লেখক-পাঠককে নিয়ে বাংলা মিডিয়ার উল্টো স্রোতে হাঁটার এক বছর

শুধু পাঠকই নয়, ইনস্ক্রিপ্ট-এর অহংকার ইনস্ক্রিপ্ট-এর লেখকবৃত্ত। বাংলার অন্যান্য কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মে যেমন পাঁচ-দশজনের ওপর ভুবনের ভার দেওয়া হয়, ইনস্ক্রিপ্ট সেই ক্ষমতাতন্ত্রকেও ভাঙতে চায়।

স্বাধীনতার প্রথম সূর্যোদয়ের পর ৭৫ বছর পেরিয়ে এলাম আমরা। আর এই দিনেই এক বছর পূর্ণ করল ইনস্ক্রিপ্ট, বাংলার প্রথম লেখক-পাঠকের যৌথমঞ্চ। কেন পথচলা শুরু করার জন্য এই দিনটিকেই বেছে নিয়েছিল ইনস্ক্রিপ্ট? এককথায় বললে, ইনস্ক্রিপ্ট প্রথম থেকেই চেয়েছে বন্ধনমুক্তি।

গত এক দশকে সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশই 'পাবলিক রিলেশন' প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনই আয়ের পথ, কাজেই রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে তারা ভয় পায়। রাজনৈতিক নেতাদের উদ্ধৃতিকেই তারা খবর মনে করে। জনতাকে খবরের নামে যা তারা পরিবেশন করে, তার বেশিরভাগটাই চটুল, সস্তার বিনোদন। ব্রেকিংয়ের নামে যে ধরনের খুচরো তথ্য তারা দেয়, তা কোনওভাবেই বাঙালির জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করতে পারে না। বরং অকারণ তথ্যের স্রোত ক্লান্ত করে। ছোট ছোট চটুল প‍্যাকেজ আমাদের চিন্তার পরিসরকে ক্রমাগত সংকুচিত করে। এইখানেই জরুরি পর্যালোচনা। এক বছর আগে ইনস্ক্রিপ্ট পরিবার ভেবেছিল, এই গড্ডালিকা প্রবাহের উল্টোদিকে হাঁটার কথা। চিন্তার দৈন্য দূর করে এমন একটা মঞ্চ তৈরির পরিকল্পনা ইনস্ক্রিপ্ট করে, যার মূল মন্ত্র হবে মুক্তচিন্তা। শৃঙ্খলের পরাভব থেকে মুক্তির জন্য ১৫ অগাস্টের চেয়ে শুভকাল আর কী হতে পারে?

আত্মবিশ্লেষণের জন্য ৩৬৫ দিন অতি অল্প সময়। তবে প্রতিটি দিনই নতুন দিন। স্বাধীনতার মন্ত্র থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ইনস্ক্রিপ্ট চায় পাঠকের সামনে প্রতিদিন নতুন কিছু তুলে ধরতে। পাঠকের বেঁচে থাকার গুণগত মান যাতে সুন্দর হয়, সেই লক্ষ‍্যেই ইনস্ক্রিপ্ট-এর যাবতীয় শ্রম। ডিজিটাল মিডিয়ার ধর তক্তা মার পেরেক লেখার ঢেউয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে নিবিড় পাঠ, একাগ্রতা। কিন্তু একাগ্রতা হারিয়ে ফেলা মানে তো শুধু পাঠক হিসেবেই পিছিয়ে পড়া নয়, মানুষ হিসেবেও নিজেকে ক্রমে একটি খাঁচায় সেঁধিয়ে আনা। ইনস্ক্রিপ্ট-এর লড়াই এর সঙ্গেই। আমরা চাই, বাঙালির নিবিড়পাঠের পুরনো অভ্যেস ফিরে আসুক, এর মধ্য দিয়েই বাঙালি ফিরে পাক তার ব্যক্তিত্বের প্রাবল্য, আর তাতে আমাদের কাঠবেড়ালির মতো সেতুবন্ধনের অবদান থাকুক।

কোনও একটি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে গেলে প্রথমেই তাকে নিবিড়ভাবে জানতে হয়, জানতে হয় ওই ব্যবস্থাটি থেকে কী নেব না। চিন্তাকে স্বাধীন করতে গেলে সবার আগে বাদ দিতে হয় অন্ধবিশ্বাসের ঝোঁক। তাই ইনস্ক্রিপ্ট চালু বাংলা মিডিয়ার মতো বিজ্ঞাপনের বকলস পরে জ্যোতিষচর্চা করে না। বিগ ব্রেকিং বলে মূষিকপ্রসব করে না। বোকা ভণ্ড নেতাদের পৃষ্ঠকণ্ডূয়ন করে না। মানুষকে অযথা ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়া থেকে শতহস্ত দূরে থাকি আমরা। কনটেন্ট প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আমরা অগ্রাধিকার দিই বিজ্ঞানচর্চাকে। রাজনীতি হোক বা সংস্কৃতি, আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেই স্বচ্ছন্দ। ঘটনাপ্রবাহকে তথ্যের আকারে পরিবেশন না করে আমরা পাঠকের সামনে তুলে আনি সময়ের ময়নাতদন্ত। বাজারধর্মে গলদঘর্ম হওয়া ইনস্ক্রিপ্ট-এর চরিত্র নয়, আমরা চাই সেরা পাঠকের বৃত্ত তৈরি করতে, সেই বৃত্তের পরিধি ক্রমেই ছড়িয়ে দিতে। পাঠরুচির সংক্রমণ হোক এই মঞ্চ থেকে, এই আমাদের একমাত্র অভিপ্রায়।

প্রথম থেকেই আমরা পাঠকের বিবেচনায় আস্থা রেখেছিলাম। স্বাধীনতার মূল্যায়ন অতি দুরুহ বিষয়, কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই জানি, পাঠক ছুটি চায়।আমরা যে সস্তার জিনিস দেখাচ্ছি, তার থেকে তোমার পরিত্রাণ নেই এবং তুমিও এই সস্তা বিনোদনের অংশ- এই পাকচক্র থেকে পাঠক ছুটি চায়। কারণ প্রতিটি স্বাধীন মন নতুন করে ভাবার প্রেরণা পেতে আগ্রহী। কোনও পক্ষপাত নয়, সে চায় স্বচ্ছ দৃষ্টি, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা। পাঠক জানে, সে যা পড়ে, তা-ই তাকে সংজ্ঞায়িত করে। নিজেকে ভিড়ের থেকে আলাদা করতে তাই বহু পাঠক আমাদের হাত ধরেছেন। মাত্র এক বছরে আমাদের প্ল্যাটফর্মের পাঠক মাসিক পাঁচ লক্ষর বেশি। কালের নিরিখে আমাদের যাত্রা অতি স্বল্প, কিন্তু এই স্বল্প দিনে পাঁচ লক্ষ মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা, গভীরভাবে ভাবার স্বাধীনতার শরিক করা খুব কম কথা নয়। পাঠকের এই আস্থা আমাদের প্রত্যয়, শ্রমের খিদে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইনস্ক্রিপ্ট পরিবার চায় বিষয় নির্বাচন থেকে পরিবেশনে প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে। একইসঙ্গে সময়ের বিশ্লেষণ এবং চিরকালীন আবেদনময় বিষয়ের মিশেলে একটি অনন্য পাঠরুচির মানদণ্ড তৈরি করাই ইনস্ক্রিপ্ট-এর লক্ষ্য। আমরা চাই, একদিন গর্ব করে বাঙালি বলুক, তারা ইনস্ক্রিপ্ট-এর পাঠক। ইনস্ক্রিপ্ট কোনও ঐতিহ্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়, ইনস্ক্রিপ্ট অনতিক্রম্য উচ্চতায় পৌঁছতে চায় তারুণ্যের স্পর্ধায়, প্রবীণের প্রজ্ঞায় ভর করে।

শুধু পাঠকই নয়, ইনস্ক্রিপ্ট-এর অহংকার ইনস্ক্রিপ্ট-এর লেখকবৃত্ত। বাংলার অন্যান্য কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মে যেমন পাঁচ-দশজনের ওপর ভুবনের ভার দেওয়া হয়, ইনস্ক্রিপ্ট সেই ক্ষমতাতন্ত্রকেও ভাঙতে চায়। কারণ ইনস্ক্রিপ্ট বিশ্বাস করে, প্রত্যেকের মৌলিক ভাবনা রয়েছে। সেই ভাবনাকে ইনস্ক্রিপ্ট সম্মান করে। যদি ইনস্ক্রিপ্টের ছন্দের সঙ্গে সেই ভাবনা সাযুজ্য রাখে, তাহলে ইনস্ক্রিপ্ট সেই ভাবনাকে যথাযথ সম্মানে বরণ করে নেবে। ইনস্ক্রিপ্ট-এর প্রযুক্তি সহায়ক দল যে ভাবে অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট বানিয়েছে, তাতে যে কোনও মানুষ যে কোনও জায়গা থেকে নিজের সুসংহত ভাবনাকে আমাদের প্ল্যাটফর্মে পাঠাতে পারেন। চিন্তার দৈন্যর দিনে একজন লেখকের অভিনব ভাবনাকে আমরা ক্ষমতার করতলে দীর্ঘদিন ফেলে রাখি না। আমরা চাই, পাঠক এবং লেখক একই সঙ্গে একই ছন্দে স্পন্দিত হোক। তাই প্রতিটি নতুন, অভিনব ভাবনাকেই দ্রুততার সঙ্গে প্রকাশ করে টিম ইনস্ক্রিপ্ট।

ইনস্ক্রিপ্ট স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। লেখার যথাযথ মূল্যাঙ্কনে বিশ্বাসী সে। সুলেখকের লেখাকে বৃহত্তর পাঠকবৃত্তে পৌঁছে দেওয়াই নয়, ইনস্ক্রিপ্ট চায়, সেই লেখা লেখককে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক উপার্জনে সাহায্য করুক। লেখককে তাঁর সাম্মানিক দিতে ইনস্ক্রিপ্ট-এর কোনও কার্পণ্য নেই। নির্দিষ্ট সময় প্রতিটি লেখককে যাতে সর্বোচ্চ সাম্মানিক পৌঁছে দেওয়া যায়, তা সুনিশ্চিত করতেও নেপথ্যে পরিশ্রম করে একটি দল। একই সঙ্গে লেখক-পাঠকের আস্থা আদায় করতে এই দলটির শ্রমকে আজ কুর্নিশ করার দিন। আমরা বিশ্বাস করি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসুর উত্তরাধিকারী বাঙালি আজও লিখে গ্রাসাচ্ছাদন করতে পারে। আমরা লেখকের সেই স্বপ্নের উড়ালের মঞ্চ হতে চাই শুরু থেকেই।

গর্বের সঙ্গে বলতে হয়, সমাজের বহু স্তরের বহু মানুষ আজ ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে যুক্ত লেখক হিসেবে। শিক্ষক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সমাজকর্মীরা নিজেদের চিন্তার ছাপ অহরহ রেখে যাচ্ছেন ইনস্ক্রিপ্ট-এ। সবচেয়ে আনন্দের কথা, যে ছাত্রদের নিয়ে এত গেল গেল রব, তাঁরাও কলম ধরছেন ইনস্ক্রিপ্ট-এর মঞ্চে। অনেকেই ইনস্ক্রিপ্ট-এ লেখালেখিকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। আমরা চাই পাঠকের আদরে, প্রযুক্তির সাহায্যে এই লিখনস্বপ্ন অটুট থাকুক। লেখক-পাঠকের এই যৌথতায় ৩৬৫ দিনেই ইনস্ক্রিপ্ট একটা থিংক ট্যাঙ্ক। এই মঞ্চ থেকে আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই মহামতী গোখলের সেই বাণী, 'হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টু-ডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো।' পঁচাত্তর বছর আগে বহু মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রাথমিক শর্ত ছিল অন্যের ভাবনাকে সমাদর, বিবিধতাকে কুর্নিশ করা। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ কন্টকসম, যে কোনও সুস্থ, সচেতন মানুষই বুঝতে পারবে প্রতিদিন স্বাধীনতার এই বোধকে হেলায় হারিয়ে ফেলি আমরা। এই অসূয়ার দিনে ইনস্ক্রিপ্ট চায় বিবিধতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যে হৃতগৌরব, তা ফিরে আসুক।

আমরা জানি, স্বাধীনতা শুধু কেন্দ্রস্থ মানুষের প্রাপ্য নয়, স্বাধীনতা প্রাপ্য প্রান্তিকেরও। অন্য স্বরকে জায়গা না দেওয়াটা এক ধরনের সংকীর্ণতা, স্বাধীনতার স্পিরিটের পরিপন্থী। ইনস্ক্রিপ্ট ভিন্নতাকে আদর করে। জাতি-বর্ণ-ধর্ম, যা কিছু কাউকে দূরে ঠেলে দিতে ব্যবহার করে মৌলবাদীরা, ইনস্ক্রিপ্ট তাকে চ্যালেঞ্জ করে। অন্যকে স্বর দেওয়া, যে কোনও প্রান্তের পরিস্থিতিকে তুলে ধরা ইনস্ক্রিপ্ট-এর রূপাদর্শ। এই কারণে দলিত হোন বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, তার ওঠাপড়া, ভাঙাগড়াকে আলাদা করে জায়গা দিতে চায় ইনস্ক্রিপ্ট। আমরা জানি, আমাদের সাধ্য সীমিত। কিন্তু গর্ব করে আমরা বলতে পারি, বাংলায় আমরাই প্রথম একটি বাণিজ্যিক মঞ্চ থেকে তৃতীয় লিঙ্গর জয়-পরাজয়ের কথা প্রতিদিন বলছি। দলিতের যন্ত্রণার অভিজ্ঞান পাঠকের সামনে রোজ তুলে ধরছি। যে কোনও ভিন্নতাকে দূরে ঠেলে না দিয়ে, খাপ পঞ্চায়েত না বসিয়ে, আমরা তাকে স্বাগত জানাচ্ছি, কারণ স্বাধীনতার নিহিতার্থ তাই-ই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ইনস্ক্রিপ্ট আসলে পাঠকের প্রস্তুতি, নিজের দেশের স্বরূপ বোঝার স্পেস।

সমস্যায় দীর্ণ আমাদের দেশ। দারিদ্র রয়েছে, বর্ণবৈষম্য রয়েছে, ডানা মেলছে দুর্নীতি, মৌলবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সমর্পিত অন্ধ ভক্তর পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। পারলে পারবে একজন আত্মবিশ্বাসী, শ্রমনির্ভর, বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তচিন্তার মানুষ। তাঁর যাত্রাপথেই শরিক হতে চায় ইনস্ক্রিপ্ট। আমরা জানি, আমরা ক্ষুদ্র। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের আখ্যান বলে যায়, আছে বল দুর্বলেরও। লেখক-পাঠকের এই ক্ষুদ্র সম্মিলনেই আছে সমুদ্রের সিংহগর্জনের সম্ভাবনা, বাতাসের প্রলয়নাচের অঙ্গীকার, জলের সহজতা আর আগুনের অহং। সমস্ত অপ্রাপ্তি ঝেড়ে ফেলে আমরা আপনাকে আজ এই সম্মিলনের অংশ হতেই ডাকছি।

More Articles