকারেরও শেষ রাত হবে তা বাংলাদেশ ছাড়ার সময় ভাবিনি, তবে এমন কিছু যে খুব শীঘ্রই হবে তা টের পাচ্ছিলাম। ৪ আগস্ট রাতে কারফিউ জারি হওয়ার পর যখন কোনওক্রমে একটি গাড়ি জোগার করে বেনাপোলের দিকে এগোচ্ছি, খবর পাচ্ছি বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাস শুরু হয়ে গিয়েছে। থানায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে বেশ কিছু পুলিশ কর্মীকে। আমাদের গাড়ি যখন মঙ্গলা পোর্ট পেরিয়ে গেল, তার দু'ঘন্টা পরই সেখানে বিক্ষুব্ধ জনতা টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করল, মানুষ অ্যাম্বুল্যান্সে লুকিয়ে দেশ ছাড়ছেন, অন্য গাড়ি আটকে দিচ্ছেন জনতা। তারা কেউই ছাত্র নয়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে তীব্র ভারত-বিদ্বেষ। তার অন্যতম একটি কারণ হল এই মঙ্গলা পোর্ট। এছাড়াও রয়েছে তিস্তা, কলকাতা থেকে আগরতলার ট্রেন-সহ আরও বেশ কিছু ইস্যু যা মূলত দুই দেশের সরকারের বিভিন্ন বৈদেশিক নীতি।

বাংলাদেশের মানুষ এগুলো ভালো ভাবে নেননি কারণ এগুলোতে বাংলাদেশের লাভ তাঁরা খুঁজে পাননি। অন্য দেশের দয়া দাক্ষিণ্যে বাঁচতে চায়নি বাংলাদেশ, সমান অধিকার সমান ভাগ চেয়েছিল। এই বিদ্বেষকে তলায় তলায় উস্কে দিয়েছে মৌলবাদ। ইতিহাস জানে, যেখানে গণতন্ত্রের গলা টেপা হয়েছে, সেখানেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ধর্মীয় মৌলবাদ। এখন বাংলাদেশের যা অবস্থা তার জন্যও এই দুটি কারণই দায়ী। শেখ মুজিবুর রহমানকে তার কন্যা প্রায় ঈশ্বরতুল্য করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশে। বিগত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ব্যবহার করেছে এই নাম নিজেদের স্বার্থে। মুজিবুর রহমান হয়ে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের প্রতীক। সেই রাগের বহিঃপ্রকাশই দেখা গিয়েছে বিভিন্ন মুর্তি ভাঙায়। তবে এতে যে জামাতিদের যোগসাজশ নেই তা-ও বলা চলে না।

আরও পড়ুন:ধর্ম বা রাজনীতি দিয়ে কোনও বাংলাদেশির সঙ্গে বৈষম্য হবে না! ইউনূসের আপ্তবাক্য ফলবে?

ইসলামে ভাস্কর্য নিষিদ্ধ। সরকার পতনের পর পরই হামলা হয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দু বাড়ি এবং মন্দিরে। পিটিয়ে মারা হয়েছে একমাত্র হিন্দু কাউন্সিলরকে। মারা হয়েছে কমিউনিস্ট নেতাদের। এ কাজ ছাত্রদের নয়। তারা এই বাংলাদেশ চায়নি এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। শেখ হাসিনা জামাতকে নিষিদ্ধ করার পরেও কোনও রকম রিয়্যাকশন দেয়নি তারা। কারণ তারা জানত, তাতে ছাত্র আন্দোলন ব্যহত হবে। অপেক্ষা করছিল সঠিক সময় আর সুযোগের। আফগানিস্তানের তালিবানি কায়দায় রাস্তায় নেমে পড়েছে জামাত। সরকার পতনের পর, লাশ ঝুলেছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, আগুন জ্বলেছে। হিন্দুদের বাড়িঘর মন্দিরে ডাকাতি হয়েছে, পুড়েছে।

ঠিক এমনটাই দেখা গিয়েছিল ৭১-এ। ঝালকাঠিতে এক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সাত পুরুষ ধরে তাঁরা রয়েছেন সেখানে। ৪৭ এর দেশ ভাগ, ৭১ এর স্বাধীনতা সবটাই দেখেছেন। একাত্তরের পরে কেন দেশে ফিরে এলেন জিজ্ঞেস করায় বললেন মাটির টান। তখন কিছু মুসলিম ভাই তাঁদের বলেছিলেন ফিরে আসতে। কিন্তু তারপরে সহ্য করতে হয়েছে অনেক অত্যাচার। বাড়িতে ডাকাতি থেকে শুরু করে জমিজমার মামলা। ভারতে থাকা আত্মীয়দের মৃত ঘোষণা করতে হয়েছে। যাতে জমি বেদখল না হয়ে যায়। হাসিনা সরকারে আস্থা আছে কিনা জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, আসলে সমস্ত সরকারই সমান। সংখ্যালঘুদের কোনও সরকার হয় না। ভারতে মুসলমানদের যে অবস্থা বাংলাদেশের হিন্দুদেরও একই অবস্থা। আবার কিছু মানুষ বলেছিলেন, হাসিনা সরকার আছে বলেই হিন্দুরা থাকতে পারছে নইলে এটুকু স্বাধীনতাও তারা পেতেন না।এখন তাঁরা কেমন আছেন সে খোঁজ আর আমার নেওয়া হয়নি। তবে বিভিন্ন সংবাদ সূত্র মারফত খবর, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আসার চেষ্টা করছেন।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এমন কোনও শক্তি নেই, যা একই সাথে দুর্নীতি এবং সাম্প্রদায়িকতাকে রুখবে। তবে ছাত্ররা আশা করছে, বিভিন্ন ছোট ছোট দল এবং ছাত্রদের সংগঠন মিলে এমন কোনও শক্তির জন্ম বাংলাদেশে হবে, যা আক্ষরিক অর্থে সোনার বাংলা তৈরি করবে। এ স্বপ্ন কতদূর সত্যি হবে তা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশ আশার আলো খুঁজতে গিয়ে অন্ধকারের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেল কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলাকে নিয়ে লিখেছিলেন,‘ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশস্মৃতি দিয়ে ঘেরা’। বাংলাদেশ সংস্কারের যে স্বপ্ন ছাত্ররা দেখেছিল, সে স্বপ্ন পূর্ণ হল নাকি আদতে ভঙ্গ হল, তা তারাই ভালো বলতে পারবে। আর আমরা এপার বাংলা থেকে শঙ্কায় থাকব কেবল এই ভেবে যে বাংলাদেশ শুধুমাত্র ‘স্বপ্ন’ আর ‘স্মৃতি’ হয়েই না থেকে যায়।

More Articles