কে আমার বন্ধু, আমি বন্ধু কার

যে কথা আমি কাউকে বলব না, তা বলেছি বন্ধুকে। যে হৃদয় চির-অপ্রকাশ, আমার সেই হৃদয় আমি খুলে রেখেছি বন্ধুর চরণে। বন্ধু যখন যায়, আমার হৃদয় নিয়ে চলে যায়।

ট্রেনের গোলমাল। দীর্ঘ সময় অন্য যাত্রীদের সঙ্গে শিয়ালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। চারটে ট্রেন বাতিল হয়ে গিয়েছে। রানাঘাটগামী রাতের শেষ ট্রেনটাই একমাত্র যাবে। উঠে বসলাম। ট্রেন ছাড়ার আগে উল্টোদিকে এসে বসল ছোটবেলার বন্ধু মৃন্ময়। অভাবের সংসারে বড় হয়েছি আমরা। অনেক অনেক বছর পর দেখা হতেই ও প্রথম বলল, একটা বাড়ি বানিয়েছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে ফিরছে ও? একটা লম্বা গল্প শোনাল। যার নির্যাস, একটি মেয়েকে সোনার গয়না উপহার দিয়ে ফিরছে ও। মেয়েটিকে ও ভালবাসত। মেয়েটি বলেছে তোমায় বন্ধুই ভাবতে চাই। মেয়েটির সামনে বিয়ে, তাই ও একটা গয়না কিনেছে। দিয়ে বলেছে, তোমার বিয়েতে তো যাব না, আজই নিয়ে নাও। গল্পটা শুনতে শুনতে অনেকদূর চলে এসেছি। সোদপুরে নামব। মৃ্ন্ময় বলল, একটাই আফশোস, আজকের পর ও আর আমার বন্ধু রইল না। আমার কোনো বন্ধুই রইল না। আমাদের কাগজে বন্ধু ইরফান খান-কে নিয়ে লিখেছেন মুম্বইয়ের পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়া। লিখেছেন, আমার কোনো বন্ধুই আর রইল না। আমার বন্ধু ছিল। আমার বন্ধু নেই। একজন বন্ধু থেকে যাচ্ছে। একজন বন্ধু চলে যাচ্ছে। এর মধ্যেই শুয়ে আছে জীবন। দূরের জীবন। কাছের জীবন। লোকাল ট্রেনে চড়া জীবন। আরবসাগরের তীরের জীবন। আজ আর অটো পাব না। হেঁটে ফিরতে হবে। হাঁটি আর জিজ্ঞেস করি। ওদের দুজনেরই অনেকের সঙ্গে দেখা হয় রোজ। মৃন্ময়ের সঙ্গে পেশার স্বার্থে দেখা হয় সেই সব লোকের যারা ট্যাক্স ফাঁকি দিতে চায়। তিগমাংশুর সঙ্গে দেখা হয় সিনেমা সংশ্লিষ্ট লোকজনের। কিন্তু কেউই ওদের বন্ধু না। তাহলে প্রকৃত বন্ধু কে? আমার পাশে যারা বন্ধুর মতো তারা কারা? আমার সব বন্ধুই কি এক ধাঁচের? সব বন্ধুত্ব থেকেই কি আমার চাওয়া পাওয়া এক? আমি ভাবতে থাকি। ভাবতে থাকি, জীবনে বন্ধুর জায়গা কতটা, যে সে চলে গেলে মানুষ জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বলে আমার আর কথা বলার কেউ রইল না। মা আছে, পরিবার আছে, আত্মীয় আছে, সন্তান আছে। তবু কথা বলার কেউ নেই?

মহাভারতে কৃষ্ণ বলছেন, যোহং তমর্জুনং বিদ্ধি যো'জুন সোহমেব তু। অর্থাৎ যে বন্ধু সেই আমি। অর্জুন আলাদা কেউ নয়। সে কৃষ্ণের আত্মার প্রতিফলন মাত্র। কিন্তু বন্ধু যদি সত্যিই অভিন্নহৃদয় হয়, তাহলে একালের দার্শনিক জাক দেরিদা কেন বললেন, মাই ফ্রেন্ড দেয়ার আর নো ফ্রেন্ডস। আসলে বন্ধুর মধ্যে কি আমি আমাকেই খুঁজি? আমি ভাবতে ভাবতে হাঁটি। ফাঁকা মাঠ। এক কোণে মরা চাঁদ পড়ে আছে। আমি একা সে পথ পার হই। পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টেটল বন্ধুত্ব বিষয়ে দার্শনিক ভাষ্য তুলে ধরেছেন দু'হাজার বছর আগে। অ্যারিস্টটলের মতে দুর্ভাগ্যে, দারিদ্র্যে বন্ধুত্বকেই সবচেয়ে বড় আশ্রয় ভাবে মানুষ। কথায় বলে যদি হও সুজন তবে তেতুল পাতায় ন'জন। অর্থাৎ বন্ধু থাকলে সামান্যেও চালিয়ে নেওয়া যায়। বন্ধু থাকলে ডিঙি নৌকোয় সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া যায়। অ্যারিস্টটল তিন রকম বন্ধুর কথা বলেছেন। স্বার্থের বন্ধুত্ব বলতে তিনি বোঝান তেমন বন্ধুত্বকে যা চিরদিনের নয়। দু'পক্ষই যেখানে কিছু বেনিফিট বা সুবিধের জন্য আসে। জেনেবুঝেই সেই সুবিধেগুলি দেওয়ানেওয়া করে। এই দেওয়ানেওয়া শেষ হলে বন্ধুত্বও শেষ হয়। এর জন্যে কোনো মনস্তাপের জায়গা থাকে না। ব্যবসাদারির কথা ভাবুন, সেখানে বন্ধুত্বটা এমনই, লেনদেনের। ব্যবসা ফুরোলে বন্ধুত্বের রেশ থাকে না। একটা আড্ডায় শুনলাম, নির্মাল্য আচার্য্যরা দিনের পর দিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়দের বাড়িতে থেকে যেতেন, আড্ডার জন্যে। লেনদেনের বন্ধুত্ব এমন নয়। কাজ ফুরোলে সেই বন্ধুত্ব থেকে দুজনেই সেখান থেকে মুক্তি চাইবেন। আরেক ধরনের বন্ধুত্বকে অ্যারিস্টটল দেখাচ্ছেন। তার মতে এটা সুখের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বের মূল সুরটা আবেগ। এখানে সবাই সমান অংশীদার। একটা সাধারণ আকর্ষণ সবাইকে মিলিয়েছে। বিশুদ্ধ আনন্দ, কোনো মঞ্চে একসাথে লড়ে জিতে যাওয়া- এই উদ্দেশ্যেই এই ধরনের বন্ধুরা মিলিত হন। কলেজের বন্ধুদের কথা ভাবুন বা কোনো ক্রিকেট টিমের মেম্বারদের বন্ধুত্ব। ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি যখন টিম ইন্ডিয়া জিতে গেল, সৌরভ জামা খুলে ঘোরালেন, বাকিরাও একই আনন্দে ভেসে গিয়েছিলেন। এখানে উপস্থিত সকলেরই উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তারা পরীক্ষায় পাশ করতে এসেছে। জিততে এসেছে। একই আবেগে গা ভাসাতে এসেছে। কিন্তু উদ্দেশ্যপূরণ হয়ে গেলে, এই বন্ধুকেও আমি চাই না। নিভৃত মুহূর্তে তাকে আমরা চাই না। তাকে ছেড়ে বাড়ি আসতে পারব না, এমন বোধ আমাদের গ্রাস করে না। এই বন্ধুত্ব চিরস্থায়ীও নয়। হয়তো যোগাযোগ থাকে। কিন্তু জীবন সম্পর্কে ধারণা বদলাতে শুরু করলে, বাঁকবদল হলে এই বন্ধুত্বগুলি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। স্কুল কলেজের বন্ধুরা কি আগের মতোই আমায় ঘিরে আছে? তাদের সঙ্গে হয়তো কোনও মনান্তর হয়নি। তাহলে বন্ধুত্ব কেন চলে গেল? কারণটা আর কিছুই নয়, জীবন গিয়েছে চ'লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। চাওয়াপাওয়াগুলি আমাদের দুই মেরুতে নিয়ে গিয়েছে। রিউনিয়নগুলি তাহলে কি? রিইউনিয়ন চিরস্থায়ী নয়। আমরা আগামী একমাস রিইউনিয়ন করব, এমনটা কিন্তু হয় না। রিইউনিয়ন মিটে গেলেই ফের যোগাযোগের সুতোগুলি আলগা হতে শুরু করে। পুনর্মিলনে সকলে সাধারণ উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণের জন্যে আসে। উদ্দেশ্যটা বিশুদ্ধ হইহুল্লোড়। তা ফুরিয়ে গেলে একে অন্যেকে দেওয়ার মতো কিছুই থাকে না।

এই দু'ধরনের বন্ধুত্ব ছাড়াও আরেক ধরনের বন্ধুত্বকে জায়গা দেন অ্যারিস্টটল। একে তিনি বলেছেন ফ্রেন্ডশিপ অফ গুড। সদগুণের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বের মাপকাঠি অটুট পারস্পরিক শ্রদ্ধা। এই বন্ধুত্ব- জহুরির চোখ দিয়ে যাচাই করে নেওয়া। আবেগের ভেসে যাওয়া ক্ষণকালের বন্ধুতা নয় এটা। এখানে আমরা মানুষটির প্রতি আকর্ষিত হই তাঁর গুণগুলিতে। শ্রদ্ধার বশে একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। এই শ্রদ্ধা একদিনে আসে না। যে কোনও মানুষের প্রতিও আসে না। যে বিষয়গুলিকে আমরা বহুকাল মন থেকে শ্রদ্ধা করে আসছি তাই যেন অবয়ব পায় আমার বন্ধুর দেহে। ফলে এই বন্ধু যেন আমারই ইচ্ছেয় গড়া। দীর্ঘকাল এই বন্ধুত্ব অটুট থাকতে পারে। যাদর মধ্যে সহমর্মিতার অভাব রয়েছে, তারা এই বন্ধুত্বে জড়ায় কম। তাদের বন্ধুত্ব ক্ষণিকের আবেগ অথবা লেনদেনেই সীমাবদ্ধ থাকে। সদগুণের বন্ধুত্ব অনেক বেশি নিঃস্বার্থ, অনেক সময়সাপেক্ষ। গাছে জল দিয়ে ধীরে ধীরে তাকে বড় করার মতো। এমনকী বন্ধু চলে গেলেও বন্ধুত্বের রেশ থেকে যায় আমার মনে। মন বলে, তাকে যেতে নাহি দিব। এই বন্ধুত্বেও কিন্তু প্রথম দুই বন্ধুত্বের প্রাপ্তিগুলি থাকছে। কারণ এই সদগুণের বন্ধু যে কোনো দরকারে বা স্বার্থে পাশে এসে দাঁড়াবেই। কিন্তু তাঁর ভূমিকা এটুকুতে থেকে থাকবে না। প্রবল আনন্দের মুহূর্তেও তাকে কাছে পেতে ইচ্ছে হবে। তার সঙ্গে থাকাটাই আনন্দঘন মুহূর্ত তৈরি করে। জীবনের সবচেয়ে মধুস্মৃতিগুলি আমরা আমাদের এই বন্ধুত্বগুলি থেকেই পাই। এভাবে দেখলে আমাদের বন্ধুই কিন্তু আমাদের জীবনকে একটা মানে দেয়। আমাদের বেঁচে থাকার গুণমান নির্ভর করে এই বন্ধুত্বগুলির উপর। এই বন্ধুকে হারিয়েই তিগমাংশু লিখছেন, আমার আর কোনো বন্ধু নেই। মৃ্ন্ময় বলছে, আমার বন্ধুটা চলে গেল।

অ্যারিস্টটল প্রশ্ন করে এসছেন, বন্ধুত্ব ভালো নাকি খারাপ? আমরা বন্ধুত্ব কেন রাখি, বন্ধুত্ব ভালো বলে নাকি আমার প্রিয় ব্যক্তিটি আমার চোখে ভালো বলে বন্ধুত্ব বিষয়টি আমার কাছে ভালো হয়ে উঠছে? মনে পড়ে, একবস্ত্রে সংসার ত্যাগ করা ইন্দ্রনাথের কথা। কেমন তার গুণ? শুকনো সিদ্ধির পাতা চিবোয় সে। নেশার জিনিস ভাগ করে খেতে চায়। সিগারেট খায়। মনে ছাপ মেরে চলে যায়। এমন তার প্রভাব, শ্রীকান্ত কয়েক দশক পরেও ছেলেটির কথা ভুলতে পারে না। শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথে মুগ্ধ ছিল নাকি ইন্দ্রনাথের গুণগুলিতে? শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ করে বলে, "যদি ওমনি করিয়া বাঁশী বাজাইতে পারতাম।" সাপের কামড় অগ্রাহ্য করে নিশুত রাতে গভীর জঙ্গলে হেঁটে যায় ইন্দ্রনাথ। ইন্দ্র স্কুলছুট। পণ্ডিতের টিঁকি কেটে নেয় সে। আসলে ইন্দ্রর চরিত্রকে গড়ছেন শরৎচন্দ্র এক কিশোরের অভীপ্সায়। তার হৃদয়ে লুকনো বিদ্রোহের স্রোতই যেন ইন্দ্রনাথ। মন্দের সঙ্গে মিলনের জন্য তার দেহকণা উন্মুখ।

দর্শনবোদ্ধা অরিন্দম চক্রবর্তী এই জায়গায় একটা জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন। 'দেহ গেহ বন্ধুত্ব' গ্রন্থে তিনি বলছেন, বন্ধু ছাড়া আমার চলে না, একা থাকতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু বন্ধুকে যত ভালোবাসি তত আমার আমিত্ব, আমার স্বার্থ দুরকম আতঙ্কে ভোগে। এক হলো, আমার নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে। আমি ওই বন্ধুর কেনা গোলাম হয়ে যাচ্ছি। আর অন্য ভয় হল--ও যদি আমায় ছেড়ে চলে যায়। অরিন্দম এই দুই ধরনের ভয়কে বলেছেন গ্রস্ত হওয়ার ভয় এবং ত্যক্ত হওয়ার ভয়। এই দুই ভীতি দিয়ে তৈরি সখাপ্রীতির রীতিনীতি। অটুট নাছোড় বন্ধুত্ব থাকলে এই ভয়ও থাকবে। যে আমার যত বন্ধু তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ভয় তত বেশি। এমনকী সে ছেড়ে চলে যাবে, এই বোধও আমায় বেঁধে রাখে। তাহলে আমি বন্ধুর থেকে আলাদাও হতে চাইছি আবার একও থাকতে চাইছি, এই দ্বৈতসত্তাই বন্ধুত্বের একটা পরীক্ষা বলা চলে। এর মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার আছে। নিয়ন্ত্রণ করেই বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ বাঁচে। অর্থাৎ তার হাতেই থাকে দাঁড়িপাল্লাটা। বন্ধুকে আমি আটকে রাখলে চাপিয়ে দেওয়া হবে। আবার আঙুল আলগা করে রাখলে, বন্ধুত্বের মৌতাত জমবে না।

একত্রিশ বছরের নিবেদিতার সঙ্গে জগদীশ বসুর বন্ধুত্ব হয় এক পার্টিতে। নিবেদিতা জগদীশচন্দ্রকে প্রশ্ন  করলেন ব্রাক্ষ্মধর্মের সারাৎসার নিয়ে। কথাবার্তায় বন্ধুত্বটা গাঢ় হল। একে অন্যের সদগুণের খোঁজ পেলেন। এক অত্যাগসহন বন্ধুতা তৈরি হলো। বন্ধুকে আমি ছাড়তেও পারি না। বন্ধুকে আমি কাছে রাখতেও পারি না। বন্ধু ছেড়ে অন্যের কাছে থিতু হবে তাও সইতে পারি না। স্বামীজী নাম দিয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা। জগদীশ বলেন, "আপনাকে মিস নোবেলের পরিবর্তে ভগিনী নিবেদিতা ডাকতে আমার কষ্ট হয়। নাম বদলে আপনি নিজেকে সংকীর্ণ করে ফেলেছেন।" এদিকে বিবেকানন্দ বলছেন, আমাদের ব্রাহ্মদের মধ্যে ঢুকতে হবে, একটি চা আড্ডা বন্দোবস্ত করো। সেই চা আড্ডায় এলেন ঠোঁটকাঁটা বদমেজাজি জগদীশ, রবীন্দ্রনাথ। আরও কত কে। কিন্তু বিবেকানন্দ ঢুকতেই পারলেন না যেন, কেন এতটুকুও শ্রদ্ধা দেখালেন না জগদীশচন্দ্র? নিছক যুক্তিক্রমের ফারাকের জন্য নাকি বন্ধু নিবেদিতাকে হারিয়ে ফেলতে পারেন এই ভয়ে? কত কু-কথা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলেছেন জগদীশচন্দ্র। সবটা সয়েছেন নিবেদিতা। বিরূপ হননি। মিস বুলকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, আই লাভ দ্যাট ম্যান। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত নিবেদিতা তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই। নিবেদিতা জগদীশকে আদর করে ডাকছেন খোকা। জগদীশের গ্রন্থচর্চা, মৌলিক লেখা, অনুবাদ, বিদেশে বক্তৃতা-সবেতেই নিবেদিতার প্রত্যক্ষ ছায়া। কিন্তু তিনি কি সম্পূর্ণ গ্রস্ত হচ্ছেন! অথবা জগদীশকেও কি নিবেদিতা বিবেকানন্দ পথে নিয়ে আসতে পারছেন! পারছেনও না, ছাড়ছেনও না। একেই বলা চলে অত্যাগসহন বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব সবসময়েই একটা মেকিং। কারণ বন্ধু একদিনে উন্মোচন করে না। ধাপে ধাপে ফুটে ওঠাই বন্ধুতার প্রকৃতি। বন্ধুতের গতিপথ সময়ের উল্টোদিকে। কেননা সময় এগোচ্ছে সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে আমি এগোতে পারছি না। আমি স্রোত উপেক্ষা করে অপেক্ষা করছি, বন্ধুকে বুঝতে। সে তাকে যত উন্মোচন করবে আমি বন্ধুত্বকে তত বুঝতে পারব। আমার বন্ধু যদি চলে যায়। আমি বন্ধুত্বের ব্যাগ হাতে আরবসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকব। সময়ের বালুতটে দাঁড়িয়ে আমার চুলে পাক ধরে যাবে।

বন্ধুত্ব স্বভাবনির্জন। ভিড়ের মাঝে তা ডালপালা মেলবে না। নিভৃতে, কথায় কথায় দুই বন্ধু বন্ধুত্বের ছায়াকায়া ছড়িয়ে দেবে মাটি-আকাশে। কথায় কথায় বন্ধু এক হয়ে যায়। কৃষ্ণ বলেন যে তুমি, সেই আমি। সে নেই মানে আমিও নেই। বন্ধু যেখানে আমিও যাব সেখানে। চৈতন্যের বারণ না শুনেই নীলাচলে যান নিত্যানন্দ। বৃন্দাবনদাসের বক্তব্য, “নিত্যানন্দ চৈতন্যে যখন দেখা হয়। প্রায় আর কেহ নাহি থাকে সেসময়।।” কৃষ্ণদাসও লিখছেন, “কিবা যুক্তি কৈল দোঁহে কেহ নাহি জানে।”

যে কথা আমি কাউকে বলব না, তা বলেছি বন্ধুকে। মাকে টাকা পাঠিয়ে ম্যানেজ করা কথা তো অপু স্রেফ তার বন্ধুকেই বলেছিল!

যে হৃদয় চির-অপ্রকাশ, আমার সেই হৃদয় আমি খুলে রেখেছি বন্ধুর চরণে। বন্ধু যখন যায়, আমার হৃদয় নিয়ে চলে যায়। বন্ধুবিহনে, শেষ ট্রেনে, আরবসাগরের তীরে, শীর্ণচাঁদের রাতে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে আমি আমার হারানো হৃদয়কে খুঁজি অনন্তকাল।

More Articles