আকাল আমাদিগের সর্বাঙ্গে
Mrinal Sen: ছবিতে শিক্ষকের মুখে একটি ছোট শব্দবন্ধ বসিয়েছেন মৃণাল সেন। তিনি বলেন, বুঝতে চেয়েছি, পারিনি। মৃণালের লেন্স বুঝতে চায়। সমাজের সংকট, শ্রেণির ধর্ম বুঝতে চায়।
নিশ্চুপে পার হয়ে এলাম মৃণাল সেনের শতবর্ষ। ঠিক যেমন নীরবতা মৃণাল সেন চেয়েছিলেন। আমরা সদলবলে মৃণাল সেনের ছবি দেখিনি, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আলোচনাচক্র আয়োজন করিনি। এরই মধ্যে সুযোগ এল, তাঁকে নিয়ে দু'কথা বলার। তাঁর কাজ নিয়ে কিছুক্ষণ অন্তত ভাবার। বয়সোচিত কারণে 'আমার মৃণালদা...' বলে লেখা শুরু করব এমন সুযোগ আমার হয়নি। অবশ্য, ভুল লিখলাম। তিনি ছোটদের প্রশ্রয় দিতেন। চাইলেই কলেজপড়ুয়া আমি এক দশক আগে গিয়ে দাঁড়াতেই পারতাম তাঁর দরজায়। যাওয়া হয়নি। প্রথম মুখোমুখি হলাম তাঁর মৃত্যুর পরের দিন, শেষযাত্রায়। শহরের রাজপথে সেদিন কাতারে কাতারে মানুষ নেমে এসেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকার ডিজিটাল বিভাগে চাকরি করি তখন। আমিও সেদিন রীতিমতো উপরতলায় অনুরোধ করে মাঝপথে অফিস কেটে বেরিয়ে গিয়েছিলাম সেই শবযাত্রায় যোগ দিতে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল মৃণাল সেনও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে হাঁটছেন, নিজস্ব অননুকরণীয় ভঙ্গিতে। শ্মশানের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, তাঁরই তৈরি করা ছবি বাইশে শ্রাবণ-এর কথা। তারপর কেটে গিয়েছে অনেকদিন। আমরা ভুলে মেরে দিয়েছি মৃণাল সেনকে। জীবদ্দশাতেই আমাদের জীবনবোধের সঙ্গে ওঁর চিন্তার দুস্তর ব্যবধান রচিত হচ্ছে ক্রমে। পদাতিক থেমে গিয়েছেন, আমরা তাঁকে ফেলে রেখে অনেক এগিয়ে গিয়েছি, এমন অবস্থায় হঠাৎই এক সভায় তাঁকে নিয়ে বলতে ডাকলেন আমার শিক্ষক সৌমিককান্তি ঘোষ। আমি এর আগে কখনও মৃণাল সেনকে নিয়ে কিছু বলিনি কোনো সভায়। এখানে, কথা বলতে হবে রাজনৈতিক সিনেমা এবং মৃণাল সেনকে নিয়ে। নিজের সুবিধার্থে আমি বিষয়টা একটু ছোট করে আনি। ভাবি, মৃণাল সেন বললেই আমার মন যে ভাবে ভাবতে শুরু করে, সেটুকুই যদি কথায় ধরে রাখা যায়। মন প্রথমেই বলল, আকালের সন্ধানে। ফলে বুঝে নিলাম, একটিই সিনেমা আমার বলায় উদারহণ হয়ে আসবে। তাই দিয়েই আমি মৃণাল সেনের সিনেমা-দর্শনটার দিকে তাকাতে চাইব। এভাবে দেখা খণ্ডচিত্র হবে, কিন্তু ওই শেষযাত্রায় যাঁরা হাঁটছিল, তাঁদের সবার এমন খণ্ড খণ্ড চিন্তার মালা জুড়েই একজন মৃণাল সেন। আমার ক্ষেত্রে, ভাবনা শুরুর ছবিটির নাম- আকালের সন্ধানে। আকালের স্মৃতি, আকালের ক্ষতকে ফিরে দেখবার ছবি। ছবির শুরুতেই এক হাড় জিরজিরে বৃদ্ধকে বলতে শোনা যায়, আকাল তো আমাদিগের সর্বাঙ্গে। আমি এই কথাটির মধ্যে দিয়ে কিছুটা পথ হাঁটার চেষ্টা করব। এই কথার অর্থের ব্যপকতা খুঁজতে চেষ্টা করব।
মৃণাল সেন কে? এক কথায় বললে, একজন বাঙালি হিন্দু কায়স্থ। তিনি যে ভদ্রবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি সেই ভদ্রবিত্তই একদিন 'মুসলিম অপশাসন' থেকে মুক্ত হতে যাবতীয় বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত হয়েছে এই কলকাতা শহরে বসে। ক্লাইভের চরবৃত্তি, নানা গোপন নথি ক্লাইভের জন্যে অনুবাদ, তথ্য পাচার করা থেকে শুরু করে কী না করেছে তারা। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে, নিজের শ্রেণি ব্যতীত অন্য সব শ্রেণির সঙ্গে। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, সুফলও তারাই পেয়েছে। শিক্ষায় সর্বাগ্রে অংশগ্রহণ করেছে। অর্থবান হয়েছে। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের সাঁকো পারাপারের সুযোগ পেয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগী, মুনাফাভোগী, দালাল, চাকুরিজীবী, অনুগত কেরানি থেকে হোয়াইট কলার কর্পোরেট, কালচার মাফিয়া- এই শ্রেণিরই একেকটি ক্ষুদ্র সংরূপ। আবার এই শ্রেণিই তার যাবতীয় দীর্ঘতর যাত্রাপথে প্রশ্নাকীর্ণ মন পেয়েছে। এই মন তাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উৎসাহী করেছে, কংগ্রেসে যোগদানে উৎসাহী করেছে। এমনকী স্বাধীনতা পরবর্তী নকশালবাড়ি আন্দোলন পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছে। অচলায়তনের মূলে আঘাত করার, নিজের যাবতীয় সুবিধে ছেড়ে বেরিয়ে আসার শক্তি দিয়েছে কখনওসখনও। তবে, শেষ পর্যন্ত, গ্লোবালাইজেশন পরবর্তী সময়ে সুখী, প্রশ্নহীন, মধ্যমেধার সাংস্কৃতিক পণ্যভোগী আপনি বাঁচলে বাপের নাম বলিয়ে জীবে পরিণত করছে। মনে রাখব, এই ভদ্রবিত্ত বারবার অন্তর্গত প্রশ্নে সমাজসংস্কার আন্দোলনে শরিক হয়েছে। সেই সংস্কারে বিধবা-বিবাহ যেমন ছিল, তেমনই আবার ভদ্রবিত্ত নৈতিকতার দায়ে মদ্যপান নিবারণে অংশগ্রহণ করাও ছিল। অর্থাৎ স্বাধীনতাহীনতার ক্রোধ নয়, নৈতিকতার নানামাত্রাই ছিল তার চালিকা-শক্তি। এই সমাজভুক্ত গোষ্ঠী কখনও রেগে বিদ্রোহ শুরু করেনি। স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে, সিপাহী বিদ্রোহে, কোল-ভিল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। ভদ্রবিত্ত ক্রমে নানা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এবং তার মনে পুঞ্জীভূত অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই আমাদের সমাজ-রাজনীতিকে, গণতন্ত্রকে একটা আকার দিয়েছে। কিন্তু ক্রমে সর্বোচ্চ সুবিধে পাওয়ার অভ্যেসটা, সুবিধেজনক অবস্থান থেকে এক ধাপ নেমে আসার ভয় তার জিনে সেঁধিয়ে যাওয়ায় মন থেকে প্রশ্ন করার অভ্যেসটা যেন মুছে গিয়েছে। মৃণাল সেই এই সমাজের প্রতিনিধি, শেষ প্রতিনিধি, যিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন নিজেকেই।
আকালের সন্ধানে ছবিতে ভদ্রবিত্তের এক প্রতিনিধিই সদলবলে আকাল খুঁজতে গ্রামে গিয়েছে। কখন যাচ্ছে? যখন আকাল আর নেই। অর্থাৎ বিপদের সঙ্গে তাঁর একটা প্রাথমিক দূরত্ব আছে। ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সে তিনি বাধ্য হননি। সিনেমা তোলার শৌখিনতা তার আছে। সেই শৌখিন ক্ষমতাকেই যেন মিমিক্রি করছে ছবি। ছবিওয়ালা সদলবলে যাদের দেখতে যাচ্ছে, তারা একদম প্রথমেই ডিক্লেয়ার করে দিচ্ছে- এরা আমাদের সমাজপ্রতিনিধি নয়। এ বাবু সমাজের অংশ। আমাদের দেখতে এসেছে। এই প্রশ্ন উঠতে পারে, এটা জেনেও সে এসেছে। এবং প্রশ্নটিকে সিনেমায় স্থান দিয়েছে। বাদ দিচ্ছে না। অর্থাৎ নিজের শ্রেণির প্রতি দীর্ঘদিন ধরে লালিত, দূর থেকে ধেয়ে আসা প্রশ্নগুলিকে সিনেমার আছিলায় গ্রহণ করছে।
আকাল খুঁজতে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার গল্প এই ছবির শুরুয়াত। শহুরে গণসঙ্গীত কণ্ঠে নিয়ে চলাচল শুরু হয়। মজার ব্যাপার হলো, সেই গণসঙ্গীতের সঙ্গে আকালধ্বস্ত জীবনের কোনো সম্পর্কই নেই, তা গাওয়া হয় নাগরিক কণ্ঠে। আকালের সন্ধানে দুর্ভিক্ষের গল্প দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামের পটভূমিতে তুলে ধরার চেষ্টা এবং ব্যর্থ হওয়ার গল্প। ব্যর্থতা, বলা ভালো ছবি করার ধকলটাই ছবি। দেখা যায়, মৃণাল ছবিতে সবার নামই অবিকল রেখেছেন। অর্থাৎ ভদ্রবিত্ত যেমন ঠিক তেমন করেই তাকে ধরতে চাইছেন তিনি। নাম গোপন করছেন না সিনেমার প্রয়োজনে। যে অংশ নিচ্ছে তাকে যেন দায়ীও করা হচ্ছে। এই দায় নিলে তবেই তাকে সিনেমায় অংশ নেওয়া যাবে। পরিচালক হিসেবে ধৃতিমানের বেশভূষা আচরণ, কে কে মহাজন বা সুপান্থ ভট্টাচার্যদের নাম ব্যবহার করেই ডাকা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, মৃণাল কোনো অনুকরণ চান না, নকলনবিশি চান না, কোনো ভান চান না। সত্য যেমন তাকে তেমন ভাবেই তুলে ধরতে চান।
প্রশ্ন হলো, একজন ভদ্রবিত্তের প্রতিনিধি তার জীবন-চৌহদ্দি ছেড়ে কেন যাচ্ছেন? গ্রামের ছবি যেমন-তেমন দেখানোই তার লক্ষ্য? পথের পাঁচালিই তো আছে, তার একদশক পরে আবার কেন গ্রাম দেখব? লেন্স নিয়ে একজন শিল্পীর গ্রামে যাওয়া, এই প্রবণতার শুরু কোথায়? ইতিহাস দেখলে, এমনিতে শহর গ্রামে যায় না। গ্রাম শহরে আসে। গ্রাম ভাঙে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলে, নীলচাষে বাধ্য করলে, জমি বাঁজা হয়ে গেলে গ্রাম ভাঙে। গ্রাম্য কর্মক্ষম লোক শহরে আসে। টোলা তৈরি হয়, যেমন আহিরিটোলা, কলুটোলা। সস্তার মজুর তৈরি হয়। তার ফেরার উপায় থাকে না। অতি-শ্রমে অর্জিত অল্প অর্থ পাঠায় সে। কিন্তু মৃণাল সেন এর বিপ্রতীপে সাংস্কৃতিক ঢাল তরোয়াল নিয়ে কেন গ্রামে যাচ্ছেন? যে শহর গ্রামকে উপনিবেশে পরিণত করেছে। তার সম্পদ লুটেছে, সেখানে ফিরে যাওয়াটাই যেন মৃণাল সেনের অনুশোচনার দলিল।
একদিক থেকে দেখলে, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকরা ঘুরে ঘুরেই ছবি করতেন। তিতাস একটি নদীর নাম ছবিটি তোলার সময়ে বাংলাদেশের বহু গ্রাম পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন ঋত্বিক। মৃণাল কখনও গুজরাট গিয়েছেন, কখনও ওড়িশার গণ্ডগ্রামে গিয়েছেন। বলেছেন, প্রয়োজনে উগান্ডাও যেতে পারি। কারণ দারিদ্রকে দেখি, দারিদ্রকেই দেখাই। মৃণালের এই কথার অর্থ, আমি দরিদ্রসীমার নীচে নেই। আমি শ্রেণির দিক থেকে এখনও একটু উপরে। এটা আমার মস্ত সুবিধে। আমার হাতে রয়েছে শুধু প্রশ্ন করার অধিকার। দারিদ্রকে দেখাও শিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে দেখছে সে দরিদ্র নয়। কিন্তু তাকিয়ে দেখাটাই তাঁর সামাজিক ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথের বহুশ্রুত কবিতা 'ওরা কাজ করে'। ওরা শব্দের প্রয়োগে এখানে নিজেকে পৃথক সুবিধেভোগী শ্রেণি বলে চিহ্নিত করা হয় নিরুচ্চারে। আমার দেখার সময় আছে। ভাবার সময় আছে। আমি অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি সেই ক্ষমতাকেই প্রয়োগ করি। দারিদ্রকে দেখি এবং দেখাই। এই কাজটি কি মৃণালই প্রথম করলেন?
আমরা মনে রাখব গোটা আকাল জুড়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিনরা। ওদের ছবিতে বারবার দেখি দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রাম। চিত্তপ্রসাদের ছবিতে দেখব, স্ত্রী কাজ করছে রুগ্ন স্বামী বসে আছে।
মৃণাল সেন শহুরে লোক, দীর্ঘসময় শহরের চালচিত্র ছবিতে তুলে ধরেছেন। তারপর গ্রামে যাচ্ছেন। এই উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রে। আমরা দেখেছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একই সঙ্গে লিখেছেন, কে বাঁচায় কে বাঁচে। যে গল্প শহুরে মধ্যবিত্তকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। আবার গ্রামে চলে যায় সাড়ে সাত সের চাল। চিত্তপ্রসাদ,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়দের পথে হেঁটেই বাঙালি ভদ্রবিত্ত শ্রেণির এক ব্যতিক্রমী প্রশ্নাকীর্ণ প্রতিনিধি মৃণাল গ্রামে যান। নিজের যাবতীয় সুবিধেকে আড়াল না করে, গাড়িতে, দূরে ট্রেন দেখা যায়, শ্যুটিং ইউনিট যায় নিজস্ব গাড়িতে। এবং পথেই শোনেন- আকাল সর্বাঙ্গে।
মৃণাল সেন এক সময়ে ছবিতে নিটোল গল্প বলতেন। কিন্তু এই পর্বে, আকালের সন্ধানে-র মতো ছবিতে, আমি বিশ্বাস করি, মৃণাল সেনের কাছে গল্পটা তত বড় নয়। তাঁর আছে এক আয়না। আয়নায় সমাজের চালচিত্র ধরা পড়ে। তিনি একটি প্রশ্ন নিয়ে যাত্রা করেন। তারপর ক্রমে এই প্রশ্নে সমাজের সবরকমের বৈষম্য, উচ্চ-নীচ অবস্থা, ভদ্রবিত্তের যাবতীয় দ্বিচারিতা, ভন্ডামি, বিবেকের তাড়না ধরা পড়ে। ভেবে দেখুন, একদিন প্রতিদিন। মেয়েটি প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরোয়। ফেরে। কেউ খোঁজ করে না। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। মেয়েটি লড়ে। একদিন মেয়েটি আর ফিরল না। মৃণাল পরিস্থিতি তৈরি করলেন। একটি পরিস্থিতিতে সবার রিঅ্যাকশান ধরলেন। অর্থাৎ একটি প্রশ্নে সামাজিক উত্তর খুঁজলেন। এখানে এটা জেন্ডার কোশ্চেন। যে মেয়েটি মুখে রক্ত তুলে সবার জন্য অন্ন আনছে, তার দিকে তুমি সমানুভূতি নিয়ে তাকাচ্ছ না, এইটেই বলা। ঋত্বিকের নীতার মতো মেয়েটির হাহাকার, যন্ত্রণা ফুটে ওঠে না এই ছবিতে। কারণ মৃণাল জানেন, এই যন্ত্রণা ব্যক্ত করার ক্ষমতা তাঁর জৈবিক ভাবেই নেই। মেয়েটির অনুভূতিমালার মধ্যে দিয়ে তিনি যেতে পারবেন না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে সমাজ কী করে, একটি তথাকথিত ভদ্রপরিবারের মেয়ে নিখোঁজ হলে সমাজে কী ধরনের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তৈরি হয়, তা তুলে ধরে সমাজকে তিরস্কার করার ক্ষমতা তাঁর লেন্সের আছে।
আকালের সন্ধানে ছবিতে প্রশ্নটা হলো, আকাল কেমন দেখায়? আকাল দেখানোর ছলে ছবিতে ক্রমে ফুটে ওঠে ভদ্রবিত্তের মনের আকাল। পান থেকে চুন খসলেই সে গ্রাম ছাড়তে তৈরি। সেকেলে নাছোড় রক্ষণশীল সংস্কার আঁকড়ে আছে সে। ধরি মাছ না ছুঁই পানি মনোভাব তার। সংস্কারে সে মনে করে সিনেমায় লোকে- নামে। সে বিশ্বাস করে, দারিদ্র থাকুক কিন্তু সিনেমায় বেশ্যার ভূমিকায় অভিনয় করা যাবে না। অথচ সেই গ্রামেই যে পালাগান গায়, যে একার্থে ছোটলোক, যাকে কেউ কেউ তুইতোকারি করে, সেই লোকটির কিন্তু কোনো সংস্কার নেই। কোনো মূল্যবোধের চাপ নেই। সে বরং ভাবতে পারে, মানুষ খাঁটি হলেই অন্য দুঃখী মানুষের ভূমিকায় সে অভিনয় করতে পারে, অর্থাৎ দুঃখের দিকে তাকাতে পারে। মৃণাল সেন দেখাচ্ছেন, অনুদার সংস্কার, বন্ধ দরজা আমাদের দুঃখের দিকে তাকানোর মনটাকে হত্যা করেছে। ছবিতে ভদ্রবিত্তের ভন্ডামি সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত করে জোগাড়ে লোকটিকে। সেই কারণে সে নিজের মেয়েকে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য নিয়ে যেতে গেলেও বাধা আসে পরিবার থেকে। কারণ তার পরিবার হতে পারে দরিদ্র। কিন্তু একথাও ভাবতে হবে, ভদ্রবিত্ততা কোনো থিতু অবস্থান নয়, একজন দরিদ্রও নিজের শ্রেণি অবস্থান থেকে ওই সোনালি জুতোয় পা গলাতে চায়। এটাই তার উচ্চাশা। আর সেই কারণেই চাল থাকুক না থাকুক, সংস্কারগুলি জাঁকিয়ে বসতে থাকে। একটা দমবন্ধ শামিয়ানায় বসবাসে অভ্যেস হয়ে যায়। যার ভিতর সূর্য-চাঁদের আলো পড়ে না, যা পরীক্ষাবিমুখ।সন্দিগ্ধ চোখে পালাগান করা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বাড়ির লোক বলে, মেয়েকে টাকার লোভে বেচে দিচ্ছে বাবা। অথচ এই অভিপ্রায় তার ছিল না।
ছবিতে এই ভদ্রবিত্তই দেখি গ্রামে সালিশিসভা বসায় বারবার। যারা সালিশিসভা বসাচ্ছে তারা সকলে সুবিধেভোগী। মধ্যসত্ত্বভোগী। সবচেয়ে সুবিধেজনক অবস্থানে আছে। ঈর্ষা, দ্বিধা, সংস্কার, আরাম তাদের সঞ্চয়। আত্মপ্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার কথা সে ভাবতেও পারে না। একজন শিক্ষক শুধু বলে ওঠেন, তোমাদের কোথায় লেগেছে আমি জানি। শিক্ষকের এই সংলাপ ডিরোজিও থেকে সুশোভন সরকার-শিক্ষকের প্রশ্ন করার স্বচ্ছ মনটির প্রতি মৃণাল সেনের ট্রিবিউট।
মৃণাল সেনের ছবি আকালের সন্ধানে-তে মূল ভূমিকায় দু'জন নারীচরিত্রকে দেখি। একজন স্মিতা পাটিল (এই নামেই তাঁকে ছবিতে ডাকা হয়)। অন্যজন দুর্গা চরিত্রে শ্রীলা মজুমদার (এইখানে কিন্তু নামটা বদলে গেল)। একজন প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতার শরিক। আরেকজন সেই অভিজ্ঞতাকে নকল করছে। অর্থাৎ অভিনয় করাটাও তার একটা সুবিধেজনক অবস্থান। তার জনখাটার কাজ নয়। তাকে প্রতিদিন কৈফিয়ত দিতে হবে না। সে যখনতখন চলে যেতে পারে। কিন্তু গরিব দুর্গা মেয়েটিকে রোজ কাজে যেতে হয়। যেতেই হয়। ছেলে হাসপাতালে ভর্তি হলেও কাজে যেতে হয়। ভদ্রবিত্তের হাতে সুযোগ আছে তার সুবিধে-অসুবিধের দিকে মানবিক হয়ে সেদিকে তাকানোর। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। স্মিতা ব্যতিক্রমী, দুর্গাকে সে এমনিই একদিনের পারিশ্রমিক দিতে চায়। দুর্গা পরে সেই পারিশ্রমিক ফিরিয়ে দেয়। কারণ ভদ্রবিত্তের যেমন দেওয়ার মতো আছে অর্থটুকুই, নিম্নবিত্ত সেটা প্রত্যাখানের মধ্যে দিয়েই নিজের অভিমান বাঁচিয়ে রাখে। সে জানে কাজে তাকে যেতে হবেই। মনে পড়ে কেন লোচের ছবি, সরি উই মিসড ইউ। যেখানে ডেলিভারি-কর্মীকে গাড়ির সব মাল চুরি হয়ে যাওয়ার পরেও, মারের চোটে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে শেষমেষ কাজে যেতেই হয়। কারণ তার আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই। দুর্গা কিন্তু বাড়তি রোজগারের আশাতেই সিনেমার কাজটা করতে চেয়েছিল। সেই বাড়তি টাকায় হয়তো সে ছেলের চিকিৎসা করাতে পারত। দুর্গার বর নুলো। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করতে হয় তাকে। আপনাদের হয়তো মনে পড়বে চিত্তপ্রসাদের ছবির কথা। বউ রাঁধছে, শুয়ে আছে দুর্ভিক্ষপীড়িত পরিবার। মনে পড়বে, কিম কি দুকের পিয়েতা ছবির কথা। যেখানে মহাজনের চাপে পরিবারের নাভিশ্বাস। নুলো স্বামী ভাত দিতে পারে না। স্ত্রী কাকভোরে উঠে খাবার বিক্রি করতে যায়। সুদ দিতে না পারলে মহাজন ওই স্ত্রীর গায়ে হাত দেয়। মৃণালের দুর্গা অভিনয় করতে পারে না, বর চাপ দেয় তাকে। সে বলতে চায়, ভাত না পেলে ঠুনকো শরম, ফালতু সংস্কার রেখে কী হবে! প্রশ্নটি পুরুষকে, মৃণালের আরও এক জেন্ডার কোশ্চেন।
এখানে অন্য একটি চিন্তার কথাও রেখে যেতে চাই। যারা দুর্গাপুজোর যাবতীয় সংস্কারগুলি জানেন, তারা জানবেন, পুজোর দিনগুলিতে প্রতিমার সামনে দর্পণ রেখে যাবতীয় উপাচার চলে। তারপর দর্পণটি সরিয়ে নিয়ে দুর্গা বিসর্জনের আয়োজন করা হয়। ছবিতেও দুর্গার জীবন প্রতিবিম্বিত হয় লেন্সে, দর্পণে। তারপর চলচ্চিত্রকার ফিরে যান, দর্পণটি সরে যায়, দুর্গা তলিয়ে যায় অজানিতের অন্ধকারে। বিপদের মুখ থেকে ফিরে আসাটাই মৃণালের শ্রেণির চরিত্র। তাকে কোথাও সেতু পুড়িয়ে যেতে-আসতে হয় না। সে যায়, আবার ফিরে আসতেও পারে। ফিরে আসতে পারে বলেই যেন তার যাওয়া উচিত, প্রশ্ন করা উচিত। এই ফিরে আসা মনে করায় জাফর পানাহির ট্যাক্সি ছবিটি। গোটা দিন ইরান দেশটির চরিত্র প্রতিবিম্বিত হলো পরিচালকের গাড়িতে রাখা ক্যামেরায়, লেন্সে। পরিচালক নিজে ছবিতে হাজির। শেষে গাড়িটি যখন ভাঙচুর হয়, ততক্ষণে পরিচালক হাঁটা দিয়েছেন, যাওয়ার আগে রেখে গিয়েছেন একটি গোলাপ ফুল।
মৃণাল হোন বা পানাহি পদাতিক মন লেন্সকে ব্যবহার করে সমাজের সঙ্গে, সমস্যাগুলিকে সামনে রেখে সংলাপে মাতেন। খোঁজ চলে আকালটা আসলে কোথায়। সেই খোঁজ, প্রশ্নটি সিনেমা শেষ হয়ে গেলেও চলে যায় না। কোনোদিনই চলে যায় না। তখন হয়তো লেন্সটি তোমার হাতে উঠে আসে। একটা ছানবিনের মন পাও তুমি। নিজেকেই কাঠগ়ড়ায় তুলতে শেখো তুমি। যাতে তুমি প্রশ্নাকীর্ণ হও, সুবিধেবাদ ছেড়ে একটু বেরিয়ে আসো, সেই কারণেই এই ছবি করা। ছবিতে শিক্ষকের মুখে একটি ছোট শব্দবন্ধ বসিয়েছেন মৃণাল সেন। তিনি বলেন, বুঝতে চেয়েছি, পারিনি। মৃণালের লেন্স বুঝতে চায়। সমাজের সংকট, শ্রেণির ধর্ম বুঝতে চায়। যে গ্রাম ভেঙে গিয়েছে, শহরে নিরন্তর কর্মী জোগান দিচ্ছে যে গ্রাম, যে গ্রাম প্রতিদিন শহরে সুইগি ডেলিভারি বয় পাঠায়, নাসিকে চাষের জল নেই তাই যে গ্রাম-শ্রমিককে মুম্বইয়ে বহুতল নির্মাণে আসতে হয়, আমরা যেন তাকে বুঝতে চাই। পুরোপুরি না পারলেও যেন বুঝতে চাই, যেন তার কাছে যাই, এ কথাই বলে বলে যান মৃণাল সেন। যেতে হবে কারণ ফেরার সুবিধে আছে।
আগেই বলেছি, মৃণাল সেনের ভাষায় ছবি করছেন কেন লোচ। তাঁর ছবি আই ড্যানিয়েল ব্লেক-এর বিষয় খিদে। ক্ষুধার্ত আর গৃহহারার জীবনসংকটকে ভরকেন্দ্র করে গোটা সমাজের উদগ্র ছবিটা তুলে ধরেন কেন লোচ। আমাদের দেশেও নন্দিতা দাস সেই একই পদাতিক-চেতনা অংশীদার। মৃণালের আমার ভুবন-খ্যাত নন্দিতার ছবি জুইগ্যাটো এই শহরের মাল্টিপ্লেক্সে দেখানো হয়েছিল। যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম, সব মিলে ছ'জন দর্শক ছিলেন। রকি অউর রনি কি প্রেমকাহিনি-তে হল হাউজফুল। কারণ?
আকাল আমাদিগের সর্বাঙ্গে।