ট্যুরিস্ট স্পট উত্তরবঙ্গের জন্য কান্না, ঘাটাল-ভাটোরার বন্যা নিয়ে কেন এত উদাসীনতা?
Bengal Floods 2025: বরং বেশিরভাগের চোখের জল পড়ছে পাহাড় আর ডুয়ার্স নিয়ে। ঘাটালে আমরা বেড়াতে যাই না। সেখানে দেখার মতো কিছু নেই। সেখানকার 'দেবতা' দেবকে আমরা দেখতে পাই পর্দায়।
ছোটবেলায় দিঘা জায়গাটার নাম শুনেছিলাম বাড়িতে বড়দের আড্ডায়। জেনেছিলাম, সেখানে সমুদ্র আছে, বে অফ বেঙ্গল। একটু বড় হয়ে ঘুরতে গিয়ে দেখলাম, শুধু সমুদ্র নয়, সেখানে বহু মানুষ আছেন। জীবন আছে। বেঁচে থাকা আছে। বেঁচে থাকার লড়াই আছে। আছে সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি ও অল্প কংগ্রেস। শুধু সমুদ্র নয়, দার্জিলিঙের কথাও জেনেছিলাম এই ভাবে। জেনেছিলাম ডুয়ার্সের কথা। কিছু দিন পর, সেই সব জায়গায় বেড়াতে গিয়ে দেখলাম সেই একই দৃশ্য। অজস্র পাহাড়, নদী, জঙ্গল, প্রবল ঠান্ডা। আর সেই সব ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি। একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল সুন্দরবনের নাম শ্রবণ ও দর্শনেও।
সম্প্রতি বড়সড় দুর্যোগ হানা দিয়েছে সেই পাহাড় ও ডুয়ার্সে। প্রবল বৃষ্টি, ফুলেফেঁপে ওঠা নদী, ধস সব কিছু মিলে নাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। ঘটেছে প্রাণহানি। বহু মানুষ শিকড়হীন। তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন ত্রাণশিবিরে। কোমর বেঁধে উদ্ধার ও ত্রাণকার্যে নেমেছে প্রশাসন। আর পাহাড় ও ডুয়ার্সের আক্ষরিক অর্থেই আচমকা জলে পড়ে যাওয়া এই মানুষগুলির জন্য স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মতো সমতলের মানুষের প্রাণ কেঁদে উঠছে। তাঁদের দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছি আমরা। সত্যিই তো এ হেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তাঁরা কোথায় যাবেন? কী ভাবে আগের খাতে ফিরবে পাহাড় ও ডুয়ার্সের মানুষের জীবন-নদী? এই সব আশঙ্কা নিরন্তর কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের। আমরা অনেকেই সমাজমাধ্যমে এই সব আশঙ্কা প্রকাশ করে ফেলছি দীর্ঘ বা নাতিদীর্ঘ পোস্ট করে। কেউ কেউ আরও উদ্যোগী হয়ে ত্রাণ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। পোস্টে ফোন নম্বর জানিয়ে টাকা সংগ্রহ করছি। উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় কবলিত এই সব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন টলিউডের শিল্পীরাও। মোটামুটি ভাবে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জনগণের গোটা নজরটাই এখন উত্তরবঙ্গে। একইসঙ্গে প্রায় গোটা বাংলা মিডিয়াও ঝুঁকে পড়েছে সেই দিকেই।
আরও পড়ুন
উন্নয়নের নামে যেভাবে বিপর্যয় ডেকে আনা হলো উত্তরবঙ্গে
কিন্তু এই সব সংবাদমাধ্যম বা চোখের জলে আঁকা ফেসবুক পোস্টের বাইরেও একটা বড়সড় পশ্চিমবঙ্গ আছে। বস্তুত সেটাই এ রাজ্যের ৯০-৯৫ শতাংশ বলা যায়। সেখানে বহু মানুষ আছেন। জীবনযাপন আছে। বেঁচে থাকার লড়াই আছে। কিন্তু সেই বৃহৎ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি কিছুতেই পৌঁছচ্ছে না। বলা ভালো, সেই অভ্যাসও আমাদের বড় কম। যখন মিডিয়া সেই সব খবর কালেভদ্রে দেখাচ্ছে তখন তা নিয়ে মেতে উঠছি আমরা। তার আগে নৈব নৈব চ। এক প্রবীণ সাংবাদিক বার বার বলতেন,
''গড়পড়তা বাঙালি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা চেনে টুরিস্ট স্পট হিসাবে। এর বাইরে রাজ্যের আর কিছু চেনে না।''
আসল পরিস্থিতি থেকে নজর ঘুরিয়ে রেখে, পাহাড় ও ডুয়ার্সের বর্তমান অবস্থা নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির এই চোখের জল ফেলা সেই প্রবীণ সাংবাদিকের বলা সূত্র মেনেই হচ্ছে বলে আমার বক্তব্য। কিন্তু কেন?
গত কয়েক দিনে বৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, মনসুকা-সহ কয়েকটি এলাকা। এই নিয়ে গত চার মাসের মধ্যে ষষ্ঠবার প্লাবন পরিস্থিতি ঘাটালে। বেড়েছে ঘাটালের শিলাবতী, মনসুকার ঝুমি ও চন্দ্রকোনার কেঠিয়া নদীর জলস্তর। কোথাও বাঁশের সেতু ভেঙেছে। গ্রামীণ ও পুর এলাকা মিলিয়ে জলমগ্ন অবস্থায় রয়েছেন বহু মানুষ। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি সে দিকে নেই। বরং বেশিরভাগের চোখের জল পড়ছে পাহাড় আর ডুয়ার্স নিয়ে। ঘাটালে আমরা বেড়াতে যাই না। সেখানে দেখার মতো কিছু নেই। সেখানকার 'দেবতা' দেবকে আমরা দেখতে পাই পর্দায়। আর ফেসবুকে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে দুটো খোঁচা দিয়েই দায় সারি। আর সবচেয়ে বড় কথা, ঘাটালের এই পরিস্থিতি নিয়ে বাংলার মূল সংবাদমাধ্যম তেমন একটা খবর দেখাচ্ছেও না।
একই সূত্র খাটে হাওড়া জেলার আমতার ভাটোরা ও ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান অঞ্চলের ক্ষেত্রেও। সেখানে এক দিকে মুণ্ডেশ্বরী ও অন্য দিকে রূপনারায়ণ। এই এলাকা পরিচিত হাওড়ার দ্বীপাঞ্চল নামে। ডিভিসির জল দামোদর হয়ে ঢুকে পড়ে মুণ্ডেশ্বরীতে। তার জেরে অনেক সময়েই কার্যত দ্বীপের চেহারা নেয় ওই এলাকা। কিন্তু ভাটোরা ও ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান অঞ্চলে আমরা, মানে বাঙালিরা বেড়াতে যাই না। গিয়ে কী লাভ! সেখানে দেখারই বা কী আছে? কয়েক হাজার মানুষ আর জীবনযাপনের লড়াই ছাড়া আর কিছু তো নেই। ফলে আমাদের দৃষ্টির ফোকাসও ওমুখো হয় না কখনও।
আরও পড়ুন
শুভেন্দু থেকে রাজীব, ব্যর্থ সকলেই || স্রেফ দেবের চেষ্টায় কাটবে ঘাটালের দুর্দশা?
মালদহের ভূতনির চর। তার এক দিকে গঙ্গা এবং আর এক দিকে ফুলহার নদী। তার মাঝে চরের তিনটি পঞ্চায়েতে রয়েছেন বহু মানুষ। নিচু এলাকা। দু'দিক থেকে অজগরের মতো তেড়ে আসছে নদী। প্রায় প্রতি বছর কয়েক মাস ধরে লাগাতার জলমগ্ন থাকে ভূতনির চর। দুর্ভোগ সহ্য করেন মানুষ। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি সে দিকে প্রায় পড়ে না বললেই চলে। কারণ ভূতনির চরে আমরা কেউ বেড়াতে যাই না। আর মিডিয়া সেই খবর দেখায় নেহাতই দায়সারা ভাবে।
আয়লা, আমপান, রেমাল ইত্যাদি নানা ঘূর্ণিঝড় বিভিন্ন সময়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলীয় অঞ্চলে। ঘটনাচক্রে দু'টি জায়গাতেই পর্যটকদের যাতায়াত লেগেই আছে। কেউ যান বাঘ দেখতে। আবার কেউ সাঁতার কাটতে। ফলে, রাজ্য জুড়ে ওই দুই জেলার পরিচিতিও কম নয়। এক একটি ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার পর ওই এলাকাগুলিতে সরকার-প্রশাসন তো নিজের মতো করে ত্রাণ ও উদ্ধারকার্য চালিয়েছিলই। এর পাশাপাশি, ওই দুই জেলায় ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হয়েছিল ত্রাণবণ্টন। যার সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এই ছবি, বাংলার অন্যান্য দুর্যোগ কবলিত এলাকায় তেমন একটা দেখা যায় না।
এ হেন মধ্যবিত্ত-লিবারেল বাঙালিরই কেউ কেউ ফেসবুকে মাঝে মাঝে আকাশের নিচে নিজের ছবি পোস্ট করেন। সঙ্গে থাকে একটি বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি লাইন,
''বিজয়ন, আকিল, কুলজিৎ, বাইচুং, মাঠটাকে আরও বড় কর। মাঠ বড় না হলে আমরা কেউ ভালো থাকব না।''
কিন্তু আসল কথা আমাদের মাঠের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আটকে থাকে নিজেদের শ্রেণীভাবনার মধ্যেই।
Whatsapp
