অষ্টমী পুজোর নানা কিসসা
আমাদের ১২ মাসে ১৩ পার্বণ হলেও, বছরের এই পাঁচটা দিনের জন্য আমরা যেভাবে অপেক্ষা করে থাকি, তা যেন পাহাড়ের ট্রেনের টিকিট কেটে দিন গোনার মতো অপেক্ষা। পুজোর এই পাঁচটা দিনের মধ্যে আবার সবথেকে প্রিয় দিনটার কথা জিজ্ঞেস করলে প্রায় প্রত্যেকের উত্তরেই, 'মহাষ্টমী'। ষষ্ঠী, সপ্তমী, নবমী এবং দশমীর দিনগুলো জনপ্রিয় হলেও, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে বাঙালিদের কাছে অষ্টমীই।
নবরাত্রির অষ্টম দিন বা অষ্টমী হল দুর্গাপুজোর পবিত্রতম দিন। আশ্বিন মাসের শুক্লাষ্টমী তিথি যে দিনটিতে পড়ে সেই পবিত্র দিনটিকেই আমরা মহাষ্টমী বলি। অষ্টমী তিথির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির আবির্ভাব তিথি। যে কারণে অষ্টমীর দিনটি দুর্গাপুজোর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। অষ্টমীতে অস্ত্রপুজো করা হয়। অষ্টমীর তিথিতেই স্বর্গের বিভিন্ন দেবতারা একে একে দেবী দুর্গাকে তাঁদের অস্ত্রপ্রদান করেন অসুরবিনাশ করতে। তাই অষ্টমীর শুভ তিথিতে দেবীর অস্ত্রসমূহকে দেবজ্ঞানে পুজো করা হয়। ভারতের বহু অঞ্চলে এই দিনটিকে 'বিরাষ্টমী' ও বলা হয়ে থাকে।
জনপ্রিয়, জাঁকজমকপূর্ণ, আড়ম্বরে টইটুম্বুর পুজোর এই দিনটা বিশেষ কিছু কারণে অন্যান্য দিনগুলোর থেকে আলাদা। সেই কারণগুলি বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয় সন্ধি এবং কুমারীপুজোর কথা। অষ্টমীর এই বিশেষ তিথিতে দেবীদুর্গার পুজোর সঙ্গে হয় কুমারীপুজো এবং সন্ধিপুজো।
কুমারীপুজোতে কুমারী বালিকাকে মাতৃরূপে বন্দনা করা হয়। শাস্ত্রমতে ১ থেকে ১৬ বছরের কুমারী, অজাতপুষ্প সুলক্ষণা মেয়েকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কুমারী মেয়েটি ব্রাহ্মণের অবিবাহিত কন্যা কিংবা অন্য কোনও জাত বা গোত্রের অবিবাহিত কন্যা হলেও অসুবিধা নেই। এমনকি কোনও পতিতা মহিলার কন্যাকেও দেবী দুর্গারূপে পুজো করার নির্দেশ দেওয়া আছে শাস্ত্রে। বাংলাদেশ, নেপালে ও ভারতের কিছুকিছু জায়গায় এখনও দুর্গাপূজার অঙ্গ হিসেবে কুমারী পূজা করার রীতি-রেওয়াজ আছে। দুর্গা অষ্টমীর রাতে পাঁচ বা সাত অবিবাহিত কন্যাকে ভোজন করানোর প্রথা আছে। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে কুমারী কন্যাদের পা ধুইয়ে দিয়ে তাদের আরতি ও পূজা করা হয়।
প্রকাণ্ড প্রতিমার ঠিক সামনে বসানো হয় কুমারী দেবীদুর্গাকে। তিনিই তখন চিন্ময়ী দেবী, তিনিই মহাশক্তি, তিনিই জগৎজননী মা। ভালো করে গঙ্গাস্নানের পর কুমারী দেবীকে পরানো হয় লাল রঙের শাড়ি, চন্দনে সাজানো হয় ললাট, কুমকুমে চর্চিত, আলতা সিঁদুরে অর্চিত, পুষ্পে শোভিত তিনি। এরপর শুরু হয় কুমারীপুজো। পুরুতমশাই শুরু করেন মন্ত্র উচ্চারণ, "কুমারী রক্তবর্ণভা শক্তিহস্তা ভয়ানকি"।
সনাতন হিন্দু দর্শন বলে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় নামক ত্রিবিধ শক্তি আবদ্ধ থাকে কুমারীর মধ্যে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্ত বা দেবীসূক্তে বলা হয়েছে, কুমারীর মাধ্যমেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, বসুন্ধরার বুকে জন্ম নেওয়া সকল কুমারীই প্রকৃতি দেবীর অংশ। দেবীদুর্গা এই কুমারীরূপ ধারণ করেই অশুভ শক্তির প্রতীক কোলাসুরের বিনাশ করেছিলেন।
অষ্টমীর তিথি এবং নবমীর তিথির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় সন্ধিপুজো। সন্ধিপুজো চলে প্রায় ৪৮ মিনিট ধরে, যার ২৪ মিনিট হয় অষ্টমীর শেষ তিথির এবং বাকি ২৪ মিনিট নবমী শুরুর তিথি। সন্ধিপুজো হলো দেবীর এক অসুরদলিনী রূপের পুজো, যার নাম হল চামুণ্ডা। পুরাণ মতে চন্ড ও মুন্ড নামের দুই অসুরের বিনাশ করতে দেবী দুর্গার ললাট থেকে আবির্ভুত হয়েছিলেন দেবী চামুণ্ডা। অষ্টমী এবং নবমীর ঠিক সন্ধিক্ষণে দেবী চামুণ্ডা বধ করেন দুষ্ট অসুর চন্ড ও মুন্ডকে। তুই সন্ধিপুজো শুরু হয় অষ্টমী এবং নবমীর ঠিক সন্ধিক্ষণেই। দেবী চামুণ্ডার আরাধনা করতে করতেই শুরু হয় মহা নবমী।
এছাড়াও, এই তিথিতে পুজো করা হয় মহাগৌরী দেবীরও। পুরাণমতে, দেবাদিদেবের অর্ধাঙ্গিনী মা পার্বতী ছিলেন গৌরবর্ণা। কিন্তু শিবকে বর হিসাবে পাওয়ার তপস্যায় প্রখর রৌদ্রে তিনি কৃষ্ণবর্ণা হয়ে যান। দেবাদিদেব পার্বতীকে গঙ্গাজলে স্নান করালে তিনি ফের তার গৌর বর্ণ ফিরে পান। বলা হয়ে থাকে যে, অষ্টমীর রাতে দেবী মহাগৌরীর পুজো করলে পাপস্খলন ঘটে। অষ্টমীতে অষ্ট-মাতৃকার আবির্ভাব দুর্গাডামর ও যোগিনীতন্ত্রে বলা বর্ণিত হয়েছে চৌষট্টি যোগিনীর কথা। এই যোগিনীরা মহাশক্তিরূপিণী মহাদেবীর অংশ। এই চৌষট্টি যোগিনী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনায় মহাশক্তিকে সাহায্য করেন। এই চৌষট্টি যোগিনীর আটজন করে একই দেহে সম্মিলিত হয়ে মহাষ্টমীর দিন আবির্ভূতা হয়েছিলেন আট জন ভয়ঙ্কর দেবী। অশুভ শক্তির বিনাশে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দানবদলনী অষ্ট-মাতৃকা বা অষ্ট-শক্তি। এঁরা হলেন ব্ৰহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বরাহী, নরসিংহী, ইন্দ্রাণী ও চামুণ্ডা। অশুভশক্তিকে বিনাশ করার পর যাঁরা বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন দেবীর দুর্গার অঙ্গে। তাই মহাষ্টমীর দিন পুজো করা হয় অসুরবিনাশিনী অষ্ট-মাতৃকাকেও।
শাস্ত্রমতে, অষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলি দিলে সর্বকর্মে সিদ্ধি লাভ হয়। জীবন থেকে দুঃখ ব্যথা যন্ত্রনা শোক দূরে চলে যায়। বাধা দূর হয়, অর্থ আর সন্তান লাভ হয়। অন্তরের শয়তান শক্তি দুর্বল হয়, শত্রুর বিনাশ হয়। অষ্টমীর দিন নিরামিষ আহার করা হয়। আবার অনেক ভক্ত সারাদিন নির্জলা উপবাস রেখেও কাটিয়ে দেন। বাঙালিদের সঙ্গে অষ্টমী তিথির এই যোগাযোগ যেন আত্মার যোগ।