কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব? কেন শশী থারুরকে সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিল কেন্দ্র?
Shashi Tharoor: প্রতিনিধিদলে জায়গা পাওয়া নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে শশীও স্পষ্টভাবে বলেছেন, "এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।
অপারেশন সিঁদুরের পরে একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল নির্বাচন করেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার। কী কাজ এই প্রতিনিধি দলের? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের জিরো টলারেন্সের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার দেশগুলিতে যাবে এই প্রতিনিধি দল এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করবে। আর এই দলের মাথা কে? কংগ্রেস নেতা শশী থারুর। শশী থারুরকে মনোনীত করছে বিজেপি শাসিত সরকার! তার চেয়েও গুরত্বপূর্ণ হলো, কংগ্রেস এই প্রতিনিধিদলের জন্য যে চারজন সদস্যের নাম মনোনয়ন করেছিল, শশী ছিলেনই না সেই তালিকায়! অর্থাৎ শশী থারুরের নির্বাচন হয়েছে কেন্দ্র সরকারের ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে। কেন বিরোধী নেতাদের মধ্যে শশী থারুরকে বিশেষ গুরুত্ব দিল কেন্দ্র? কংগ্রেস মনে করছে, এই সিদ্ধান্ত সরকারের বদ উদ্দেশ্যে দেওয়া চাল।
শশী থারুরের প্রতি স্পষ্ট কটাক্ষ করে, কংগ্রেসের যোগাযোগ বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ বলেছেন, "কংগ্রেস মে হোনা অউর কংগ্রেস কা হোনা মে জমিন-আসমান কা অন্তর হ্যায়"। তাহলে কংগ্রেস কি মনে করছে, শশী কংগ্রেসে থাকলেও তিনি নিজে কংগ্রেসের নন? কেন্দ্র সরকার কংগ্রেসকে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য বিদেশে পাঠানো সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের জন্য চারজন সাংসদের নাম জমা দিতে বলার পর দল আনন্দ শর্মা, গৌরব গগৈ, সৈয়দ নাসির হুসেন এবং অমরিন্দর সিং রাজা ওয়ারিংকে মনোনীত করেছিল। কিন্তু দেখা গেল, এই তালিকাকে গুরুত্ব না দিয়ে শশী থারুরকে প্রতিনিধি দলে রাখা হয়েছে। জয়রাম রমেশ বিজেপি সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, "দলের সঙ্গে পরামর্শ না করে প্রতিনিধিদলের মধ্যে সাংসদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন না।" জয়রাম রমেশের অভিযোগ, সরকার 'নারদ মুনির রাজনীতি' করছে।
আরও পড়ুন- পাকিস্তানের গুপ্তচর! কে এই ভারতীয় ট্রাভেল ভ্লগার জ্যোতি মালহোত্রা?
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি এবং রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আলোচনার জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশনের দাবি জানিয়ে একটি চিঠি সরকারকে পাঠিয়েছিল। তার কোনও উত্তর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেননি। হঠাৎ করেই বহুদলীয় প্রতিনিধিদলের কথা জানিয়েছেন তিনি। কংগ্রেসের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদি নিজে সর্বদলীয় বৈঠকে আসেননি, বিশেষ অধিবেশন ডাকেননি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মার্কিন বিদেশমন্ত্রী মার্কো রুবিওর দাবি বিষয়েও নীরব থেকেছেন অথচ তিনিই বহুদলীয় প্রতিনিধিদলের কথা ঘোষণা করেছে। তাতে আবার নিয়ম বহির্ভূতভাবে শশী থারুরকে জুড়ে দিয়েছেন। এর নেপথ্যে কী কারণ? তাহলে কি শশী থারুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে বিজেপির?
সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কেন্দ্র নেতাদের বুঝে শুনেই নির্বাচন করেছে। যারা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন তারা রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতের দলের হলেও স্পষ্টবাদী নেতা। নেতাদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাসীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের চারজন এবং বিরোধী ভারত জোটের তিনজন। পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় অপারেশন সিঁদুর নিয়ে বিরোধী সব দলই সরকারকে সমর্থন করেছে। তবে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শশী থারুরের অবস্থান ছিল আরও জোরালো। শশী থারুর প্রাক্তন কূটনীতিক হওয়াতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা আছে। পাকিস্তান এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে ভারতীয় হামলার পক্ষে এবং ভারত-পাক সংঘাতের বিষয়ে ক্ষমতাসীন জোটের কঠোর অবস্থানকে সমর্থন করেছেন শশী সর্বতোভাবে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাত আবহে নরেন্দ্র মোদি সরকারের অন্যতম সোচ্চার সমর্থক হয়ে উঠেছেন শশী, এতটাই সোচ্চার যে কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে যে শশী থারুরের বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত মতামত, এর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক অবস্থানের সম্পর্ক নেই।
প্রতিনিধিদলে জায়গা পাওয়া নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে শশীও স্পষ্টভাবে বলেছেন, "এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। যখনই দেশের আমার সেবার প্রয়োজন পড়ে, আমি প্রস্তুত থাকি এবং আমার দেশের জন্যই প্রস্তুত থাকি। আমার মনে হয়, এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশ যে অবস্থা দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার গভীর প্রয়োজন এসে পড়েছে... ঐক্য যখন এত গুরুত্বপূর্ণ, তখন এটি জাতীয় ঐক্যের একটি দুর্দান্ত প্রতিফলন।” এই ঐক্যবদ্ধ হওয়া কি শুধুই সন্ত্রাসের জবাবে নাকি গোপনে নরেন্দ্র মোদির সন্ত্রাস ছাড়া সমস্ত অবস্থানের প্রতিই গোপন সমর্থন বাড়ছে শশী থারুরের? এটুকু স্পষ্ট যে কেন্দ্রের বিশেষ ভরসার হয়ে উঠেছেন শশী। তাই কংগ্রেসের তালিকাকে গুরুত্ব না দিয়ে পৃথকভাবে তাঁকে নির্বাচন করা হয়েছে। শশীর অবস্থান কংগ্রেসের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে একথাও সত্য। কেরল কংগ্রেস ইতিমধ্যেই শশী থারুরের এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার বিতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলেছে, এই বিষয়ে মন্তব্য করার ভার দলের হাইকমান্ডের। আর হাইকমান্ডের নেতারা তো বুঝিয়েই দিয়েছেন, কংগ্রেসে থাকা আর কংগ্রেস হওয়া এক নয়।
আরও পড়ুন- ২০২২ সালেই সতর্ক করেছিলেন! রাহুল গান্ধির কথায় আমল দিলে এড়ানো যেত পাক হামলা?
শশী থারুরও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উল্টোপিঠে ভারতের অবস্থান তুলে ধরার জন্য বিদেশে বহুদলীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার কেন্দ্রের আমন্ত্রণ গ্রহণের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বলে দিয়েছেন, "আমাকে এত সহজে অপমান করা যাবে না। আমি আমার মূল্য জানি।" তিরুবনন্তপুরমে সাংবাদিকদের শশী থারুর বলেছেন, বিদেশ বিষয়ক অভিজ্ঞতার কারণেই কেন্দ্রীয় সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু তাঁকে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং শশী সঙ্গে সঙ্গেই তাতে সম্মতি জানিয়েছেন। কিন্তু কেন বাকি প্রস্তাবিত নাম বাদ দিয়ে তাঁকে বাছা হলো? শশী থারুর সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি। বলেছেন, “তাদেরই (কংগ্রেস) জিজ্ঞাসা করতে হবে এই নিয়ে।” বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিষয়টি দল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেকার ইস্যু।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, পহেলগাঁওয়ে হামলা আর অপারেশন সিঁদুরের পর রাজনীতিতে মেরুকরণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে কেন্দ্রের সরকারকে পাকিস্তান প্রসঙ্গে সমর্থন করছেন মানুষ। সরকার স্বীকারও যে পহেলগাঁও হামলার পিছনে গোয়েন্দাদের ত্রুটি ছিল। তারপরেই অপারেশন সিঁদুর দিয়ে সেই ক্ষত মেরামতও করে ফেলেছে সরকার। কংগ্রেসও সমস্ত বিরোধীদের মতোই বিজেপি সরকারের পাশে থাকার কথা জানিয়েছে এই ইস্যুতে। তাহলে শশী থারুর কি এতদিনের কংগ্রেসের সঙ্গ পরিবর্তন করবেন এবার? বিজেপির সঙ্গে জুড়লে কেরলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারাবেন শশী। সেই 'রিস্ক' এই বয়সে তিনি নেবেন কিনা, প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে কংগ্রেসে এক বৃহত্তর ভূমিকা আশা করতে পারেন তিনি। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য দল তাঁর নাম প্রস্তাব করুক, চাইতেই পারেন। তাতে দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। তবে সেসবের অনেক আগে, শশীর অবস্থান, শশীকে কেন্দ্রের ব্যবহার যে রাহুল গান্ধির দলের জন্য খুব ভালো সংকেত নয় তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।