ট্রাম্প বনাম মাদুরো: কিউবান মিসাইল সংকটের ছায়া কি ফিরছে?

Trump vs Maduro: যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও কঠোর সামরিক তৎপরতা দেখায়, আর ভেনেজুয়েলা পাল্টা প্রতিরোধে নামে তাহলে নতুন এক আঞ্চলিক সংকট তৈরি করতে পারে, যার প্রভাবে পুরো মহাদেশ অস্থিতিশীল হতে পারে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর মধ্যে চলমান রাজনৈতিক টানাপোড়েন গত কয়েক মাসে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর মধ্যেই ক্যারিবীয় অঞ্চলের নৌকার উপর মার্কিন হামলা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, মাদক পাচার বন্ধ করতেই তারা এই অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল বলছে, এসব নৌকায় আদৌ মাদক ছিল কি না, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি ওয়াশিংটন। তাহলে কেন এই হামলা?

মানবাধিকার সংগঠনগুলির অভিযোগ, আইন মেনে বিচার না করে কাউকে হত্যা করা আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী অপরাধ। তাই তারা এই পদক্ষেপকে মাদকবিরোধী অভিযান নয়, ভেনেজুয়েলার উপর রাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর হচ্ছে বলেই দাবি করছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই মাদুরো সরকারকে ‘নার্কো-স্টেট’ আখ্যা দিয়ে আসছে। কিন্তু এখনকার অভিযানকে অনেকেই বলছেন ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে লক্ষ্য করেই সবটা করা হচ্ছে।

নিকোলাস মাদুরো অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সব অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ভেনেজুয়েলা স্বাধীন দেশ, কোনো বিদেশি চাপ তারা মানবে না। তাঁর কথায়,

“ভেনেজুয়েলাকে দাস বানানোর চেষ্টা চলবে, কিন্তু আমরা মাথা নত করব না।”

মাদুরোর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, মাদকবিরোধী অভিযান কেবল একটি অজুহাত, মূল উদ্দেশ্য হলো সরকারকে দুর্বল করা এবং ‘রেজিম চেঞ্জ’ ঘটানো।

যুক্তরাষ্ট্র যে সাম্প্রতিক সময়ে মাদুরোকে ক্ষমতা ছাড়ার বিনিময়ে ‘সেফ প্যাসেজ’ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সেই খবরও ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে। ওয়াশিংটনের ধারণা, মাদুরোর নেতৃত্বেই ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট গুরুতর অবস্থায় পৌঁছেছে এবং দেশটি অপরাধচক্রের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মাদুরো সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে এক মুহূর্তও নষ্ট করেননি। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, দেশ ছাড়ার কথা ভাববেন কেবল তখনই, যদি তাঁর জন্য পূর্ণ আইনি সুরক্ষা, পরিবারকে নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অভিযোগ প্রত্যাহার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এর বাইরে অন্য কিছুতে তিনি রাজি নন। তাঁর কঠোর অবস্থানেই ট্রাম্প প্রশাসন তাদের পদক্ষেপ আরও কড়া করেছে বলে অভিযোগ করছে ওয়াকিবহাল মহলে।

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের ভিসা নীতি, কতটা দুর্বল হবে মার্কিন গবেষণাক্ষেত্র?

২০২৫ সালে পরিস্থিতির ঘুরে গিয়েছে আরেকভাবে— যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বড় আকারে বাড়িয়ে ফেলেছে। উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধজাহাজ, নজরদারি বিমান, সমুদ্রপথে হাই-টেক অপারেশন সব মিলিয়ে মার্কিন নৌবাহিনী ভেনেজুয়েলার উপকূলের খুব কাছেই এখন অবস্থান করছে। ওয়াশিংটনের দাবি, এটি আন্তর্জাতিক মাদক চক্র দমনের অংশ। কিন্তু ভেনেজুয়েলা-সহ আন্তর্জাতিক অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এই সামরিক প্রস্তুতি পরিষ্কারভাবে রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোর বিরুদ্ধে পুরস্কারের টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাঁর সরকারকে অবৈধ বলে উল্লেখ করছে, তখন এই নৌ-মহড়াকে নিছক ‘অভিযান’ হিসেবে দেখা কঠিন।

কারাকাসের আবার দাবি, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে এবং তাদের লক্ষ্য সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা। মাদুরো ঘোষণা করেছেন, প্রয়োজন হলে দেশকে 'প্রতিরোধের প্রজাতন্ত্র' হিসেবে গড়ে তোলা হবে। অর্থাৎ বিদেশি হস্তক্ষেপ হলে সর্বোচ্চ সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রস্তুত রয়েছেন তিনি।

তবে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দফতর জানাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোকেন বাজার এখনও যুক্তরাষ্ট্রই। আশির দশকে কলম্বিয়ার কার্টেলগুলি মূলত ক্যারিবিয়ান সাগরপথে মাদক পাঠাত, তখন সেই রুট ছিল তুলনামূলক নিরাপদ। কিন্তু একুশ শতকে এসে বোঝা গেল, ক্যারিবিয়ান জলপথ আর নির্ভরযোগ্য নয়। ফলে সমুদ্র ছেড়ে পাচারকারীরা সরে আসে স্থলভিত্তিক রুটে। ধীরে ধীরে নতুন করিডর গড়ে ওঠে পানামা, কোস্টা রিকা, নিকারাগুয়া, গুয়েতেমালা দিয়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই দেশগুলিতেও নজরদারি ও ধরপাকড় বেড়ে যাওয়ায় আবার নতুন পথ খুঁজা হচ্ছে। তাই ফের ফোকাস ঘুরে গিয়েছে ইকুয়েডর ও ভেনেজুয়েলার দিকে।

আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, পরিস্থিতি কি আরও বড় সংঘাতের দিকে যাচ্ছে? কিউবান মিসাইল সংকটের ছায়া দেখা যাচ্ছে? অনেকে বলছেন, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এমন উত্তেজনা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও কঠোর সামরিক তৎপরতা দেখায়, আর ভেনেজুয়েলা পাল্টা প্রতিরোধে নামে তাহলে নতুন এক আঞ্চলিক সংকট তৈরি করতে পারে, যার প্রভাবে পুরো মহাদেশ অস্থিতিশীল হতে পারে। এমনকি পোপ লিও পর্যন্ত সতর্ক করে বলেছেন, ভেনেজুয়েলায় সামরিক হস্তক্ষেপ অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে ফেলবে।

এই সংকটে ভেনেজুয়েলার পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া ও চিন। তারা প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের সমালোচনা করছে। রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে এই দেশগুলির সমর্থন মাদুরো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশও উদ্বেগ জানাচ্ছে, পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। এদিকে আন্তর্জাতিক আইন ও সমুদ্রসীমা নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে ভাবে ভেনেজুয়েলার জলসীমার কাছে সামরিক মহড়া করছে, তা আইনি দিক থেকে কতটা গ্রহণযোগ্য— সেই প্রশ্ন উঠছে বারবার।

আরও পড়ুন

ট্রাম্প-পুতিন-আম্বানি, ত্রয়ীর মধ্যে মিলটা কোথায়?

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষ। রেশন লাইনের সামনে দাঁড়ানো মানুষদের দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়, রাজনৈতিক সংঘাতের মূল্য কে দেয়। বহু বছর ধরে ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্যাভাব, ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি আর স্বাস্থ্যব্যবস্থার অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে আছে। এই অবস্থায় যদি নতুন করে সামরিক উত্তেজনা শুরু হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন করে সংঘাত হলে শরণার্থী সংকট বাড়াবে, মানবাধিকার লঙ্ঘন আরও তীব্র হবে, আর দেশীয় রাজনীতিও নিষ্ঠুরতম রূপ নিতে পারে। শুধু ভেনেজুয়েলাই নয়, সীমান্তবর্তী দেশগুলোও এর প্রভাব অনুভব করবে।

বর্তমান উত্তেজনা কোন দিকে যাবে, তার স্পষ্ট উত্তর এখন কারও কাছে নেই। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিক দু'দিক থেকেই চাপ বাড়াচ্ছে। মাদুরো সরকার বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলিও ইতোমধ্যে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে আর পুরো ল্যাটিন আমেরিকা শঙ্কায় অস্থির। এই চাপ-প্রতিচাপের মাঝেই সাধারণ মানুষের আশঙ্কা, যদি দু'দেশের সংঘাত আরও বাড়ে, তা হয়ত ভেনেজুয়েলাকে নতুন এক দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিতে পারে। কূটনৈতিক আলোচনার পথ কতটা খোলা থাকবে, দু'দেশের নেতৃত্ব কতটা সংযম দেখাবে তার উপরই নির্ভর করছে এই সংকটের ভবিষ্যৎ।

যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রে। একসময় দু'টি দেশের মধ্যে জ্বালানি-নির্ভর ঘনিষ্ঠতা থাকলেও রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের পরিবর্তন, বহির্বিশ্বের প্রভাব সব মিলিয়ে এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে অবিশ্বাস ও সংঘাতের পথে এগিয়েছে। ২০২৫ সালে সেই সংঘাত এক নতুন পর্বে ঢুকে পড়েছে, যেখানে সামরিক পদক্ষেপ, কূটনৈতিক উত্তেজনা ও রাজনৈতিক চাপ মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে জটিল পর্যায়ে। এখন দেখার বিষয়, বিশ্বের বড় শক্তিগুলো এই সংকট প্রশমনে এগিয়ে আসে কি না, আর যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা অবশেষে কথোপকথনের টেবিলে ফিরতে সক্ষম হয় কি না। কারণ ল্যাটিন আমেরিকার ভূ-রাজনীতি ও ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ— দু'টোই এখন অনিশ্চিত সমীকরণের উপর দাঁড়িয়ে।

More Articles