দুর্গাদর্শক সবাই, দুর্গাদ্রষ্টা আছেন কেউ?
Durga Puja 2023 : এখনও গ্রামের দিকে দেখা যায় দেবীমুখ বর্তুলাকার। কারণ যে কোনও জিনিসকে গোলচে আকার দেওয়াই কুমোরের ধর্ম।
যে লেখে তার জানা উচিত কী লিখব, কেন লিখব। তবেই লেখার অভিমুখ স্পষ্ট হয়। আর যে দেখে? সে কি চোখের সামনে যা আসছে বাধ্যত স্রেফ তাই-ই দেখবে? যেমন কবি-অকবির ফারাক আছে লেখায়, তেমন দর্শক আর দ্রষ্টার ফারাক নেই কি? আমার মনে হয়, আছে। একজন সাধারণ দেখিয়ে আর ভিজুয়ালাইজারের ফারাক আছে। কী দেখব, কেন দেখব-- গাইডবই নেই ঠিকই কিন্তু দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে দর্শক আর দ্রষ্টা চেনা যায়। একজন দর্শক যা দেখেও দেখবেন না, দ্রষ্টা তাকে জায়গা দেবেন মনের গহিনে। দর্শকের চোখ আটকে যাবে জৌলুসে, দ্রষ্টার আন্তরিক পর্যটন হবে পুতুলখেলার আয়োজনের পেরিয়ে, ইতিহাসের অখ্যাতনামাদের ঘামের নুন আর চিন্তার ফসল তাকে স্তব্ধবাক করবে।
প্রতিবছর পুজো এলেই সত্যজিৎ রায়ের ছবির খণ্ডচিত্র মিম হয়ে ফোনে ফোনে ঘোরে। ফেলুদা গণেশ মহল্লার শশীবাবুকে জিজ্ঞেস করেন, "পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ পরশুর মধ্যে শেষ হবে?" শিবের গলায় জড়ানো সাপের গায়ে কালো ছোপ ছোপ রঙ ধরাতে ধরাতে একটু থেমে শশীবাবু অভয় দেন, হয়ে যাবে। তবে ফেলুদার শঙ্কাটা কিন্তু অমূলক নয়। তখনও দেবীমুখে রঙ হয়নি। বাকি সমস্ত অর্নামেন্টেশান বা অলংকরণ। এই অলংকরণ দেখেই চেনা যায় মূর্তি কোথায় যাবে, মূর্তি কার হাতে গড়া।
আরও পড়ুন- ‘বাসন্তী’ই আসলে বাংলার আদি দুর্গা, জানেন কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই পুজোর নেপথ্যে?
ষোড়শ- সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই বাংলার গ্রামগুলি ভাঙছিল। মন্বন্তর-মারীর চাপে কারিগর এবং শিল্পীরা চলে আসছিলেন শহরে। এই প্রবণতা আরও বাড়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপে জমিদারিগুলির পতন শুরু হলে। গ্রাম ভেঙে আসা কারিগরসমাজকে নিয়ে কলকাতার তলপেটের কাছে একে একে গড়ে উঠছিল টোলাগুলি। যেমন কুমোরটোলা, আহিরীটোলা, শাঁখারিটোলা, কাপালিটোলা। টোলা মানে বসতি, একই জীবিকার মানুষের একজায়গায় বসবাসের ব্যবস্থা। সে যাই হোক, উত্তর কলকাতাস্থিত কুমোরটুলির কারিগরদের ভাগ্যের চাকা ঘুরল শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হতেই। গ্রামের বর্তুলাকার মৃৎপাত্র, ছোটখাটো মূর্তি বানানোয় দড় শিল্পীদের হাতে উঠল গুরুদায়িত্ব। শোভাবাজারের পাশাপাশি তামাম বনেদি বাড়ি দুর্গাপুজো করতে লাগল। কুমোরটুলির কারিগরদের বরাত প্রতিবছর বাড়তে লাগল। যা দেখা হয়নি, যা অভিজ্ঞতায় নেই তা তৈরি করতে পারবেন না একজন শিল্পী, তাই প্রথম কয়েক দশক সিংহবাহিনী আসলে চাপতেন ঘোড়ায়। আর তার গয়না? তার গড়ন চিনতে মৃৎশিল্পীরা সুযোগ পেতেন এইসব বাড়িগুলির অন্দরমহলে ঢোকার। মেয়েদের গয়না দেখার। গয়নার খোঁজ তারা পেয়েছেন কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকেও। যে রামায়ণ তাদের গ্রামের দাওয়ায় বসে পড়েছেন কথকঠাকুর। রামায়ণ শোনার স্মৃতি এবং বনেদি গয়না দেখার অভিজ্ঞতাতেই দেবীমূর্তির অঙ্গসজ্জা তৈরি হতো কুমোরটুলিতে। বনেদি বাড়ির পুজো হোক বা কোনও বারোয়ারি উদযাপন, আজও কুমোরটুলির পালশিল্পীরা মাটির গয়না বানিয়ে আসছেন ইতিহাসের ধারা বেয়ে।
ক্রমেই এসেছে শোলার কাজ। মাটির গয়না বানাতে সময় লাগে বেশি তাই ডাক পেলেন একদল মালাকার, যারা উঠে এসেছিলেন শাঁখারিটোলা অঞ্চলে। কথিত আছে শিব বিবাহের সময়ে সাদা মুকুট পরতে চাইলে শিবের ইচ্ছেয় বিশেষ উদ্ভিদ এবং তা থেকে গয়না বানানোয় দক্ষ শিল্পী মালাকারের জন্ম। শিবের উপাসক মালাকাররা প্রকৃতি থেকেই তুলে এনেছেন গয়নার উপাদান। এমনিতে শোলা একটা কাণ্ডসর্বস্ব জলজ গাছ। বেশির ভাগ সময়ে ধানক্ষেতে জন্মায়। শোলা কেটেই নানা রূপ দান করেন মালাকাররা। কখনও ময়ূর, কখনও প্রজাপতি, কখনও মাছ, উঠে আসে বাংলার নিজস্ব পৃথিবী, বৃহত্তর পরিবারের-বাস্তুতন্ত্রের অংশ।
আরও পড়ুন- বাঙালির দুর্গাপুজোর ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান ধরা রইল ‘ইন দ্য নেম অফ গডেস’-এ
মাটির গয়না বানানোর কায়িক শ্রম, খরচ- কমাতে এল শোলা। কিন্তু শোলার একঘেয়েমি কাটবে কীসে? জার্মানির থেকে ডাকযোগে এলো ফয়েল। রূপোলি তার রঙ। প্রকৃতির মতোই, যেন স্থলের সঙ্গে জলের স্বচ্ছতোয়া ধারা এসে মিশল। কিন্তু দেবী তো অনন্যা, লৌকিকতার সীমা ছাড়ানো। অলৌকিক সমাচার আনতেই এই ডাকের সাজের সঙ্গে যুক্ত হলো তবক, বুলেন, সলমা জরি। নানা ধরনের ধাতব তার জড়িয়ে দেবীর এই অঙ্গসজ্জা, মুকুট তৈরিতে দক্ষ গুজরাতের মুসলমান কারিগররা। বাগবাজার সার্বজনীনের প্রতিমা দেখলে বুলেন সালমাজরি চেনা যাবে। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সালমা জরির পরিবর্ত হিসেবে অবশ্য আসে রোলেক্স। রোলেক্স রিবন, মুক্তাভস্ম, শোলার আরও জোরালো সূক্ষ্ম মোটিফে তৈরি অলংকরণ বাঙালি পেল আশির দশক থেকে। যাকে বলা হয় আর্টের সাজ। কারা এই বিবর্তনের কারিগর, কাদের মাথায় এই নতুন নতুন উদ্ভাবনের বিদ্যুৎ খেলে গেছে? আমরা মনে রাখিনি। কিন্তু চলাচল থামেনি। নতুন চিন্তা করার লোকেরাই এগিয়ে গিয়েছে থিমের দিকে। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল, কন্টেম্পোরারি সাজ। বিচ্যুতি নয়, ধারাবাহিকতাই। আমাদের পোশাকের অলংকারের বিবর্তনের মতোই এই বদলে বদলে যাওয়া।
আসবে দেবীমুখে লাবণ্য রচনা করা কারিগরদের কথাও। এখনও গ্রামের দিকে দেখা যায় দেবীমুখ বর্তুলাকার। কারণ যে কোনও জিনিসকে গোলচে আকার দেওয়াই কুমোরের ধর্ম। কিন্তু একজন শিল্পী নিজেকে ক্রমেই ভাঙবেন। তাই কুমোরের গোলচে ভাবের সঙ্গে মিশল সূত্রধরের কৌণিকতা। বাগবাজার সার্বজনীনের দুর্গা দেখলেই বোঝা যাবে। পানপাতার মতো মুখ৷ ওপরের দিকে বর্তুল, নীচে কৌণিক আভাস। একে বলা হয় দোভাষী। দেবীর চোখের দু'পাশ লাল, কিষেণগড়ের রাধার মতো পদ্মপত্রাভনেত্র। সারা গায়ে সালমাজরি বুলেনের কাজ, মাথায় আশ্চর্য এক মুকুট। বছরে একবার যে বাড়িতে আসে, যার এমনি নিয়তি শ্মশানমশানে পাগলাটে বরের সঙ্গে আজীবন অশান্তি ভোগ, সকলের দুর্গতিহরণ, তার নিজের জন্য মাত্র চারটে দিন। তাকে যারা সাজান তারা প্রাণ ঢেলে দেন। দর্শকের চোখ এড়ালেও দ্রষ্টা যেন ইতিহাসের এই বহমানতাকে খুঁটিয়ে দেখেন। যেন প্রাণটাকে খোঁজেন। এই দেখাই তো দেবীমুখে প্রাণসঞ্চার-প্রকৃত বোধন।
আরও পড়ুন- মুম্বইয়ের রঙ কোম্পানি বদলে দিল বাংলার দুর্গাপুজো! কীভাবে শুরু হল থিমের পুজো?
একটি সর্পিল ঠাকুর দেখার লাইনে থেকে লক্ষ্যভেদ করে অন্য লাইনে যেতে তৎপর যারা তারা কি দু'দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখবেন চালচিত্রের রকমফের? রানি রাসমণির বাড়ির চালচিত্র তৈরি করেন বীরভূমের কারিগর বাবলা পালের পরিবার। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পর্ব এখানে বিশদে ধরা থাকে। দেখার মতো, সাহিত্য পরিষদের বাড়ির পুজো। এইখানে দু'টি দরজাকে ব্যবহার করে যেভাবে দুর্গাপট দেখার ব্যবস্থা করা হয় তা গোটা বাংলায় আর কোথাও হয় না। দরজা খুললে খণ্ড খণ্ড ইমেজারিগুলি জুড়ে যেতে থাকে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতেও অনবদ্য চালচিত্র ব্যবহৃত হয়। আগে থেকে ব্লক বানিয়ে দশমহাবিদ্যা, অষ্টসখী আঁকেন ছোট কারিগররা। সারা বাংলাজুড়ে এই দুর্গাপট তৈরি করেন সূত্রধররা। কোথও কোথাও ধরা থাকে বিষ্ণুর দশ অবতার, কেথাও দশমহাবিদ্যা। বাঁকুড়া জেলায় পটদূর্গা তৈরি করেন ফৌজদার শিল্পীরা। কলেজ স্ট্রিটের শীলবাড়ির চালচিত্রের পট খুব অন্য রকম। পটের পাশে একটা ঘড়ি থাকে। দুর্গা সময়ে আসেন, সময়ে ফিরে যান। আপনভোলা ছেলেমেয়েদের নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে চান, তাই যেন রূপকে ধরেছেন শিল্পী।
দেখা যাচ্ছে গোটা দুর্গাশরীরটাই তৈরি অনামা কারিগরদের বুদ্ধিমত্তায়, শ্রমে। এককথায় এই শিল্প চিরকাল নিম্নবর্গের কাজের স্মারক। এখন প্রশ্ন, আমরা যারা আর্টশোভিত, নয়নভোলানো দৃশ্যের সমঝদার, আমরা যারা পুজোয় জনসমুদ্র, আমরা কি এই পাল, মালাকার, সূত্রধর, ফৌজদারদের কথা মনে রাখি? আমরা কি আদৌ এই কাজকে হাইআর্ট মনে করি? গ্যালারি শিল্পীদের মতো কদর কি একজন দুর্গাপট আঁকিয়ে পান? তাদের কাজের দিকে স্থির হয়ে দু'দণ্ড তাকাই? সে সময় আমাদের আছে? নাকি স্রেফ ক'টা প্যান্ডেল দেখা হলো সেই সংখ্যাই পাখির চোখ? আমরা সবাই দুর্গাদর্শক, আমরা কি কখনও দুর্গাদ্রষ্টা হতে পারব?