উৎসবে তিলোত্তমাকে ভুলছে না মানুষ! প্রবাসের পার্বণ যেভাবে প্রতিবাদে মুখর
Durgapuja 2024 in Seattle: আরজি কর কাণ্ডের দোষীদের শাস্তির দাবিতে কলকাতা যখন উত্তাল, সিয়াটেলের সবার মন তখন খুব খারাপ কারণ প্রত্যক্ষভাবে এই বিচারের আন্দোলনে কেউই কিছু না করতে পারছেন না
দুই মাস অতিক্রান্ত। আরজি কর হাসপাতালে কর্মরত তরুণী চিকিৎসকের নির্মম হত্যা এবং ধর্ষণের ঘটনার সুস্পষ্ট কিনারা আজও অধরা। বিচারের অভিমুখ এখনও সুনির্দিষ্ট নয়। এই হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণের বীভৎসতা চিকিৎসক সম্প্রদায় তথা আপামর জনসাধারণকে বিহ্বল করেছে। আর এই মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিহত করতে প্রশাসনের সর্বস্তরের ব্যর্থতা, ঘটনা-পরবর্তী তদন্তকে প্রভাবিত করতে পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কিছু অংশের তৎপরতা মানুষকে যেমন ক্ষুব্ধ করেছে, তেমনই সঙ্ঘবদ্ধও করেছে। সুবিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। মেরুকরণের রাজনীতি মাথা নত করেছে মেরুদণ্ডের দৃঢ়তার কাছে। নাগরিক আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে তিলোত্তমা কলকাতা। এ যেন সমাজের অভিনব জাগরণ। এই রুখে দাঁড়ানোর ঝড় উদ্বেলিত করেছে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষকে। এমনকী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি আর উপমহাদেশের প্রবাসী নাগরিকদেরও।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের রাজ্য ওয়াশিংটন এবং এই রাজ্যের অন্যতম প্রধান শহর সিয়াটেলকেও স্পর্শ করেছে পৃথিবীব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ঢেউ। কর্মসূত্রে বিগত প্রায় ১২ বছর আমি সিয়াটেলের বাসিন্দা। ক্যাসকেড পর্বতমালার কোলে আমেরিকার এই অঞ্চলটির নৈসর্গিক স্নিগ্ধতা প্রকৃতপক্ষেই মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো। অন্যদিকে মাইক্রোসফট, আমাজন, এক্সপিডিয়ার মতো কোম্পানির প্রধান দফতর এই শহরে হওয়ার সুবাদে, বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বজনস্বাস্থ্যের কার্যালয় থাকার ফলে প্রাণচাঞ্চল্য আর জনবৈচিত্র এখানকার জীবনযাত্রাকে এক অন্য মাত্রা দেয়। এই মাত্রা প্রগতিশীল, উদারপন্থী। বৃহত্তর সিয়াটেল অঞ্চলে বাঙালির সংখ্যাও কম নয় এবং তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, বাঙালির তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ পার্বণ দুর্গাপুজোর সংখ্যা এই শহরে এখন প্রায় দশ ছুঁইছুঁই। এখানকার প্রবাসী বাঙালিদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা প্রায় দুই তিন সপ্তাহান্ত জুড়ে পালন হয়ে থাকে দেবীর আরাধনা, পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সর্বোপরি, একে অপরের সঙ্গে দেখা হওয়া আর তার সঙ্গেই ভাবনা, মননের আদানপ্রদান।
আরও পড়ুন- রক্তবর্ণা দেবী, বিশালাকার অসুর! কোচবিহারের বড়দেবীর পুজোর ইতিহাস চমকে দেবে
কলকাতা আমার জন্মভূমি। আমার বড় হওয়ার, হয়তো প্রকৃত অর্থে 'মানুষ' হয়ে ওঠার শহর। কলকাতারই সরকারি মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতাল প্রাঙ্গণ সাক্ষী আমার প্রথম যৌবনের প্রশিক্ষণের, আজীবন বন্ধুত্বের এবং চিকিৎসক হয়ে ওঠার। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রায় দুই দশক পরেও এই নাড়ির টান অক্ষত, অটুট। আমার শহরের হাসপাতালে এক কর্মরতা চিকিৎসকের নারকীয় হত্যা, ধর্ষণ এবং সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে একাধিক তথাকথিত চিকিৎসক, আধিকারিক এবং 'সুরক্ষা' কর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। শোকার্ত এই আবহের সঙ্গে শারদীয়া উৎসবের সহাবস্থানকে তাই ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। মনের এই দ্বন্দ্ব, টানাপড়েন নিয়েই ঠিক করলাম পুজোয় যোগ দেব। তবে একইসঙ্গে এখানকার পুজো কমিটির সদস্যদের অনুরোধও করলাম যাতে পুজোর মণ্ডপে বা অনুষ্ঠানে স্থান পায় সমকালীন পরিস্থিতি। প্রতিবাদী চিকিৎসকদের সঙ্গে যেন একাত্ম হতে পারি আমরা।
আরও পড়ুন- মেয়েকে ছাড়া শুধুই অন্ধকার! পুজো যেভাবে কাটাবেন নির্যাতিতার পরিবার
এখানকার সবচেয়ে পুরনো বাঙালি সংগঠনের পুজো, 'উত্তরণ' এই বছর কুড়ি বছরে পা দিল। উত্তরণের দুর্গাপুজো এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো গত সপ্তাহেই। কয়েক শতাধিক মানুষ 'তিলোত্তমা'র প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলেন নতমস্তকে, নীরব মূর্ছনায়। সংগঠনের বর্তমান সভাপতি রাজর্ষি রায় বলছেন, আরজি কর কাণ্ডের দোষীদের শাস্তির দাবিতে কলকাতা যখন উত্তাল, সিয়াটেলের সবার মন তখন খুব খারাপ কারণ প্রত্যক্ষভাবে এই বিচারের আন্দোলনে কেউই কিছু করতে পারছেন না। তাই উৎসবকে বেছে নিয়েছেন তারা। পুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, শারদপত্রের প্রচ্ছদে এবং পুজোর মণ্ডপে 'অভয়া'-র বিচারের দাবিতে কিছু স্মারক রেখেছেন তারা। শুধুই যে উৎসবের আনন্দে মেতে নেই তারা, তাঁদের যে মন খুব খারাপ, সুবিচারের দাবিতে সোচ্চার মানুষদের পাশেই যে তারাও আছেন, সেই বার্তাই দিতে চাইছেন তারা। চাইছেন দুষ্কৃতীদের কঠোরতম শাস্তি হোক, জানাচ্ছেন সিয়াটেল পাশে আছে।
সিয়াটেল এলাকার আরও কয়েকটি সংগঠনের পুজোর মধ্যে 'বারোবাড়ি'-র পুজোর এক বিশেষ স্থান আছে। এই পুজোর আয়োজনের প্রায় সমস্ত কর্মকাণ্ড আর পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রাক-ভাবনার দায়িত্বে থাকে এখানকার বেশ কিছু পরিবার। অসীম ভৌমিক সিয়াটল 'বারোবাড়ি' দুর্গাপুজোর একজন অন্যতম সদস্য। তিনিও বলছেন, আরজি করের ঘটনা শুধু বাঙালি নয়, সমস্ত মানুষ জাতির জন্যই কলঙ্কজনক। আর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই মাপের প্রতিবাদ করে জুনিয়র ডাক্তাররা যে নজির সৃষ্টি করেছেন, তাকে সবরকমভাবে সমর্থন করছেন তারা। তিলোত্তমা বিচার পান, জুনিয়র ডাক্তাররা বিচার পান এই দাবি তাদেরও! "আমরা সবাই চাই হাসপাতাল এবং সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ থ্রেট-কালচার মুক্ত হোক। যারা এই পরিবেশ তৈরি করেছেন আর যারা তাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন তারা শাস্তি পান,” বলছেন অসীম। এবছর দুর্গাপুজোয় পুষ্পাঞ্জলির আগে তিলোত্তমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করবেন সকলে। শত বিষণ্ণতা সত্ত্বেও, এই ঝরাপাতার হেমন্তে, এই সূদুর সিয়াটেলে বাঙালি সম্প্রদায়ের এই প্রচেষ্টাগুলির মধ্যেই কোথাও যেন খুঁজে পেলাম আমার কলকাতার অমলিন উষ্ণতা। কলকাতা হয়তো শুধু কলকাতাতেই নেই, তার খানিকটা রেশ, আমেজ, সজীবতা আছে সিয়াটেলেও!
লেখক পরিচিতি- ডাঃ আনন্দ শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পোলিও নির্মূলের জন্য কাজ এবং বিগত প্রায় দেড় দশক বিশ্বব্যাপী পোলিও ভাইরাস ও টিকাকরণ গবেষণায় নিয়োজিত তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ব বিদ্যালয়ে সংক্রামক ব্যাধি ও টিকাকরণ সংক্রান্ত বিষয়ের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত তিনি।