রামমন্দিরের জয়ে আসলে হারল ভারতই?

Did India lose: ভক্তেরা যদি ধর্না দেয় অবতারের লাঠির ঘা পড়বে না তো? শত শত বছর লেগেছে লোকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। বিলীন করতে লাগল মাত্র দশবছর? এমন অবতারধন্য 'অচ্ছে দিন'ই আপনি চেয়েছিলেন?

২২ জানুয়ারি, অসমাপ্ত রাম মন্দিরেই হয়ে গেল বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাশাপাশি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে'র সরসংঘচালক মোহন ভাগবত ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।

সকাল এগারোটার আগেই মন্দির চত্বরে পৌঁছে যান মোদি। শহর থেকে একটি ফুলসজ্জিত হেলিকপ্টারে করে তাঁকে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়।

প্রাণপ্রতিষ্ঠা শুরু হওয়ার আগে রামভজন গাইতে দেখা যায় শঙ্কর মহাদেবনকে। মন্দিরে পৌঁছান শিল্পপতি মুকেশ আম্বানিও। চম্পত রাই জানান, সন্ধ্যাবেলা মন্দিরে রামজ্যোতি পালন করা হবে। পালিত হবে অকাল দীপাবলির অনুষ্ঠানও। দেশ জুড়ে একশ মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে আজ।

নির্ধারিত সময়ে মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীকে। শাঁখ বাজিয়ে তাঁকে বরণ করা হয়। গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন নরেন্দ্র মোদি। প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে মোদির পাশাপাশি দেখা যায় মোহন ভাগবত ও যোগী আদিত্যনাথকে। ঘণ্টাখানেক প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান চলে। হাতের পদ্ম রাম-বিগ্রহের পায়ে অর্পণ করে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এ'সময় দুটি হেলিকপ্টার থেকে লাল আবির ছড়ানো হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হেমা মালিনী ও সচিন তেন্ডুলকরের মতো তারকারা।

এ'সময় মিডিয়ার আলোচনার বিষয় ছিল ঐতিহ্যগত আস্থা। বিষয় ছিল, পাঁচ বছরের শিশু কী খায়? ভগবান রামকে নাকি সেইসব ভোগ দেওয়া হচ্ছে। সমস্ত গোদি মিডিয়া মেতে থাকল দিব্য বিগ্রহ আর তার সোনার গয়না নিয়েই। কোন আচার কীসের জন্য─তার সবিস্তার ব্যাখ্যা করছিল তারা।

প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান সেরে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী। মঞ্চে নরেন্দ্র মোদি, মোহন ভাগবত ও আদিত্যনাথকে বস্ত্রদান করে সম্মান জানানো হয়। রূপো নির্মিত দুটি রামমন্দিরের মডেল যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফে ভেট দেন প্রধানমন্ত্রী ও মোহন ভাগবতকে। এরপর মঞ্চে শুরু হয় মোদিবন্দনা। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে মহাপুরুষ বলেন গোবিন্দ গিরি দেব। বলেন, এমন সাত্বিক রাষ্ট্রনেতা পাওয়া দেশের সৌভাগ্য। মোদিকে শিবাজির সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। গিরি দেবের হাতে মোদি উপবাস ভাঙেন।

যোগী আদিত্যনাথ বলেন, অযোধ্যা বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী হতে চলেছে। রামমন্দির ভারতের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ঘটাবে। মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন তিনিও। মোহন ভাগবতের পরে মঞ্চে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী।

রামভক্তদের প্রণাম করে মোদি জানান, মন্দিরের ভিতরে তিনি ঈশ্বরীয় চেতনার সাক্ষী হয়েছেন। বলেন, "আমাদের রামলালা আর তাঁবুতে থাকবেন না। তাঁর জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে।" রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনটিকে নতুন কালচক্র শুরুর দিন বলে উল্লেখ করেন মোদি। চারিদিকে তিনি নাকি দিব্যাত্মাদের অনুভব করছেন। তাঁর মতে, এ'ভাবেই নতুন ইতিহাস তৈরি করে রাষ্ট্র। আজ থেকে হাজার বছর পরেও নাকি এই নিয়ে চর্চা করবেন মানুষ।

আরও পড়ুন: রাম ভগবান না কি ইতিহাসপুরুষ? যে প্রশ্ন গুলিয়ে দিচ্ছে রামমন্দির

মোদি আরও বলেন, রামের রূপে এ রাষ্ট্রচেতনার মন্দির। রাম ভারতের চেতনা, রাম ভারতের বিধান, রাম নীতি, রাম নিত্যতা, রাম জ্ঞাপক, রাম বিশ্ব, রাম বিশ্বাত্মা। তাই রামের প্রতিষ্ঠার প্রভাব হাজার বছর থাকবে। ত্রেতায় রাম আবির্ভূত হন। তখনও হাজার বছর বিশ্বকে পথপ্রদর্শন করেছিলেন তিনি। আজ অযোধ্যায় আবার তাই হল। দেব থেকে দেশ পর্যন্ত, রাম থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত চেতনার বিস্তার করতে হবে। রাম-সমর্পণের মতো রাষ্ট্রের কাছেও নিজেদের সমর্পণ করতে হবে।

গণতান্ত্রিক সংবিধানের এক দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, রোজ রামের পুজো করলে তবেই ভারতের উন্নতি হবে। ভারত নাকি যুবশক্তিতে ভরে রয়েছে। এমন নজির কি বিশ্বে কোথাও রয়েছে? দেশের শিক্ষার হার ভয়াবহ, হাসপাতালগুলি ধুঁকছে। বেকারত্বের হার আকাশছোঁয়া, মূল্যবৃদ্ধির দাপটে বাজার আগুন। আর প্রধানমন্ত্রী বলছেন রামই সমাধান!

বলছেন, "আমি ভগবান রামের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এতদিন রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, সে আমাদের দুর্বলতা। আজকের দিনে রামলালা আমাকে নিশ্চয়ই মাফ করবেন। কারণ রামমন্দিরে আজ প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে।" বিগ্রহে তো প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল, রামসংকট তাতে মিটবে? কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির কী হল? তার জন্য জনতা জনার্দনের কাছে ক্ষমা চাইবে কে?

আমাদের প্রশ্ন, মঞ্চ থেকে সর্বধর্মমত কেন প্রচার করলেন না মোদি? উনি জননেতা? নাকি এক তপস্বী? গণতান্ত্রিক দেশে নেতা না হয়ে দেবতা হতে হচ্ছে কেন? তিনি নিজেকে বারংবার ঈশ্বরপ্রেরিত বলছেন কেন? কালচক্রের প্রবর্তন করেন অবতার। বিজেপির নেতারাও ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় মোদিকে অবতার বলেই প্রচার করে থাকেন। গণতন্ত্রে নেতা হয়ে উঠতে গেলে জনতার কাছে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অবতারের সেই দায় থাকে না। তাঁর কাছে যোগ্যতার প্রমাণ চায় না কেউ। প্রেরিত পুরুষের কাছে ভিক্ষে চায় আমজনতা। তাই কি অবতার হয়ে ওঠার চেষ্টা? একটি মন্দির, একজন ধর্মগুরু এবং একজন অবতার─তিন মাথাতেই দেশ চলবে? বিজেপির বাকি নেতাদের কেন দেখা গেল না মঞ্চে? বাদ গিয়েছেন অমিত শাহ’ও? রামমন্দিরের আসল প্রবক্তা লালকৃষ্ণ আডবানি কোথায়? পিএমও-র সাইট বলছে, প্রতি চারদিনে প্রধানমন্ত্রী একটি করে মন্দির দর্শন করেন। ভোট এলেই যে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ায়, তাকে মন্দিরজীবী বলা কি খুব অসঙ্গত? হাউজিং সোসাইটি, ফ্ল্যাটবাড়ি আবাসনে থাকা ভদ্রবিত্ত প্রশ্ন করতে ভুলে গেল? ভক্তেরা যদি ধর্না দেয় অবতারের লাঠির ঘা পড়বে না তো? শত শত বছর লেগেছে লোকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। বিলীন করতে লাগল মাত্র দশবছর? এমন অবতারধন্য 'অচ্ছে দিন'ই আপনি চেয়েছিলেন? রইল বিশেষজ্ঞদের আলোচনা।

সুমন ভট্টাচার্য, সাংবাদিক

প্রধানমন্ত্রী রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের ভাষণে বলছেন, রাম থেকে শক্তি আসে। কাল থেকে তাহলে সারা দেশে সস্তায় পাওয়া যাবে গ্যাস ও পেট্রোল? 'জয় শ্রীরাম' কোনও দিনই স্লোগান ছিল না। মানুষ মানুষকে অভিবাদন জানাতেন, 'জয় সিয়ারাম' বলে। সে'খানে সীতার একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল। মমতা ব্যানার্জি সঠিকভাবেই বলেছেন, "রামের পাশে সীতা নেই কেন?" অযোধ্যাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী করে তোলা হল। তবে মণিপুরের সমস্যার কী হবে? প্রশ্ন থাকছেই।

আরও পড়ুন: মোদির রামরাজ্যে ঠিক কেমন আছেন সাধারণ মানুষ?

যে শিল্পীরা রামভজন গাইলেন, তাঁরা কয়েক বছর আগে আজানের শব্দে বিরক্ত হয়েছিলেন। তখনই তাঁদের ঝোঁক বোঝা গিয়েছিল। প্রগতিশীলদের মুখোশ খুলে দিল রামমন্দির। এঁদের মেরুদণ্ড নেই। দেশের বিবিধ সমস্যা নিয়ে তাঁরা মুখ খোলেন না। কিন্তু ভারতের অন্তরাত্মা 'অপমানিত' হলে তাঁদের প্রাণ কেঁদে ওঠে। বিদ্বেষের পৃথিবীর বাইরে কে? কথা বললেই কাজ হারাতে হবে তারকাদের। শিল্পপতিদের বাড়িতে গিয়ে এঁরাই মাঝেমধ্যে খাবারদাবার পরিবেশন করেন। ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্র বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেল। নরেন্দ্র মোদি দেখিয়ে দিলেন, দুনিয়ায় সব কিছুই ব্যবসা, এমনকি রামমন্দিরও।

গ্রেট হিরো সিনড্রোমে আক্রান্ত মোদি। তাঁর আশেপাশে কাউকে থাকতে দেবেন না তিনি। যোগী আদিত্যনাথকে পর্যন্ত কেবলমাত্র মোদির সুনাম করতে হচ্ছে। লালকৃষ্ণ আডবানি যদি বক্তব্য রাখতে এসে বলে ফেলতেন, তিনিই রামমন্দিরের আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাহলে মোদির উপর থেকে খানিকটা হলেও আলো সরে যেত। তাই তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হল না। নেতাজি নিজে প্রচণ্ড কালীভক্ত ছিলেন। অথচ, রাজনীতির গেরুয়াকরণের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, প্রশাসনের উপর তাকে প্রভাব ফেলতে দেওয়া যাবে না—এই ছিল তাঁর মত। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নজরুল শ্যামাসঙ্গীত লিখতে পারতেন? মানুষের ভাবাবেগে আঘাত লাগত না তাতে?

শেয়ারবাজার নির্ভর এই অর্থনীতিতে গণতন্ত্র সোনার পাথরবাটি মাত্র। যে পুঁজি উৎপাদনকে গুরুত্ব দেয় না, কেবল শেয়ারবাজারে মূলধনের উপর খেলে, সেই পুঁজির কাছে গণতন্ত্রের কোনও মূল্য নেই। ফাটকা বাজারি অর্থনীতি কেবল তাৎক্ষণিক লাভ দেখে।

পুতিন আজকাল নরেন্দ্র মোদির খুব প্রশংসা করছেন। আরএসএসের সঙ্গে এতদিন জিওনিস্ট দর্শনের মিল পাওয়া যেত, এবার হয়তো পুতিনের দর্শনেরও মিল পাওয়া যাবে। দেখা যাবে ৯০% ভোট হয়তো মোদিই পাচ্ছেন। সে'টা খুবই চিন্তার বিষয়। বিজেপি-বিরোধিতা খুব জোরের সঙ্গে আজ আর কেউ করছেন না। সবাই ধর্মের রাজনীতিই করছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রামমন্দির বিরোধী মিছিল কালীঘাট থেকে শুরু করতে হয়েছে‌। সুভাষ বোস বা রবীন্দ্রনাথের বাড়ির সামনে থেকে মিছিল শুরু করা যাচ্ছে না—এই ব্যর্থতা আখেরে আমাদেরই।

প্রতীক, সাংবাদিক

বিজেপি বিরোধী দলগুলি মোদির জুতো পায়ে দিয়েই চলছে। এতে কিছু ভোট হয়তো পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়াইটা ভোটের লড়াই নয়, একটা সাংস্কৃতিক লড়াই। এই জায়গাটা বিরোধীরা বুঝতে পারছেন না। বা সচেতন ভাবেই বুঝতে চাইছেন না।

ধর্ম পরিচয়ের সঙ্গে সফলভাবে ভোটব্যাঙ্ক শব্দটা জুড়ে দিতে পেরেছে বিজেপি। এদেশে 'হিন্দু-ভোটব্যাঙ্ক' সবথেকে বেশি। ফলে বিরোধীরাও ধর্মের রাজনীতির বাইরের বেরোতে পারছেন না। মুসলমানদের ভোটের যেন কোনও মূল্যই নেই—এমন একটা ব্যাপার প্রতিষ্ঠা করতে সফল মোদি সরকার। মমতা ব্যানার্জি সম্প্রীতি মিছিল করলেন। কিন্তু সেই মিছিল কালীঘাটে পুজো দিয়ে শুরু হল কেন? আজ যে তারকারা রামমন্দির উদ্বোধনে গেলেন, তারা নিশ্চয়ই দীঘার জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনেও আসবেন কেউ কেউ। সে'টাও সরকারি টাকাতেই হচ্ছে। উত্তর-ভারতে শাসকের মুসলিম-বিদ্বেষী অবস্থান অনেক পরিষ্কার। সবাই সে'টা জানেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কাকে ভোট দেবে, তাই নিয়েই বিভ্রান্ত। কারণ এ'খানে শাসক দলের অবস্থান ঠিক স্পষ্ট নয়।

আরও পড়ুন: কেন দক্ষিণ ভারতীয় প্রতিমার ছাঁচে গড়া রামলালার মূর্তি?

বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, এ'খানে সাম্প্রদায়িক হানাহানি করতে এলে মাথা ভেঙে দেওয়া হবে। সে'টা দক্ষিণপন্থীদের গায়ে লেগেছিল খুব। তথাগত রায় বারবার এই বক্তব্য তুলে বলতেন, বামপন্থীরা হিন্দুবিরোধী। সরাসরি এ'রকম বিরোধিতা আজ আর করতে পারছেন না কেউ।

রাহুল গান্ধীকে মন্দিরে যেতে দেওয়া হল না। রাহুল গান্ধী রাস্তায় বসে গান্ধীজির সেই বিখ্যাত ভজন শুরু করলেন, "রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পাবন সীতারাম"। 'জয় শ্রীরাম' কোনও দিন স্লোগান ছিল না। মানুষ মানুষকে অভিবাদন জানাতেন, 'জয় সিয়ারাম' বলে বা 'জয় রামজি কি' বলে। রামনামের পর এই 'জি'-এর প্রয়োগ রামকে ঘরের লোক করে তুলত। সে'খানে 'জয় শ্রীরাম'-এর মধ্যে দিয়ে রামকেই দূরে সরিয়ে দেওয়া হল। রাম ঘরের লোক হলে তাঁর জন্য আলাদা করে বিরাট মন্দিরের প্রয়োজন হয় না। আনন্দ পট্টবর্ধনের বিখ্যাত তথ্যচিত্র, 'রাম কে নাম'-এ রামমন্দিরের নির্বাচিত পূজারী লালদাসের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল। সেই লালদাসকে খুন করা হয়। হিন্দু হয়ে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন তিনি। এই ছিল তাঁর অপরাধ।

বিজেপি প্রচার করে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র ধারণা বাইরের দেশ থেকে ধার করা। আসলে হিন্দুত্ববাদের ধারণাটাও সম্পূর্ণ ভাবে ইউরোপ থেকে ধার করা। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে মোদির হাতে রাজদণ্ড দেখা গিয়েছিল। কেন? এক গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাজদণ্ড থাকবে কেন? রাজাকে প্রেরণ করেছেন ঈশ্বর—এই ধারণাও ইউরোপীয় ধারণা। ভারতের রাজতন্ত্র কিন্তু এ'রকম ছিল না। সে'খানে প্রজার অধিকারের একটা স্বীকৃতি ছিল। সম্রাট অশোক সমস্ত প্রজাকে সন্তানতুল্য মনে করতেন। কিন্তু রাজা ঈশ্বর-প্রেরিত—এই ধারণা ইউরোপীয় ধারণা। নাজিরা, ফ্যাসিস্টরা সেই ধারণা নিয়েই চলত। মোদিও সেই ধারণা নিয়েই চলেন। তাই মোদি ছাড়া আর কেউ মঞ্চে থাকবেন না। একনায়কতন্ত্রী ঝোঁক এ'খানে স্পষ্ট। এ'ভাবেই ফুয়েরারের ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য, সাংবাদিক

গোটা বিশ্বতেই গত এক দশক ধরে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটছে। এর অন্যতম কারণ সারা পৃথিবীতে পুঁজির ব্যাপক কেন্দ্রীকরণ। কয়েকজন মানুষের হাতে প্রচুর সম্পদ জমা হচ্ছে। আর পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ ন্যূনতম সুবিধাটুকুও পাচ্ছেন না। সম্পদ অর্জন করার জঞ্য তাঁদের প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তাঁরা এই জালে জড়িয়ে হাঁসফাঁস করছেন যেন। তাঁরা ক্রমে সমস্যা জর্জরিত হয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন। একই সঙ্গে মোবাইল ফোন ও সমাজ মাধ্যম মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। ফলে মানুষ ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে, আর সম্পদ ক্রমশ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এর প্রভাবেই সারা বিশ্ব জুড়ে একনায়কতন্ত্রী দক্ষিণপন্থার উত্থান।

আরও পড়ুন: রামরাজ্যের নারী ও নারীর রামরাজ্য

দক্ষিণপন্থী শাসকেরা এমন ভাবে কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে যে এই পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে প্রয়োজনীয়তা, লড়াই করে সমস্যা সমাধানের যে প্রয়োজনীয়তা, তা বাদ দিয়েও কোনও শর্টকাট পথ রয়েছে। ইউরোপের মাইগ্রেশনের সমস্যা কার তৈরি? পশ্চিমী দেশগুলিরই সৃষ্টি। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিকে তারাই ধ্বংস করেছে। সে'খান থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হাতে করে তাই ইউরোপে যাচ্ছে আশ্রয়ের সন্ধানে। ইউরোপের দেশগুলি মূল সমস্যা নিয়ে চর্চা করছে না। বরং সহজতর পথ বেছে নিচ্ছে। যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে এই উদ্বাস্তু মুসলমানদের উপরে। 'বহিরাগত শত্রু'র ভাবমূর্তি তৈরি করা গেলে একনায়কতন্ত্রী শাসন চালানো সুবিধা হয়। ভারতেও তাই হচ্ছে আজকাল।

সংঘ কিন্তু বিজেপি সরকারের প্রচার করেনি। মোদি সরকারের প্রচার করেছে। অর্থাৎ , হিন্দুত্ববাদী একনায়ক হিসেবে মোদিকেই প্রতিষ্ঠা করা হবে। মোদি সরকার এসে সংঘকে সমস্ত জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। রামমন্দিরের উদযাপনের মধ্যে দিয়ে মোহন ভাগবত ও মোদি জনতাকে বার্তা দিলেন, যে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। বিরোধীশূন্য রাষ্ট্র গড়তে পারলে হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতেও কোনও সমস্যা হবে না।

More Articles