বাংলায় রেনেসাঁসের ধারাকে আটকে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ | মুখোমুখি আশীষ লাহিড়ী
Swami Vivekananda Contradiction: বিবেকানন্দের শিকাগোর বক্তৃতাও তো নারীবিদ্বেষে ভরা! মানে ওঁর নিজেরই তো কথা, "স্বর্গস্ত পিতার মতো পুণ্য হওয়াই হিন্দুধর্ম..."
২০২০ সালে বিদ্যাসাগর পুরস্কার পেয়েছিলেন চিন্তাবিদ, গবেষক আশীষ লাহিড়ী। আরজি কর কাণ্ডের পরে সেই পুরস্কার ফিরিয়েছেন তিনি। আশীষ লাহিড়ী বলেছেন, "৯ তারিখে যা ঘটেছে, কলকাতা শহরের ইতিহাসে এমনটা আগে ঘটেছে বলে আমি মনে করতে পারছি না। ১৯৪৬ সালের যে দাঙ্গা দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বলে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে, আমি এটাকে সেরকমই নারকীয় ঘটনা বলে চিহ্নিত করতে চাই। সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যাপার এই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশ্যে এত বড় ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার খেলায় নেমেছে। পুরো ঘটনাটাকে অনেক ধর্ষণের মধ্যে 'নিছক' একটা ধর্ষণ বলে প্রচার করে মূল পাপচক্র থেকে মানুষের মন ঘুরিয়ে দেওয়ার পৈশাচিক খেলায় মেতেছে তারা। আসলে তো ধর্ষিত হয়েছে পশ্চিমবাংলার মানুষের যৌথ বিবেক। ধর্ষক পশ্চিমবঙ্গ সরকার। প্রাতিষ্ঠানিক সংবেদহীনতার এমন ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ আমার এই ৭৬ বছর বয়সে আমি জীবনে কখনও দেখিনি। এই সব কারণেই আমার মনে হলো আমরা তো আর কিছু করতে পারি না , আমরা তো ঠুঁটো জগন্নাথ। আমাদের কথার কোথাও কোনও মূল্য দেয় না কেউ। অন্তত এদের সঙ্গে সংস্রবটা ত্যাগ করতে পারি এই পুরস্কার ফেরত দিয়ে।" যুক্তিবাদী, চিন্তক আশীষ লাহিড়ীর সঙ্গে রূপক বর্ধন রায়ের এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার রইল ইনস্ক্রিপ্টের পাঠকদের জন্য।
রূপক বর্ধন রায়: প্রথমেই জানতে চাই, ২০১২ সালে হঠাৎ এমন একটা বিতর্কিত ব্যাপার নিয়ে চর্চা এবং বই লেখার কথা (স্বামী বিবেকানন্দ ও বাংলার সেকিউলার বিবেক) আপনার মনে হল কেন? কাজটার মোটিভেশনটা বুঝতে চাইছি আসলে।
আশীষ লাহিড়ী: এর উত্তরটা খুবই সহজ। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি, মানুষকে যদি যুক্তিশীলতার দিকে না নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে আমাদের সমাজের কোনও সমস্যাই মিটবে না এবং বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পেরেছি যে, সেই মোবিলিটিটা শেষ পর্যন্ত ধর্মে এসে ধাক্কা খেয়ে যায়। আমি বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষের কথাও বলছি। অনেকেই আছেন যাদের বলতে শুনি, “আমি আর কী এমন বিজ্ঞান শিখেছি, আমার থেকে অনেক বড় মাপের এক্কেবারে অনেস্ট লোক যেমন স্বামী বিবেকানন্দ যখন বিজ্ঞানকে মেনে নিয়ে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতার কথা বলছেন, সেটা খুব মহৎ হয়ে দাঁড়ায়!” সমস্যা হল, বিবেকানন্দ কী বলে গেছেন সেটা সম্বন্ধে তাঁরা মোটেই সচেতন নন কিন্তু বিবেকানন্দ টু অল ইজ, সামথিং অ্যাবাভ রিপ্রোচ! আমার নিজের বন্ধুদের মধ্যেও এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক এমনকী বন্ধু বিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়েছে। আমি তো নিজের পাড়ার লোক, আমার স্কুলের বন্ধুবান্ধব, যাদের অনেকের সঙ্গে এখনও মাঝে মধ্যে কথা হয়, বলতে শুনি, “তুমি বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ সবাইকে নিয়ে আলোচনা করতে পারো কিন্তু বিবেকানন্দকে নিয়ে নয়।” প্রশ্ন হল, কেন? হোয়াই বিবেকানন্দ ইজ সো স্পেশাল?
রূপক: কেন?
আশীষ: এখানে সকলের যুক্তি হচ্ছে যে, তিনি নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনার এমন একটা স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন যে ওঁকে বুঝতে হলে আলাদা একটা সাধনার প্রয়োজন। এইটা আমি একেবারেই মানতে পারি না! আমার কেবলই মনে হয়, তিনি যেহেতু আমার চেনা বাংলা গদ্যে এবং আমার চেনা ইংরেজি গদ্যে কথাগুলো বলছেন, তাঁর লেখা পড়ে আমি যদি ব্যাকরণগত দিক থেকে ভুল না বুঝি, তাহলে সেই কথাগুলোকে নিয়ে আমি আলোচনা করতে পারব না কেন? একদিকে তাঁর দেশপ্রেমের কথা, আমাদের জাতিগত প্রগ্রেসের কথা অবশ্যই মহৎ এবং গ্রহণযোগ্য কিন্তু সেটার পথ হিসাবে তিনি যাকে বেছে নিচ্ছেন তার মধ্যে এত কন্ট্রাডিকশান যে সেটা বিস্ময়কর হয়ে ওঠে।
বর্ণাশ্রমকে কেস স্টাডি হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এক জায়গায় তিনি বলছেন যে, বর্ণাশ্রমই হচ্ছে আমাদের সব থেকে বড় জোরের জায়গা এবং এইটা আছে বলেই এই এত বছরের এত উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েও হিন্দুধর্ম বেঁচে আছে। এই কথা বলার কয়েক মাস পরেই বলছেন যে, এই প্রথাই আমাদের সমস্ত সর্বনাশের কারণ! এবং কথাটা তখন তিনি এতই চমৎকার করে ব্যাখ্যা করছেন যে তুমি মানতে বাধ্য! বর্ণাশ্রম কী করে? বিবেকানন্দ বলছেন, বর্ণাশ্রম আমাদের প্রতিযোগিতার প্রবৃত্তিটাকে নিরস্ত করে। অর্থাৎ যে শূদ্র বা বৈশ্য হয়ে জন্মেছে সে কখনই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে কম্পিট করবে না! কাজেই এই কম্পিট করার প্রবৃত্তিকে নিরস্ত করে দেওয়ার ফলে সমাজে এক ধরনের শান্তি বিরাজ করে। কিন্তু সেটা কী ধরনের শান্তি? এই শান্তির অর্থ হল আমার দেশের মেজরিটির নিরক্ষর হয়ে থাকা! এরই ফলে তাদের দু'বেলা দু'মুঠো খাবার জোটে না। আবার এই বর্ণাশ্রমই এই সমাজকে টিকিয়ে রেখেছে বলে তিনি গর্বিতও বটে! তাহলে আমি কোন কথাটাকে ধরব?
তুমি পৈতের কথাই ধরো। ব্রাহ্মণ জিনিসটা কী তার মাথামুণ্ডু না বুঝেই কেবল একটা দড়ি আর কিছু পদবির জোরে আজও নিজেকে সুপিরিয়ার প্রমাণ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে একদল মানুষ। জাতির দিক থেকে আমি নিজে যেহেতু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছি আমি আমার শিক্ষিত আত্মীয়দের মধ্যেই এটা লক্ষ্য করেছি। অর্থাৎ এই বর্ণাশ্রমকে বাঁচিয়ে রেখে সমাজের বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এটা কি এই আধুনিক যুগে আধুনিক দেশে কাম্য? এসবের পিছনে ইচ্ছেমতো বিবেকাননন্দের নাম ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
রূপক: কিন্তু অনেকেই তো যুক্তি সাজান এই বলে যে, বিজ্ঞানের নিয়মেই তো সবাই সমান নয়?
আশীষ: হ্যাঁ, সে যুক্তি অনেকেই দেন। তবে শূদ্র বলে একজন লোক পড়ার সুযোগ পেল না আর আমি ব্রাহ্মণের ছেলে বলে ৫ খানা মাস্টার রেখে ৯৮% নম্বর পেয়ে চাকরি বাগিয়ে এলাম, সেটা কি বিজ্ঞানের নিয়মে হচ্ছে? দেখো, সুস্থ সমাজের ডেফিনেশন খুব সহজ; যেখানে প্রত্যেকে খেতে-পরতে পাবে এবং অকারণে অর্থাৎ তার জন্মের কারণে বা অন্য কোনও অযৌক্তিক কারণে কেউ তাকে ছোট করবে না। সমান সুযোগটা সবাই পাচ্ছে কিনা সেটা দেখা দরকার। এরপর অবশ্যই ক্লাসে যে ফার্স্ট হয় সে আমার থেকে বেটার এটা মেনে নিতেই হবে। কিন্তু আমার ঘরে ভাত চড়ে না অথচ আমি একটা বড়লোক ঘরের ছেলের সঙ্গে একই পরীক্ষায় বসছি, সেই কম্পিটিশন কখনই ইভেন হতে পারে না! কাজেই, এই সমান সুযোগসম্পন্ন একটা সমাজের দিকে যেতে গেলে যে মনোভাব তৈরি করা দরকার, সে পথে এই ধর্মীয় আচার-আচরণ দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন তথাকথিত আধুনিক মানুষ, যিনি সমাজে এমন বৈষম্য থাকা উচিত নয় বলেই স্বীকার করেন, তিনি ৫০০ টাকা দিয়ে একটা বাংলা বই কিনতে গিয়ে দু'বার ভাবছেন, অথচ বাড়িতে একটা পুজো করার জন্য অনায়াসে ৫০০০ টাকা খরচ খরচ করছেন! কেন? প্রশ্ন হল, আমার কাছে কোনটা অবশ্য পালনীয়? আমার বাবা বা তার বাবা পুজোটা করতেন বলে কিছু না ভেবে আমিও ওই একই পথে হাঁটব না কি আরেকটু যুক্তিশীলতার রাস্তায় হেঁটে সমাজের বৈষম্যকে দূর করার পথটা আরেকটু মসৃণ করব?
এই বাঁধটা ভাঙতে গিয়ে আমি দেখেছি, বিবেকানন্দ একটা মস্ত বড় বাধা হরে দাঁড়াচ্ছেন! অ্যাপারেন্টলি ওঁর প্রকাশভঙ্গি সত্যিই খুব আধুনিক। তিনি বিজ্ঞানের বহু সত্য জানতেন এবং তা খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশও করতে পারতেন। বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে তাঁর পরিকল্পনগুলোও অসাধারণ। কিন্তু এতসবের শেষেও কিন্তু তিনি বলছেন যে, আসল জিনিসটা হল ধর্ম! ধর্মটা ভাত, অন্যগুলো যেন তরকারি। ভাতটা থাকলে তবে তরকারি জিনিসটা প্রয়োজনীয়। ওঁর কথার জোর, ওঁর সাবলীল প্রকাশভঙ্গি শিক্ষিত মানুষকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করে। তখন আর কেউ তাঁর সেই কথার খোলসটা ছাড়িয়ে ভিতরটা দেখেন না, আসল বক্তব্যটা তবে কী দাঁড়াল সেটা ভাবেন না? এই জায়গাটাতেই একটা ধাক্কা দেওয়া দরকার বলে আমার মনে হয়েছে।
ব্যক্তিগত স্তরে আমি ওঁকে বেশ বড় মাপের মানুষ বলেই মনে করি। তাঁর অজস্র ক্ষমতা ছিল। তাঁর সমসাময়িকদের স্মৃতিচারণ থেকেই জানতে পারি যে, তিনি খুবই ব্রিলিয়ান্ট লোক ছিলেন কিন্তু তা নিয়েও কীরকম অকারণ মিথ তৈরি করা হয়েছে দেখো। আমাদের ছোটবেলায় বলা হত যে বিবেকানন্দ দারুণ রেজাল্ট করেছিলেন। কথাটা আদপেও সত্যি নয়! ওঁর স্মৃতিশক্তি নিয়েও এমন মিথ ছোটদের আজও বলা হয়ে থাকে। আমার নিজের কানে শোনা যে, তিনি নাকি একদিন একটা অঙ্কের বই পড়ে পুরোটা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। এর অনেক পরে দেখি যে, রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর বইতে বিবেকানন্দের পুরো মার্কশিটটা তুলে দিয়েছেন। বিবেকানন্দ অঙ্কে ৩৭ পেয়েছিলেন! তাহলে এই স্মরণশক্তির কথাটা নিশ্চয়ই মিথ্যে, তাই না? প্রশ্ন হল, এই মিথগুলো তৈরি করার দরকার হয়েছে কেন? কারণ এই 'লার্জার দ্যান লাইফ' ইমেজ থাকলে তাঁর সম্বন্ধে যে কোনও প্রশ্ন তোলার সম্ভাবনাটাকেই বন্ধ করে দেওয়া যায়। ওই যে আমার বন্ধুরা বলে 'স্বামীজি' সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন তোলাই চলবে না, তেমন। আমি এই জায়গাটাতেই একটু আঘাত দিতে চেয়েছি।
আরও পড়ুন- গৃহী রবিঠাকুর ও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ; প্রেমের অলিন্দে অচেনাই রয়ে গেলেন স্বামীজি
রূপক: আচ্ছা, বিবাহিতা বাঙালির বর বা স্বামী বা ভূ-স্বামীর ক্ষেত্রে স্বামী কথাটার যা অর্থ ওঁর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত স্বামীজির ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা তাই? আপনার কী মনে হয়?
আশীষ: এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আমাদের জাগতিক লেভেলের উপরের লেভেলের ব্যাপার (হাসি)। অর্থাৎ আমার জগতের যে পিতা, নোট ইট, 'মাতা' নন (হাসি), তাঁর কাছে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা এই 'স্বামীর' আছে। কাজেই স্বামীজি অর্থে 'সব কিছুরই প্রভু'!
রূপক: বেশ! বইয়ের আরও নানা প্রসঙ্গে যাব, তবে তার আগে বই থেকেই একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। বইয়ের ১৪৩ নম্বর পাতায় আপনি লিখছেন, “…আবাল্য বিবেকানন্দ পূজারী কোনও এক তরুণের মনেও একসময় স্বামীজির প্লাস্টার করা ভাবমূর্তি সম্বন্ধে অনুরূপ প্রশ্নচিহ্ন জেগেছিল, তাঁর বর্ণাশ্রম স্তুতি কিম্বা জন্মান্তরবাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা অলৌকিক সমর্থক বিবিধ মন্তব্য পড়ে। এরকমই হয় চিন্তা ভাঙে, চিন্তা গড়ে।”
এই ‘আবাল্য বিবেকানন্দ পূজারী কোনও এক তরুণ’ তো আপনি?
আশীষ: হ্যাঁ, আমি! ছোটবেলায় আমি খুব বিবেকানন্দ ভক্ত ছিলাম। আর এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু বলে আমি মনেও করি না। বিশেষ করে আগেও যেমন বললাম, আমাদের ওই অঞ্চলটা বিবেকানন্দের বাড়ির একদম কাছে, ফলত আমি দেখতাম যে, সকলেই ওই জিনিসটা নিয়ে বেশ গর্বিত। সেই ব্যাপারটাতে ছোটবেলায় আমি খানিক আচ্ছন্ন ছিলাম। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখি; ওই বয়সে বিবেকানন্দে আচ্ছন্ন থাকলেও, পুজোআচ্চায় আমার কখনই কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না। আমার, ওঁর কথার জন্য, ভাষার জন্য ওঁকে পছন্দ হতো। মনে হতো তিনি যে ভাষায় কথা বলছেন, বিষয় আধ্যাত্মিক হলেও সেটা আমি বুঝতে পারছি!
রূপক: মোহটা ভাঙল কখন?
আশীষ: সে কথা বলতে গেলে একটু রাজনীতির কথা উঠে আসবে।
রূপক: বলুন না।
আশীষ: তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই যে, মূর্তি ভাঙার আন্দোলনের পিছনে নকশালরা একটা থিওরি দিয়েছিল। এই মূর্তি ভাঙা ব্যাপারটাকে এখন ছেলেমানুষি মনে হলেও সেই থিওরির মধ্যে একটা পজিটিভ এলিমেন্ট ছিল। সেটা হল এই যে, 'আমরা কাকে মহাপুরুষ বলব', ওরা তার একটা মানদণ্ড তৈরি করেছিল। ওরা বলেছিল, আমাদের সমাজে, যেখানে কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই সমাজে থেকে যারা তাদের কথা বলছেন না বা ভাবছেন না তারা মহাপুরুষ হতে পারেন না। যেমন ধরো, আমাদের দেশের ইতিহাসে কৃষকরা যখন ন্যায্য আন্দোলন করেছে অধিকাংশ ভদ্রলোক তাদের সমর্থন করেননি, ইনক্লুডিং বিদ্যাসাগর। সুতরাং, এই এলিটিস্ট সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তারা একটা প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল। সেই প্রতিবাদের ধরন বীভৎস হওয়ায় বুমেরাং হয়ে আসে ঠিকই কিন্তু তাদের সেই যুক্তিটা আমায় খুব নাড়া দিয়েছিল। সেই কারণে আমি এক সময়ে একটু রবীন্দ্রবিরোধীও হয়ে উঠেছিলাম কিন্তু অচিরেই বুঝি যে, একজন ওই লেভেলের ক্রিয়েটিভ জিনিয়াসকে অমন সাদা-কালোয় বিচার করে বোঝা চলে না। অ্যাবসার্ড!
কিন্তু বিবেকানন্দের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম দাঁড়ালো। আমরা তখন সব কিছুকেই মার্ক্সিজমের দিক থেকে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। মার্ক্সের গোটা কথাটা, “Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people…”
রূপক: হ্যাঁ সর্বত্র তো শুধু শেষটুকুই ব্যবহৃত হয়। আসলে কথাটা তো ধর্মের বিরুদ্ধে নয় বরং উল্টোটাই বলা চলে!
আশীষ: হ্যাঁ! (হাসি)। কিন্তু কথাটা বলে তিনি আসলে বোঝাতে চাইলেন যে, যাদের আর কোথাও যাওয়ার নেই, তারা এতই অত্যাচারিত যে তখন তারা 'হে প্রভু' বলে ঈশ্বরের পায়েই লুটিয়ে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। এবং এটা বলে তিনি মূলত রুলিং ক্লাস যে এই ব্যাপারটাকেই এক্সপ্লয়েট করে ধর্মের বোঝা নিপীড়িত মানুষের কাঁধে আরও বেশি করে চাপাচ্ছে সেটা বলতে চাইলেন। তাদের জন্য বড় বড় মন্দির-মসজিদ করে দিচ্ছে ওরা কিন্তু আসল সমস্যাটার কোনো সমাধান করছে না। মার্ক্সের আপত্তি এবং ফলত আমাদের আপত্তির জায়গাটাও সেখানেই।
আজকাল আমি যেমন রিলিজিওসিটি (ধার্মিকতা) এবং অর্গানাইজড রিলিজিয়ান (ধর্ম) এই দুটোকে আলাদা করে দেখি। দেখো, এ কথা তো ঠিক যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূলে বা গোড়ায় কী আছে তা তো কোনও সায়েন্টিস্ট আজও অবধি খোলসা করে বুঝে উঠতে পারেনি! কোনওদিনই বলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে; কাজেই এই জায়গাটায় একটা সন্দেহ বা সংশয়ের অবকাশ থেকে যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যা নিয়ে আইনস্টানের কথা হয়েছিল…
রূপক: আইনস্টাইন কনভিকশানের কথা বলে বলেছিলেন যে, ‘দেন আই অ্যাম মোর রিলিজিয়াস দ্যান ইউ?'
আশীষ: হ্যাঁ, সেই কনভিকশানকে বা মানুষের মনের সেই প্রশ্নগুলোকে আমি ধার্মিকতার ব্র্যাকেটে রাখতে চাই। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর সে বিজ্ঞান পড়ে বা হাজার ভেবেও পাচ্ছে না। কোনওদিন পাবে কিনা তাও জানে না। আমি এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখি না। যেটাকে ‘গড অফ গ্যাপ্স’ বলা হয়, আমি তার কথা বলছি। তাকে তুমি ভগবান, এক্স, ওয়াই, জেড যা খুশি নামে ডাকতে পারো। আমাদের জ্ঞান আর শুরুর আগের মুহূর্তের মধ্যেকার যে না-জানা অংশটুকু, তাকেই আমি আমি রিলিজিওসিটি বলছি।
কিন্তু যে কোনও অর্গানাইজড রিলিজিয়ানের বিরুদ্ধে আমার আপত্তির জায়গাটা অন্য। তারা প্রথমেই ধরে নেয় যে, সমস্তটাই জানা হয়ে গিয়েছে। আর তার উপর ভিত্তি করে বলে দেওয়া হচ্ছে, তুমি এই এই করো, এই এই পুজো দাও, ওমুক দিনে তমুকটা করো দেখবে তোমার সমস্যা মিটে গেছে। এই ব্যাপারগুলোই মানুষকে বাস্তবতা থেকে সরিয়ে দেয়।
কাজেই ৭০-এর দশকে এই প্রশ্নটাই আমায় উত্যক্ত করছিল। আমাদের দেশে এবং বিশেষ করে বাঙালি সমাজে কারা আমাদের মনে এই ধর্মভীরুতার বীজটা গেঁথে দিয়ে গেছেন আমি সেটা খুঁজে বের করতে চাইছিলাম। কারণ তা থেকে না বেরোতে পারলে আমরা কোনওদিনই প্রকৃত বাস্তবতাকে বুঝতে পারব না। এভাবেই বিদ্যাসাগর নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে আমি আরেকটা জিনিস দেখেছিলাম। দেখলাম আমার বাবা, কাকা, মামা, পাড়ার দাদা সবাই-ই বিদ্যাসাগর এবং বিবেকানন্দ উভয়কেই একইসঙ্গে ভক্তি করে। একটা সময়ে আমিও তাই করতাম। একটু বয়স হওয়ার পর, মানে যখন ওই একটু পাকামি গজাচ্ছে (হাসি), তখন বিদ্যাসাগর পড়তে গিয়ে স্ট্রাইক করল যে এঁরা দু'জন তো একেবারে বিপরীত কথা বলছেন! একটা আবিষ্কারের মতো মনে হল। বিদেশ থেকে আগত মার্ক্স বলছেন বলে আমায় কোনও কিছু অনুসরণ করতে হবে না, সাক্ষাৎ বিদ্যাসাগর মশাই তো আমাদের সামনে পালটা একটা প্যারাডাইম তুলে ধরেছেন। তিনি কিন্তু নিজেকে নাস্তিক বলছেন না, বলছেন অজ্ঞেয়বাদী। বলছেন, আমি জানি না এবং আমি মাথা ঘামাতে রাজিই নই! আমার কনসার্ন হচ্ছে এই জগতটাকে নিয়ে। কী করে এই জগতটাকে আমি আরও একটু ভালো করে তুলতে পারি সেটাই আমার ভাবার জায়গা। আর সেইখানে কেউ যদি বলে যে, এই জগতটাকে বুঝতে হলে আগে ভগবানকে বুঝতে হবে, যেমন ধরো বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রশ্ন করেছিলেন, "তুমি কী ভাবো, আগে বিজ্ঞান না আগে ঈশ্বর?" তা তখন বঙ্কিম বলেন, "না, মানে একটু এদিকের (মানে ইহলোকের) ব্যাপার, মানে বিজ্ঞানটা না বুঝে নিলে তো ওদিকটা বোঝা যায় না!" তাতে রামকৃষ্ণ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বলেছিলেন, একদম এই ভাষায়, "আরে ঈশ্বর জানলে ওসব সায়েন্স-ফায়েন্স সবই তোমার জানা হয়ে যাবে। আগে ঈশ্বরকে জানো।"
আর এরই সঙ্গে আমি দেখলাম বিবেকানন্দ এর মাঝামাঝি কোনও একটা জায়গায় আসতে চাইছেন। ওঁর মনের একটা দিক কিন্তু অসম্ভব র্যাশনাল। খুব আধুনিক লোক ছিলেন। তিনি দেখছেন যে, যদি ওঁকে রামকৃষ্ণের ভাবধারা প্রচার করতে হয় এবং একই সঙ্গে যেটাকে তিনি প্র্যাক্টিকাল বেদান্ত বলছেন সেটার ভিত্তিতে মানুষের অবস্থার একটু উন্নতি করতে হয় সেক্ষেত্রে তাঁকে একটা মাঝামাঝি জায়গায় আসতে হবে। এবং সেটাই খুব সেলফ কন্ট্রাডিকটারি হয়ে দাঁড়ায়। তা সত্ত্বেও তিনি সেটাই বেছে নিলেন। একদিকে বিবেকানন্দ বলছেন যে, বিদ্যাসাগরের ওইসব দিয়ে কিছু হবে না, মানে পরিষ্কার বলছেন 'বর্ণপরিচয়' বা 'গোপাল অতি সুবোধ বালক', ওসব কোনও কাজের কথা নয়, কারণ ধর্ম ছাড়া কোনও শিক্ষা দিলে সেটা প্রকৃত শিক্ষা হবে না! তারপরই বলছেন, ধর্মের অনুসারী হিসাবে আমি বিজ্ঞান পড়ব, বিজ্ঞানের তথ্যগুলো জানব। ওটার দরকার আছে। তুমিই বলো জিনিসটা কেমন একটা গোলমাল হয়ে গেল না?
রূপক: আরেকটু খোলসা করে বলুন।
আশীষ: মানে বলতে চাইছি, ধরো একজন পড়াশোনা করে বিজ্ঞানের একটা প্রিন্সিপল সম্বন্ধে জানল। ফলত তার মনে আরও কিছু প্রশ্ন তৈরি হল। এবার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, সবই তো ঈশ্বর করেছেন ((হাসি) আমার এই জায়গাটা খুব অবাক লেগেছিল।
রূপক: একটা উদাহরণ দিন, বই থেকেই দিন, সকলের জন্য।
আশীষ: হ্যাঁ, একটা ক্লাসিকাল উদাহরণ হলো সেই মুরগির গল্পটা। দেখো, তখন মানে ওই ১৮৯৮ সালে তো জিন নিয়ে পড়াশোনা চালু হয়নি। তা বিবেকানন্দ উদাহরণ দিচ্ছেন,
ধরা যাক একটা মুরগির ছানা। সে দেখছে, উপর থেকে একটা ছায়া নেমে আসছে, যেটা আসলে একটা বাজপাখি। সে অমনি ছুট্টে মায়ের কাছে চলে গেল। মা তাকে ডানা দিয়ে ঢেকে নিল।
বিবেকানন্দ প্রশ্ন করছেন, এটা যে করতে হবে, সেটা কে ওকে শেখালো? সত্যিই তো, এই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে এই ইনফরমেশানগুলো কীভাবে জিনের মাধ্যমে সঞ্চালিত হচ্ছে, তখনও কিন্তু বিজ্ঞান জানে না। যদিও এই নিয়ে নানা হাইপোথিসিস তখন আসতে আরম্ভ করেছে। এরপর নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, এটা তো জন্মান্তরবাদের ফল! মানে ওই যে মুরগির ছানাটি , তার মধ্যে তো হাজার জন্মের স্মৃতি সঞ্চিত আছে! যদিও তিনি কম্পিউটারের কথা বলেননি, তবে বোধহয় বলতে চেয়েছেন যে কম্পিউটারের মেমরির মতো সেই পরতে-পরতে সাজানো ভাণ্ডার থেকে সে আসল স্মৃতিটা বার করে আনছে; যে ওইরকম ছায়া নামলে আমাকে ছুটে মায়ের কাছে চলে যেতে হবে। এটা কিন্তু ভালো ব্যাখ্যা, এটাকে আমি মোটেই খারাপ ব্যাখ্যা বলতে পারব না, অন্তত ওই সময়ে দাঁড়িয়ে...
রূপক: আশীষদা এখানে আপনাকে আমি একটু আটকাচ্ছি। আমি মানলাম যে ওই সময়ে দাঁড়িয়ে ওঁর বিশ্লেষণ খানিকটা যুক্তি-ঘেঁষা, কিন্তু আপনার মনে হয় না যে, জন্মান্তরবাদকে এস্টাব্লিশ করার জন্য তিনি উদাহরণটাকে তৈরি করেছিলেন? আমি তো এই উল্টোদিকটাই দেখতে পাচ্ছি।
আশীষ: একশোবার! আমি এর পরের ধাপে সেটাই বলতে যাচ্ছি! ওঁর এক্সপ্লানেশন আমরা অবশ্যই মানতে পারি না এবং সেটা জেনেই বোধহয় এর পরের কথাটায় তিনি বলছেন যে, "এখন বিজ্ঞানীরা অনেকে বলছেন যে, কিছু কিছু দেহকোষের মধ্যে নাকি ওই স্মৃতিগুলো সঞ্চিত থাকে যেটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়।" ব্যাপার হল যেহেতু বিজ্ঞান তখনও সেটা প্রমাণ করতে পারেনি, বলতে পারো তিনি খানিকটা লজিকাল জাগলারি করলেন (হাসি)। বিবেকানন্দ বিজ্ঞানীদের আক্রমণ করে বলছেন, কই তোমরা তো প্রমাণ করতে পারোনি, আর যদ্দিন না তোমরা প্রমাণ করতে পারছো তদ্দিন আমি জন্মান্তরের কথাই বলব! এবার এখানে যদি আমি লজিকালি প্রশ্ন তুলি, আপনার জন্মান্তরবাদটা কে প্রমাণ করল?
রূপক: এগজ্যাক্টলি! আমার এখানেই পয়েন্ট! এখানে আমি কেন বলব না যে আমি জানি না?
আশীষ: এই! আমিও ঠিক সেই কথাটাই লিখেছি। এইখানেই এই ধরনের চিন্তা ধারার গণ্ডগোল। বহু লোককে এটা ভয়ানক অ্যাপিল করে। অনেকেই ডিফেন্ড করে বলেন যে, কেন তিনি তো ঘটনাটাকে অস্বীকার করছেন না, বরং ওই একই সময়ে দাঁড়িয়ে অন্য অনেক হাইপোথিসিসের মতো তিনিও আরেকটা হাইপোথিসিস দিচ্ছেন। তাই যদি হয়, আমি মেনে নিচ্ছি কিন্তু হাইপোথিসিস ঠিক বা ভুল প্রমাণ করার তো পদ্ধতি আছে বিজ্ঞানে! সে পদ্ধতিতে কি জন্মান্তরবাদ প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হয়েছে? সে ব্যাপারে কি তিনি কিছু বলছেন? না! বিবেকানন্দ সে বিষয়ে কোনও কথা বলছেন না! তিনি বলছেন যে, ৫০০০ বছর আগে ঋষিরা একথা বলে গেছেন! গণ্ডগোলটা হচ্ছে এইখানটায়। বিজ্ঞান আর অবিজ্ঞানকে তিনি এমনভাবে মিশিয়ে দেন যে আমাদের দেশে, যেখানে বিজ্ঞানচেতনা আজও খুব উন্নত নয়, মানুষকে সেটা খুবই প্রভাবিত করে। তাই এই মিথ্যে কথাগুলোকে সত্যি রূপে এস্টাব্লিশ করার এই কৌশলের বিপক্ষে আমার মনে হয়েছিল একটু রুথলেস হওয়া প্রয়োজন। আমি জানি, অনেকের মনে এতে আঘাত লাগবে, কারণ বিবেকানন্দকে অনেকেই নিজের বাবা-মায়ের থেকে বেশি শ্রদ্ধা করেন, আমার বন্ধুরাই যেমন। অনেকেই বলেন যে, তুমি আর যাকে নিয়েই কথা তোলো ওঁকে নিয়ে তুলবে না। এই জায়গাটা আমি হিট করতে চেয়েছিলাম। কেউই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন!
রূপক: এখানে আমি আরেকটা কথা একটু যোগ করি। বাঙালিদের একটা বড় অংশ আছে যারা বলেন; আমি নিজে শুনেছি, 'আমি ভগবানে বিশ্বাস করি না কারণ আমার রবীন্দ্রনাথ এবং রামকৃষ্ণ আছেন!' (হাসি)
আশীষ: (হাসি) আমি বাঙালিদের যে অপরচুনিজমের কথা বলি, যেটা আমাদের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে, এটা তার ক্লাসিকাল উদাহরণ! রামকৃষ্ণ আর রবীন্দ্রনাথ দু'জনকে তুলে আনছেন যখন, এর মানে কি রামকৃষ্ণের কথাগুলো তাদের কাছে আর ভ্যালিড নয়? দু'জন তো সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছেন। রামকৃষ্ণ যা বলেছেন সেগুলো যদি মানতে হয়, তাহলে আমি কখনই রবীন্দ্রনাথকে মানতে পারব না। একদম কন্ট্রাডিক্টরি! রবীন্দ্রনাথও ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু সেই ঈশ্বর আর রামকৃষ্ণের ঈশ্বরের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত! এবং রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে বিমলাকান্ত রায়চৌধুরীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা চিঠি আছে; সেখানে অদ্ভুত সুন্দর কথা আছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, "আমি সত্যিই ওঁকে শ্রদ্ধা করি, তিনি একজন অনেস্ট সাধক, তিনি যা ঠিক মনে করেছেন সেই পথে সাধনা করেছেন কিন্তু তাঁর শিষ্যরা যারা ওঁর অলৌকিকতাগুলোকে প্রচার করছেন তাঁরা কিন্তু অসত্য কথা বলছেন।" যারা রামকৃষ্ণে বিশ্বাস করেন, তাঁদের মধ্যে ক'জন কথামৃত পড়েছেন? এই স্ট্যাটিসটিকসটা আমার মাঝেমাঝে নিতে ইচ্ছা করে (হাসি)! এবং যদি বা পড়ে থাকেন ক'জন ওই কনসাইজ এডিশান না পড়ে গোটাটা পড়েছেন?
রূপক: এটা খানিকটা মার্ক্সের 'রিলিজিয়ান ইজ দ্য ওপিয়াম অফ মাসেস'-এর মতো ব্যাপার! (হাসি)
আশীষ: হ্যাঁ, তাইই! আরেকটা কথাও আমার মনে হয়। কোনও মহিলা যদি খোলা মনে কথামৃত পড়েন, তিনি কোনওদিন, কোনও অবস্থায় রামকৃষ্ণের ভক্ত হতে পারেন না! মেয়েদের এত বড় অসম্মান রামকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ করেননি এবং বিবেকানন্দ, সব জায়গায় একটা মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়ার মতোই, প্রথমে আমেরিকায় গিয়ে আমেরিকার মেয়েদের দেখে তাদের ডায়নামিজম দেখে মুগ্ধ হয়েও তারপরে বলছেন যে, সীতা-সাবিত্রীই আমাদের আদর্শ। যার স্বামীই সব! এগুলো অন-রেকর্ড রয়েছে। বিবেকানন্দ কন্টিনিউয়াসলি এই দুটো খেলা খেলে যান! বর্ণাশ্রম নিয়ে, সমাজে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে, সমস্ত কিছু নিয়েই ওঁর এমন অদ্ভুত স্ট্যান্ড। একটা খবর তোমাকে দিই।
রূপক: হ্যাঁ।
আশীষ: এই যে গোলপার্কে ইন্সটিটিউট অফ কালচার, বিবেকানন্দর তৈরি করা সংবিধান অনুযায়ী এখানে কোনও মহিলাকে কোনওরকম পারফর্ম করতে দেওয়া হতো না। ব্যাপারটা পরিষ্কার ভাষায় লেখা আছে। এবং সেটা এঁরা কয়েকমাস আগে অবধি ফলো করেছেন। ক'দিন আগে বেরোনো স্টেটসম্যানের খবর অনুযায়ী, এতদিন পরে, ২০২৩ সালে ওঁদের মনে হয়েছে যে এটা উচিত নয়! তাহলে তাঁরা বলুন যে তাঁদের গুরুদেব, স্বামী বিবেকানন্দ অন্যায় করেছিলেন! সেটা কিন্তু তাঁরা বলবেন না। তার মানে ভাবো, মেয়েরা আসলে ক্ষতিকারক, এই ব্যাপারটা কতখানি ভিতরে এনগ্রেভড!
রূপক: ওঁর শিকাগোর বক্তৃতাও তো নারীবিদ্বেষে ভরা! মানে ওঁর নিজেরই তো কথা, "স্বর্গস্ত পিতার মতো পুণ্য হওয়াই হিন্দুধর্ম..." অর্থাৎ মায়ের কোনও জায়গা নেই! বর্ণবিদ্বেষেরও অভাব নেই। ঈশ্বরের বর্ণ 'আদিত্যের ন্যায়', মানে তো ব্রাইট, সোনানি, শুভ্র!
আশীষ: একদম, একদম! এবং এইগুলো তো অনেক আনকশাস নারীবিদ্বেষ, রেসিজম। অনেক ক্ষেত্রে কনশাস রেসিজম আছে। তুমি তো দেখেইছো আমি লিখেছি, গানবাজনার কথায় বিবেকানন্দ বলছেন যে, মুসলমানরা এসে সব্বোনাশ করে দিল! আমাদের হিন্দু গানবাজনা কত উন্নত হচ্ছিল, আর ওরা এসব ঠুমরি, টপ্পা এসব এনে আজেবাজে জিনিস ঢুকিয়ে দিল। দিস ইজ হিস স্ট্যান্স, অ্যান্ড ডকুমেন্টেড! প্রত্যেকটা ব্যাপারে ওঁর কন্ট্রাডিকশান!
আরও পড়ুন- ‘অন্ধকার বলে কিছু নেই, আছে আলোর অভাব’, বলতেন আজীবন মার্কসবাদী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
রূপক: আপনি ডকুমেন্টেশনের কথা বললেন বলে, পাঠকদের জানিয়ে রাখি যে আশীষদা কিন্তু তাঁর বইয়ের প্রত্যেকটা দাবিকে উইথ রেফারেন্স এস্টাব্লিশ করেছেন! রেফারেন্স ছাড়া বইতে কোনও কথাই লেখা হয়নি বলতে গেলে।
আশীষ: নিশ্চয়ই! অত বড় মাপের একজন মানুষের ব্যাপারে কথা হলে রেফারেন্স ছাড়া আমি বলবই বা কেন? ওটা করা যায় না।
রূপক: এবার গান-বাজনা বিষয়ক আলোচনাটায় আসি। আপনি বারবার বলেছেন যে বিবেকানন্দ কীর্তনকে ফেমিনিন মনে করছেন। এটা মনে করার কারণ কি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ?
আশীষ: সেটা অবশ্যই একটা কারণ। ধরো একটা আসর হচ্ছে, সেখানে চড়া গলায় গান, ঘন ঘন খঞ্জনির আওয়াজ, যেন একটা ফ্রেঞ্জির মতো ব্যাপার এবং তারপরেই, আমি নিজের চোখে দেখেছি, হিস্টিরিয়ার মতো কেউ একজন মেঝেতে একদম লুটিয়ে পড়ছেন। আমার ধারণা ইদানীংকালে এসব নিশ্চয়ই অনেক কম হয় কিন্তু আগেকার দিনে যখন মানুষ অনেক বেশি ধর্মমনস্ক ছিল তখন এইটা খুব বেশি হতো। তুমি দেখবে হুতোমের নকশা থেকে আমি একটা কোট করেছি, একজন কীর্তনী এসে নেচে একটু ফ্লার্টেশিয়াস ধরনের অঙ্গভঙ্গি করে গান গাইছে, কাজেই ওই সভায় ওইরকম একটা অবস্থায় আনওয়ান্টেড সেক্সুয়াল বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। এই ব্যাপারটাকেই বিবেকানন্দ পয়েন্ট-আউট করেছেন। তাছাড়া ভাষার ব্যবহারটাও একটা বিষয়। 'সখী রে', 'মরি লো মরি' ইত্যাদি ধরনের টার্মগুলো, যে কারণে রবীন্দ্রনাথকেও অনেক সময় অনেক ব্যঙ্গ সহ্য করতে হয়েছিল, এইগুলোকে বিবেকানন্দ বলছেন ফেমিনিন, কিন্তু আবার নিজেই এখানেও কন্ট্রাডিক্ট করছেন।
রূপক: যেমন?
আশীষ: আরে ওঁর প্রিয় গিরীশ ঘোষের যে গান, তাতে তো এই ধরনের শব্দবন্ধের ছড়াছড়ি। যে পার্টিকুলার গানটা তিনি নিজে অসম্ভব ভালো গাইতেন সেটা তো কীর্তন-অঙ্গের গান। আমার এইটা খুব অবাক লাগে, প্রত্যেকটা ফিল্ডে বিবেকানন্দ ইজ কন্ট্রাডিকটিং হিমসেলফ!
রূপক: কিন্তু কেন?
আশীষ: আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে যেটা মনে হচ্ছে সেটা তিনি খুব জোর গলায় বলছেন এবং অনেক সময়তেই সেটা ওঁর মনের আসল কথা নয়! পরে মনে হওয়ায় হয়তো কথাটা খানিকটা নরম করে নিতেন। কীর্তন নিয়েই এমন হয়েছে! ওই এফেমিনেট কথাটা বলার পর যখন তিনি মুসলমান বিরোধিতার কথাটা বলছেন, অর্থাৎ বলছেন মুসলমানরা এসে আমাদের এই ধ্রুপদকে নষ্ট করেছেন; একইসঙ্গে এও বলছেন যে কীর্তন হচ্ছে খাঁটি দিশি সঙ্গীত যেটাকে মুসলমানরা নষ্ট করতে পারেনি! আবার এও বলছেন যে, ওটা একটা এফিমিনেট ব্যাপার, এই করে সব মেয়েমানুষ হয়ে গেল! ভাবো! মূলত কান্নার ব্যাপারটা নিয়ে ওঁর বিশেষ আপত্তি ছিল। আরে সে তো খেয়াল, ধ্রুপদ বা অন্য যে কোনও মিউজিকেই হতে পারে। ফ্রয়েডিয়ান শব্দবন্ধ ব্যবহার করলে, যে জিনিসের মাধ্যমেই মনের সেন্সরটা সরিয়ে দিলে আমার ভিতরটা ফুটে বেরোবেই। তখন আমার কোনও ইনহিবিশানই থাকবে না। এর মধ্যে অন্যায়টা কী? ভুলটা কী? বিবেকানন্দ বলছেন, তিনি আমেরিকায় দেখেছেন যে চার্চে বাইবেল পাঠ শুনে মানুষ কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে এবং বেরিয়েই নাকি ব্রথেলে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই আধ্যাত্মিকতার কন্ডিশনে যেখানে মানুষের সেন্সরটা থাকছে না,সেই কান্নাকাটির পরই নাকি তার সেক্সুয়াল আর্জ চাগাড় দিচ্ছে!
রূপক: অর্থাৎ হি ওয়াজ আগেইন্সট দা আইডিয়া অফ কনসেন্সুয়াল সে্কস!
আশীষ: হ্যাঁ, এগজ্যাক্টলি, বিবেকানন্দ ওয়াজ আগেইন্সট দ্য আইডিয়া অফ সেক্সুয়ালিটি! এটা মানতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক জিনিসটাকে তিনি অস্বীকার করছেন, এটাকে পাপ বলে মনে করছেন! এটাকে অস্বীকার করছেন। এইটা আমার একটা বিরাট আপত্তির জায়গা! এমনকী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে স্বাভাবিক সম্পর্ক সেটাকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করছেন। এটা কী ধরনের মানসিকতা? আমার মনে হয়, ইট কলস ফর সাম সাইকো অ্যানালিসিস! (হাসি)
রূপক: (হাসি) এইখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে, সেই জায়গাটাই আমি কীর্তনের কনটেক্সটে ধরতে চাইছিলাম। মুসলমানের জায়গাটায় বা সায়েন্স বনাম ধর্মের জায়গাটায় বা বিবেকানন্দের রাজনীতির জায়গাটায় আমি পরে আসছি কিন্তু কীর্তনের ক্ষেত্রে তিনি যে যুক্তিটা দেখাচ্ছেন তা হল, স্বাভাবিক যৌনতা একটা খারাপ জিনিস এবং তার জন্য মেয়েরা দায়ী!
আশীষ: অবশ্যই! ওঁর মতে সব কিছুর জন্যই মেয়েরা দায়ী! (হাসি)
রূপক: সেক্ষেত্রে তাঁকে মেয়েরা কী করে সম্মান করছে বা পুজো করছে কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি!
আশীষ: আমারও তো সেটাই সব থেকে বড় প্রশ্ন! এটা তিনি পুরোপুরি রামকৃষ্ণের কাছ থেকে পেয়েছেন। কথামৃতের ছত্রে ছত্রে এই জিনিসটা আছে যে, মেয়েরা হচ্ছে সর্বনাশা! যা কিছু প্রলোভন শুধু মেয়েদের দিক থেকেই আসে! ছেলেরা এমনিতে নষ্ট হত না, মেয়েরাই তাদের নষ্ট করে। সেক্স যে একটা টু-ওয়ে ট্রাফিক সে বিষয়ে কোনও বোধই নেই এঁদের! তিনি সেক্সকে একটা ওয়ান-ওয়ে ট্রাফিক বলে মনে করতেন।
রূপক: আমাদের কালেকটিভ কনশাসনেসে তো ছেলেরা সেক্স নেয় আরে মেয়েরা দেয়! দেখবেন হিন্দিতে একটা কথা আছে, 'উসকি লে লিয়া'! অ্যাজ ইফ মেয়েরা এতে আনন্দ পাচ্ছে না! (হাসি)
আশীষ: সেই! ধারণা হল, মেয়েরা সারেন্ডার করছে। অথচ বাস্তব জীবনে অনেক সময়তেই কিন্তু সেটা মেলে না। ওই যে মার্ক্স বলেছিলেন, ধর্ম আমাদের ফলস কনশাসনেসের দিকে নিয়ে যায়!
রূপক: আমি এখুনি শব্দবন্ধটা ব্যবহার করতে যাচ্ছিলাম! (হাসি)
আশীষ: আমরা প্রতিদিন যা দেখছি বা করছি আমার বিশ্বাসটা তার বিপরীতধর্মী। আমার একবারও মনে হচ্ছে না যে, আমি যে কথাটা বলছি সেটা আমার আচরণের সঙ্গে মিলছে না! এই যে রামকৃষ্ণের কথা 'যত মত তত পথ', অর্থাৎ 'এনি অপরচুনিজম ইজ ওয়েলকাম'! আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত ক্লাসের মধ্যে এই গ্রস অপরচুনিজমটা আছে। আমরা যেকোনও অন্যায়কে খুব অনায়াসে মেনে নিতে পারি। বিবেকানন্দ অফ অল পিপল এটাকে প্রোমোট করেছিলেন। মার্ক্স বলুন, রবীন্দ্রনাথ বলুন বা বিবেকানন্দই বলুন, একটা সাদা জিনিসকে কালো বলাকে কোনওভাবেই জাস্টিফাই করা যায় না! বিদ্যাসাগর বা অক্ষয়কুমার দত্ত প্রদত্ত আরেক ধরনের যুক্তিশীল পথ আমাদের দেশেই থাকতে সকলেই এই 'তিনি বলেছেন' রাস্তায় ছোটে কেন?
রূপক: কনভিনিয়েন্ট তাই!
আশীষ: সে তো একশো বার! কিন্তু আমি বুঝতে চাইছি যে এর মধ্যেকার কন্ট্রাডিকশনটা কারও চোখে পড়ে না, এই কনশাসনেসটা অধিকাংশের মধ্যেই নেই! অনেকেই আমার 'অন্য কোনো সাধনার ফল' বইটা পড়ে অবাক হয়েছিল। প্রশ্ন করেছিল যে, তাই? বিদ্যাসাগর একেবারে অন্য মেরুর লোক? আমার গুরুজনদের আমি বলেছিলাম, এসব তো আমাদের তোমাদের কাছ থেকেই জানা উচিত ছিল। বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িতে এই সুবিধাবাদটাই স্ট্যান্ডার্ড! আর তার একটা কারণ হচ্ছে এঁরা বিবেকানন্দও পড়েন না, বিদ্যাসাগরও পড়েন না। আমি নিজে একটা ছোট স্টাডি করেছিলাম। পনেরো-কুড়ি জনের মধ্যে একজন বা দু'জন ওই শিকাগো বক্তৃতাটা খানিকটা পড়েছিলেন। ওই 'সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা'-তেই নাকি বাজিমাত! বললাম তারপর? বললেন, না সেটা সম্বন্ধে জানি না (হাসি)! খুব কম লোক বিবেকানন্দ পড়েছে! একইভাবে বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। আমাদের ছোটবেলায় সকলেই খালি আবেগের দিকটায় জোর দিয়েছেন, যেমন বিদ্যাসাগর মায়ের জন্য দামোদর নদী সাঁতরে পার হয়েছেন, ইত্যাদি। কিন্তু ওঁর র্যাশনাল দিকটা নিয়ে কেউ কোনও কথাই বলেননি!
রূপক: আমাদের প্রজন্মেরও ক'জন ওঁর এই দিকটার কথা জেনে বড় হয়েছেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
আশীষ: সেই! তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? বিবেকানন্দের কেবল এই লার্জার দ্যান লাইফ মূর্তিটাই ছোটবেলা থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে ঢুকে থাকছে! সুতরাং এই আবেগকে বাড়িয়ে র্যাশনালিজমকে দমিয়ে দেওয়া যে পরিষ্কারভাবেই একটা শ্রেণির স্বার্থকে চরিতার্থ করে সেটা বলাই বাহুল্য! এটা মানতে হবে। এইরকম চলতে থাকলে তো একদলের সুবিধে!
আমার একটা খুব সহজ প্রশ্ন। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন সেন্টার অফ কালচারে মহিলাদের বা মেয়েদের পারফর্ম করতে দিতে ২০২৩ সাল লেগে গেল কেন? আজ 'অ্যালাও' করে “আমরা কত মহৎ’’ সেটা দেখানো হচ্ছে কিন্তু “এতদিন করা হয়নি কেন?” এই প্রশ্নটা কেউ তুলছে না! এবং কার নির্দেশে হয়নি? যার নির্দেশে হয়নি তিনি খোদ স্বামী বিবেকানন্দ! এই প্রশ্নগুলো যাতে না জাগে সেই জন্যেই এমনতরো হোয়াইট ওয়াশের ব্যবস্থা! এই করে করে আমাদের প্রশ্ন করার প্রবৃত্তিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা কোনও ব্যাপারেই প্রশ্ন করি না।
রূপক: একটা একটু অন্য ব্যাপারে আপনার মত জানতে চাইছি।
আশীষ: বলো!
রূপক: বিবেকানন্দ যখন মধ্য গগনে, তখন তার আশেপাশে তারই মতো একঝাঁক কৃতি বাঙালি ছিলেন। মোটামুটি এই সময়টাকেই উৎপল দত্ত বেঙ্গল রেনেসাঁস নাম দিয়েছিলেন। তা আশীষদা, বিবেকানন্দকে কি সত্যিই এর মধ্যে ফেলবেন আপনি?
আশীষ: প্রথমত এই বেঙ্গল রেনেসাঁস ব্যাপারটাকেই আমি মানি না। ইওরোপের রেনেসাঁসের যে বিরাট ইম্প্যাক্ট তার সঙ্গে এটার কোনও তুলনাই হয় না! ক'টা লোক এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তা গুনে-গুনে বলে দেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই বলেছেন, চার কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র একজন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত ইত্যাদি সবাইকে মিলিয়ে চার কোটির মধ্যে মেরে কেটে ১০০০ জনকে উল্লেখ করা যায়। কাজেই আমার প্রশ্ন, চার কোটির মধ্যে হাজার লোকে যে জিনিসটা সীমাবদ্ধ, তাকে কি আমরা রেনেসাঁসের মতো একটা বিরাট স্ট্যাম্প দিতে পারি?
অক্ষয় দত্তের জীবৎকালের ৭০ বছরে শিক্ষিত বাঙালি মননে যে চিন্তা-পদ্ধতির একটা আলোড়ন এসেছিল সেটা মানতেই হবে। সেই সময়ে পৃথিবীর কোথাও এই পরিমাণে জ্ঞান চর্চা হয়নি কিন্তু তার প্রভাব মধ্যযুগীয় ইওরোপের রেঁনেসাসের মতো নয়।
এই ব্যাপারটা নিয়ে শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় একটা তুলনামূলক বই লিখেছিলেন, ভালো বই, তো সেখানে তিনি পরিষ্কার ভাষায় যে কথাটা বলেছেন তা হল, সে সময়ের চিন্তা-বিপ্লবকে যদি রেনেসাঁস বলে মেনেও নিই, সেই রেনেসাঁসের ধারাকে আটকে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। অন্নদাশঙ্কর রায়ও একই কথা বলেছেন। আবার সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিতেও আছে। তিনি একটু বিদ্রূপ করে বলেছেন, "যেই লোকগুলো ঘেঁটু পুজো, আর শীতলা পুজো ছেড়ে একটু লেখাপড়ার দিকে মন দিল – বলে বিদ্যাসাগর-রামমোহনের কথা বলছেন – "তাদের মুখ আবার কালীঘাটের দিকে ফিরিয়ে দিলেন বিবেকানন্দ!’’ এটা তো বাস্তব সত্য।
রূপক: আমি এই পয়েন্টাতেই আসতে চাইছিলাম। আপনি বলুন।
আশীষ: হ্যাঁ , ওঁর বেদান্ত নিয়ে এক্সপ্লানেশান আমার একটা অত্যন্ত আপত্তির জায়গা। ওর মধ্যেই আজকের মধ্যবিত্ত বাঙালির অপরচুনিজমের সমস্তটা ধরা আছে। আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে মুকেশ আম্বানি, ডঃ মেঘনাদ দেশাই এবং আরও কয়েকজন মিলে একটা প্যানেল ডিসকাশন করছিলেন। তাতে, অফ অল পিপল, মুকেশ আম্বানি বলেছিলেন যে আমাদের ভারতবর্ষ তো স্পিরিচুয়াল দেশ, কাজেই এই মেটিরিয়াল ব্যাপারটা যে আসল নয় সেটা আমরা বুঝি। অনেকক্ষণ ধরে মেঘনাদ দেশাই চুপ করে বসে শুনছিলেন, হঠাৎ টেবিল থাবড়ে উঠলেন, “স্পিরিচুয়ালিটি মাই ফুট!” তারপর বললেন, যে কোনও ভারতীয় শহরের যে কোনও শপিংমলে গেলেই বোঝা যাবে, এত অকারণ জিনিস কেনা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে দেখা যায় না। আর তাই যদি হয় তাহলে এরা ভোগবাদ বিরোধী কী করে হল?
রূপক: আমেরিকা ছাড়া। আমি নিজে দেখেছি!
আশীষ: হ্যাঁ আমেরিকা ইজ অফকোর্স আ স্পেশাল কেস ইন মেনি সেন্স।
আরও পড়ুন- ‘আমরা শুধু সব ধর্মকে সহ্যই করি না…’ ১৩০ বছর আগে শিকাগোয় ঠিক কী বলেছিলেন স্বামীজি?
রূপক: আমার পরের প্রশ্ন বিবেকানন্দের রাজনীতি নিয়ে। বিবেকানন্দ কথায় কথায় বলছেন, বিজ্ঞানে আছে! কিন্তু কোনও জায়গাতেই কোন বিজ্ঞানে কী আছে তার কোনও প্রমাণ দিচ্ছেন না! আরেকটা কথা, তিনি শিকাগোর বক্তৃতা সমেত সব জায়গায় একটা স্টান্স মেইন্টেন করে গেছেন। বিজ্ঞান প্রসঙ্গ তুলে পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের থেকে যে তা উচ্চমানের সে কথা বলে গেছেন, আবার একই সঙ্গে হিন্দু ধর্ম বা ওঁর কথায় 'ব্যবহারিক বেদান্তের' প্রশ্ন উঠলেই বলেছেন বিজ্ঞানে যা বলা হয় তার সবই বেদান্তে আগেই বলা আছে। এটা তো রাজনীতিবিদের কথা, যেভাবে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন 'ক্রোনোলজি সামঝিয়ে', তেমন। তা আমি কি আমার হোমমিনিস্টারকে পুজো করব?
আশীষ: (হাসি) আসলে বিজ্ঞানের যে মেথডোলজি, মানে প্রমাণ ছাড়া আমি কোনও কিছুকেই মানব না, বিবেকানন্দ সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন, অথচ সারাক্ষণ বিজ্ঞানের কথা বলে যাচ্ছেন! সারাক্ষণ! এমনকী মিউজিকের ক্ষেত্রেও! তবে আমার ধারণা তিনি যে কথাগুলো লিখেছেন সেগুলো ওঁর মনের কথা নয়। ব্রজেন শীলের স্মৃতিচারণে আছে। তিনি বিবেকানন্দের থেকে একবছরের সিনিয়র ছিলেন স্কটিশে। তিনি যা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় যে ওঁরা একসঙ্গে বাইজি পাড়ায় খুবই যেতেন। ওইখানে বিবেকানন্দের মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ জাগে। ওঁর মনে হয়েছিল, এত অপূর্ব গান-বাজনা, তেমন নাচ, অথচ পরিবেশটা খাপ খায় না! এটাকে তিনি মেলাতে পারছিলেন না। ওঁর আধ্যাত্মিকতার দিকে যাওয়া পিছনে কিন্তু এই কন্ট্রাডিকশানটার মস্ত বড় হাত ছিল। ভাবো, আমি যে জিনিসটাকে মনে প্রাণে চাইছি, অর্থাৎ মিউজিক, যেটা সত্যিই ওঁর ভিতরকার জিনিস, তাকে অ্যাক্সেপ্ট করতে পারছি না কারণ তার আধারটা অত্যন্ত 'নোংরা'!
এই ব্যাপারটা ওঁর প্রত্যেকটা জিনিসের মধ্যে আছে। একদিকে যেমন বলছেন, বর্ণাশ্রম অত্যন্ত খারাপ জিনিস এবং সত্যিই তো তাই! শুধু শুধু একটা লোককে জন্মের কারণে চাকর-বাকর বা দেবদাসী করে রেখে দেব কেন? এটা বিবেকানন্দ দিব্যি বুঝতে পারছেন কিন্তু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলছেন যে, এইটা আছে বলেই হিন্দুধর্ম টিকে আছে! এইদুটো একইসঙ্গে কোনও মানুষের মনের কথা হতে পারে না। তিনি একটা কিছুকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এটা করছেন। আমার ধারণা হি ইজ আ পজিটিভ মাইন্ডেড ম্যান। তিনি চেয়েছিলেন একটা পরিবর্তন হোক, তৎকালীন পরিস্থিতি দেখে খুব শিউরে উঠেছিলেন, এত খারাপ অবস্থা! কিন্তু সরাসরি রাজনীতিতে কোনও আগ্রহ ছিল না, আর অন্য কোনও পথেও কিছু করার কথা ভাবেননি। মাথাতেই আনেননি! এমনকী শিক্ষার পথেও নয়! যে শিক্ষাটা তিনি সমাজে প্রোপাগেট করাতে চাইছেন যে, 'ধর্মটা হল ভাত আর বাকিগুলো তরকারি'- ওই দিয়ে সমাজ বদলায় না! কিন্তু তিনি বারবার বলছেন যে, সমাজ একমাত্র ওই শিক্ষাতেই বদলায়! ইসলামের অনেক মোল্লারা তো এই কথা বলেছেন! এখনও বলেন।
রূপক: ঠিক!
আশীষ: সেদিন একটা বাংলা বইতে পড়ছিলাম, এই যে মুসলমানদের এত অধঃপতন তার কারণ হল, তারা নাকি প্রকৃত অর্থে ধর্মাচরণ করে না! এরা কোরান পালন করে না! কোরান পালন করলে আজ মুসলমানদের এই অবস্থা হত না ইত্যাদি ইত্যাদি। এ তো বিবেকানন্দের কথা! হিন্দুদের নিয়ে তো তিনি এই কথাই বলছেন! কাজেই যে কোনও ব্যাপারে ওঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে এই গভীর কন্ট্রাডিকশান ছিল। অর্থাৎ, তিনি যা করতে চাইছেন তা করার কোনও পথ পাচ্ছেন না। বুঝতে পারছেন যে এভাবে হবে না, অথচ হি হ্যাজ টু সার্ভাইভ ইন হিজ ওন আইডিওলজিকাল স্ট্রাকচার, যে আমি দেশপ্রমী, দেশকে ভালোবাসি, এবং তার জন্য আমি যা খুশি করতে পারি! এইটা তিনি নিজেকে বুঝিয়ে রেখেছেন! কিন্তু কিছুই আসলে করতে পারছেন না! খুব প্র্যাক্টিকাল টার্মসে বিচার করলে বিবেকানন্দ দেশের জন্য কী করেছেন? তিনি আমেরিকায় ঘুরে হিন্দুধর্মের প্রচার করেছেন। তার বিনিময়ে প্রচুর অর্থ তিনি পেয়েছিলেন, অবশ্যই নিজের জন্য নয়, তা দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন তৈরি হয়। তাতে দেশের কী হল? হ্যাঁ, একথা ঠিক যে তাঁরা অনেক ভালো ভালো স্কুল কলেজ তৈরি করেছেন কিন্তু, এই ব্যাপারটা যে পুরোপুরি আগেইন্সট রামকৃষ্ণ সেটা ধরে ধরে দেখিয়ে দেওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ কোনওদিন চাননি যে লোকশিক্ষা হোক! বিদ্যাসাগরকে পর্যন্ত তিনি এই বলে সমালোচনা করছেন যে, লোকটা জানে না ওর অন্তরে কী সোনা চাপা আছে! সে কারণেই কোথায় গরিব খেতে পাচ্ছে না, কে পড়াশোনা করতে পারছে না এইসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। যেদিন এসব মন থেকে সরে যাবে সেদিন ওর মুক্তি হবে। কাজেই রামকৃষ্ণের মতে মুক্তি কী? আমি সমাজের জন্য ভাবব না, নিজের মন যা চাইছে সেই সাধনা করে মুক্তি পাব। তাই বিবেকানন্দ যা করতে বলেছিলেন বা মিশন যা করছে তার সঙ্গে রামকৃষ্ণের কী সম্পর্ক?
রূপক: একটা জায়গায় বোধহয় সম্পর্ক আছে। সেটা হল ইন্নেট নারীবিদ্বেষ!
আশীষ: এইটা একটা জায়গা ঠিকই! এইভাবে ভাবিনি। হ্যাঁ, তা বলা যাতে পারে। নাহলে ২০২৩ সাল! গোলপার্কে মেয়েদের পারফর্ম করার সুযোগ হতে ১২৩ বছর সময় লাগল? অবশেষে তাঁরা বললেন যে আমরা এখন থেকে মহিলাদের অ্যালাও করব!
রূপক: এখানে এই 'অ্যালাও করব' টার্মটা খুব জরুরি।
আশীষ: হ্যাঁ ঠিকই! অ্যাজ ইফ অ্যালাও করার অধিকারটা আমাদের!
রূপক: নরেন্দ্রপুর থেকে বা ওদের বানানো অন্যান্য যে কোনও স্কুল কলেজ থেকে পাসআউট বন্ধু বান্ধবদের বেশিরভাগের মধ্যেই আমি একটা জিনিস দেখেছি। তারা কেউই মেয়েদের সঙ্গে কমফর্টেবল নন। হয় তারা মেয়েদের যৌনসঙ্গী ভাবেন বা মা ভাবেন! অবশ্য রামকৃষ্ণ মিশনের বাইরেও যে সমাজের বিরাট অংশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা সেকথাও বলতে পারি না। (হাসি)
আশীষ: একদম! সেক্স অবজেট ভাবছি!
রূপক: অথবা 'মা' ভাবছি!
আশীষ: আরে মা ভাবাটা তো আসলে ক্যামোফ্লেজ! শ্রীরামকৃষ্ণের এমন কথাও আছে, 'যে সাধক হবে সে নিজের মায়ের সঙ্গে অবধি রাত্রিবাস করবে না!' এটা কোন লেভেল থেকে আসতে পারে? অর্থাৎ ফেমিনিন ফর্মটাই হচ্ছে সেক্স অবজেক্টের ফর্ম! আমার কথা হল, এই কথাগুলো তো তোমরাই প্রচার করছো! তোমাদের ছাপা বই থেকেই আমি এই কথাগুলো পাচ্ছি! তাহলে এটাকে সত্যি বলে মানতে তোমাদের অসুবিধা কোথায়?
সম্প্রতি, এক ভদ্রলোক যিনি সুলেখকও, খুব ভালো ইংরেজি জানেন, উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা বাংলা করেছেন এবং রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের ভক্ত, আমাদের এক কমন ফ্রেন্ডকে বলেছেন যে, আশীষবাবুরা যা করছেন সেগুলো সব মিথ্যাচার হচ্ছে। এইটাকে নাকি উনি এক্সপোজ করবেন! তাতে আমার বন্ধু আমায় ডিফেন্ড করে বলেছে, আমি যা কিছু বলেছি তার সমস্ত রেফারেন্স রয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন যে ওদের 'উদবোধন'-ও নাকি সম্পূর্ণ শুদ্ধ নয়! বিবেকানন্দকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে যদি তিনি ওদের সংস্থাকেই অশুদ্ধ বলেন তাহলে হোয়ার ডু দে স্ট্যান্ড? ওঁরাই বলে দিন তাহলে কোনটা অথেন্টিক! (হাসি)
রূপক: এদিকে তো এর মধ্যেই উদবোধন কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষিত ছেলে এডিটর চাই বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে! সেই নিয়ে ফেসবুক তোলপাড়! (হাসি)
আশীষ: (হাসি) হ্যাঁ শুনেছি! তুমিও পাঠিয়েছিলে। তাহলেই বলো, আমরা কি তবে যুক্তি বুদ্ধি সমস্তকিছুকে বিসর্জন দেব? আমি মার্ক্সকে সমালোচনা করার সময় রাশিয়া, কিউবা ইত্যাদি কমিউনিসস্ট দেশের লিটরেচারের রেফারেন্স দিলে কোনও অসুবিধা নেই কিন্তু বিবেকানন্দের জন্য নাকি সেটা চলবে না! উদবোধন যা লেখে সেটাও নাকি ঠিক নয়! হাস্যকর যুক্তি!
রূপক: তাছাড়া বিবেকানন্দের অসুস্থতা বিষয়ক অনেক চিঠিপত্র ওদের অনেক পাবলিকেশনে চেপে যাওয়ার কথাও বইতে আপনি একাধিকবার বলেছেন!
আশীষ: হ্যাঁ লন্ডনে থাকতে ওঁর খাওয়া দাওয়ার যে অযত্নের কথা চিঠিপত্রে বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, যাতে ওঁর একপ্রকার মিন-নেস প্রকাশিত হয়, বাংলা ভার্শনে ওগুলো চেপে যাওয়া হয়েছে! অর্থাৎ ওঁর এইদিকটা বাঙালিদের কাছে উন্মুক্ত হোক এটা এঁরা ডেলিবারেটলি চাইছেন না! এই ছেলেমানুষিটাই বা কেন? আমার মনে হয় সবই ওই একটাই মোটিভে করা, মানুষের প্রশ্ন করার প্রবৃত্তিটাকে একেবারে শেষ করে দাও!
রূপক: কাজেই এঁদের পলিটিক্সের এইটাই বেসিক নির্যাস বলতে পারা যায় না কি?
আশীষ: অবশ্যই! শুধু বিবেকানন্দ বলে নয়, রবীন্দ্র-কোম্পানিতেও একসময় এই জিনিসটা ছিল।
রূপক: রাবীন্দ্রিক্স-রা তো এখনও দিব্যি রয়েছেন! (হাসি)
আশীষ: হ্যাঁ, কিন্তু এখন অনেক কমে এসেছে। কিন্তু বিবেকানন্দের দিকটা কমেনি! তার কারণ হচ্ছে টাকার জোর! আজকে রামকৃষ্ণ মিশনের যা টাকা, সংগঠনের জোর, তেমনটা দেশে আর কার আছে দেখাও দেখি! এমনকী পলিটিকাল পার্টিগুলোর কথাও ভেবে বলছি! এদিকে বিশ্বভারতী তো গন, প্র্যাক্টিকালি বেচে দেওয়ার অবস্থায় চলে এসেছে। সেখানে রামকৃষ্ণ মিশন ওয়েল ওয়েইল্ড অ্যান্ড থ্রাইভিং! অর্গাজানাইশনালি ইট ইজ আ সাকসেস! নীতির কথা বাদ রেখে বলছি!
রূপক: আশীষদা এই ক্ষেত্রে নীতি নয় রাজনীতির প্রশ্ন বেশি রেলেভেন্ট বলেই আমার মনে হয়।
আশীষ: ঠিকই। এই যে সমর বাগচী মশাই চলে গেলেন, আমি আমার কাণ্ডজ্ঞান বলে বইটিতে যার চিঠি কোট করেছিলাম...
রূপক: হ্যাঁ, মনে আছে।
আশীষ: সমরদা আমায় বলেছিলেন যে, তিনি সেই চিঠির কোনও উত্তর পাননি! তিনি গোলপার্ককে চিঠিতে লিখেছিলেন যে, আপনাদের লোক দিল্লিতে আরএসএস-এর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রটেস্ট করছে, তা আপনারা করছেন না কেন? শুধু তাই নয়, মালদার একটা মঞ্চ থেকে আরএসএস-এর লোক এবং ওখানকার লোকাল রামকৃষ্ণ মিশনের সেক্রেটারি একসঙ্গে বক্তৃতা দিয়েছেন, হোয়াট ডাজ ইট ইন্ডিকেট? অর্থাৎ এদের এত সাংগঠনিক সাফল্য কিছু একটার মূল্যে আসছে, এমনি এমনি আসছে না! আমেরিকার বেদান্ত সোসাইটিতেও শুনেছি একই ব্যাপার, আমি নিজে অবশ্য জানি না।
রূপক: আমি নিজে বার্লিনের বেদান্ত সোসাইটির হেড মহারাজের মুখে মলিকিউলার বায়োলজি সম্বন্ধে যা শুনেছি তাতে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! ইংরেজি সিলেক্টেড লেটার্স অফ বিবেকানন্দ, মানে যেখানে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ চিঠিই বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটা আমার ওখান থেকেই কেনা!
আশীষ: তিনি কি ভারতীয়?
রূপক: বাঙালি। কলকাতার সোসাইটি থেকেই গেছেন।
আশীষ: তাহলে ভাবো, এই জিনিস এখনও চলছে!
রূপক: রমরমিয়ে! এবারে বইয়ের স্ট্রাকচার নিয়ে একটা প্রশ্ন করি। আপনি দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে এক জায়গায় উপেন্দ্রকিশোরের প্রসঙ্গ আনছেন এবং বিবেকানন্দের সঙ্গে তুলনা টানছেন।
আশীষ: হ্যাঁ, ওই মিউজিকের ব্যাপাটা নিয়ে, দে ওয়্যার পোলজ অ্যাপার্ট!
রূপক: ঠিক। প্রথমত আপনি উপেন্দ্রকিশোরকে কেন টানলেন? আপনি কি অপর দিকের কাউকে খুঁজতে খুঁজতে ওঁকে পেলেন? না কি...
আশীষ: এগজ্যাক্টলি! সমসাময়িক একজন মানুষ এবং মিউজিশিয়ান এবং অন্যান্য দিকেও যথেষ্ট রিনাউন্ড, কাজেই... আমি হঠাৎই বইটা পাই এবং দেখি যে একই বিষয়ে একই সময়ে তাঁর এক ভিন্ন মত। তাই বিবেকানন্দ যা বলছেন সে সময়ে দাঁড়িয়ে, সেটাই একমাত্র প্রিভেইলিং মত ছিল না। বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত যেমন আমাদের দেশেরই একটা ট্র্যাডিশন, তেমনই উপেন্দ্রকিশোর মিউজিকের ক্ষেত্রে এই জায়গাটা নিচ্ছেন। প্রাচীন ধ্রুপদ বা হিন্দু ধ্রুপদ কী তা কেউ শোনেননি। আমরা যে ধ্রুপদ শুনেছি তার অনেকটাই মুসলমানদের হাত থেকে নেওয়া ধ্রুপদ। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ একজায়গায় খুব সুন্দর করে বলছেন, অনেকেই আমাদের নাট্যশাস্ত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে নানা কথা বলেন কিন্তু সঙ্গীত হল প্র্যাক্টিকাল অর্থাৎ করে দেখাবার জিনিস। বইয়ে যা লেখা হচ্ছে, তা যদি গলায় বা যন্ত্রে না আনা যায় সে তত্ত্বের কোনও মূল্য নেই। অথচ সব্বাই হিন্দু সঙ্গীত বলতে সেই শাস্ত্রগুলোকেই মনে করছেন। মুসলমানদের ইনফ্লুয়েন্সে আমাদের দেশের সঙ্গীতের যে অনেক লাভ হয়েছিল সেটা আমার ধারণা বিবেকানন্দও বুঝতেন, বুঝেও ওই ধরনের কথা বলতেন, কারণ লোকে ইম্প্রেসড হবে। ওঁর হাজার অ্যাবসার্ড কথার মধ্যেই কখনও কখনও অন্য দিকটা বেরিয়ে পড়ত! মানে ধরো, একজন ওঁকে জিজ্ঞেস করছেন যে, স্বামীজি, কৌপীন পরলে কি সত্যি সত্যি কাম দমন হয়? বিবেকানন্দ বলছেন, কচুপোড়া হয়! উদাহরণস্বরূপ বলছেন, ওঁর নাকি এই ভাব একদিন এমন হয়েছিল যে, বেলুড়ে শীতকালে মাঝরাত্তিরে গঙ্গার ধারে গিয়ে দৌড়েছিলেন, তাতেও সামলাতে না পেরে ঘরে এসে জ্বলন্ত মালসার উপর বসে পড়ায় তা স্তিমিত হয় এবং সেই ঘায়ের দাগ নাকি অনেকদিন অবধি ছিল। আমার প্রথম কথা হল, আবেগে কী অন্যায়টা আপনার হয়েছিল যাতে জ্বলন্ত মালসার উপর গিয়ে বসতে হয়? এটা কি আরেক ধরনের পারভার্শন নয়? এটাকে লোকে মহৎ বলে ভাবে! মানে সেক্স ব্যাপারটাকে প্রথমেই পাপ বলে বোঝানো হচ্ছে, তারপর দেখানো হচ্ছে তিনি সেক্সের কত বিরুদ্ধে ছিলেন!
রূপক: তামাক সেবনে বা ফুটবল খেলায় যদি সমস্যা না থাকে তবে সেক্সে সমস্যা কেন?
আশীষ: দেখো, যে কোনও ধর্মের মধ্যেই কোথাও না কোথাও এই ব্যাপারে ব্যাখ্যাতীত একটা ইনহিবিশান দেখা যায়।
রূপক: আমি যে কারণে উপেন্দ্রকিশোরের কথাটা তুললাম সেই প্রসঙ্গে ফিরি। আপনি যদি উপেন্দ্রকিশোরের লেখাগুলো ভালো করে দেখেন, দেখবেন 'ছেলেদের রামায়ণ', 'ছেলেদের মহাভারত', ছেলেদের অমুক...
আশীষ: না, এইখানে একটা কথা বলার আছে। এটা ভাষাভঙ্গি ব্যবহারের একটা ব্যাপার আছে। যেমন আমরা লক্ষ্মী ছেলে বলি, সেখানে লক্ষ্মী তো মেয়ে, তাই না? সিমিলারলি ওইসময়ে ছেলে কথাটা কিন্তু বাচ্চা অর্থে ব্যবহৃত হতো। ছেলেদের রামায়ণ মানে বাচ্চাদের রামায়ণ! হ্যাঁ এমনটা কেন চালু হয়েছিল সে বিষয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠতে পারে।
রূপক: সেটা আমি বুঝেছি কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরকে যখন আপনি র্যাশনাল ফিগার হিসাবে দাঁড় করাতে চাইছেন...
আশীষ: মানছি কন্ট্রাডিকশান ছিল। সেটা মেনে নিয়েই কেবলমাত্র মিউজিকের ব্যাপারটা আনতেই ওঁকে নিয়ে আসা।
রূপক: বুঝেছি। আমি এই জায়গায় একটু ক্ল্যারিটি চাইছিলাম।
আশীষ: হ্যাঁ আমার সেটা বলে দেওয়া উচিত ছিল, মানছি!
রূপক: আরেকটা জায়গা আছে যেটা আমার মতে আপনার বইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট, তা হল দ্য স্টাডি বিবেকানন্দ কনফ্লিক্ট! আপনার কি মনে হয় যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওঁর ভাবনার মিননেস এবং ওঁর কন্ট্রাডিকশনগুলো লোকসমক্ষে যাতে না এসে যায়, শুধুমাত্র সেই কারণেই রামকৃষ্ণ মিশন বা বেদান্ত সোসাইটি এই বিরাট অংশটা তাদের একাধিক পাবলিকেশনে চেপে দিয়েছে?
আশীষ: সে তো সর্বক্ষেত্রেই, তবে এই ক্ষেত্রে আরও বিশেষত এই কারণে যে এই গোটা ব্যাপারটাই বিবেকানন্দ পার্সোনার জন্য ভয়ানক ড্যামেজিং! এমন ঘটনা আরও আছে। বিবেকানন্দ ক্ষেত্রির রাজার কাছ থেকে নিজের মায়ের জন্য বাড়ি বানাবেন বলে প্রায় দশ হাজার টাকা ভিক্ষা চেয়েছিলেন এবং তিনি স্পষ্ট লেখেন যে, এই সম্মতিটা রাজা যেন ওঁকে চিঠি মারফৎ না পাঠিয়ে আলাদা করে টেলিগ্রাম করেন। কারণ তিনি জানতেন যে চিঠি মারফৎ এলে সেটা অন্য কারও হাতে পড়তে পারে এবং ব্যাপারটা তাঁর ইমেজের পক্ষে মোটেই ভালো হত না! হি ওয়াজ অ্যাওয়ার অফ দ্যাট! এটা মিথ্যাচার নয়?
বিবেকানন্দের ক্ষেত্রে আরও একটা জায়গা এক্সপ্লোর করা দরকার। তিনি যে সময়ে দেরাদুন ইত্যাদি জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় নাগাদই ওঁর এক বিবাহিতা বোন আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার উল্লেখ নানান জায়গায় আছে, তবে ঠিক কী ঘটেছিল সে বিষয়ে আমি কোনও তথ্য পাইনি। তবে ব্যাপারটা ওঁকে দারুণ ধাক্কা দিয়েছিল। এই ঘটনার পরবর্তী বেশ কিছুদিন, মানে ধরো ছয় কি আট মাস তিনি ঠিক কোথায় ছিলেন বা কী করছিলেন পরিষ্কার জানা যায় না। ওই পর্বের কোনও চিঠিপত্রও নেই। জলধর সেনের লেখায় যেমন আমরা জানতে পারি, বিবেকানন্দ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং কোনও একটি নির্দিষ্ট পাতার রস খাইয়ে তাঁকে সুস্থ করা হয়। কিন্তু কোন পরিস্থিতে তাঁর বোনের ঘটনাটা ঘটেছে তার কিছুই জানা যায় না। কেউ জানলে বিবেকানন্দকে বোঝার ক্ষেত্রে এবং মূলত ওঁর 'আজ এই কথা বলছি তো কাল অন্য কথা বলছি', এই উইমজিকালিটির সোর্সটা হয়তো বা ট্রেস করা যেত। এইরকম একটা বিরাট ঘটনা মানুষের মনে নানা ছাপ ফেলে এবং একজন মানুষকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে গেলে এই তথ্যগুলো জরুরি।
এইরকমই আরও অনেককিছুই আমরা জানি না, বিরাট একটা গ্যাপ রয়ে গেছে। ওঁর একাধিক জীবনী লেখা হয়েছে কিন্তু কোথাওই এই বিষয়গুলোকে ছোঁয়াও হয়নি। আসলে কেউ একজন সাক্ষাৎ ভগবানের দরবার থেকে নেমে এসেছে এই ইনহিবিশান নিয়ে জীবনী লিখলে থাকার কথাও নয়!
এইটা ভাঙা দরকার। আমি প্রশ্ন করতে পারব না কেন? মানুষ তো ত্রুটিবিহীন নয়। বিদ্যাসাগরও ছিলেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ত্রুটিগুলো কি একজন মানুষকে তার মৌলিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে? বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অন্যদিকে, বিবেকানন্দের ক্ষেত্রে কোনটা মৌলিক জায়গা সেটা ঠিক বুঝতে পারা যায় না।
ঠিক সেই কারণেই মনে হয়, বইয়ের শেষে আমি যেটা বলেছি, মানুষটা সত্যিই খুব গুণী মানুষ কিন্তু এই ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের মনের খোলা দিকটা ধামাচাপা না দিয়ে যদি অ্যাক্টিভ পলিটিকস বা সোশাল অ্যাক্টিভিজমে আসতেন দেশের অনেক লাভ হতো। তিনি কি অ্যাক্টিভ সমাজকর্ম বিশেষ কিছু করেছেন? আমি সেটা জানতে ইচ্ছুক। সেখানেও তো ধর্মের গোঁড়ামিই প্রাধান্য পেয়েছে। ওঁর তো চিঠিই আছে যেখানে তিনি আদেশ দিচ্ছেন যে, ‘যেখানে দুর্ভিক্ষ হয়েছে সেখানে গিয়ে আগে একটা কুটির তৈরি করবি, আগে ধর্মের কথা বলবি তারপর চাল দিবি।’ কাজেই দুর্ভিক্ষের মধ্যেও প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ধর্ম প্রচার করা!
রূপক: তাহলে আর যে সমস্ত খ্রিস্টান পাদ্রী রেশনের লোভ দেখিয়ে মানুষের ধর্মান্তর ঘটান তাদের থেকে বিবেকানন্দ আলাদা হলেন কীভাবে? পার্থক্য থাকবে এমনটা আশাও করিনি, তাও যারা ওঁকে পুজো করেন তাদের জন্যই ধরুন প্রশ্নটা করলাম।
আশীষ: পার্থক্য নেই তো! কারণ যারা প্রাইমারিলি বিশ্বাস করন, অর্থাৎ যারা মেজরিটি, তারা ভাবেন এই দেশটা হিন্দুদের দেশ। কাজেই এছাড়া ভালো বা খারাপ যাই থাকুক সেটা সেকন্ডারি। তাই এই মূল ধারণার হয়ে যিনি কথা বলছেন ইন্সপাইট অফ এভরিথিং তিনিই ঠিক।
অথচ দেশভাগের পর নেহেরু বা গান্ধি যে কথাটা বলেছিলেন যে, যারা এ দেশটা নিজেদের মনে করে, বিশ্বাস করে পাকিস্তান বা অন্যত্র চলে গেলেন না তাদের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। সেই কথাটার যে একটা জোর আছে তার মূল্য আর আমরা দিলাম কোথায়? নাহলে আজও মুসলমানদের পাকিস্তান চলে যেতে বলা হয়? যেন করুণা করে থাকতে দেওয়া হয়েছে।
তাই আজ যারা বলেন যে আরএসএস নাকি বিবেকানন্দকে ভুলভাবে ব্যবহার করছে তাদের সঙ্গে আমি একমত হতে পারি না। কারণ বিবেকানন্দের কথার মধ্যে এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো আজকের আরএসএস-এর সঙ্গে মিলে যায়। ঠিক সে কারণেই আমার মনে হয় বিবেকানন্দের কথাগুলো আরও ভালো করে পড়ে, তথ্যগুলো ভালো করে যাচাই করে তারপর সিদ্ধান্তে আসা দরকার, এইটুকুই। আমি চাই প্রশ্ন করার ধাঁচটা আবার ফিরে আসুক। নাথিং ইজ স্যাক্রোস্যাংক্ট! উই মাস্ট বাও বিফোর মিস্টার ফ্যাক্ট। মিস্টার ফ্যাক্ট যে সত্যিটাকে তুলে ধরবেন, তা যত অপ্রিয়ই হোক, তা আমাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গেলেও আমাদের সেটা মানতে হবে। সেই ইন্টিগ্রেটিটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আর বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রে তার জন্য প্রধানত বিবেকানন্দই দায়ী।