জীবনানন্দ তৃতীয় নয়নে দেখেন বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা

Jibanananda Dash and Francois Villon: মার্ক্সের বিপরীতে জীবনানন্দ আনছেন ভিলোঁকে। কেন ভিলোঁ?

দ্বিতীয় কিস্তি

কথা হচ্ছিল আশমান প্রসঙ্গে। কথা হচ্ছিল জীবনানন্দ দাশের কবিতা প্রসঙ্গে। সেসব বলতে মনে ভিড় করে এল আরও নানা কথা। কবির কথা, কবিতার কথা। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনানন্দের কবিতা অসংলগ্ন কোনও কাহিনি নয়, একটা মেজাজ বা মুড যেন তরঙ্গের মতো পাঠকের উপর আছড়ে পড়ে। সেই ঢেউ সংকেত দিয়ে গড়া। ইশারা দিয়ে বানানো। তার সঙ্গে না-বলা বাণী। তার সঙ্গে অনুষঙ্গের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সংলাপ। একটু ঝুঁকি নিয়ে বলা যায়, ‘কথা ও কাহিনি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার যেমন সারসংক্ষেপ লেখা যায়, এ ধরনের কবিতার তেমন কোনও কাহিনি-চুম্বক নেই। হওয়া সম্ভবও নয়। মানবজীবনের নানা অনুভবই তো পারম্পর্যহীন কিছু মুহূর্তের উদ্ভাস। ধরুন স্মৃতি। কিংবা স্বপ্ন। কিংবা দুঃস্বপ্ন। সবথেকে বড় অসংলগ্ন প্রবাহে এগোয় আমাদের মন। আমাদের চেতনাপ্রবাহ। একা হাঁটতে হাঁটতে। বসন্ত দুপুরে। প্রবল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অথবা ট্রামের টিকির সঙ্গে লাগা তারের ফুলকিতে – এমনকী হঠাৎ কোনও পথ-চলতি মানুষের দিকে তাকিয়ে অচেনা মুখে চেনা মানুষের স্মৃতি দেখতে পেয়ে...। প্রতিদিন কতশত ভালো লাগা, বিরক্তি, অনুকম্পা, উল্লাস, বিষাদ, যন্ত্রণা, রাগ-অনুরাগের পারম্পর্যহীন এলোমেলো ছায়া এসে পড়ে মনে। স্মৃতিমেদুরতা থেকে বাস্তবে ফিরি, মনের বাইরে থেকে মনের অন্দরমহলে আবার মনের বাইরে। জীবনানন্দের কবিতা-কথাসাহিত্যে মনের এই অন্দরমহল প্রধান পরিক্রমার এলাকা। সেজন্য তাঁর লেখায় এত অন্তঃসার, অন্তর্দীপ্ত, অন্তর্কাল, অন্তর্জীবন – তাঁর বক্তব্যে চিহ্নিত হয় ‘সুড়ঙ্গ লালিত সম্পর্ক’। মাল্যবান প্রসঙ্গে বলছেন, ‘মাল্যবানের অবকল্পনা আছে, অবপ্রতিভাও। চেতনার একটি সূর্যের বদলে অবচেতনায় অন্তহীন নক্ষত্র পেয়েছে সে’। এই অবচেতনা, অধিচেতনার চিত্রদ্যুতি আলোকবিন্দুর মতো ছড়িয়ে পড়ে। ‘আশমানদারি’-র পাঠক/পাঠিকা, লক্ষ্য করুন এখানেও এল আকাশলগ্ন দুই প্রতিমা। সূর্য আর নক্ষত্রবীথি।

এইসবের প্রভাব পড়েছে আমার কলমেও। মাঝে মধ্যেই অসংলগ্ন কথাপ্রসঙ্গ ঢুকে পড়ে নিটোল প্রবন্ধের আকার ব্যাহত করে দিচ্ছে। প্রবন্ধ হলো, প্রকৃষ্টরূপে বন্ধ্ (ধা) অর্থাৎ কঠিন বন্ধনের যুক্তিসিদ্ধ কাঠামো! বৈয়াকরণের তোয়াক্কা না করে আমি মলয় বাতাসে ছোট ছোট মেঘের মতো অর্গল খুলে দিগ্বিদিকে অনির্দিষ্ট ছুটে বেড়াচ্ছি!

আবার চোখে পড়ল, জীবনানন্দের ‘জলপাইহাসি’ উপন্যাসের একটা পৃষ্ঠা। নমিতা আর নিশীথের কথাবার্তার একটা টুকরো। ‘... তাদের ভিতর কেউ যদি ভিলোঁর মতোন শয়তানের কবিতার রসগ্রহণ করার দুঃসাহস দেখায়, তাহলে –’। খানিকদূর এগিয়ে আবার, ‘ভিলোঁর কবিতার কথা ভুলেই গিয়েছিলুম’। ... ‘ভিলোঁ ফরাসিতে আরও ভালো লাগবে আপনার’। মার্ক্সের বিপরীতে জীবনানন্দ আনছেন ভিলোঁকে। কেন ভিলোঁ? সেই নিয়ে নানা অবান্তর কথার চলাচল শুরু হয়ে গেল মাথার মধ্যে।

যতদূর জানি, ফরাসি উচ্চারণে ফ্রাসোঁয়া ভিওঁ (Francois Villon)। সময়কাল মোটামুটি ১৪৩১-১৪৬৩ সাল পরবর্তী কোনও সময়। অদ্ভুত জীবন, ব্যতিক্রমী কবিতা! আজ তিনি বিশ্বে পরিচিত, কিন্তু কেউ জানে না এই কবির মৃত্যু কোথায় হয়েছিল, কবে-কীভাবে হয়েছিল। নামটিও ছদ্মনাম। যাজক-শিক্ষক তথা পালক পিতার থেকে নাম ধার করা। ‘ভিওঁ’ শব্দের অর্থ মধ্যযুগে ছিল ‘সুকবি’। তাঁর পাঠকদের সন্দেহ, ভিওঁ হয়তো মারা গেছেন সস্তা কোনও সরাইখানার প্রবল ঠান্ডা ঘরে, নাকি কোনও বারবনিতার জীর্ণ কুঠুরিতে, শুঁড়িখানায়, কারও সঙ্গে বন্দুকবাজির চ্যালেঞ্জ লড়াইয়ে, নাকি জেলে বা ফাঁসির মঞ্চে? এ এক আশ্চর্য কবির জীবন-মৃত্যুই বটে! অন্তর্ধানের রহস্যে তিনি চিরকাল ঢাকা। স্নাতকোত্তর পড়াশোনার পর মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মহিলাঘটিত ঝামেলায় খুন করেন এক পাদ্রীকে। তারপর প্যারিস শহর থেকে পলাতক। ছ’ মাস পর অপরাধের ক্ষমা পেয়ে প্যারিসে ফিরে আসেন। অচিরেই সোনা লুঠের চক্রে যোগ দিয়ে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডাকাতি। তারপর পাঁচ বছরের জন্য চম্পট। এ সময় থেকেই কাব্য প্রতিভার উন্মেষ। পাঁচ-পাঁচটা বছর তিনি বেপাত্তা। এ সময়ে তিনি ভবঘুরের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন নানা প্রান্তে, অবহেলিত নানা গোষ্ঠীতে, অজানা তল্লাটে। তারপর জনৈক ডিউকের কাছে সমাদর পেল তাঁর কবিতা। যদিও আবার কোনও গর্হিত অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের আসামী হয়ে জেলে গেলেন। প্রায় অবিশ্বাস্য ভাগ্যবলে ডিউকের কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে কয়েদিদের কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হলো। তিনি সেই দলে ভিড়ে বেরিয়ে এলেন। ১৪৬১ সালের কারাগার নথিতে এসব কথা লেখা আছে। আবার ঢুকলেন প্যারিসে। ১৪৬২-তে এক ডাকাতির ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হয় এবং তিনি গ্রেপ্তার হন। এরপর স্বর্ণমুদ্রা লুঠের পুরনো অভিযোগে তাঁর ফাঁসির হুকুম হলো। সেই অপেক্ষার মর্মান্তিক দিনগুলিতে লিখলেন কবিতা। মরিয়া হয়ে একটি আবেদন পাঠালেন বিচারকের কাছে। আবার আশ্চর্যভাবে মুক্তি মঞ্জুর হলো। তবে খুন, লুঠতরাজ এবং রাস্তায় মাস্তানি-মারামারির ইতিহাস মনে রেখে দশ বছরের জন্য প্যারিস থেকে তাঁকে বিতাড়ন করা হল। ৫ জানুয়ারি, ১৪৬৩ তারিখে আদালতের এই নির্দেশনামা। ভিওঁ আবার রহস্যের গভীর অন্তরালে লুকিয়ে পড়লেন। প্রায় নব্বই বছর পর প্রখ্যাত কথাকার রাবলে তাঁর লেখায় ভিওঁর অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন কখনও রাজসভায়, কখনও বৃদ্ধাবাসে। তাঁর এই দুই বিবরণকে অবশ্য ‘কল্পনাজাত আজগুবি’ হিসেবে তেমন গুরুত্ব দেননি মান্য পণ্ডিতেরা। যদিও বোঝা যায়, কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন এই কবি, এই ভবঘুরে, অপরাধপ্রবণ, দেহোপজীবিনী পল্লীর নিয়মিত খদ্দের।

আরও পড়ুন- ‘ঘড়ির সময়’ আর ‘মহাকাল’ আমাদের বিস্ময়ে নির্বাক করে উড়ে যাচ্ছে

প্রায় তিনহাজার লাইন কবিতা পাওয়া যায় ভিওঁর নামে। তাঁর কবিতা আত্মগত এক প্রকাশ। নিজস্ব স্বরভঙ্গিতে তিনি ধরেছেন প্যারিসের তথা নগরের উত্তল-অবতল অভিজ্ঞতা এবং জীবনচর্যা। তখনকার চালু রীতি ছিল গানের আঙ্গিকে কবিতা রচনা। ভিওঁর কবিতা প্রধানত সুরবর্জিত। একেবারে রাস্তার হৈ-হুল্লোড়, চটুল গান, অশ্লীল উক্তি-প্রযুক্তি মিলেমিশে রহস্যময় অপরিচিত লোকালয়ের চরিত্র তথা বুলিবাতেলার একক প্রদর্শনী করে তোলে কবিতাকে। পঞ্চদশ শতকের রাজসভাকেন্দ্রিক বা ধনাঢ্য ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় লিখিত সাজানো গোছানো কবিতার বাগিচায় ঝড় তুলে দিলেন ভিওঁ। প্যারিসের জনবৃত্তের দিনগুজরান আর ভাষার নাগরিক স্ফুলিঙ্গ যেন ভিওঁর কবিতা। দু’জন আধুনিবাদী কবিকে ধরা হয় ভিওঁর উত্তরসূরি। একজন বোদলেয়র আর অন্যজন ডেরলেন। ফরাশি কবিতায় যে ভ্রাম্যমাণ, অবলোকনবাদী, পাগলাটে, মেজাজি কবি-অবয়ব সমাদৃত তার প্রথম বীজ ভিওঁ এবং তাঁর কবিতা। স্তবক গঠনে, বিষয়ে এবং আঙ্গিকের নানা দক্ষ ব্যবহারে ভিওঁ অনন্য। তাঁর ব্যক্তিগত নানা উদ্বেগ, সময়ের ক্ষত, জীবনের তুফান, ঐশ্বরিক উদ্ধারের স্পৃহা – সবই আধুনিকতার হঠাৎ আলোর ঝলকানি।

বিশ শতকের বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে জীবনানন্দ এভাবে পঞ্চদশ শতকের এক কবির কথা, কবিতার কথা হঠাৎ শুনিয়ে দেবেন। জীবনানন্দের ‘রাত্রি’ কবিতার দিকে তাকালে আমরা দেখি রহস্যময়, আধোচেনা, অদ্ভুত এক কলকাতাকে। ভবঘুরে এক কবি মাইল মাইল হেঁটে দেখছেন হাইড্র্যান্ট খুলে কুষ্ঠরোগীর দল জল খাচ্ছে, ইহুদিরমণী জানলায় গান গাইছে, ব্রায়ার পাইপ হাতে লোল নিগ্রো হাসে – নগরীর মহৎ ভণ্ড গ্যাসলাইটের জাদুময় রাত্রি এভাবেই তৈরি হয় প্রান্তিক আঁধারচিহ্নে। আবার দেখুন, প্রায় কাফকার মতোই জীবনানন্দ দেখছেন আমাদের শ্বাসরোধী ব্যবস্থায় ক্ষমতার চোখ রাঙানি বিচার আর শাস্তির আয়োজন। ফলে ভিওঁর সমান্তরালে জীবনানন্দই পারেন বাঙালি অভিমততায়, কলকাতার প্রেক্ষাপটে, নিজস্ব আর্ত চিৎকার –

‘আকাশে সূর্যের আলো থাকুক না – তবু -/ দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে।/ আমরা দণ্ডিত হয়ে জীবনের শোভা দেখে যাই/ মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে’।

লক্ষ্য করুন, এই পঙক্তিতে মিশে আছে ক্রোধ নয়, স্নায়ুযন্ত্রণা। মিশে আছে এক তীব্র ভীতিময় দৈনন্দিন। কাকে এই ভয়? মৃত্যুকে? অজানা শাস্তিদাতাকে? ক্ষমতার বীভৎস মুখব্যাদানকে? সমাজপতিদের? জীবনানন্দ প্রকৃতপক্ষে এভাবেই ইওরোপ তথা আবহমানের আন্তর্জাতিক মানবজিজ্ঞাসা তথা মানবসংশয়গুলির শরিক হয়ে দাঁড়ান। ফলে তাঁর কবিতার সংকট একটু দুর্বোধ্য  লাগে, অনুষঙ্গের হদিশ না পেয়ে। ভাষাও তো জীবনানন্দ নিজস্বভাবে গড়েছেন। ভাঁড় আর সম্রাজ্ঞী, ভিখারি আর ভবঘুরে, চোরাবাজার দস্তানা আর হেঁয়ালিতে কণ্টকিত নগর সড়ক জীবনানন্দের টিপছাপ তাঁর একান্ত পৃথিবী। আলোক সরকার লিখেছেন, ‘সুবোধ রায়ের কাছে শুনেছি শেষদিকে হেঁটে হেঁটে আলিপুর চিড়িয়াখানায় গিয়ে দুপুর কাটানো তাঁর একটি নিত্যকর্ম ছিল’। এ কি কোনও অস্বাভাবিকতা? নাকি, ব্যতিক্রমী কবি-মনীষীর ভিন্নতলস্পর্শী জীবনচর্চা?

তাহলে কি বলা চলে, জীবনানন্দের কথাসাহিত্য আর কবিতা একই স্বপ্নদীপ্ত মনের দুই প্রকাশ? দুইয়ের মধ্যে স্রোত তো বয়েই চলেছে, এমনকী পরস্পর দেওয়া-নেওয়ার এরকম বহু দৃষ্টান্ত ছড়ানো আমাদের চোখের সামনে। ‘তবুও শ্মশান থেকে দেখেছি চকিত রৌদ্রে কেমন জেগেছে শালি ধান...’।

প্রকৃতি যখন স্বাভাবিক – সে হলো মুক্ত নিসর্গ। কিন্তু, নগর মানেই কৃপণ প্রকৃতির সমারোহ। তখন টবে আর বৈঠকখানায়, ছাদের কার্নিশে আর বারান্দার কৃত্রিম কোণে প্রকৃতির বসবাস। বন্দি। সেখানে একফালি আকাশ আসলে কয়েদির আকাশ। আধুনিকবাদী কবির কাছে এই শহরবৃত্তই প্রধান। জীবনানন্দও যেন তৃতীয় নয়নে দেখেন বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা, দিনের রাতের সন্ধ্যা-সকালের। মনে হয় স্টক মার্কেট আর ট্রামবাসের চিৎকার যেন পশুর মতোই গর্জন করছে। আবার মনে ছায়া ফেলে যায় প্রকৃতির মুক্ত হরিৎ কল্লোল। হেমন্তের কুয়াশা, নলবন, নদী-ঘাস ভাঁটফুল আর পাখি ফড়িঙের বাংলা ও জীবনানন্দের। মনে রাখতে হবে, দুপুরে চিড়িয়াখানায় যে দৃশ্য তিনি দেখতেন, তারই ইশারা কলকাতা বর্ণনায় হয়তো ফিরে আসত। বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতা এক অত্যাশ্চর্য জগৎ। নানা দেশের, নানা প্রান্তের, নানা পরিচয়ের মানুষ-মানুষীর ভিড় সেখানে। তার সঙ্গে দাঙ্গা, মন্বন্তর, বোমারু বিমান। এই স্থান-কালের কবি জীবনানন্দ।

স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু, সিগারেট নিয়ন টেরিকাটা মানুষ ‘লন্ডন রুশিয়া দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা চিন/ অগণন কনফারেন্স বিকীর্ণ য়ুরোপ’ – এইসব অন্তঃস্রোতে জীবনানন্দকে আলোড়িত করে। নগর আর তার রক্তস্বেদলোভ। নগর আর তার অসাড় জনস্রোত। অদ্ভুত রাত্রিগুলি। রহস্যময়। অবচেতনের মতো। আমরা জানি, ফরাসি ভাষায় একটি শব্দ আছে, ফ্ল্যানক বা ফ্লেনর। বানানটা ‘Flaneur’। নগরে যে ভবঘুরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায় আর শীতল দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে সবকিছু, তাকে বলে ফ্ল্যানর। আধুনিকতার এক অব্যর্থ প্রতীক হয়ে ওঠে এই শহর পরিক্রমাকারী। যন্ত্রাকীর্ণ, বহু পরিচয়ের মানুষে ভরা, ধোঁয়াধুলো-কংক্রিট, বহুতল আর মুখোশ চটকের শহরে এই উৎসুক, অলস, রাস্তার আলোছায়া ভরা লোকটি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করছিল আধুনিক তথা আধুনিকবাদী সাহিত্যে। প্রধানত কবিতায়। শার্ল বোদলেয়রের ১৮৬৩ সালে লেখা ‘আধুনিক জীবনের চিত্রশিল্পী’ প্রবন্ধে, পরবর্তীকালে ভালটের বেনিয়ামিনের নিবন্ধে আলোচনায়, বিশ শতকের প্রেক্ষিতে এই সদাভ্রাম্যমান ব্যক্তিত্বটির বীজবান বিস্তার। উনিশ শতকের পার্ক-জটলা-ভিড় সরাইখানা-চত্বর-বুলেভার সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় তীক্ষ্ণ নজরের মানুষটি। কখনও কখনও সে কবি, কখনো শিল্পী, কখনও যেন সমালোচক, কখনো করুণ ! স্যঁৎ-বোভ থেকে বালজাক কিংবা এডগার অ্যালান পো – সকলেই একে নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছেন। লোকটির বাঁচার রসদ তিনটি – নগর, পথঘাট গলিঘুঁজি আর তৃতীয়ত লোকজনের জটলা। সবের বুকের মধ্যে সে আছে অথচ একা হয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে। জীবনের নানা প্রবাহে ভেসে ভেসে সে স্বপ্ন দেখতে চায় আবার থেঁতো হয়ে যাওয়া স্বপ্নের জন্য অশ্রু বিসর্জন করে। এই আশ্চর্য মানুষটি, একা দ্রষ্টা মানুষটিকে বাংলা কবিতায় নিয়ে এলেন জীবনানন্দ। অথচ, সে একান্তই বিশ শতকের কলকাতার পথচারী। একদিকে চেনা শহরের চৌহদ্দির লোক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক।

(চলবে)

More Articles