কীভাবে বাংলায় এল জনপ্রিয় ক্যাপ বন্দুক! অবাক করবে দুর্গাপুজোর এই খেলনার ইতিহাস
Cap Gun Nostalgia: সিভিল ওয়ারের পরবর্তীতে ১৯০০ সালের সময়কাল থেকে শুরু হয় সুপারহিরো সিনেমার চল। সেই সিনেমায় ব্যবহার করা হয় এই সমস্ত খেলনা বন্দুকের।
নয়ের দশক বা ২০০০-এর প্রথমদিক, তখনও সবাই এতটা টেক স্যাভি হয়ে ওঠেনি, তখনও বাংলার মানুষকে প্রযুক্তির আধুনিকতা ততটা গ্রাস করেনি। মানুষ তখনও ফোনের স্ক্রিনে পুজো দেখার থেকে প্যান্ডেলে গিয়ে পুজো দেখতে বেশি স্বচ্ছন্দ। সামান্য বিষয়গুলির মধ্যে থেকেই আনন্দ খুঁজে পেতেন তখনকার মানুষ। থিমের ভিড় ছিল না, ফলে রেষারেষির কোনও জায়গাও তেমন তৈরি হত না। পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতো কিছু এমন বিষয় যা আজকের ‘অতি আধুনিকতা’র ঠেলায় বিলুপ্তপ্রায় বলা চলে। এরকমই একটি বিষয় ক্যাপ বন্দুক। সেই যুগের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আজও এই বন্দুক এক নস্টালজিয়া। পুজো এলেই মনের মধ্যে অন্যরকমের খুশি, অন্যরকমের আনন্দ কাজ করতে শুরু করত। শুধু ঘুরতে যাওয়ার জন্য নয়, এই আনন্দের মূলে ছিল একটি বিশেষ ধরনের বন্দুক, যাকে একটা গোটা প্রজন্ম চিনেছে ক্যাপ বন্দুক নামে। দুর্গাপুজোর সময় এই ক্যাপ বন্দুকের জনপ্রিয়তাই ছিল তুঙ্গে। ক্যাপ বন্দুক ছাড়া দুর্গাপুজো ভাবাই যেতনা। শুধু বাচ্চারা নয়, এই আনন্দে সামিল হতেন বড়রাও।
দুর্গাপুজোয় এই ক্যাপ বন্দুক ছিল বাঙালি জীবনের এক অনবদ্য অংশ। পুজো এলেই ক্যাপ ফাটানোর গন্ধে ভরে যেত প্রতিটা পাড়া। এমন কোনও বাড়ি নেই, যেখানে ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও এই আনন্দ উপভোগ করেননি। পুজো এলেই দাদু বা ঠাকুমার কাছে শুরু হতো আবদার। আর পঞ্চমীর দিন তাদের হাত ধরেই বাড়িতে আগমন ঘটত এই বন্দুকের, তার সঙ্গে এক রিল ক্যাপ। প্রতিবছর নতুন জামা আর নতুন বন্দুক ছিল পুজোর প্রাণভোমরা। প্রথম প্রথম ক্যাপের আওয়াজ একটু সমস্যা করলেও পরে সয়ে যেত। আর তারপরেই ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে ফাটানো হতো ক্যাপ। পুজোর কয়েকটা দিন তখন অনেক শিশু বা কিশোর কিশোরীই নিজেদের মনে মনে হয়ে উঠত পুলিশ। আজ বিলুপ্তির পথে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী ক্যাপ বন্দুক।
১৮৬০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় আবির্ভাব হয় এই খেলনা বন্দুকের। সেই সময় আমেরিকায় বিভিন্ন প্রদেশে চলছে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পরিবেশটাকেই কাজে লাগিয়ে কচিকাঁচাদের জন্য নতুন বিনোদনের মাধ্যম তৈরির পরিকল্পনা করল আমেরিকার নামী দামি বন্দুক প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলি। তৈরি হলো প্লাস্টিকের খেলনা বন্দুক। তবে প্রথমে যে রকম বন্দুক তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলি কচিকাঁচাদের মাঝে বিশেষ একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তার কারণ অবশ্য এই ধরনের বন্দুকের ডিজাইন। খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না সেই যুগের খেলনা বন্দুকের ডিজাইনগুলি।
আরও পড়ুন- বাঙালির দুর্গাপুজোর ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান ধরা রইল ‘ইন দ্য নেম অফ গডেস’-এ
তবে এরপরে এই বাজার অনেকটা পরিবর্তিত হয়। সিভিল ওয়ারের পরবর্তীতে ১৯০০ সালের সময়কাল থেকে শুরু হয় সুপারহিরো সিনেমার চল। সেই সিনেমায় ব্যবহার করা হয় এই সমস্ত খেলনা বন্দুকের। সেই সময় সিনেমার জন্য যেরকম খেলনা বন্দুক তৈরি করা হতো, সেগুলি দেখতে ছিল একেবারে আসল বন্দুকের মতো। আওয়াজও ছিল বেশ জোরে। ফলে ছোটদের মাঝে বেশ ভালোভাবেই জনপ্রিয়তা পায় এই বন্দুক। তবে, সেকালের বন্দুকে এক বিশেষ ধরনের ডার্ট বা গুলি ব্যবহার করা হতো যা অনেক সময়ই শিশুদের আহত করত।
তখন প্রয়োজন পড়ল এমন এক খেলনা বন্দুকের যাতে আওয়াজও হবে, আবার বাচ্চারাও একেবারে সুরক্ষিত থাকবে। সেখান থেকেই আবিষ্কার হলো ক্যাপের। এই ক্যাপ ছিল মূলত দুই রকমের। একটি হলো বড় ক্যাপ, এগুলি ব্যবহার করা হতো সিনেমার ক্ষেত্রে। আরেকটি হল ছোট পেপার ক্যাপ, যেগুলি পাওয়া যেত কাগজের রোলের আকারে। বড় ক্যাপ সিনেমার জগতেও তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু ছোট ক্যাপ এবং সেই বন্দুক ১৯৩০ এর যুগ থেকেই হয়ে ওঠে ব্যাপক জনপ্রিয়। সেকালের বিভিন্ন ম্যাটিনি আইডলদের নামেও তৈরি হয় একাধিক বন্দুকের মডেল। রয় রজার্স, জেনি আর্ট্রি, হোপালং ক্যাসিডি, মার্শাল ম্যাট ডিল্লন, এই সমস্ত তারকাদের নামে তৈরি হলো একাধিক বন্দুকের মডেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে বিভিন্ন টিভি শোতে ব্যবহার করা হয় এই ধরনের বন্দুক। সেই সময় থেকে ২০ বছর পর্যন্ত পশ্চিম বিশ্বে ছিল এই ধরনের বন্দুকের সব থেকে ভালো সময়। নিকলস, হাবলি, কেন্টন, কিলগরে, ক্লাসিক, ম্যাটেল, এক্টয়, জর্জ স্মিট, স্টিভেন্সের মতো কোম্পানি আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অন্যদিকে পাইওনিয়ার, কোল্ট ৪৫, কাউ বয়, স্ট্যালিন ৪৫, টেক্সান, পনি-র মতো কোম্পানিগুলি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। তবে, বাংলায় এই ধরনের ক্যাপ বন্দুকের জনপ্রিয়তা শুরু হতে একটু সময় লেগেছিল। ১৯৬০ এর দিকে বাংলায় এই ধরনের বন্দুকের আগমন ঘটে। তার সঙ্গেই আগমন হয় লায়ন নামের একটি কোম্পানির যারা তৈরি করত রোল ক্যাপ। প্রথমদিকে খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও ১৯৬৫ সাল নাগাদ ভারতের খেলনার বাজারে একেবারে জাঁকিয়ে বসে এই ক্যাপ বন্দুক। মোটামুটি ৪০ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত এই ধরনের ক্যাপ বন্দুকের ব্যবসা ছিল রমরমা। তবে আজ এই বন্দুক প্রায় লুপ্ত বলা চলে।
ক্যাপ বন্দুকের শব্দের সঙ্গে মিলে আগমনীর যে বার্তা বইতো বাংলার আকাশে, তার জায়গা আজ দখল করে নিয়েছে জেবিএল এর হাইপারসনিক স্পিকার। সবই কম্পিউটার আর মোবাইল নির্ভর, সেখানেই ব্যস্ত আট থেকে আশি সকলেই। ক্যাপ বন্দুক ফাটানোর মতো সকলের কাছে সময়ও নেই। তাই প্রয়োজন কমেছে। আগে ১০ টাকায় যে ক্যাপ বন্দুক পাওয়া যেত, এখন ৬০ কিংবা ৭০ টাকা দিলেও এই বন্দুক অমিল। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বন্দুক চালায় এখনও। বরং ইদানীং কালেই বাচ্চাদের বন্দুক চালানোর প্রবণতা বেশি বেড়েছে। তবে সেই বন্দুক সীমিত ভিডিও গেম পার্লার পর্যন্তই। যারা হাতে ফোন পেয়েছে, তাদের বন্দুক চালানোর দৌড় স্মার্টফোনের স্ক্রিন পর্যন্তই। সেই বন্দুকও দেখতে এই সমস্ত ক্যাপ বন্দুকের থেকে অনেকটাই ‘স্মার্ট’। অগমেন্টেড রিয়ালিটিতে সেই বন্দুক দিয়ে গুলি করে ক্যারেকটার নিধনও সম্ভব। তবে, সেইসব বন্দুক পুজোর সুর বহন করে না। সেখানে না আছে পুজোর গন্ধ, আর না আছে আগমনীর সেই সুর।
আরও পড়ুন- ডক এলাকার সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ও আটের দশকের দুর্গাপুজো
এখনকার বাবা মায়েরা তাঁদের বাবা মায়েদের কাছে ৫ বা ১০ তারার বন্দুকের দাবি করত, দাবি করত লায়ন ছাপের ক্যাপের। পুজো আসছে মানেই পাড়ার মোড়ে মোড়ে বাঁশের বাঁশি, বন্দুক, ক্যাপ, বেলুনের দোকান। এসবের জায়গা নিয়েছে প্লাস্টিকের খেলনা, মোবাইলের অফারের স্টল। পুজোর বিজ্ঞাপনও পাল্টেছে অনেকখানি। পানমশলা বা মোবাইলের বিজ্ঞাপনের কাছে হেরে গিয়েছে বাংলার পুরনো কিছু কোম্পানির বিজ্ঞাপন।
পকেটে করে লুকিয়ে ক্যাপ বন্দুক নিয়ে পাশের পাড়ায় চলে যাওয়া, সে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাপ বন্দুকের লড়াই, এসবের কোনও বালাই আজ নেই বললেই চলে। বারুদের গন্ধ মানেই যে শুধু হিংসা নয়, বারুদের গন্ধ মানেই যে স্রেফ ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা নয়, বারুদের গন্ধ যে সারল্যেরও প্রতীক হতে পারে, বারুদের গন্ধও যে আনন্দের অনুভূতি তৈরি করতে পারে, সেটা ক্যাপ বন্দুকের সামনে নাক না নিয়ে গেলে কেই বা জানত?
স্মার্টফোন আর স্মার্টওয়াচের ভিড়ে কোনও দিন কি আর জায়গা ফিরে পাবে এই নস্টালজিয়া? আবারও কি মণ্ডপে মণ্ডপে ক্যাপ ফাটানোর লড়াইয়ে আকর্ষণ খুঁজে পাবে একালের শৈশব? ‘নাইন্টিজ কিডস’দের খেলনা কি ফের দুর্গাপুজোর অঙ্গ হয়ে উঠবে কখনও? এসব প্রশ্নেই পেরিয়ে যাচ্ছে নয়া জমানার উৎসব, পেরিয়ে যাচ্ছে উৎসবের কার্নিভাল।