মূর্তি গড়া থেকে বিসর্জন, জলই কথা বলে! অভাবনীয় যে শিল্পের সন্ধান দিল কলকাতা
Durga Puja 2023 : থিমের আবহে শিল্পীদের হাত ধরে দুর্গাপুজো প্রতি বছর তার প্রতিমা, মণ্ডপ, সাজসজ্জা, নিয়ে ক্রমশ একটা হাইব্রিড আর্ট-ফর্মের আকার নিচ্ছে।
শেষ বর্ষার জল শুকিয়ে শরতের আলো ঝলমলাতেই দুর্গোৎসবের ঢ্যাং কুড়াকুড় বাজনা বেজে গেছে। সেই আবহে জার্মান দূতাবাস এবং কলকাতার অলাভজনক সংস্থা ‘মাসআর্ট’ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শহরবাসীকে উপহার দিল দুর্গাপুজোর এক অন্যরকম প্রিভিউ। জার্মানির লাইট অ্যান্ড মিডিয়া ডিজাইনার টমাস আইখর্ন এবং ভারতের ধ্বনি শিল্পী (সাউন্ড আর্টিস্ট) সুকান্ত মজুমদারের সহভাগিতায় অক্টোবর মাসের ১২ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত টাউন হলে হয়ে গেল ‘জল কথা বলে’।
...ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল/ ঘাটের কাছে গল্প করে নদীর জল...। জল কি শুধু নদীর? শুধু সে-ই কি গল্প বলে? কুয়োর জল? বর্ষার? শিশিরের? চোখের? তাদের কথা? তাদের কোনও গল্প নেই? ‘জল কথা বলে’ প্রদর্শনী দেখার আগে প্রশ্নগুলো মনে ঘোরাফেরা করছিল।
চওড়া সিঁড়ি, বিশাল খিলান। আলোকিত মর্মর মূর্তিতে বন্দি ইংরেজ ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে আধুনিকতম বন্ধ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই চোখ কাড়ে আলো আঁধারির খেলা। এক জায়গায় দর্শক-শ্রোতাদের জন্য বৃত্তাকারে রাখা হয়েছে আরাম করে বসার জায়গা। তার আশেপাশে হল ঘরের বড় বড় থামের গায়ে আলোয়-লেখায় ফুটে উঠছে বাংলা কথা। ঝটিতে এই থাম, কলকাতার রাজবাড়ির থাম মনে করিয়ে দেয়। তরঙ্গ মিলায়ে যায়-এর মতো সে সব কথাগুচ্ছ ভেসে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। জলকে জড়িয়ে তৈরি হচ্ছে এক অন্য অনুরণন। সেই সঙ্গে কখনও কানে আসছে স্টিমারের জেটি ছেড়ে যাওয়ার আওয়াজ। কখনও জলের উপর দিয়ে হাওয়ার ফিসফিসানি। কেউ বা গাইছে জীবন-তরীর গান, জলের যাবতীয় আনুষঙ্গিকতা নিয়ে একের পর এক জেগে উঠছে, ভেসে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে ধ্বনি। টাউন হলের কঠিন মেঝেতে কি মাছ ঘাই মারল? তাই বিরাট বৃত্তে জেগে উঠল আলো দিয়ে তৈরি গোলাকার ঢেউ। মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। শব্দ-স্রোতের সঙ্গে আলো-কালো মিশিয়ে এই ঢেউ ভাবায়, সীমান্ত মেনে জার্মানির হামবুর্গের এল্ব নদীর জল, কী কথা বলে?
প্রদর্শনী নিয়ে ভাবনা চিন্তার সময় শিল্পী টমাসের কাছে প্রশ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি জানালেন, সেভাবে দেখতে গেলে জার্মানিতে দুর্গাপুজোর ব্যাপারে কেউ কিচ্ছু জানেই না। কিন্তু দুর্গাপুজোকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পরে এই প্রিভিউয়ের আয়োজন হওয়ায় তিনি পড়াশুনো শুরু করেন। এর আগে কলকাতা ঘুরে গেলেও বাংলার পুজো নিয়ে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। তাই, পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার মতো করে দুর্গাপুজোকে অনুধাবন করা সম্ভব নয় তা স্বীকার করে নিয়েই টমাসের পাল্টা প্রশ্ন, ক্রিসমাসে সান্টা ক্লজকে কলকাতা কীভাবে দেখে? তাছাড়া দুর্গাপুজোর প্রিভিউ-এর প্রদর্শনীতে ভিন্ন ধর্ম ও তার আচার নিয়ে কাজ করাটা কতটাই বা সমীচীন? এই সব প্রশ্ন থেকেই দুর্গাপুজো আর জলের যোগাযোগ নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে শিল্পী সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে আলোচনা করেন। বুঝতে চেষ্টা করেন দুর্গাপুজোর ব্যাপকতা। ধর্মীয় সংশ্লেষ থেকে বেরিয়ে শৈল্পিক খোঁজ তাঁকে পৌঁছে দেয় প্রশ্নে- জল কথা বলে? এই কোলাবোরেটিভ ইন্সটলেশন সে সন্ধানেরই প্রতিফলন।
আরও পড়ুন- পুজো ছিল, পুজো নেই : সুমন চট্টোপাধ্যায়
সুকান্ত মজুমদারের জন্য অবশ্য ‘জল কথা বলে’- এক বিবৃতিই। তিনি জানালেন, দুর্গাপুজো উপলক্ষে আয়োজিত এই দ্বিপাক্ষিক প্রদর্শনীর প্রস্তাব যখন আসে, তখন এমন একটা কিছু ভাবনার প্রয়োজন ছিল, যা সর্বজনীন, বিশ্বজনীনও। ধর্মের সঙ্গে তার যোগ নিবিড় আবার সহজ সরল দৈনন্দিন নামচাতেও তা অপরিহার্য। এমন একটা বিষয় যা সীমান্তে সীমাবদ্ধ নয়। তাছাড়া দুর্গাপুজোয় মূর্তি গড়া থেকে প্রতিমা নিরঞ্জন, সব কিছুতেই জল অবিচ্ছেদ্য। সেই সব ভেবেই সুকান্ত মজুমদার বিষয় হিসেবে জলকে বেছে নেন। ধ্বনি শিল্পী বিভিন্ন শব্দ-স্রোত জুড়ে জুড়ে গল্প-গাথা গড়ে তোলেন। কোথাও তা আটপৌরে খিলখিল হাসি। কখনও বা স্টিমারে ভোঁ-তে ভেসে পড়ার ডাক। নদী, জলের কাব্যময়তা নিয়ে জীবনানন্দের কবিতাংশের পাঠ শুরু হয়। তাল মিলিয়ে মেঝেতে আলো-ছায়ায়, সাদা-কালোয় তৈরি হয় এক অদ্ভুত মানচিত্র। প্রথম ঝলকে তা ফুটি ফাটা মাটি মনে হলেও কবিতার সঙ্গে তা ক্রমশ তা নদীর একান্ত মানচিত্র হয়ে ধরা দেয়। শ্রাব্য-ধ্বনিতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারাণসীর গঙ্গা আরতির ছবি। আজানের সুরে মনশ্চক্ষে ভাসে, বৈঠা রেখে কেউ কী গলুইতে নমাজ পড়ছে? নদীর সঙ্গে কথোপকথন এক ভিন্নতর ভাষ্যের জন্ম দেয়।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পরে ইন্দো-জার্মান সহযোগিতায় কলকাতায় এই প্রথম দুর্গাপুজো ‘প্রিভিউ’ প্রদর্শনী যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে দুনিয়া দুর্গাপুজোকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে। অন্যদিকে ধর্মীয় ঐতিহ্য, সাবেকিয়ানার গাম্ভীর্য ছেড়ে শহর গ্রাম মিলিয়ে এক বিপুল অংশের জন্য তা শারদীয়া শিল্পোৎসবের আকার ধারণ করছে। পুষ্পাঞ্জলি বা সন্ধ্যারতির ভক্তি নয়, সাধারণ মানুষ এক শিল্পযাত্রার বড় শরিক হয়ে দুর্গামূর্তি, মণ্ডপ, আবহ, আবহসঙ্গীত, আলোকসজ্জার সামগ্রিকতার তারিফ করছে। দুর্গাপুজোর প্রিভিউতে কি এই সূক্ষ্ম টানাপড়েনের ছায়া আছে? এ বিষয়ে এক মজাদার উত্তর দিলেন, এই প্রদর্শনীর কিউরেটর এবং মাসআর্ট-এর ভাইস ডিরেক্টর সায়ন্তন মিত্র। তিনি মনে করেন, পাড়ার বা বাড়ির পুজো, তার নিজস্বতা নিয়ে চললেও, থিমের আবহে শিল্পীদের হাত ধরে দুর্গাপুজো প্রতি বছর তার প্রতিমা, মণ্ডপ, সাজসজ্জা, নিয়ে ক্রমশ একটা হাইব্রিড আর্ট-ফর্মের আকার নিচ্ছে। হাইব্রিড শব্দটা নিয়ে আপত্তির কথা মাথায় রেখেই তিনি জানালেন, হাইব্রিড এই কারণেই যে, পুজো-শিল্প বা দুর্গা-আর্ট- এর যে ভাষা, তা এখনও তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে বহু স্বর, বহু পর্যায় রয়েছে। এ প্রদর্শনী দুর্গাপুজোর সেই বহু স্বরেরই প্রতিফলন।
কোচি শহরে কোচি বিয়েনাল, গোয়াতে ‘সেরিন্ডিপিটি’ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ছোট-বড় শহরে আর্ট ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে তার কদরও যথেষ্ট। অবশ্য এই ধরনের আর্ট ফেস্টিভ্যাল বরাবরই নির্দিষ্ট এক শ্রেণির দর্শক/শ্রোতা মণ্ডলীর জন্য। আয়োজিত আর্ট ফেস্টিভ্যালে বছর বছর থিম পাল্টে যায় আর কলকাতা-সহ গোটা পশিচমবঙ্গে বছরের পর বছর ধরে একটাই থিম—দুর্গা আর্ট। সায়ন্তন মিত্রের প্রশ্ন, আর কোথায় এই রকম গোটা শহর জুড়ে এত দিন ধরে বিভিন্ন শিল্পীর কাজ কোটি কোটি মানুষকে মাতিয়ে রাখতে পারে? এইখানে শিল্পী সুকান্ত মজুমদারও সহমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাক বা না থাক, দুর্গাপুজো ধর্মের নাটমন্দির থেকে ‘পাবলিক আর্ট’-এর চত্বরে পা রেখেছে। শুরু হয়েছে শিল্পী-দর্শকের বার্তালাপ। তা ভবিষ্যতে দুর্গাপুজোর নিজস্ব ভাষা তৈরির সম্ভাবনার কথা বলে। সেই দীর্ঘ যাত্রার এক পদক্ষেপ ‘জল কথা বলে’।
চণ্ডীপাঠের সুরেলা স্তোত্র, দুর্গাদালান, ঝাড়বাতি, নহবতের সানাই, একচালায় গর্জন তেলে চকচকে প্রতিমার মতো স্মৃতি মেদুরতায় সাড়া দিয়ে দর্শনার্থী ভিড় করছেন। আবার তাঁদেরই কল্যাণে দুর্গা-আর্টের জনপ্রিয়তা নতুনতর শিল্প-পরিভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে লড়ছে। দুর্গোৎসব ঘিরে সাবেকিয়ানা এবং আধুনিক শিল্প, এই দুই বাজারের সূক্ষ্ম বিভাজন বেশ চোখে পড়ে। অবশ্য বাজারের আবেদন মেনে যে যার জায়গায় স্বমহিমায় অবস্থানরত।
কোণারক থেকে ভিলওয়ালাড়া মন্দির অজন্তা গুহাচিত্র, মুঘল মিনিয়েচার বা পটচিত্র, ধর্মের সঙ্গে শিল্পের নিবিড়তার সাক্ষী ভারতের শিল্পকলার ইতিহাস। আধুনিকতা এবং পশ্চিমি শিক্ষা শিল্পকে ধর্মীয় মোড়ক থেকে টেনে তাকে ‘সেকুলার’ বলে ভাবতে শিখিয়েছে। এও এক রকমের কথোপকথন বৈ কি! সেই আলোচনাতেই বাঙালি দুর্গা আর্ট-এর পথ তৈরি করছে। তা আরও একটু এগিয়ে নিতে পুজোর ক’টা দিন, দমদমের পুজোতে দর্শনার্থীদের জন্য অন্যরকম অভিজ্ঞতার প্রলোভন। সুকান্ত মজুমদার এবং টমাস আইখর্ন আরও একবার একযোগে কাজ করছেন। দমদমের তিনটি জনপ্রিয় পুজোয় মাইকে নিরন্তর ঘোষণা, ভেঁপু, মোগলাই পরোটার পাশাপাশি, একটি বা দু'টি নির্দিষ্ট ই-রিকশ চড়ে ঘুরতে ঘুরতে দর্শনার্থীরা ধ্বনি-কথন, আলো ও মিডিয়া মিলিয়ে পুজোয় এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন।