দীপাবলি এবং দিওয়ালি-র মধ্যে মূল পার্থক্য কী? আজও যা অনেকেরই অজানা
Diwali vs Dipabali: অনেকেই ভাবেন, দীপাবলিকে হিন্দিতে দিওয়ালি (Diwali) বলে। কিন্তু দীপাবলি এবং দিওয়ালির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও একটি মূল বৈসাদৃশ্য আছে।
দুর্গাপুজো এবং লক্ষ্মীপুজোর পর বাঙালির মনে যে পুজো-শেষের বিষাদ জমেছিল তা কাটিয়ে ফেলছে কালীপুজোর আমেজ। কালীপুজোর দিন স্বাভাবিকভাবেই আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবসহ অনেকের শুভেচ্ছা বার্তা আসে। আর সেই শুভেচ্ছাবার্তায় ‘Happy Diwali’ বলার রেওয়াজও বিদ্যমান। ক্যালেন্ডার দেখলে বুঝতে পারবেন, দিওয়ালি আসলে দীপাবলির পরের দিন পালিত হয়। এ-বছর ২৪ অক্টোবর দীপাবলি বা কালীপুজো এবং ২৫ অক্টোবর দিওয়ালি। অনেকেই ভাবেন, দীপাবলিকে হিন্দিতে বুঝি দিওয়ালি (Diwali) বলে। কিন্তু দীপাবলি এবং দিওয়ালির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও একটি মূল বৈসাদৃশ্য আছে।
উত্তর ভারতীয় প্রথায় দিওয়ালি আসলে পাঁচ দিনের উৎসব। এই পাঁচ দিনের উৎসব বাংলার অঙ্গীভূত হয়েছে বটে, তবে তার কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন ঘটেছে এই বাংলায় এসে। দিওয়ালি মূলত পাঁচ দিনের একটি উৎসব। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে হলো, ধনতেরস বা ধনত্রয়োদশী, নরক চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশী, কার্তিক অমাবস্যায় কালীপুজো বা দীপাবলি, লক্ষ্মী-গণেশের পুজো, এবং গোবর্ধন পুজো বা অন্নকূট।
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে উৎসব শুরু হয় ধনতেরস দিয়ে। সারা ভারতে এই দিন পালিত হয় ধনতেরস। এই তিথিতে লক্ষ্মী, কুবের ও যমের পুজো করা হয়। মনে করা হয়, এই দিনেই হয়েছিল সমুদ্রমন্থন। এই সমুদ্রমন্থনের সময়ে যাবতীয় দৈব সামগ্রী এবং অমৃতের সঙ্গে উঠে এসেছিলেন মা লক্ষ্মী। তাই এই দিন ধন-সম্পদের জন্য মানুষ লক্ষ্মীপুজোও করে থাকে। একইভাবে কুবেরের কাছে থাকে দেবতাদের সম্পদ। তাই ধন-সম্পদের জন্য ওইদিন কুবেরের পুজোও প্রচলিত। মনে করা হয়, এই দিন কোনও ধাতুর দ্রব্য কিনলে তার মূল্য বৃদ্ধি পায় ১৩ গুণ। একই সঙ্গে এই দিন বাড়ির প্রবেশপথে দরজার দুই দিকে মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়। ধনতেরসের দিন যমরাজের-ও আরাধনা করা হয়।
এর পরের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন পালিত হয় ভূত চতুর্দশী। এইদিন অনেকে বাড়িতে বা বাড়ির ছাদে আকাশ-প্রদীপ জ্বালান। মনে করা হয়, এই প্রদীপের আলো পূর্বপুরুষদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে, তারা এসে বর্তমান প্রজন্মকে আশীর্বাদ দেন। এছাড়াও সেদিন চোদ্দ ভুবনের অধীশ্বরী দেবীর উদ্দেশে ১৪ দীপ দান করা হয় এবং চোদ্দশাক খাওয়ার রীতি রয়েছে। এছাড়াও ভূত চতুর্দশীর দিন অনেক পরিবারের চোদ্দ শাক খাওয়ার নিয়ম রয়েছে। এই চোদ্দ শাক হলো- ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হেলেঞ্চা, পলতা, শুলফা, গুলঞ্চ, ভাঁট পাতা, শুষনি শাক।
এর পরের দিন বাংলায় পালিত হয় কালীপুজো। প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথিতে মা কালীর আরাধনা করা হয় এখানে। পৌরাণিক মতে দীপাবলির দিনই অযোধ্যায় ফিরেছিলেন রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে। তাঁদের ঘরে ফেরার আনন্দে মেতে উঠে দেশবাসী আলোর রোশনাইতে। মূলত উত্তর ভারতে এবং হিন্দি বলয়ে এই দিন অথবা এর ঠিক পরের দিন, সুখ এবং সমৃদ্ধির জন্যে ঘরে ঘরে পুজো হয় লক্ষ্মী-গণেশের। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় অনেকের বাড়িতে, এদিন অলক্ষ্মী তাড়িয়ে মা লক্ষ্মীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং সেই উপলক্ষে লক্ষ্মীপুজো পালন করা হয়। অনিষ্টের ওপরে ভালোর জয়, অন্ধকারের ওপরে আলোকপাত এবং অজ্ঞতার ওপরে জ্ঞান লাভ করা। এই দিনগুলোতে অফিস, মন্দির এবং দোকানপাট, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, সবকিছু আলোয় আলোয় ভরিয়ে তোলা হয়। দিওয়ালি পালনের সময় ‘দিয়া’ বা মাটির তৈরি প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই উৎসবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে মানুষ আনন্দ করেন, বাজি ফাটান এবং রকমারি রঙের ফানুস আকাশে ওড়ান। এই সময়ে পরিবার-পরিজন এবং তাদের বন্ধুরা নাচ-গান করে, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে এবং উপহার বিনিময় করে। এছাড়াও অনেকের বাড়িতে আবির দিয়ে সুন্দর আলপনা বানানো হয়, যাকে ‘রঙ্গোলি’ বলা হয়। দক্ষিণ ভারতেও দীপাবলি উপলক্ষে আলপনা বানানো হয়। তবে আবির দিয়ে নয়, রংবেরঙের কুচো ফুল দিয়ে। একে ‘কোলাম’ বলে। রঙ্গোলি তৈরির উদ্দেশ্য কেবল সজ্জা নয়, প্রতিটি বাড়ির ভেতরে দেবী লক্ষ্মী এবং অন্যান্য অতিথিদের স্বাগত জানানোও বটে।

রঙ্গোলি
জ্যোতিষ-শাস্ত্র অনুযায়ী দিওয়ালি বা দীপাবলি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এটি নতুন চন্দ্র-বছরকে চিহ্নিত করে এবং মনে করা হয় ফসল কাটার জন্য এটিই যথাযথ সময়। জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী এইদিন গ্রহের অবস্থানগুলিও খুব অনুকূল হয় এবং তা সকলকে সম্পদ এবং সমৃদ্ধি প্রদানে সহায়তা করে। দীপাবলির উৎসবের দিনগুলিতে, সূর্য এবং চন্দ্র একত্রিত হয়, অর্থাৎ এই সময়টি সম্প্রীতি প্রচার করে। তাই এই উৎসব মানুষের জীবনে ভালবাসা, সম্পদ, আনন্দ, সুস্বাস্থ্য ও সুখের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

গোবর্ধন পর্বত
দিওয়ালির পরদিন পালিত হয় গোবর্ধন উৎসব। এই উৎসবে গোবর্ধন পর্বতকে পুজো করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের মায়া বুঝতে না পেরে ক্রুব্ধ হয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। প্রতিশোধ নিতে বৃন্দাবনের ওপর অবিরাম বর্ষণ শুরু করেন তিনি। সকল বৃন্দাবনবাসীকে বাঁচাতে এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে যোগ্য জবাব দিতে নিজের ক্ষমতা দেখান শ্রীকৃষ্ণ। ভাগবত পুরাণ অনুসারে মহাপ্রলয়ের রাতে শ্রীকৃষ্ণ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন গোবর্ধন পর্বত। এই গোবর্ধন পর্বতের নিচেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সমগ্র বৃন্দাবনবাসী।
সেই থেকে গোবর্ধন পর্বত এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে প্রতি বছর পালিত হয় এই গোবর্ধন উৎসব। এই উৎসবে মূলত ভাতকে (অন্ন) পাহাড়ের মতো চূড়া (কূট) করে দেওয়া হয় বলে একে ‘অন্নকূট’ উৎসবও বলা হয়। প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে এই পুজো হয়ে থাকে। তবে আসল কথা হলো দীপাবলি হোক বা দিওয়ালি, সবার জীবনে আসুক সুখ, ঘুচে যাক সকল অন্ধকার, সকল যন্ত্রণা, জ্বলুক শান্তির প্রদীপ, ভালবাসার প্রদীপ, এমনটাই প্রার্থনা করে সকলে।

Whatsapp
