শুভ মহালয়া বলা কি ভুল? দিনটির তাৎপর্য জানলে চমকে যাবেন
Durgapuja 2022: মহালয়ার তিথি থেকেই দেবীপক্ষর সূচনা। কী তাৎপর্য এই দিনের?
আশ্বিনের শারদপ্রাতে বাজিছে আলোকমঞ্জরি...
লাইনটা শুনলেই যেন মনটা জুড়িয়ে ওঠে বাঙালির । বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবের সূচনা এটি। এই দেবীবন্দনা দিয়েই শুরু হয়ে মা দুর্গার আরাধনা। যে দিনটিকে আমরা মহালয়া বলি। মহালয়ার অর্থ হলো পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরু। পুরাণমতে এই দিনই মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন মা দুর্গা। বাঙালির মহালয়া বলতেই সবার প্রথমে মাথায় আসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠে স্তুতিপাঠ। এই বিশেষ দিনে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার জন্য বিশ্বজুড়ে বাঙালি অপেক্ষা করে থাকেন বছরভর। এই মাতৃ-আরাধনা শুনতে ভোর ৪টে-তে উঠতেও দ্বিধা বোধ করে না ঘুমপ্রিয় বাঙালি। কারণ তাদের মনে তখন শুধু একজনই বাস করেন, দেবী দুর্গা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মহালয়ার নিজস্ব সাংস্কৃতিক মর্যাদা আছে বাঙালিদের কাছে।
মহালয়ার এই দিনে অর্থাৎ পিতৃপক্ষের এই শেষ লগ্নেই বাঙালি তারা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করে বিভিন্ন জায়গায়। যদিও 'মহালয়া' শুভ না অশুভ, এই নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে সমাজে। কারও মতে এটি শুভ, কারোর মতে এটি অপবিত্র। একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে এই দিনটাকে ঘিরে। যদিও পুরাণে বা শাস্ত্রে এটি শুভ না অশুভ, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা না মিললেও আনন্দ এবং আবেগকেই এখানে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়। যদিও একথা সত্য যে, শাস্ত্রে এই দিনে পূর্বপুরুষদের জল নিবেদনের বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তাই এই দিনটি অশুভ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিৎ নয়। মহালয়ার ব্যাখ্যা নানা ভাবে করা যেতে পারে, তবে বেশিরভাগ মানুষই দেবীপক্ষের শুরু হিসেবে দিনটিকে জেনে এসেছে। যদিও মহালয়ার গুরুত্ব মহাভারতের দিক থেকেও বিবেচনা করা যায়। আশ্বিনের অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপুরুষকে জলদান করে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার কাহিনি শোনা যায়।
আরও পড়ুন: বোধন নয়, ইছামতির বিসর্জনে শুরু হয় হুল্লোড়! ৩৮৭ বছরে এটাই ঐতিহ্য বসু বাড়ির পুজোর
পুরাণ মতে, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর অমর হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর পরাজয় নিশ্চিত ছিল কোনও নারীশক্তির কাছে। যখন অসুরদের অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, সেই সময় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই ত্রিশক্তি একত্রে এক নারীশক্তি সৃষ্টি করেন। তিনিই হলেন দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গা এই দিনেই মহিষাসুরকে বধ করেন। যেহেতু অশুভ শক্তির বিনাশ করে যেহেতু শুভশক্তির সূচনা হয়, তাই এই দিনটি শুভ বলে মনে করেন অনেকে।
কেবল মহাভারতেই নয়, কৃত্তিবাসের রামায়ণেও পাওয়া যাবে মহালয়ার উল্লেখ। শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে অকালে দেবী দূর্গাকে এই আহ্বান করেছিলেন। যার জন্য একে অকাল বোধনও বলা হয়। এইদিনে দেবীর চোখ আঁকা বা চক্ষুদান করা হয়। সুতরাং পুরাণ, শাস্ত্র, ইতিহাসে যাই-ই লেখা থাকুক না কেন, দেবীর আগমন মানুষের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দ ও সুখ। সেদিক থেকে বিবেচনা করলেও এই দিনটি আসলে শুভ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী এখনও পর্যন্ত বাঙালির ঘরে ভোর হতে না হতেই বাজতে থাকে। যেন সেই রেকর্ডিং আজও নতুন এবং অদ্বিতীয়। বেজে ওঠে সুপ্রীতি ঘোষের গলায় 'বাজলো তোমার আলোর বেণু'। প্রত্যেক বছর এই একটি সকাল, যেদিন প্রত্যেক বাঙালি গানটি কেবল শোনেই না, উপলব্ধিও করতে পারে। গানটি যেন অন্যরকম এক শান্তি বয়ে আনে মনে, এক আশ্চর্য খুশি অনুভব করতে পারে বাঙালি। এমন এক মায়ায় এই গান বেঁধেছে আমাদের, সেই মায়াজালে প্রত্যেকটি বাঙালি মন জড়িয়ে। ভোর থেকেই বাংলার প্রত্যেকটি টেপরেকর্ডার, এফএম একটাই সুর বাজায়, তা হলো 'ইয়া চন্ডী'। সঙ্গে থাকে 'জাগো তুমি জাগো'।
দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসেন শক্তিরূপে, পাপের বিনাশ করতে, এমনটাই বিশ্বাস। দেবী দুর্গাকে জগতের কল্যাণকারী মনে করা হয়, তাই তিনি জগৎজননী। ভক্তদের ধর্ম, অর্থ, জ্ঞান, মোক্ষ দান করতে মর্ত্যে দেবীর আবির্ভাব হয়ে তাই তিনি সর্বকামার্থদায়িনী। দেবী দূর্গা এই জগতের অন্নদাতা, তাই তাঁর নাম অন্নদা। রুদ্রের ঘরনি তিনি, তাই সকলে তাকে রুদ্রাণী নামে চেনে। শত অক্ষি দিয়ে তিনি সব কিছু নিজের নজরে রাখেন, তাই তিনি শতাক্ষী। তিনি পরম বৈষ্ণব, তাই তিনি বৈষ্ণবী; অন্যদিকে তিনিই অঙ্গকান্তি গৌরবর্ণা, তাই তিনি গৌরী নামেও খ্যাত। কৈলাস পর্বতে বাস, তাই তিনি পার্বতী। বহু নামের অধিকারিণী আমাদের দেবী দুর্গা। স্বরূপত তিনি এক ও অভিন্ন এবং অনন্য শক্তির রূপে-রূপান্তরে প্রকাশ হওয়ায় তিনি মহাশক্তি মহামায়া।
বিভিন্ন দেবতার তেজপুঞ্জে সৃষ্টি হয়ে তিনি সমস্ত তেজের উৎস, তাই তিনি প্রতিভাত তেজময়ী। মহিষাসুরকে দমন করার পরেই শাস্ত্রমতে শিবের পায়ে প্রবেশ করেছিলেন দেবী দূর্গা। সেই থেকে তিনি রুদ্রপন্তী উমা, অম্বিকা, হৈমবতী, দুর্গা, গৌরী, ভবানীর মিলিত দৈব সত্তা। ভাবপ্রবণ বাঙালির কাছে তিনি পরিপূর্ণভাবেই শিবপত্নী শিবানী বা সকলের 'মা দুর্গা'। তাই দুর্গাপ্রতিমার মধ্যে দুর্গার মাথার ওপরে শিবের অবস্থান দেখা যায়। পাশে থাকে তাঁর সন্তান-সন্ততি। এই রূপেই আমরা দুর্গাপুজোতে আরাধনা করে থাকি দেবীর।