জুকু ভ্যালি, স্বর্গের প্রবেশপথ

'ঠিক কী কী কারণে জুকু ভ্যালি ট্রেক মিস করা অপরাধ?'

আমার ফেসবুক ডিপি দেখে, কিছুদিন আগে জানতে চেয়েছিল এক বান্ধবী।
প্রশ্নটা শোনার পর থেকে আমি ভাবছি, কী কী কারণ যথেষ্ট হতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর হিসাবে! অফিসে, বাড়িতে, বন্ধুদের আড্ডায়, শহরের ট্রাফিকে সব জাগায় মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে এই একটাই প্রশ্ন। 'কী কী কারণে জুকুভ্যালি ট্রেক না করা অপরাধ?'

উত্তর হিসাবে যে যে কারণগুলো মাথায় এলো সেগুলো কিছুটা এরকম -

১. যারা কখনো ট্রেকিং করেনি, কিন্তু ভাবছে শুরু করবে, তাদের জন্য নাগাল্যান্ডের জুকু ভ্যালি ট্রেক  একফালি পাঁউরুটির ওপর মাখনের টুকরোর মতো। এই স্বাদের আলাদাই প্রলোভন। বিলো এভারেজ ওয়াকার'রাও ৪ ঘন্টার মধ্যে এই ট্রেক শেষ করে নিতে পারে। অন্যান্য ট্রেকের মতো রোজ রোজ মাইল মাইল হাঁটাও নেই এখানে।

জুকু ভ্যালি, স্বর্গের প্রবেশপথ

লেখকের নিজস্ব চিত্র - জুকু ভ্যালির দৃশ্য

২. ভারতবর্ষের অন্যান্য যে কোনো পাহাড়ি এলাকার ভ্যালিগুলোর সাথে নাগাল্যান্ডের ভ্যালির একটা পার্থক্য আছে। ছোট ছোট বাঁশগাছ দিয়ে ঢাকা থাকায় পাহাড়গুলো বছরের অধিকাংশ সময়ই সবুজ হয়ে থাকে। চট করে দেখলে মনে হয় যেন একটা আদিম সভ্যতা সারা গায়ে সবুজ রঙের আবির মেখে, পাহাড় সেজে বসে আছে। বৃষ্টি আসে, ভিজে যায় তার শরীর। কিন্তু তার রং মোছেনা, বরং গাঢ় হয়ে যায় আরও।

৩. বাড়ির পাশে যদি এমন কিছু থাকে যা পৃথিবীর অন্য কোত্থাও নেই, তা সামনে থেকে চাক্ষুস না করলে, মনটা কেমন একটা উসখুস উসখুস করেনা? জুকু লিলি। মাটির দিকে মাথা নিচু করে ফুটে ওঠা লিলির এই প্রজাতিটির যেন বহুজনমের অভিমান সূর্যের ওপর। যেন পৃথিবীতে এক এবং অনন্য হয়েও অহংকার তাকে ছোঁয়ার স্পর্ধা পায়নি কক্ষনো। যেন একটা গোলাপি আভা কোনো স্বর্গীয় অপ্সরার শরীর থেকে ঠিকরে পড়ছে সারা ভ্যালিতে।
আর এই লিলি, একমাত্র জুকু ভ্যালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোত্থাও নেই। পৃথিবী ছাড়ুন মশাই, স্বর্গেও নেই।

৪. দ্য ভ্যালি। মনিপুর আর নাগাল্যান্ডের বর্ডারে অবস্থিত জুকু ভ্যালি। ভ্যালির ঠিক মাঝ বরাবর দিয়ে বয়ে গ্যাছে একটা সরু স্ট্রীম, যা জুকু এবং জাপফু এই দুই নদীর মিলিত প্রবাহ। অসংখ্য বাহারি ফুলের মেলা বসে রোজ তার দুই পাড়ে। সেই মেলায় শরিক হতে প্রজাপতি নেমে আসে, রামধনু ডানা পিঠে নিয়ে। মেঘ ছুঁয়ে মাখামাখি হয় তার রঙে। আর কিছু প্রাকৃতিক গুহা, ট্রেলের দিকে চোখ মেলে বসে থাকে আজন্মকাল। যেন কারোর অপেক্ষা করছে সে। যেন প্রত্যেকটা ট্রেকার কে সে বলছে - 'এসো বন্ধু। তোমার শহরের স্যাঁতস্যাঁতে দু'কামরা, ঘ্যানঘ্যানে চাকরি, প্যানপ্যানে জীবন আর ঘিনঘিনে রাস্তা ভুলে, দু'টো দিন এসো। আমার বুকে আশ্রয় নাও'।
আপনি হেঁটে যেতে যেতে ওদের এসব কান্ড কারখানা দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে যাবেন ভ্যালির একদম শেষতম প্রান্তে। যার পরেও ভ্যালি বিস্তৃত বহুদূর, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর রাস্তা বানায়নি কেউ। সেখানেই দেখা যায় একটা সাদা রঙের প্রায় দু'তলা উঁচু ক্রস। যার পাশেই একটা বোর্ডে লেখা আছে 'এখানেই থামো বন্ধু। এরপরের প্রকৃতি শুদ্ধ।'

লেখকের নিজস্ব চিত্র - জুকু ভ্যালির দৃশ্য

৫. দ্য ডর্ম। জুকু ভ্যালির টপে থাকা একমাত্র ডর্মিটোরিকে আরামসে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটিতে ফেলাই যায়। ভাবুন তো দেশ বিদেশ থেকে আসা নানান জাতের, নানান ক্লাসের, নানান রঙের, নানান ভাষার কিছু মানুষ এই জায়গাটায় এসে একসাথে থাকে। কারণ প্রকৃতির কাছে মানুষের কোনো বিভেদ নেই। তাই যে জার্মানির সুপারনোভা তন্বী তার দেশে রোলস রয়েলস বা ফারারী চালায়, এবং যে বাংলাদেশের ছেলেটা সাইকেল চালিয়ে বাস ভাড়া বাঁচিয়ে বা টিফিন না খেয়ে টাকা জমিয়ে, এই ভ্যালিতে এসে পৌঁছায়,  তারা দু'জনেই সারাদিন ভ্যালিতে প্রজাপতির মতো উড়ে, রাতে ৫০টাকা দিয়ে ম্যাট্রেস ভাড়া করে ডর্মের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ে। পাশাপাশি।

৬. কালচার। এই ট্রেকের একটি অন্যতম টপআপ হলো নাগা কালচারকে জানতে পারা। একবার ভাবুন শুধু, আপনার হোমস্টের হোস্ট আপনাকে নিয়ে পৌঁছে গেছে তার গ্রামে। তার বাড়ির ভিতরে রান্নাঘরে বসে চা খেতে খেতে আপনি দেখছেন তার ৭৫ ছুঁইছুঁই বৃদ্ধা মা, তাকিয়ে আছেন আপনার দিকে জুলুজুলু চোখে। বাড়ির ছোটছোট কুঁচোকাঁচারা আপনাকে দূর থেকে আড়চোখে দেখে হুটোপাটি করে পালিয়ে যাচ্ছে লজ্জা পেয়ে। তারপর সেই হোস্ট কখনো তার বাগানের গাছ থেকে আপনার হাতে পেরে এনে দিচ্ছে পাহাড়ি মিষ্টি ফল। আবার কখনো তাদের জাপানের সঙ্গে লড়াইয়ের ইতিহাস বোঝাচ্ছে। কোনো গ্রামের গেটের বিভিন্ন অদ্ভুত অদ্ভুত স্কাল্পচারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে কোন মুকুটের কি রহস্য। গ্রামের মোড়লের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনাকে সে বোঝাচ্ছে কেন  সেই বাড়ির মাথায় লম্বা একটা কাটা চিহ্ন বর্তমান। আবার কখনো সরু আলপথ ধরে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের প্যাডিফিল্ডে। এসবই যেন স্বপ্নের কারখানা। যা জুকুভ্যালির জন্য রওনা না দিলে আপনার অধরা থেকে যাবে।

ট্রেকের প্লাস পয়েন্টস :

লেখকের নিজস্ব চিত্র - জুকু ভ্যালির দৃশ্য

১. জুকুভ্যালি কে চাইলেই উইকএন্ড ট্রেক বানিয়ে ফেলা যায়। কীভাবে? শুক্রবার সকাল সকাল কোনো ফ্লাইটে চেপে নেমে যান ডিমাপুর। তারপর ডিমাপুর থেকে কোহিমাগামী একটা শেয়ার ট্যাক্সিতে উঠুন। রাস্তা মধ্যিখানে অল্প খারাপ হলেও  ৬ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন কোহিমা বাস স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে আবার একটা শেয়ার ট্যাক্সী নিয়ে ১ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন কিগওয়েমা গ্রামে। বিকাল ৩টে-৪টের মধ্যে গ্রামে পৌঁছে গেলে একটুও সময় নষ্ট না করে ২ ঘন্টার ঝটিকা সফরে ঘুরে আসতে পারেন নাগা হেরিটেজ ভিলেজ। রাতটা কাটান কিগওয়েমা গ্রামেই যেকোনো হোম স্টে'তে। ট্রাস্ট মি নাগাপুরী রান্নার স্বাদ কলকাতার আর্সালান কে, বলে বলে ১০ গোল মারতে পারে। রাতটা লেপের তলায় কাটিয়ে, শনিবার ভোর ভোর (৬টা নাগাদ) রওনা দিন বিশ্বেমা বা জাখামার উদ্দেশ্যে। যেকোনো শেয়ার্ড ট্যাক্সী বা রিজার্ভ করা গাড়ি নিয়ে (বিশ্বেমা থেকে ট্রেক শুরু করলে গাড়ি রিজার্ভ করে নেওয়া ভালো। কারণ বিশ্বেমার ট্রেকিং পয়েন্ট মেন রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতরে) ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন ড্রপ পয়েন্টে। দুপুর ১২টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন জুকু ভ্যালিতে। বিকেল অব্দি ভ্যালিতে স্বর্গের ছোঁয়াচ নিয়ে, রাতটুকু কাটিয়ে দিন ভ্যালির টপে থাকা ডর্মে। রবিবার দিন ভোরবেলা গরম চা খেতে খেতে একপ্রস্থ ভ্যালির দিকে চোখ বুলিয়ে রওনা দিন সমতলের দিকে। রবিবার দিনেই ডিমাপুর থেকে সন্ধ্যা বেলার কোনো ফ্লাইটে চেপে বাড়ি ফিরে আসুন। হ্যাঁ একটু হেকটিক হবে মানছি, কিন্তু ওই যে বলে 'টোট্যালি ওয়ার্থ ইট..'

২. শেয়ার্ গাড়ি যদি আপনার ট্রান্সপোর্টেশন মিডিয়াম হয়, এবং যাতায়াতের মাধ্যম যদি ট্রেন হয়, তবে এই ট্রেককে আপনি অনায়াসেই পকেট ফ্রেন্ডলি উপাধী দিতেই পারেন। এসি বাস, লোকাল বাস, শেয়ার্ ট্যাক্সী, শেয়ার্ সুমো সমস্ত অপশন হাতের কাছে থৈ থৈ করে।
আর ভ্যালিতে প্রতিদিন থাকা খাওয়া নিয়ে খরচ মাথা পিছু মাত্র ৬০০টাকার মধ্যে।

৩. গাইডের কোনো প্রয়োজন এই ট্রেকে হয়না। ট্রেলের একটা বেসিক আইডিয়া গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে নিয়ে নিলেই, আরামসে পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে।

ট্রেকের মাইনাস পয়েন্ট :

একটাই। একবার পৌঁছে গেলে কিছুতেই ফিরে আসতে মন চাইবেনা।

ভ্যালিতে কোথায় থাকবেন?:

ভ্যালির একদম ওপরে দুটো ডর্মেটরি আছে, এছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। এই ডর্মেটরির কতৃপক্ষের কোনও মোবাইল নাম্বার নেই, যেহেতু  ভ্যালিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক একেবারেই থাকে না। ফলত প্রি-বুকিং হয় না। তবে চিন্তা করার কিছু নেই, এখনও অবধি সেরকম ভাবে পর্যটকদের নজরে না আসায় স্বর্গের এই দ্বার একরকম অনাবিষ্কৃতই বলা যেতে পারে। সেরকম ভিড় হয় না। বছরের যে কোনও সময় গেলেই মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়ে যায়। আর ভিড় হলেও কতৃপক্ষ টেন্ট বিছিয়ে দেয় ডর্মেটরির আশেপাশে, সেই টেন্টের ভিতর থেকে ভ্যালির দিকে চোখ বিছিয়ে দিলে মনে হয় স্বপ্ন পূরণ হওয়ার স্বাদ চিনে নেওয়া যাচ্ছে।

জুকু ভ্যালি যাওয়ার সেরা সময় কখন? :

বর্ষা। বর্ষার সময় না গেলে জুকু ভ্যালির সৌন্দর্য্য বোঝা যায় না। একমাত্র বর্ষাতেই ভ্যালিতে বসে লালনীলসাদাহলুদ ফুলের মেলা, জুকু লিলি রাস্তার পাশে ফুটে থাকে স্বপ্নের মতো, পাহাড় সবুজে সবুজ হয়ে থাকে, ভ্যালির ভিতরে মেঘেদের আনাগোনা ঘন হয় বর্ষায়। তাই জুন-জুলাই'ই হলো এই ট্রেকের আদর্শ সময়।

More Articles