শেখ হাসিনার 'হাঁড়িভাঙা আম' উপহার, কূটনীতি আমোদে দিল্লি-ঢাকা মাতোয়ারা

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: আম কি শুধু খাওয়ার ! আহ্, খেতে তো হবেই। তা-বলে ফলের রাজা মশাইকে নিয়ে কূটনীতি থাকবে না ! আম মরসুমে কূটনৈতিক সৌজন্যে ভারত সহ বিভিন্ন দেশে রসালো হাঁড়িভাঙা আম (হাঁড়িভাঙ্গা) পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

উপমহাদেশের সুপ্রাচীন আম কূটনীতি রীতিতে এখন তীব্র আলোচিত হাঁড়িভাঙা আম। এই আম নিয়েই কিছু কথা, কিছু আম কূটনীতির ইতিহাস দেখার চেষ্টা।

 

করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা ভারত থেকে নেয়ার চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে এই চুক্তির পুরো চালান এখনও যায়নি ঢাকায়। টিকা চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়া ও চিনের উপর নির্ভর করেছে।

 

এই আপাত উষ্ণ পরিস্থিতির মাঝে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রীতি মেনে আম কূটনীতিতে অংশ নিলেন। এই দেশের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আম পাঠালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।

 

সৌজন্যের সূত্র ধরে  বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের দুই বাংলাভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপ্লব দেবের কাছেও সেই আম এসেছে।

 

হাঁড়িভাঙা আম- কেমন সে ফল?

আশির দশকের ঘটনা। আচমকা বাংলাদেশের আম বাজারে ম ম করে ছড়িয়ে গেল হাঁড়িভাঙা আমের সুবাস। এই আম নাকি অদ্ভুত খেতে। রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়ন থেকে এই আম এসেছে।

 

কেন নাম হাঁড়িভাঙা আম ? রংপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য- স্থানীয় চাষি নফলউদ্দিন পাইকার তার বাগানে 'মালদিয়া' নামে বিশেষ আমের গাছ রোপণ করেন।সেই আম গাছের নিচে মাটির হাঁড়ি দিয়ে ফিল্টার বানিয়ে জল দিতেন তিনি।

 

এলাকার কয়েকটা বিচ্ছু আম পাড়তে এসে সেই হাঁড়ি ভেঙে ফেলে। পরে গাছ পাকা সেই আম বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যান নফলউদ্দিন। ওই আম সম্পর্কে জানতে চান ক্রেতারা।  নফলউদ্দিন বলেন, আমার যে গাছের নিচের হাঁড়িটা ভেঙেছিল সেই গাছেরই আম। লোকমুখে তখন থেকেই ওই গাছটির আম হাঁড়িভাঙা আম নামে পরিচিতি পায়।

 

এই আমের স্বাদ ও খ্যাতি দ্রুত বাংলাদেশ জুড়ে ছড়ায়। চাহিদা বাড়তে থাকে। হাঁড়িভাঙা আম বিদেশে রফতানির উদ্যোগ শুরু করে বাংলাদেশ।  বিশেষ এই আমের রক্ষণাবেক্ষণ করতে উদ্যোগী হয় রংপুর জেলা প্রশাসন।

 

এমনিতে বাংলাদেশের আমের শহর হিসেবে সুপরিচিত রাজশাহী। বিখ্যাত হিমসাগরের জন্য। রাজশাহীর সঙ্গে আলোচিত হতে থাকে রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমের নাম। আম কূটনীতির আসরে এই আম-ই এখন ঢাকা ব্যবহার করেছে।

 

আসা যাক আম কূটনীতির রঙ্গমঞ্চে।

ফলটি নিয়ে কূটনীতির হিসেব সুপ্রাচীন। টুসটুসে আমের অতুলনীয় স্বাদ যেমন আছে, তারও ভিতরে লুকিয়ে আছে আরও অনেক কিছু৷  গরমের মরশুমে এই আম দিয়েই তো কত জটিল কূটনীতি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হয়৷ তাই তো জন্ম নিয়েছে আম কূটনীতি বা "Mango Diplomacy".

 

বাবর থেকে শুরু করে ঔরঙ্গজেব মোগল বাদশাহরা রীতিমতো আমরসে মজে থাকতেন৷ সম্রাট বাবর তাঁর রাজসভায় আগত বিদেশি অতিথি ও অন্য বাদশাহদের নিয়মিত আম উপহার দিতেন৷

 

আকবর ছিলেন আরও আম ভক্ত৷ তাঁর প্রবর্তিত দিন-ইলাহি ধর্ম যাঁরা গ্রহণ করতেন তাদের আম উপহার দেওয়া হত৷ নিজের মতবাদ প্রচারে আমকেই করেছিলেন অস্ত্র৷ এও তো কূটনীতি!

 

মোগল আমলের আম কাহিনি এরকম কতো যে গল্প বলছে৷ কবি মির্জা গালিবকে বেশ আমোদিত করেছিল৷ শুধু তাই নয় কূটনীতির মূর্ত প্রতীক হয়ে থেকে গেছে ফলের রাজামশাই৷

 

দক্ষিণ ভারতের বিশেষ প্রজাতির আম পছন্দ করতে শাহজাহান৷ কথিত আছে, সেই আম পিতাকে না পাঠিয়ে খেয়ে নিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব৷ এর জেরে ছেলের উপরেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন শাহজাহান৷ তবে এক্ষেত্রে আম কূটনীতি কাজে এসেছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷

 

চলে আসুন বিংশ শতাব্দীতে৷ আম কূটনীতির চমকে দেওয়া আরও কিছু তথ্য এমন৷ আশির দশকে ভারত ও পাকিস্তানের কুর্সিতে তখন ইন্দিরা গান্ধী ও মহম্মদ জিয়া উল হক ৷ এরই মধ্যে তিনটি যুদ্ধ (১৯৪৮, ১৯৬৫ ও ১৯৭১) হয়ে গিয়েছে৷

 

১৯৭১ সালের যুদ্ধে চরম পরাজয় হয়েছে পাকিস্তানের৷ জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের।  এরকমই পরিস্থিতিতে দু’দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্কের ভিত গড়তে আম কূটনীতিতেই ভরসা রেখেছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের দুই রাষ্ট্রপ্রধান৷ তৈরি হয়েছিল নতুন সমীকরণ৷

 

পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে আম কূটনীতি বড়সড় চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়৷ এখানেও চমক৷  ২০০৭ সালে মার্কিন মোটরবাইক নির্মাতা সংস্থা হার্লে-ডেভিডসন ভারতে ব্যবসা করতে ঢোকে। আর তার বদলে মার্কিন মুলুকে আম বিক্রির অনুমতি পায় ভারত। নতুন করে "Mango Diplomacy" শব্দটির বিশেষ ব্যবহার হতে শুরু করে৷

 

এরপর বারে বারে নয়াদিল্লি থেকে ইসলামাবাদে আম শুভেচ্ছা গিয়েছে৷ ইসলামাবাদ থেকে এসেছে পাল্টা শুভেচ্ছা৷ প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে আম পাঠিয়ে সৌজন্যের কূটনীতি দেখিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন দুই রাষ্ট্রপ্রধান পারভেজ মুশারফ ও নওয়াজ শরিফ৷ ঘটনাচক্রে শরিফ ফের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী৷

 

২৬/১১-র জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত হয়েছিল মুম্বই৷  এর জেরে চরমে উঠেছিল ভারত-পাক সম্পর্ক। সেই তিক্ততা কমাতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে কুড়ি কিলো আলফানসো আম পাঠিয়েছিলেন  তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। পাল্টা আম সৌজন্য দেখিয়েছিলেন গিলানি।  সেই রেশ ধরেই আম পাঠানোর পর্ব চলছে নিয়ম করে৷  নওয়াজ শরিফ থেকে নরেন্দ্র মোদী মজেছেন আম কূটনীতিতে৷

 

আমের মরশুম এলেই নড়েচড়ে বসেন কূটনীতিকরা৷ শুরু হয় আম কূটনীতি৷ বিভিন্ন ইস্যুতে গরম থাকা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে এই আম কূটনীতি শব্দটি আপনি শুনেছেন অনেকবার৷  সৌজন্য বজায় রাখতে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা পরস্পরকে আম পাঠিয়ে থাকেন৷

 

নয়াদিল্লি থেকে ইসলামাবাদে কখনও যায় বেগম খাস কখনও আলফানসো৷ আর ইসলামাবাদ থেকে আসে মীরপুর খাস৷ নামের বাহারে রকমারি এই আমে মিশে থাকে কূটনৈতিক বার্তা৷ বাংলাদেশ থেকে এবার এসেছে হাঁড়িভাঙা আম। স্বাদ ও গন্ধে ভিন্নতর এই আমে চমকে গিয়েছে উপমহাদেশের কূটনৈতিক মহল।

 

বিশেষ সৌজন্য:

  • বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন: রংপুরের বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম
  • Mango diplomacy: Bangladesh PM sends 2,600 kgs Haribhanga mangoes for PM Modi, Mamata Banerjee: live mint
  • India allows Harley Davidson import; mangoes to reach US soon: Outlook, 13 April, 2007
  • Mango diplomacy: The Express Tibune , Oct, 2020

More Articles