ভাষাবিভ্রাট দেখেও চোখ বুজে থাকে বাঙালিরাই
Bengali Language: যে ভালো ইংরেজি জানে এবং অঙ্ক-বিজ্ঞান জানে তার কদর, শিরোপা, পুরস্কার ঢের বেশি। যে ছাত্র বা ছাত্রী ভালো বাংলা জানে বা লেখে তার যথেষ্ট স্বীকৃতি মেলে না।
আবেগ থেকে সবসময় মুক্ত হতে পারি না। হবই বা কেন? যতই এ শহর কলকাতা শেখাতে থাকুক বহুস্বরের মাহাত্ম্য, সেখানে যেন আমার 'স্বর', বৈচিত্র্যের ঠেলায় নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়! বাংলা আর বাঙালির নানা ভাষা, সংস্কৃতি 'অস্মিতা' প্রকাশ হয় একুশে ফেব্রুয়ারি, পঁচিশে বৈশাখ আর উনিশে মে। সেই তারিখ কেটে গেলে আবার যে-কে সেই। নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি, নিজের যাপনের চিহ্ন বিষয়ে সবাই অসাড় হয়ে যাওয়া। এত আবেগ, এত হুংকার, এত শপথ দু-তিনদিনেই অবসান। এত উচ্চকণ্ঠ ঘোষণা দু-তিনদিনেই নিষ্প্রভ, ম্রিয়মাণ। সদ্য পেরিয়ে এলাম পঁচিশে বৈশাখ আর উনিশে মে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কী আর মন্তব্য করব, শুধু এইটুকুই মনে করিয়ে দিই, ওই একটি মানুষ তাঁর আজীবনের শ্রমে, প্রতিভায়, উদ্যোগে আর সৃষ্টিময়তায় বাংলা এবং বাঙালিকে কয়েক শতকের বেঁচে থাকার পুঁজি জুগিয়ে গেছেন। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, সংস্কৃতি, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই অনির্বাণ অবদান রেখে গেছেন। উনিশে মে অসমের শিলচরে বুলেটে নিহত একাদশ শহিদ। বাংলা ভাষার আন্দোলন। ১৯৬১। রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহিদের নামের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রথম মহিলা ভাষাশহিদের নামটি। কমলা ভট্টাচার্য। অসমের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার অবলুপ্তি রুখতে, মর্যাদা রক্ষার্থে যাঁরা লড়াই করেছিলেন তাঁদের কথা প্রতিটি অক্ষরে মিশে থাকে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার প্রমুখের সঙ্গেই। বাহান্ন আর একষট্টি মিলেমিশে যায়। ভাষা রক্ষার এই ইতিহাসে নানাভাবেই মিশে থাকেন রবি ঠাকুরও। এখন, মে মাসের শেষ থেকেই আমাদের আবেগের তীব্রতা রোদের তেজের মতো কমতে থাকে। নানা আপোসে, খুচরো প্রাপ্তির হাতছানিতে, আত্মগ্লানি আর হীনমন্যতায়, উচ্চাকাঙ্খার মায়া আহ্বানে সবই ভুলে থাকি।
কলকাতা শহর কেমন অচেনা লাগে আমার। এসব সময়ে। মেট্রোয় উঠলাম বহু বছর পরে। বাসেই যাতায়াত করি। কখনও কখনও ট্যাক্সি। উঠেই চক্ষুস্থির। প্রথমে স্টেশনে দেখলাম পানীয় জলের কর্নারে বড় বড় করে কিছু কথা লেখা। একদিকে লেখা 'ঠান্ডা জল'। ভালো কথা। তারপর পাশে আরও একটি পানীয় জলের কল। তার ওপরে লেখা 'শাদা জল'। বিশ্বাস করুন, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। তারপর মেট্রোতে ঢুকেও আমার বেদনার অবসান হলো না। গেটের পাশেই দেখলাম ওপরের দিকে একটা নোটিশ বোর্ড। তার বাংলাটা তথৈবচ। সেখানে লেখা আছে, 'অগ্নিশমন যন্ত্র এখানে উপলদ্ধ আছে।' তলায় নাগরি অক্ষরে লেখা (কেন যে 'দেবনাগরী' অক্ষর বলা হয় কে জানে! 'দেব' আবার হরফে যোগ কেন? হাস্যকর!) আছে একই বাক্য। খালি এখানে হয়েছে ক্রিয়াপদের পার্থক্য। বাংলা তর্জমা হিন্দি থেকে! 'ফায়ার এক্সটিংগুইশার'-এর বাংলা দীর্ঘদিন চালু আছে, 'অগ্নিনির্বাপক'। কেউ ইচ্ছে করলে 'আগুন নেভানোর যন্ত্র'-ও লিখতে পারেন। হিন্দি ভাষা থেকে ধার করে একেবারেই অপ্রচলিত শব্দ 'অগ্নিশমন' বাংলায় কেন জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে? উপরন্তু 'উপলদ্ধ' তো ভুল। ওখানে 'উপলব্ধ' হবে। প্রশ্নটা একদিক থেকে ভাবলে সম্পূর্ণ তুচ্ছ বিষয়। অন্যদিক থেকে ভাবলে এর তাৎপর্য গভীর। এর অনেকগুলো স্তর বা মাত্রা বর্তমান। প্রথমত, যে রাজ্যের প্রথম মুখ্য ভাষা বাংলা, সে রাজ্যের মেট্রো রেলে হিন্দি-অনুসারী, সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বাংলা চোখের সামনে কেন থাকবে, সেটাই প্রশ্ন। 'শাদা জল' কি আমাদের মেনে নিতে হবে? এইসব প্রশ্ন তোলার খুব মানেও হয়তো নেই। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কোনও জাতি তার ভাষা-সংস্কৃতি-সামাজিক রীতি তখনই সংরক্ষণ এবং পালন করতে চায়, যখন তার সে সম্পর্কে একটা গভীর গর্ববোধ থাকে। এই 'গর্ববোধ' উৎপাদনের সঙ্গে হয়তো অর্থনীতির এক ধরনের গূঢ় সম্পর্ক আছে।
আরও পড়ুন- বাবা কসাই, জন্ম যৌনপল্লী! কবি নামদেও ধসাল এক বেপরোয়া বিস্ফোরণ
গত চল্লিশ বছরে ক্রমে ক্রমে বাংলা ভাষা অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। যে-কারণে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত (উচ্চবিত্ত সমাজ তো বহু আগে থেকেই) ইদানীং শিশুদের বাংলা শেখাতেই চাইছেন না। সত্যিই, সারা বিশ্বজুড়ে, ভারতবর্ষ জুড়ে মূলত কর্পোরেটের ভাষা ইংরেজি। সুতরাং, যে ভাষায় অর্থকরী কোনও সাফল্য দুষ্কর, সে ভাষা থেকে দূরে থাকাই ভালো। অযথা সময় নষ্ট। যে কোনও বিদ্যালয়ে তাকিয়ে দেখুন। যে ভালো ইংরেজি জানে এবং অঙ্ক-বিজ্ঞান জানে তার কদর, শিরোপা, পুরস্কার ঢের বেশি। যে ছাত্র বা ছাত্রী ভালো বাংলা জানে বা লেখে তার যথেষ্ট স্বীকৃতি মেলে না। এ এক আশ্চর্য শিক্ষাব্যবস্থা! হয়তো সেই কারণেই সংখ্যাগুরু অর্থনীতিতেও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে এগিয়ে থাকা হিন্দি ভাষা ('হিন্দুত্ববাদী' সংগঠনও পেছনে আছে) জবরদস্তি চাপানো হচ্ছে অন্যান্য ভাষার কাঁধে। হিন্দি ভাষা কিন্তু ভারতবর্ষের সংবিধান স্বীকৃত ২২ টি ভাষার একটি। কোনওভাবেই কোনওদিন সে 'রাষ্ট্রভাষা' ছিল না। ভারতবর্ষের কোনও 'রাষ্ট্রভাষা' নেই। এ হলো, সর্বার্থেই 'নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান'-এর দেশ। বিবিধের মাঝে মিলনই সেখানে একমাত্র সত্য। এই বাংলায় যদি বিকৃত বাক্য লেখা হয়, সেটা অমনোযোগ, অজ্ঞানতা যাই হোক, সে বেশ বেদনাদায়ক বিষয়। গণতন্ত্রকে তো যেকোনও মূল্যে জীবিত রাখাই কর্তব্য! অন্তত আমি তাই মনে করি। ভাষা বা সংস্কৃতির 'মাৎস্যন্যায়' অর্থাৎ বড় মাছের ছোটো মাছকে খেয়ে নেওয়া, আদৌ অভিপ্রেত নয়। এই যে বাংলা ভাষা বিষয়ে অসাড়তা, সেটাই আমার কাছে সবথেকে বিপজ্জনক। আমরা বাংলাভাষী যারা, বাংলা ভাষা সম্পর্কে যাদের আবেগ আছে, তারা দিনের পর দিন চোখের সামনে এই ভাষাবিভ্রাট দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকি। আমরা যেন জেনে গেছি, কিছুতেই কিছু হবে না। এমনকী আমি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রসঙ্গটি তুললাম 'ইনস্ক্রিপ্ট'-এর পাতায়, তার কি কোনও প্রভাব তৈরি হবে? তেমন কোনও আশা আমি করি না। যে কোনও বিষয়েই আমাদের ঔদাস্য এখন দেখবার মতো। এখান থেকেই মনে হয়, দেশের গণতন্ত্র বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেন বলছি এই কথা?
আরও পড়ুন- আলিপুর চিড়িয়াখানায় দুপুর কাটাতেন জীবনানন্দ
যে কোনও গণতান্ত্রিক পরিসরের প্রধান শর্ত হলো, প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং অবস্থান অটুট রেখে মিথোজীবিতা। ফলে, যখনই কোনও সমাজে দুর্বলতর বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, যাপন ক্ষমতাবান কেন্দ্রীয় শক্তির হাতে কোণঠাসা হবে, বিকৃত এবং পর্যুদস্ত হয়ে ক্ষমতাধরে আদলে 'একচালা' হয়ে উঠতে থাকবে, ততই গণতান্ত্রিক পরিসর ভেঙেচুরে যাবে। তখন দেখা দেবে বলবানের আস্ফালন আর সন্ত্রাসের পরিমণ্ডল। ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতবর্ষ তথা বাঙালির সংযোগ আরও বড় কোনও উপলব্ধি বা সমৃদ্ধশালী যৌথতার দিকে যেতে পারত, যদি না এই সম্পর্ক নির্ধারিত হতো প্রভু-ভৃত্যের আঙ্গিকে। রণ-রক্ত সফলতা দিয়েই কিন্তু ক্লাইভের বাংলা দখল। খানিকটা হয়তো বিশ্বাসঘাতকতার মূলধনও আছে। সুতরাং, ওই অস্ত্র এবং শাসনের আধিপত্য-কর্তৃত্ব বাংলা এবং ইংরেজির সম্পর্ক নির্ধারণ করেছে। নানা ক্ষেত্রেই হীনমন্যতা-উচ্চমন্যতা আর রাজা-প্রজার সম্পর্কের রেশ আছড়ে পড়েছে সম্পর্কের আপাত সরল বুনিয়াদে। ঠিক এইভাবে এক-একটা মহানগর আমার কাছে গণতন্ত্রের এক অবশ্যম্ভাবী পরীক্ষা। মহানগরে অবশ্যই এসে জড়ো হবে নানা ভিন্ন-ভিন্ন পরিচয়ের মানুষ। তাদের যাপন হবে একইসঙ্গে যৌথ এবং একইসঙ্গে নিজস্বতায় গাঁথা। এই চলাচলের প্রকাণ্ড পথটিই সযত্নে, সচেতন সংকল্পে গড়ে তুলতে হয়। সারা বিশ্বজুড়ে অবশ্য এই পরীক্ষা আজও খুব সফল হয়নি। নানা সময়ে, নানা ভৌগোলিকতা এবং ইতিহাসে বারংবার এই সহজ মেলামেশাকে দু'হাতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে কোনও একপক্ষের ক্ষমতাদর্পী হুংকার। ভারতবর্ষ এবং বাংলাও তার বাইরে নয়। আজকের দুনিয়ায় ইউক্রেন-রাশিয়া, প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল থেকে ফ্রান্স-কঙ্গো, চিন-তিব্বত, স্পেন-মেক্সিকো কিংবা ইংলন্ড-শ্রীলঙ্কা অথবা আমেরিকা-ইরাক একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গণতন্ত্র সর্বত্রই ভূ-লুণ্ঠিত।
কলকাতা শহর এবং বাংলা ভাষার দিকে তাকালে ইতিহাসের ধারা স্পষ্ট দেখা যায়। 'আরণ্যক' উপন্যাসের সত্যচরণ একইভাবে পর্বত-প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে অনাদিযুগের নব-নব আগমন এবং মিলনকে দেখতে পেয়েছিল। আমি বলতে চাইছি, আঠারো শতক এবং উনিশ শতকে, ব্রিটিশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি এবং পরবর্তীকালে রাজধানী হিসেবে কলকাতা শহর ছিল ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্যদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মূল ভরকেন্দ্র। ফলে, ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতি, বর্গ এবং পরিচয়ের মানুষ দলে-দলে এই শহরে এসে বসবাস করেছে। এমনকী এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও বহু মানুষ এসে এই শহরের অংশ হয়ে গিয়েছেন। এখনও কলকাতা শহরের পূর্বদিকে দেখতে পাওয়া যাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার নাম 'চায়না টাউন'। একসময় এই শহরে কাবুলিওয়ালা বা আফগানিস্তানের মানুষের বসতি ছিল, বেশ কিছু বাড়িঘর এখনও দেখা যাবে বার্মা বা মায়ানমারের মানুষদের। এঁরাই একসময় পত্তন করেছিলেন 'সাঙ্গুভেলি রেস্তোরাঁ'-র।
আরও পড়ুন- নগরপথের উজ্জ্বলতম পথিক ভাস্কর চক্রবর্তী
আছেন তামিল জনগোষ্ঠী, পাঞ্জাবি-শিখ জনগোষ্ঠী, আছেন মলয়ালী জনগোষ্ঠী, আবার অসম-বিহার-রাজস্থানের অজস্র পরিবার। নেপালি-ভুটানি এবং সিংহলিরাও আছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই শহরের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায় যখন দেখি, অন্যান্য অনেক রাজ্যের অনেক শহরের তুলনায় এখানে গভীর প্রদেশে এক আশ্চর্য মিলনের আহ্বান আছে। সবথেকে বড় কথা, সেই মিলনে অনেকাংশেই ক্ষমতার বিপুল করাল ছায়া দেখা যায় না। যদিও, গত বিশ বছরে প্রবাহ অনেক স্তিমিত। 'আত্ম' এবং 'পর' উভয়কে নিয়েই আমরা বোধহয় কম ভাবি আজকাল। মেট্রোর ঘটনা সেই অসাড়তার চিহ্ন। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র থেকে বিচ্যুত হচ্ছি আমরা। আমার নিজস্বতা যেন কেউ কেড়ে না নেয়, আমি যেন কারো নিজস্বতার শ্বাসরোধ না করি!
বাংলা ভাষায় কত সহজে গৃহীত হয়ে গেছে, এইসব শব্দ - জানলা, পেরেক, সাবান, জমি, স্কুল বা পুলিশ। এরা সবাই বিদেশি শব্দ। জানলা, পেরেক হলো পর্তুগিজ শব্দ, সাবান এসেছে ফরাসি থেকে, জমি ফারসি শব্দ আর স্কুল-পুলিশ ইংরেজি। গণতন্ত্রের নিয়মে এরা সমান আদরে তৎসম, তদ্ভব বা দেশি শব্দের পাশে বসে। উচ্চ-নীচ ভেদ নেই। এখন প্রশ্ন হল, কেমন করে এইসব শব্দ ঢুকে পড়ল বাংলা ভাষায়? খুব স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়া। যেভাবে ভিন্ন দেশ এবং সংস্কৃতির মানুষ ঢুকতে শুরু করে মহানগরে। তবে, মনে করিয়ে দেব, জোরজবরদস্তি 'অগ্নিপ্রশমন যন্ত্র' শব্দকে ঢুকিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত নয়। মানুষ আর শব্দ আসে জাহাজে, নৌকায়, ট্রেনে, গরুর গাড়িতে, ট্রাকে, বিমানে এমনকী হেঁটেও! মসৃণ সেইসব প্রবেশের সাতকাহন!