বাড়িতে নিয়মিতই আসে ২০ লিটারের জলের জার? ভয়াবহ রোগের মুখে দাঁড়িয়ে আপনি
Water Jar Bacteria: শহরের বেশিরভাগ জায়গাতেই মূলত কুড়ি লিটারের জার ব্যবহার করে থাকেন বাসিন্দারা। সেই কুড়ি লিটারের জারে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষণীয়।
"Water is life's matter and matrix, mother and medium. There is no life without water."
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যখন মহাকাশে চোখ রেখে প্রাণের সন্ধান করেন, তখন মূল যে ক'টি উপাদানের খোঁজ করেন তার মধ্যে অন্যতম হলো জল। হ্যাঁ, একথা ঠিকই যে আমাদের পৃথিবীবাসীদের জীবন এবং তার উপাদান সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যে ধারণা রয়েছে তা খুবই সীমিত। কিন্তু, এই কথাও সত্য যে কোনও গ্রহে জল আছে মানেই সেখানে কোনও না কোনওভাবে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। আমরা ছোট থেকে যে কথাটা শিখে এসেছি, জলের আরেক নাম জীবন, তাকে বলা যেতে পারে ধ্রুব সত্য। জল আমাদের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিবেদন তা বোঝানোর নয়। বা হয়তো তাই। বা বলা যেতে পারে, এই প্রতিবেদন এক ভয়াবহ বাস্তবকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলাতে প্রথম যোগাযোগ মাধ্যম সবুজ পৃথিবী এবং অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটি সম্প্রতি যৌথ প্রচেষ্টায় একটি সমীক্ষা করে। কলকাতাবাসীরা কী জল পান করছেন, তার গুণগত মান নির্ণয় করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। প্রত্যাশামতোই দেখা যাচ্ছে, কলকাতাবাসী বেশি টাকা দিয়ে নিম্নমানের জল পান করছেন। ইনস্ক্রিপ্ট এই বিষয়ে বিশদে জানতে যোগাযোগ করে সবুজ পৃথিবীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সুইস ফেডেরাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী অরিন্দম রায়ের সঙ্গে। ইউরোপিয়ান জার্নালে প্রকাশিত হওয়া এই রিপোর্ট নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন এই পরিবেশ বিজ্ঞানী। সেই সঙ্গে জানালেন কীভাবে সিটিজেন সায়েন্স প্রোগ্রামের মাধ্যমে তারা এই সমীক্ষাটি করেছেন।
শুরুতেই আসা যাক রিপোর্টে। এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ৩০০ জন বাসিন্দা। সেখান থেকে তারা প্রায় ৫৭০ টি জলের নমুনা সংগ্রহ করেন। সেই নমুনা পাঠানো হয় পরীক্ষাগারে যেখানে জলের টোটাল ডিসল্ভ সলিড বা TDS, pH এবং কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উৎস মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণীর অন্ত্র হলেও জলে, বিশেষ করে পানীয় জলে এর উপস্থিতি একেবারেই কাম্য নয়। জলে যদি কোনওভাবে প্রাণিজ বর্জ্যের মিশ্রণ ঘটে তখনই এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন ধরনের আন্ত্রিক ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়। বিশেষ করে ডায়রিয়া, আমাশা, রক্ত আমাশা, কলেরা, টাইফয়েড, সেই সঙ্গে আশঙ্কা থাকে জন্ডিসেরও। এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির অর্থ জল সরবরাহ ব্যবস্থা ভীষণ ভাবে ত্রুটিপূর্ণ।
আরও পড়ুন- পানীয় জল থেকেই ক্যান্সার! রোজ এভাবেই মিশছে ক্ষতিকর চিরস্থায়ী রাসায়নিক
পরীক্ষাগার থেকে যে ফলাফল আসে তা দেখে বিজ্ঞানীরা চূড়ান্ত আশঙ্কিত। তার কারণ, শহরের বেশিরভাগ জায়গাতেই মূলত কুড়ি লিটারের জার ব্যবহার করে থাকেন বাসিন্দারা। সেই কুড়ি লিটারের জারে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষণীয়। অন্যদিকে, টালা সরবরাহিত জল বা সরকারি ব্যবস্থায় সরবরাহ করা জলে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি অনেকটাই কম।
২০ লিটারের জলের নমুনাতে অরিন্দমরা কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন প্রায় ৪৪ শতাংশ, যেখানে সরকারি জলে এই ব্যাকটেরিয়া ২৫ শতাংশ। সবথেকে চিন্তার বিষয়, RO-UV ব্যবহারকারী জলের নমুনাতেও কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। নিয়মিতভাবে ফিল্টার না পাল্টানো, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আধুনিক ফিল্টারের জলেও এই ব্যাকটেরিয়া দানা বাঁধছে এবং বংশবৃদ্ধি করছে।
প্রতি ১০০ মিলিলিটার জলে এই কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বা সহনশীল মাত্রা কিন্তু শূন্য। অর্থাৎ, এর বিন্দুমাত্র উপস্থিতিও মানব শরীরের জন্য হানিকারক। কিন্তু শহরের বিভিন্ন জায়গার প্রায় ১৫০ টি নমুনাতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দেখা যাচ্ছে প্রায় ৬০ থেকে ২০০। অথচ এই জলের জার গুলি নাগরিকরা অনেক অর্থ খরচ করে কেনেন। অন্যদিকে সরকার যে বিনামূল্যে জল সরবরাহ করছে তাতে এর মাত্রা অনেক কম। সুতরাং বাণিজ্যিক পানীয় জলের এই নিম্নমান খুবই চিন্তায় রাখছে অরিন্দমদের।
তবে অরিন্দম রায়, অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সৃজন হালদাররা এক উল্লেখযোগ্য কাজ করে ফেলেছেন, পরিবেশ গবেষণা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে এই পদ্ধতি এক নতুন দিশা দেখাতে পারে। বিষয়টা হলো সিটিজেন সায়েন্স। ওঁদের এই কাজটি ভারতবর্ষের প্রথম এমন কোনও সমীক্ষা যেখানে নাগরিকরাই নমুনা দিয়ে সরাসরি সমীক্ষার কাজে সাহায্য করেছেন। অন্যান্য সমীক্ষার ক্ষেত্রে যারা আয়োজক তাদেরই গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে সেটা হয়নি। নাগরিকদের শুধুমাত্র এই উদ্যোগের কথা জানানো হয়েছে, তার পর শহরের বিভিন্ন প্রান্তের বাসিন্দা এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের অবদান রেখেছেন।
"শুরুতেই বলি, অ্যাডামাসের সঙ্গে আমাদের এক বছর আগেই একটি মউ সাক্ষর হয়, যেখানে আমরা ঠিক করি, এমন পদ্ধতিতেই এবং এমন বিষয় নিয়েই কাজ করব যেখানে জটিল কোনও পরীক্ষা বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন নেই কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক এবং পরিবেশগত গুরুত্ব রয়েছে। এবার জনগণকে এই কাজে এইভাবে জড়িয়ে নেওয়ার ধারণাটা অনেকটা এরকম, এই কাজটাই যদি আমরা নিজেরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন মানুষের ঘর থেকে সংগ্রহ করে আনতাম, তাহলে যেটা সমস্যা হতো তা হল, অনেক বেশি সময় লাগত, অনেক বেশি অর্থ প্রয়োজন পড়ত এবং মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ততা সেটাও পাওয়া যেতনা। সেই সঙ্গে এত বড় একটি শহরের প্রায় প্রত্যেক প্রান্তরে নিজেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে আনা খুবই কঠিন কাজ। তাতে প্রায় চার পাঁচ মাস সময় লেগে যায়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আমরা মাত্র পাঁচ দিনে শহরের সমস্ত প্রান্ত থেকে নমুনা সংগ্রহ করি," জানালেন অরিন্দম রায়।
কিন্তু পরিবেশ নিয়ে গবেষণার কাজে এই পদ্ধতিকে কেন যুগান্তকারী মনে করছেন এঁরা?
আরও পড়ুন- ১৩৫ বছর ধরে নেশার জল বেচছে কোকাকোলা? কীভাবে জন্ম নিল এই পানীয়, অবাক করবে যে ইতিহাস
"আমাদের মনে হয়েছে যে পরিবেশ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে তথ্যের খুবই অভাব, সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যদি তথ্য সংগ্রহ করা হয় তাহলে এই গবেষণার কাজ অনেক দ্রুতগতিতে হবে এবং সব থেকে বড় বিষয় হলো, নাগরিকরা নিজেরাই গবেষণাতে অনেক বেশি জড়িয়ে পড়ছেন, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। তারা অনেক বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন।"
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই পদ্ধতিতে যদি কাজ করা যায় তাহলে মানুষ আরও বেশি উৎসাহিত হবেন, সচেতন হবেন এবং সেই সঙ্গে তারা নিজেদের চারপাশকেও সচেতন করার কাজে অনেকটাই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন বলে মনে করছেন অরিন্দম। সেই সঙ্গেই এই ধরনের সমীক্ষাকে তারা জেলাতেও ছড়িয়ে দিতে চান বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, এই কাজে শুধু সদিচ্ছা প্রয়োজন। খুব একটা জটিল প্রক্রিয়া নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে উপলব্ধ যন্ত্রপাতি দিয়েই এই পরীক্ষা করা সম্ভব। তাঁর মতে, এই ধরনের কাজের জন্যে সরকারের কাছে কর্মীর অভাব উল্লেখযোগ্য। সেক্ষেত্রে নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে যদি এইভাবে তথ্য তুলে সরকারকে ধারণা দেওয়া যায় যে কোন কোন ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ প্রয়োজন, তাহলে হয়েতো আরও অনেক ভালো ভাবে কাজ হওয়া সম্ভব।
পৃথিবীতে তিন ভাগই জল, এক ভাগ স্থল। পৃথিবীতে কয়েকশো কোটি বছর আগে প্রাণের সঞ্চার প্রথম এই জলভাগেই হয় এবং বেঁচে থাকার যে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, সেই অক্সিজেনের সত্তর শতাংশই আসে এই জলভাগ থেকে। কিন্তু সবথেকে অদ্ভূত বিষয় হলো, এই এত পরিমাণ জলের ৯৯ শতাংশই নোনা জল। মানুষ এবং বহু প্রজাতিই যে জল সরাসরি ব্যবহার করতে পারেনা, পান করতে পারেনা। খুবই কম পরিমাণ জল আমাদের সরাসরি ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ করেছে প্রকৃতি। তার মধ্যেও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ সমানভাবে এই মিঠে জলের ভাগ পাননা। সেই সঙ্গে বিশ্ব উষ্ণায়নের চোখ রাঙানি তো আছেই। তার উপর যোগ হচ্ছে জলে এই প্রকারের দূষণ। এই কঠিন লড়াইতে সবুজ পৃথিবীর মতো সংগঠন একা লড়ে যেতে পারবে না যদি সমস্ত নাগরিক নিজেদের অধিকার, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে রক্ষা করতে এগিয়ে না আসেন।