‘ঘড়ির সময়’ আর ‘মহাকাল’ আমাদের বিস্ময়ে নির্বাক করে উড়ে যাচ্ছে

Ashmandari: যদি কোনও পাঠক প্রশ্ন করেন, এই পরিসরে কী নিয়ে কথা বলব, তার রূপরেখাটা মোটামুটি কেমন, আমি একটু আমতা-আমতা করে বলব, ঠিক জানি না।

শব্দচয়ন রবীন্দ্রনাথের। ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি কিন্তু স্বভাবগত পেশা আসমানদারী’। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ প্রসঙ্গে (কালান্তর) এই ছিল তাঁর অমোঘ উচ্চারণ। প্রায় একশো বছর পরে আমি, এক অখ্যাতজন, মওকা বুঝে শব্দটি ধার করেছি মাত্র। অন্য প্রসঙ্গে। জমিদারির বিপরীতার্থে নয়, বরং মাটি আকাশের আশ্চর্য জ্যামিতিকে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে জড়িয়ে নিতে। আলিঙ্গনের মুহূর্তে, লক্ষ্য করবেন চোখের কোনও ভূমিকা থাকে না। দৃষ্টিপাতের জরিপ সবসময় একটু দূরত্ব খোঁজে। 

যদি কোনও পাঠক প্রশ্ন করেন, এই পরিসরে কী নিয়ে কথা বলব, তার রূপরেখাটা মোটামুটি কেমন, আমি একটু আমতা-আমতা করে বলব, ঠিক জানি না। স্মৃতি, স্বপ্ন, উদ্ভাস, কোনওটাই তো প্লট মেনে পূর্বাপর নিয়ত কাঠামোয় এগোয় না। মুহূর্তে মুহূর্তে এলোমেলো উদাসী হাওয়ার পথে পথে বিশ্রম্ভালাপ। এইসব ছেঁড়া-ছেঁড়া টুকরো মিলে শরৎ থেকে আষাঢ়ে পৌঁছবে কিনা জানা নেই। আশমান ফারসি শব্দ। আমার মনে হয়, ওই শব্দের মধ্যে অনেক রঙ আছে, পাল্টায় যা ক্ষণে ক্ষণে। সন্ধে হয়ে আসে। রাতেও আঁধারের রঙ কত বিচিত্র চেহারা নিয়ে দেখা দেয়। দেখি। বাউল-ফকিররা নানা রঙের কাপড়ের টুকরো দিয়ে বানান জোব্বা। জোড়াতালির সেই কামিজ পরে খুঁজতে হয় মনের মানুষ। খুঁজতে হয় আজব কুদরতি। সেই জোব্বাকে বলে ‘সহস্রতালি’।

বাউল-ফকিরদের প্রসঙ্গে মনে পড়ল ‘আসর বন্দনা’-র কথা। লালনশাহী ঘরানার ফকির বাউল আউলিয়া কর্তাডজা দরবেশদের দেখেছি, আখড়ার গানবাজনাতেও শুরুতে ‘আসর বন্দনা’ করতে। বাংলা-অসম-ঝাড়খণ্ডে অনেক মঙ্গলকাব্য, পালাগান বা বনবিবির গানে ‘আসর বন্দনা’, হ্যাঁ, প্রথমে হবেই। ‘আসর বন্দনা’ সেই বহুকাল সঞ্চিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। লোকায়তের পরম্পরা। রক্তে বহমান বীজ। 

কত বিচিত্র ধরনে ‘আসর বন্দনা’ উচ্চারিত হয়, হয় কত-শত সুরে-ভণিতায়-প্রথায়। তার আবার কিছু চেনা চৌহদ্দিও আছে। দশদিকের প্রতি সেলাম। প্রাকৃতিক নানা বস্তু এবং ঋতুসমূহ, অন্যদিকে অতীতের অনুষঙ্গে সাধুসন্ত, এমনকী মান্য রচয়িতা এবং শেষে নিজ-নিজ দেবদেবীদের আহ্বান, আশীর্বাদ প্রার্থনা আর শেষে দর্শকদের প্রণতিজ্ঞাপন। ‘আরো যত শ্রোতা আছেন শহর গঞ্জে গ্রামে। প্রণামে পূজি গো সবে বন্দি গো প্রণামে’। গেয়েছিলেন তরুণ, দীপ্ত কালিকাপ্রসাদ। ‘দোহার’–এর কোনও অনুষ্ঠানে। যখন এই লেখা লিখছি, তারিখ ৭ মার্চ ২০২৪। কালিকাপ্রসাদের চলে যাওয়ার সাত বছর অতিক্রান্ত। তার জন্য মন ভার। আমিও এই সুযোগে পাঠক মহলকে লম্বা কুর্নিশ করে আসর বন্দনার ধাঁচে শুরুয়াৎ করছি। এইসব কথাবার্তা, স্মৃতি-বিস্মৃতি, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, পর্যটন-ভোজন-মজা মশকরা, কিসসা-বাতেল্লা-আজগুবি, রূপ-অরূপ আর নগরবাজনা যদি তাঁদের পছন্দ হয়, ভালো, নইলে পত্রপাঠ পাততাড়ি গুটোব। না, না, প্রথমেই সমাপ্তির আশঙ্কা উচিত নয়। পূর্বরাগে মাথুরের কথা বলতে নেই, মহাজনেরা শিখিয়েছেন। আমি বরং আমার পাঠকের প্রতি প্রণিপাত করি নবনীতা দেবসেনের একটি কবিতা দিয়ে। যে ক'টা দিন, হে পাঠক/ হে পাঠিকা একসঙ্গে এই ছুতোয় আছি, সেই সামান্য অস্তিত্বঘনিষ্ঠতাকে উদযাপন করার এই কবিতা। আমার পক্ষ থেকে। আপনাদের কাছে।

‘কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে / এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো। / শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত/ স্বজন। এই হাত, এই নাও, হাত। / এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতক্ষণ / কাছাকাছি আছো, অস্পৃষ্ট রেখো না। / ভয় করে। মনে হয় এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। / যেমন অসত্য ছিল, দীর্ঘ গতকাল। / যেমন অসহ্য হবে অনন্ত আগামী।/’

আরও পড়ুন- শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন একটু কমলালেবু, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর পুড়ে যায় ‘ঘাতক’ ট্রামটিও

ফিরে যাই ‘আসর বন্দনা’-য়। গানের মাধ্যমে পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ দশদিক কিংবা হিমালয়-সমুদ্দুর-নদনদী-বৃক্ষ প্রান্তর-অরণ্য-কৃষিক্ষেত্র সবাই একে-একে এখানে প্রণাম-সেলাম গ্রহণ করেন। যেন শুধু শ্রোতা নয়, পুরো মহাপৃথিবীর জন্যই এই বন্দনাগান। তার সমান্তরালে থাকে নবনীতা দেবসেনের কবিতা। নশ্বরতার দীর্ঘশ্বাস। বিরহ আর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে এক মিলন-মুহূর্তের ক্ষণিক শিখর। আমার কাছে, পাঠকের হাতের স্পর্শ। তারপর শূন্যতা আবার। একদিকে বিচিত্র বিপুল সম্ভার আর অন্যদিকে আয়ুর সামান্য কাল – অনন্ত বনাম খণ্ডকাল। সেই মানবজীবন অস্তিস্ত্ববাদীর চোখে বুদ্বুদমাত্র। জন্মের আগের অজানা কাল, মৃত্যুর পর অচেনা পরিক্রমা। সেজন্যই মানবজীবন এত রোমাঞ্চকর, এত অনুভবে রঙিন। তার অনিশ্চয়তা। তার সম্ভাবনা। তার প্রতিশ্রুতি।

মুহূর্ত আর অনন্তের এই বোধ থেকেই জীবনের একপলক সময় আরও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে পড়ে, জীবনানন্দ দাশের লেখালেখির প্রসঙ্গ। বারংবার তাঁর কবিতায় স্থান-কাল-পাত্র নির্ধারিত ক্ষণসময় যেমন নানা অনুষঙ্গে ঝলমল করে উঠছে, তেমনই তারই গভীরে প্রবাহিত হয়েছে অনির্বাণ মহাসময়ের ইশারা। বস্তুত, তাঁর কথাসাহিত্য কিংবা প্রবন্ধেও প্রসঙ্গ-প্রসঙ্গান্তরে স্রোতের মতো ঢুকে পড়েছে এই সংকট, এই পরিজ্ঞান, এই কেঁপে ওঠা। মন আর স্নায়ুর এইসব সূক্ষ্ম কম্পনের চিহ্নেই মহৎ এক কাব্যভাষা গড়েছিলেন জীবনানন্দ। তার একদিকে জন্মের আনন্দরূপ, অভিজ্ঞতার আদিগন্ত আলো-আঁধার, অন্যদিকে মৃত্যুর পূর্ণছেদ, মৃত্যুর করাল ছায়া। সমকাল আর মহাকাল, মাটির পুতুল আর মহাপৃথিবী, লক্ষ্মীপেঁচা আর নক্ষত্রলোকের ইশারা মিলেমিশে তৈরি হয় তাঁর মায়াজগৎ।

মায়াজগৎ শব্দটির নানা তল। জীবনানন্দের সৃষ্টিরও বহুমাত্রা। অতল আহ্বান। সেখানে সত্যিই আছে জাদুস্পর্শ। কেননা কল্পনার আশ্চর্য উড়ানে উদঘাটিত হয় জীবনের কত সত্য, কত অনুভূতি, কত হৃদয় স্পন্দন! ভেঙে যায় প্রায়শই বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা। কল্পনার, মেধার, শিশু সারল্যের, পাগলের, প্রেমিকের, সন্তের দৃষ্টিতে ক্রমান্বয়ে উৎসারিত হতে থাকে জীবন জগতের সারাৎসার। কখনও তিনি চলে যান মহাবিশ্বের ব্যাপ্তিতে, কখনও ফড়িঙের ঘন শিহরণে। বিন্দু আর অসীম পাথার তিনি দুই করতলে নিয়ে নতুন ভাষায়, নতুন ভাষ্যে অন্তর্দীপ্ত করে তুললেন আমাদের। তাঁর মতো গদ্যপদ্যে, মিল-অমিলে, ছন্দমায়া-ছন্দহীনতায়-অন্য কেউ পারেননি এই মায়াময় অভিযাত্রা পাঠকের সামনে তুলে আনতে। এ বছর তাঁর জন্মের ১২৫ বছর। এ বছর তাঁর মৃত্যুর সত্তর বছর। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) স্বল্প আয়ুর জীবনে খুলে দিলেন অসম্ভব সব সম্ভাবনা।

এই পর্যন্ত পড়ে, আমি দেখতে পাচ্ছি, পাঠক একটু মুচকি হাসছেন। কে জানে, হয়তো তিনি পাঠিকা। ধরে ফেলবার হাসি। তাহলে কি জীবনানন্দের ১২৫ বছর উদযাপনের সমে এসে পড়ার জন্যই এত উপক্রমণিকা? আমি আবার বলে উঠব – না ! মনে রাখবেন, আমি এই পরিসরের নাম রেখেছি ‘আশমানদারি’। শব্দ প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথের। ঠিকই। কিন্তু সেই সূত্রেই বিরাট এক ছায়া ফেলে সামনে এসে দাঁড়ালেন জীবনানন্দ। আশমানদারিতে তাঁর জুড়ি কে আছেন? যদি একটু আলগাভাবেই মনে করতে থাকি, তাঁর মতো বাংলা কবিতায় এত রকমের আকাশ নিয়ে কে-ই বা বসতি করেছেন। কে-ই বা তৈরি করেছেন আশ্চর্য দুনিয়া? দিন আর রাতের আকাশ, জ্যোৎস্না আর রৌদ্রের নানা বর্ণময় শামিয়ানা, নক্ষত্র নীহারিকা গ্রহ মহাজাগতিক শূন্য, সময়হীনতা আর গোধূলি-দুপুরের নিঃসঙ্গ চিল কাক জোনাকি চড়ুই – কে এত স্নেহে বর্ণনা আর লালন করেছেন? তাঁর কথাসাহিত্যে, চিঠিপত্রে, ডায়েরিতে, এমনকী প্রবন্ধ-নিবন্ধে আকাশ আর আঁধারের পুনরাবৃত্ত প্রবাহ। তিনি যেন আকাশকে স্পর্শযোগ্য, অনুভববেদ্য, অবয়বযুক্ত করে তুললেন। আমার আশমানদারিতে তাঁর দৃষ্টিচিহ্ন, ছায়াচিহ্ন, শব্দচিহ্ন স্বাভাবিক বিনতির সুরে বেজে উঠবেই। বিনতি তাঁর কল্পনামনীষাকে। ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সংগতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো ...’। আকাশের দিগদর্শন আর সময়ের অন্তঃসার, এই দুই নিয়ে সন্ধান চালালেন জীবনানন্দ। আমার এই ‘আশমানগিরি’ তাঁকে বিনম্র অভিবাদনে স্মরণ করছে। 

আরও পড়ুন- ‘আমি বিনয় চণ্ডাল’ : এক পংক্তির কবিতার দলিত পাঠ

প্রশ্ন অবশ্য শুধু স্মরণ করার তো নয়। সমকালীন পৃথিবীতে এই প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, সহজ সরল সমাধান নয়, বরং খুঁজতে হবে গভীর অন্তর্লোক। প্রশ্নাতুর মন চাই আর কোনও নির্দিষ্ট মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য নয়, বরং বারংবার খতিয়ে দেখতে হবে উতল-অবতল ছায়া-প্রচ্ছায়াগুলি। এই স-প্রশ্ন, স-তর্ক অবস্থান, এই নিশ্চয়তাহীনতা, এই নব নব উদ্বেগ এবং পথসন্ধান – এই সমকালীনতার বীজ লুকিয়ে আছে জীবনানন্দের কাব্য পরিক্রমায়।

‘অনেক মুহূর্ত আমি ক্ষয় করে’ কবিতাটির (মনবিহঙ্গম । ১৯৭৯) দিকে তাকানো যেতে পারে। ‘অনেক মুহূর্ত আমি ক্ষয়/ ক’রে ফেলে বুঝেছি সময়/ যদিও অনন্ত, তবু প্রেম সে অনন্ত দিয়ে নয়।// তবুও তোমাকে ভালোবেসে/ মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে/ বুঝেছি অকূল জেগে রয়/ ঘড়ির সময় আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয়’। দু'টি ভিন্ন তলের কথা প্রস্তাব করছেন জীবনানন্দ। একটি অনন্ত সময় কিংবা সময়হীনতা আর অন্যটি মুহূর্তের নির্দিষ্ট কালচেতনা। কবিতাটি জানাচ্ছে ভালোবাসা এবং ব্যক্তিসম্পর্কগুলি পার্থিব ঘড়িতে আবদ্ধ। এ এক গভীর সৌরচেতনা। সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে গ্রহগুলি দু'টি আবর্তনে ঘুরছে। একটি বার্ষিক আর অন্যটি আহ্নিক। এই আবর্তনের কক্ষপথের আকার এবং দূরত্ব দিয়ে বর্ষকাল একেকটি গ্রহের জন্য নির্ধারিত হয়। যিনি পৃথিবীতে জন্মাচ্ছেন আর যিনি শনি বা শুক্রগ্রহে জন্মাচ্ছেন, তাঁদের বয়স আলাদা হতে বাধ্য। কেননা এক একটি গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এক এক সময় লাগায়। অহ্ন বা দিনের কালপরিমাপও এইভাবে নিজের অক্ষের চতুর্দিকে লাটিমের মতো ঘূর্ণায়মান গ্রহটির গতির ওপর নির্ভরশীল। যদি তাই হয়, তাহলে মন্থর গ্রহের ক্ষেত্রে দিনরাতের সময়কাল আর দ্রুতগতি গ্রহের দিনরাত সময়কাল আলাদা হবে। স্টিফেন হকিং তাঁর ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (A Brief History of Time/ 1988) পুস্তকে বিষয়টির প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। সময়ের এই পরিধি এবং সীমানা আলোড়িত করেছিল জীবনানন্দকেও। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই মহাবিশ্বে গ্রহ নির্ভর অস্তিত্ব যদি একবার সরিয়ে রাখা যায় তাহলে সময়হীনতার সূত্রপাত সম্ভব। সেই মহাকাল বা মহাসময় গণনার ঊর্ধ্বে। সেখানে কোনও সাপেক্ষতা নেই। সাত পঙক্তির এই কৃশ কবিতায় কালচেতনার দুই ডানা যেন আকাশ তোলপাড় করল। ‘ঘড়ির সময়’ আর ‘মহাকাল’ আমাদের বিস্ময়ে নির্বাক করে উড়ে যাচ্ছে।

কথাসাহিত্যে এল মহাকাশ আর মহাবিশ্ব। অন্যদিকে এল সমসময়ের বিপুল বিশ্ব। তার জনজীবন। তার মানচিত্র। মাঝখানে স্পন্দমান চরিত্রেরা। প্রেক্ষাপটে প্রশ্নভারাতুর লেখকের মন।

(চলবে)

More Articles