কলকাতার পুজোর ভিড় থেকে মুক্তি? মন ভালো করবে জয়নগরের বনেদি বাড়ির এই পুজোগুলি
Traditional Durga Puja 2022: জয়নগরের মিত্র পরিবার অন্যতম প্রাচীন পরিবারের একটি। দত্ত বাড়ির মতো এটিও লাল আর সাদা এই দুই অংশে বিভক্ত। এই পরিবারে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় ১১৪০ বঙ্গাব্দে, শ্রী মধুসূদন মিত্রের হাত ধরে।
শহুরে মানুষজনের অনেকেরই ইচ্ছে থাকে কলকাতার প্যান্ডেলের ভিড় ছেড়ে দূরে কোথাও, ছিমছাম পুজো ঘুরে দেখার। প্রশ্ন করেন এমন কোথায় যাওয়া যায়, যেখানে একটু নিরিবিলিতে পুজোর গন্ধ নেওয়া যেতে পারে? কলকাতা অথবা কলকাতার বাইরে সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব হয়, এমন বনেদি বাড়ির সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রতিটি জেলার প্রায় প্রত্যেকটি অঞ্চলে সাবেকি বাড়ির পুজোগুলি এখনও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রাচীনত্বের ধারাকে বজায় রেখে চলেছে বংশ পরম্পরায়। যারা কলকাতা থেকে খুব দূরে না গিয়ে একই দিনে, একই অঞ্চলে কাছাকাছি দূরত্বের মধ্যে বেশ কয়েকটি বনেদি বাড়ির পুজোতে সামিল হতে চান এবং ফিরেও আসতে চান সেই দিনই, তাদের জন্য রইল আজকের বনেদি পুজোর গল্প।
কলকাতা থেকে অনতিদূরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত অন্যতম প্রাচীন পৌরশহর জয়নগরকে সকলেই চিনি সুপ্রসিদ্ধ ‘মোয়া’ প্রস্তুতকারক কেন্দ্র হিসেবে। তবে, জয়নগরের মোয়া যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই জয়নগর অঞ্চলের ইতিহাসও একইরকম ভাবে সুপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। আদি গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহ পথে সুন্দরবনের অন্তগর্ত এই অঞ্চল গড়ে উঠেছে পাশাপাশি দু’টি এলাকা জুড়ে, যার একটি হল জয়নগর, অপরটি মজিলপুর। যদিও জনপদ হিসেবে জয়নগর সুপ্রাচীন। ষোড়শ-সপ্তাদশ শতকের মঙ্গলকাব্যে জয়নগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। জনশ্রুতি অনুযায়ী, স্থানীয় দেবী জয়চণ্ডীর নাম থেকে উৎপত্তি হয় জয়নগরের। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে যখন জয়নগর জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, তখন কলকাতার মতিলাল বংশের পূর্বপুরুষ গুণানন্দ মতিলাল ছিলেন এখানকার জমিদার। এইসময় জয়নগরে বেশ কিছু জমিদার শ্রেণির ব্যক্তির বসবাস ছিল, তাদের বেশিরভাগই শিক্ষাক্ষেত্রে চতুষ্পাঠী পরিচালনার পাশাপাশি দুর্গোৎসবেও সামিল হয়েছিলেন। এবার আসা যাক জয়নগরের বনেদি বাড়ির পুজোর প্রসঙ্গে।
জয়নগর দত্ত বাড়ির পুজো
মজিলপুরের দত্ত পরিবারের রামচন্দ্র দত্তের জমিদারি ছিল বিস্তৃত সুন্দরবন জুড়ে। তিনি মজিলপুরে নিজস্ব বাড়ি এবং শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক কালিদাস দত্তের জন্ম হয়েছিল এই পরিবারে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভূত ভূমিকা আছে এই পরিবারের। দত্ত পাড়ার এই দত্ত বাড়ি দুই অংশে বিভক্ত, যার মধ্যে একটি হল লাল দত্ত বাড়ির পুজো। এই বাড়ির পুজো প্রথম শুরু করেন দ্বারিকানাথ দত্ত, আজ থেকে ২৩০ বছর আগে। এখন পঞ্চম প্রজন্মের সদস্যরা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পুজোর ঐতিহ্যকে। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে পুজো হয় এই বাড়িতে এবং বলিপ্রথা একেবারেই নিষিদ্ধ। পঞ্চমীর দিন বেলতলায় বোধন হয় দেবীর এবং ষষ্ঠীর সন্ধ্যেতে বিভিন্ন অলঙ্কারে ভূষিত করা হয় মৃন্ময়ী প্রতিমাকে। সাবেকি একচালা প্রতিমার এই পুজোয় রীতিনীতি সাদামাটা হলেও সন্ধিপুজোর সন্ধিক্ষণ এখনও শুরু হয় বন্দুকের শব্দে। এরপরেই রয়েছে সাদা দত্ত বাড়ি, যাদের পুজো লাল দত্ত বাড়ির চেয়েও প্রাচীন। আজ থেকে ২৫০ বছরেরও বেশি আগে শ্রীরামচন্দ্র দত্ত শুরু করেন এই বাড়ির পুজো। এখানে পুজো হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতানুসারে।
জয়নগর মিত্র বাড়ির পুজো
জয়নগরের মিত্র পরিবার অন্যতম প্রাচীন পরিবারের একটি। দত্ত বাড়ির মতো এটিও লাল আর সাদা এই দুই অংশে বিভক্ত। এই পরিবারে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় ১১৪০ বঙ্গাব্দে, শ্রী মধুসূদন মিত্রের হাত ধরে। পরিবারের আরেকটি শাখায়, দুর্গাপুজোর প্রবর্তন করেন মহেশচন্দ্র মিত্র ১৭৭৮-১৮৫৬ সালের মধ্যে এবং একইসঙ্গে মিত্র গঙ্গার পূর্ব তীরে একটি স্নানের ঘাটও নির্মাণ করেন। কিন্তু তাঁর অকালে মৃত্যু হওয়ায় তাঁর পুত্র অন্নদাপ্রসাদ ১৮৯৫ সালে দুর্গোৎসব পুনরায় আরম্ভ করেন এবং তারপর থেকে এখনও অবধি বংশ পরম্পরায় পালিত হচ্ছে এই উৎসব। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে সেই সময়ে স্থানীয় মহিলাদের নবমীর মধ্যাহ্নভোজনে আপ্যায়ন করা হত। শোনা যায়, সেই সময়ে দুর্গাপুজোয় সর্বসাকুল্যে খরচ হয়েছিল ৬৩০ টাকা। এই পরিবারের কৃষ্ণমোহন মিত্রের কৃতিত্বেই পাঁচখিলানযুক্ত দুর্গাদালান গড়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে রথও প্রতিষ্ঠা হয় এই পরিবারে, যা জয়নগরের ইতিহাসের সমৃদ্ধি বজায় রেখেছে এখনও।
আরও পড়ুন- কোথাও বরাভয়দাত্রী কোথাও উগ্রচণ্ডা! অবাক করবে দশভুজার দশটি অজানা কাহিনি
সেই সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরেও জমজমাট হত এই মিত্র পরিবারের ঠাকুরদালান। এই সাবেকি তিনচালার প্রতিমার কাঠামো পুজো হয় রথের দিন। বৈষ্ণব মতে পুজো হওয়ায় প্রতিদিনই দেবীকে নিরামিষ ভোগদান করা হয়। অষ্টমীতে এখনও কুমারী পুজোর রীতি বর্তমান এখানে। আগে পাঁঠা বলি হলেও, এখন তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে এখনও চিরাচরিত প্রথা মেনে দশমীর দিনে কাঁধে করে বিসর্জন দেওয়া হয় এই মাতৃপ্রতিমাকে। এর পাশাপাশি গোপীনাথ জিউয়ের উৎসবও পালিত হয়ে আসছে এই পরিবারে।
সিদ্ধান্ত বাড়ির পুজো
মজিলপুরে এই পরিবারের প্রতিষ্ঠার পিছনে একটি পৌরাণিক কাহিনি জড়িত আছে। মহারাজা প্রতাপাদিত্যের মুন্সি চন্দ্রকেতু দত্ত তাঁর যজ্ঞের পুরোহিত শ্রীকৃষ্ণ উদগাতা এবং রঘুনন্দন পোতাকে ১৬০৬ সাল নাগাদ, এই আদি গঙ্গার মজিত রূপ মজিলপুরে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসেন। এই শ্রীকৃষ্ণ উদগাতার প্রপৌত্রগণ ছিলেন বঙ্গদেশের সংস্কৃতিচর্চায় এক একজন দিগ্গজ পণ্ডিত। এঁরা প্রত্যেকেই কৃতিত্বানুসারে বিভিন্ন খেতাব পান, যার মধ্যে একটি হল সিদ্ধান্ত। এখান থেকেই সিদ্ধান্ত পরিবারের বিস্তারলাভ, যাঁদের কৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তি হলেন কালিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ। একটি কালীর মূর্তি এখনও আছে এই বাড়িতে এবং রয়েছে বাড়ির সংলগ্ন শিব মন্দিরও। আজ থেকে প্রায় ১৮০ বছর আগে শুরু এই পরিবারের দুর্গোৎসব। একচালা প্রতিমার অপরূপ সজ্জা সাবেকিয়ানা বজায় রেখেছে এই পরিবারের ঐতিহ্যে।
মতিলাল বাড়ির পুজো
জয়নগরের জমিদার আক্ষরিক অর্থে ছিলেন গুণানন্দ মতিলাল। সেই বংশের সূত্র ধরে পরবর্তীকালে এই পরিবারে জন্মান আরেক কৃতী সন্তান, যিনি হলেন কলকাতার বৌবাজার অঞ্চলের মতিলাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বনাথ মতিলাল। এই বংশে প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন রত্নেশ্বর মতিলাল, আজ থেকে ২৫০ বছর আগে।
সরকার বাড়ির পুজো
ধন্বন্তরী চিকিৎসক এবং সমাজ সংস্কারক নীলরতন সরকারের মামাবাড়ি হল এই সরকার বাড়ি। ডায়মন্ড হারবারের কাছে একটি গ্রাম থেকে এই অঞ্চলে এসে বসবাস করা শুরু করে এই সরকার পরিবার। এখানেই নীলরতন সরকার ও তাঁর ছোট ভাই বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার কৈশোরযাপন করেন। কালো পাথরে নির্মিত শ্রী শ্রী বাসুদেব জিউ পূজিত হন এখানে প্রতিদিন। এই পরিবারের দুর্গাপুজো ২০০ বছরের প্রাচীন। পরিবারের সকলের যৌথ সহযোগিতায়, এখনও প্রাচীনত্বের ধারা বজায় রয়েছে সরকার বাড়ির দুর্গাপুজোর রীতিনীতিতে।
জয়নগর কান্যন বাড়ির পুজো
জয়নগরের কুমোরপাড়া লেনের কান্যন বাড়ির পুজো ৩০০ বছরের প্রাচীন। কান্ব্যায়ণ অপভ্রংশে কান্যন মূলত দাক্ষিণাত্যের বৈদিক ব্রাহ্মণ শ্রেণির অন্তর্গত পরিবার। এই গোত্রের অধিকারী শ্রী কেশবচন্দ্র ভট্টাচার্য হুগলির প্রতাপপুর থেকে মজিলপুরে এসে বসবাস করা শুরু করেন। মূল প্রাচীন পদবি ভট্টাচার্য হলেও স্থানীয় লোকজন এটিকে ‘কান্যন বাড়ি’ হিসেবেই চেনেন। সে সময় যে সমস্ত পণ্ডিতগণ মজিলপুর অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেন তাঁদের মধ্যে তর্কপঞ্চানন মহাশয় অন্যতম। তাঁর আমলেই এই পরিবারে সম্ভবত ১৭৯০ সাল নাগাদ দুর্গাপুজো শুরু হয়। এই কান্যনদেরও দু’টি বাড়িতে পুজো হয় পাশাপাশি (বড় ও ছোট)। এখানে মহামায়ার মুখের আকৃতি প্রচলিত গড়নের চেয়ে সামান্য ভিন্ন। প্রায় ২০০ বছর আগে এই পরিবারে রঘুনন্দন ন্যায়রত্ন অধিষ্ঠিত হন। তাঁর পরবর্তী তৃতীয় প্রজন্মের পুরুষ আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে কোনও এক সময়ে অযোধ্যা থেকে পদব্রজে শ্বেতপাথরের একটি লক্ষ্মণের মূর্তি নিয়ে আসেন এই বাড়িতে। এই লক্ষ্মণই কান্ব্যায়ণ পরিবারের আরাধ্য গৃহদেবতা।
আরও পড়ুন- প্রণবহীন পুজোয় কেমন আছে মিরাটির ‘মুখার্জি ভবন’, স্মৃতিচারণে পুত্র অভিজিৎ
কীভাবে যাবেনঃ-
কলকাতা থেকে জয়নগর যাবার সবচেয়ে সহজ উপায় হল শিয়ালদার দক্ষিণশাখার ট্রেন ধরে জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনে নেমে পায়ে হেঁটে বাড়িগুলি পরিভ্রমণ করা। দু’একটি বাড়িতে পৌঁছবার ক্ষেত্রে স্থানীয় যানবাহনের সাহায্য নিতে হতে পারে। অন্যথায় বাড়িগুলির দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায়, মফসসলের পুজোর আমেজ নিতে নিতে হাঁটা পথেই গোটা দিনটা অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। নিজস্ব গাড়ি থাকলে গড়িয়া হয়ে বারুইপুর রুট ধরে আসা যেতে পারে।