ঘুণধরা ব্যবস্থাকে জোরালো থাপ্পড় আমাদের এই সমস্বরে 'না'
RG Kar Movement: আরজি কর কাণ্ড পরবর্তী সময়ে এই যে গণরোষ, সেখানে এমন ব্যক্তিরা পথে নেমেছেন যারা কোনও দিন কোনও ধরনের আন্দোলনে যোগ দেননি।
আরজি কর কাণ্ডের পর রাজ্যজুড়ে গড়ে ওঠা জনতার আন্দোলন এবং ডাক্তারদের আন্দোলন মিলেমিশে গিয়েছে। কারণ দু'ক্ষেত্রেই মূলস্বর— 'না। মেনে নেওয়া আর হবে না। অনেক হয়েছে, আর না'। এখানে বারবার সিস্টেমকে প্রশ্ন করা হচ্ছে। নাগরিকরা মনে করছেন, ডাক্তারদের দাবি পূরণ হলে কোথাও গিয়ে আমাদের দাবির অংশবিশেষ পূরণ হবে। এই সমস্বরে 'না' বলাটা ঘুণধরা ব্যবস্থাটাকে জোরালো থাপ্পড়।
এতদিন ধরে প্রান্তিক লিঙ্গের, অন্য যৌনতার মানুষদের নিয়ে, নারীদের নিয়ে মানুষজনকে যে কথাগুলো চেপে রাখতে বাধ্য করা হতো এই আন্দোলনের কারণে সেগুলিই এবার উঠে আসছে। দলীয় ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে সমস্যা নিয়ে সমাজের সব স্তরে কথা বলা হচ্ছে, কোনও দলের 'হ্যাঁ' তে হ্যাঁ বলতে হচ্ছে না, এটা বড় পাওনা। আমরা হয়তো এখনও শুধুমাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ দাবির কথা জানতে পেরেছি, কিন্তু কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এখন যদি আলোচনাটা বন্ধ করে দিই তবে যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই থেকে যেতে হবে। ফলে এখন ভাবার যে, এই পরিসর কতটা বড় করা যায়।
আমারা পুরুষতান্ত্রিক পরিসরে বড় হই। আমাদের গোটা সিস্টেমটা পুরুষদের মাথায় রেখেই বানানো। তেমনই আমাদের কাজের জায়গা, আমাদের বিদ্যালয়, পরিবারও পুরুষদের মাথায় রেখেই চলে। আমাদের ভাষাও পুরুষদের সামনে রেখে বানানো। সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, ব্যাটসম্যান থেকে বিষয়টা 'ব্যাটার'-এ গিয়েছে, আবার ক্যামেরাম্যান থেকে ক্যামেরাপার্সনে বিষয়টা কিছুদিন হল গিয়েছে। এই সিস্টেম আমাদের দেখিয়েছে যে একজন পুরুষ প্রাধান, বাকি সবাই অপ্রয়োজনীয়। এখন এই বিষয়টিকেও 'না' বলার সময় সমাগত। ভাবতে হবে, যে ধরনের শব্দচয়ন করছি তার মধ্যে আমি কি কোথাও কাউকে খাটো চোখে প্রকাশ করছি? যদি করে থাকি, সেটা যে কোনও লিঙ্গের প্রতিই হোক না কেন সেই শব্দকে বাদ দিতে শিখতে হবে। আমার কাছে যে ভাষা ছোটবেলা থেকে আনা হয়েছে তাও তো সিস্টেমের দ্বারাই এসেছে, আজ তার সংস্কার সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন- আরজি করের প্রতিবাদ আন্দোলন নকশালবাড়ি, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতোই তীব্র?
এতদিন আমরা বাধ্যত যে দলই ক্ষমতায় এসেছে তাকে 'হ্যাঁ' বলে এসেছি। কিন্তু এবার মনে মনে কোথাও বুঝতে পেরেছি, আমি যেটা পাচ্ছি, সেটাই যে আমার প্রাপ্য, সেই জায়গায় বিষয়টা আর নেই। আমার মনে হচ্ছিল, ওই রাত দখলের ফেসবুক পোস্টটা কোথাও একটি সুপ্ত আগুনকে ফুলকি দিতে পেরেছিল। আমি গোটা আন্দোলনে নিমিত্তমাত্র। সাধারণ নারীরা, যারা বেরিয়ে এসেছেন, যে প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা বেরিয়ে এসেছেন তাঁরা সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে যে কথাগুলি বলছেন, যে দাবিগুলি নিয়ে আসছেন, সেগুলি তাঁদের মাথায়, মনে বহু বছর ধরে চলেছে। তাঁদের এটা ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে যে, সিস্টেম এতটাই তোমার উপর চেপে বসে আছে যে তুমি এই দাবিগুলি নিয়ে বলতে পার না এবং তোমার অধিকারই নেই এই দাবিগুলি বলার, যা হচ্ছে তা মেনে নিয়ে সেটার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এই দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। যে সাধারণ নারীরা, প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার পরিচয়ের যে মানুষরা এই আন্দোলনকে গণ আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলেছেন তাঁরা সবাই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব।
বলতে চাইছি, এই আরজি কর কাণ্ড সামনে রেখে মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কোথাও 'Enough is enough' বলতে চাইছে। তাঁরা বলতে বাধ্য হয়েছে যে, আমরা একটার পর একটা ঘটনা দেখছি কিন্তু আমরা যে ধরনের সুরাহা আশা করছি তা কোথাও পাচ্ছি না। সেই কারণেই আমার মনে হয় যে, তাঁরা সকলেই ১৪ তারিখ রাস্তায় নেমেছিলেন, রাত দখল করেছিলেন। গোটা একমাস ধরে বহু জায়গায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে একদম সাধারণ ঘরের মহিলারা বাইরে এসে রাত দখল আন্দোলনে যোগদান করছেন। মফসসলের মহিলারা, শহরের মহিলারা, গ্রামের মহিলারা, প্রত্যেকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা বলছেন, এই সংসদীয় সিস্টেম তাঁদের কোনও সুরাহা দিতে পারেনি। আমার মনে হয় এই 'না' টা কোথাও এই অসম্পূর্ণতার বিরুদ্ধেও। আমি এতদিন বাধ্য হয়ে তোমাকে 'হ্যাঁ' বলেছি কিন্তু আজকে দাঁড়িয়ে এই স্বাধীনতার সময়, আমি আমার স্বাধীনতা নিয়েও কথা বলতে চাই। আমি আমার 'না'-টুকু তোমাকে জানাচ্ছি যে আর বাধ্য হয়ে তোমাকে 'হ্যাঁ' বলতে আমি আর রাজি নই।
এনসিআরবি-র পরিসংখ্যানই যদি আমরা দেখি তাহলে বোঝা যাবে, প্রতি ১৫ থেকে ১৬ মিনিটে ১ জন করে মহিলার ধর্ষণ হচ্ছে। সেটা যদি দিন হিসেবে দেখি তাহলে ৯০টি ঘটনা উঠে আসার কথা। আমাদের কাছে সংবাদমাধ্যমে যে ধরনের সংবাদ উঠে আসে, তা কিন্তু সংখ্যায় এত নয়। কারণ বহু ধর্ষণের ঘটনা রেজিস্টারই হতে পারে না, তার এফআইআর-ই লেখা হয় না এবং তার পেছনে প্রচুর কারণ থাকে। প্রভাব খাটানো হয়। অনেক সময় হয় যে আমাদের আইনি ব্যবস্থা যেভাবে চলছে তার উপর ভরসা করতে পারেন না অত্যাচারিত। এমনও হয়, ঘটনাস্থল থেকে থানা এতটাই দূরে যে যিনি অত্যাচারের মুখোমুখি হলেন, তিনি মনে করছেন যে গোটা 'গোলমেলে' আইনি সিস্টেমের মধ্যে আমি না ঢুকে আমি বিষয়টা নিজের মতো নিজের কাছে রেখে দিলাম। কারণ এটা ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় যে, সমাজ বিভিন্নভাবেই চলবে, তোমাকে এটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। প্রান্তিক লিঙ্গের-যৌনতার মানুষদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি করে বোঝানো হয় যে, তুমি আসলে সমাজের সঙ্গে বেড়ে ওঠার জন্য তৈরি হয়েছ। তোমার ইচ্ছে এবং তোমার আকাঙ্খা সমাজের সঙ্গে খাপ খেলে তবেই তুমি টিকে থাকবে।
সেখান থেকেই দাঁড়িয়ে এই আন্দোলনের একদম শুরু থেকে যে দাবিগুলি উঠে আসছে, সেই দাবিগুলি কোনও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। প্রাথমিকভাবে সবারই দাবি, আরজি কর কাণ্ডে যত জন দোষী রয়েছেন তাঁদের সবাইকে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। চাঁইদের শনাক্ত করতে হবে। কারণ আমরা যখন আরজি করের ঘটনাপ্রবাহ পড়ছি তখন বুঝতে পারছি, সেখানে এক ধরনের 'থ্রেট কালচার' ছিল যার কারণে বহু মানুষ সামনে এসে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিছু দিন আগে অবধিও এটাই ছিল। আমরা যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছি, তখন আমরা থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধেও কথা বলছি এবং এই গণ-সমাবেশের লক্ষ্য ক্রমশ পরিধি বাড়িয়েছে।
আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, পুরুষ এবং মহিলা যে ধরনের সিস্টেমের বাইনারির মধ্যে রয়েছেন তাঁরা যে ধরনের শোষণের শিকার হন, তার থেকে বহু বেশি শোষণের স্বীকার হন প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষরা। তাঁরা তাঁদের নিজের পরিবারকেও বিশ্বাস করতে পারেন না। তাঁদের নিজের পরিবার তাঁদেরকে নিয়ে যে ধরনের সিদ্ধান্ত নেয় সেই সিদ্ধান্তগুলো অত্যন্ত সমস্যার সৃষ্টি করে। তাঁদের জোর করে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, মনে করা হয় তাঁদের চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে এই বাইনারির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেটা অত্যন্ত কষ্টকর জীবন। সেই প্রতিটি জীবনের লড়াই নিয়ে যদি আমারা মজা করতে থাকি, তাহলে আমরা প্রতি মুহূর্তে তাঁদের ছোট করতে থাকি। এসব বিষয়কে এবার জোরালো ভাবে 'না' বলব আমরা।
আরজি কর কাণ্ড পরবর্তী সময়ে এই যে গণরোষ, সেখানে এমন ব্যক্তিরা পথে নেমেছেন যারা কোনও দিন কোনও ধরনের আন্দোলনে যোগ দেননি। তাঁরা নিজেরা স্লোগান লিখছেন। চিৎকার করে শাসককে নিজেদের 'না'-টা জানিয়ে দিয়েছেন। এই স্বতঃস্ফূর্ততাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সেখানে থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরবর্তী আন্দোলনের পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত। বহু মানুষ মনে মনে ভাবছেন, তাঁরা যখন আন্দোলনটা করছেন সংসদে বিষয়টাকে কীভাবে নিয়ে যেতে পারবেন। আমার মনে হয়, সংসদেই এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে, নয়তো এই আন্দোলন কোথাও গিয়ে বিফল হয়ে যাবে, এই চিন্তা ভাবনা থেকেও বাইরে বেরনো প্রয়োজন।
আমাদের এবার নিজেদের কাজের জায়গা বড় করতে হবে। ২০১৫ সাল থেকে নারী অধিকার এবং নারী আন্দোলনে কাজ করার ইচ্ছে নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে কথাবার্তা বলার একটা চেষ্টা করছি আমরা কয়েকজন। বীরভূমের পাথর খাদানে যেখানে মহিলারা কাজ করেন তাঁরা প্রত্যেক বছর ইউটিআই-এর সংক্রমণে ভোগেন। তাঁর থেকে তাঁদের পরিবারেও বিষয়টা ছড়িয়ে যায়। সেখানে পিরিয়ড সংক্রান্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং শারীরিক পরিচ্ছন্নতাকে মাথায় রেখে এক ধরনের প্রচার চালিয়েছি আমরা। সেখানে আমাদের সঙ্গে কিছু ডাক্তার ছিলেন। তাঁরা কোনওদিনই তাঁদের যা রোজগার, সেখান থেকে ৮০ টাকা দিয়ে একটা স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট কিনে ব্যবহার করবেন এইটা ভেবে উঠতে পারেন না। হয়তো তাঁদের দিনের রোজগারই ১০০ টাকা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁদের মধ্যে যখন প্রচার করেছিলাম তখন তাঁদের কিছু বিষয়, কিছু দাবি দাওয়া আমাদের সামনে আসে। সেখানে আমরা চেষ্টা করি তাঁরা যেন নিজেদের স্যানিটারি ন্যাপকিন নিজেরাই বানাতে পারেন এবং নিজেদের মধ্যে বিলি করতে পারেন। একধরনের বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা যায় কিনা সেই নিয়ে একটা পর্যালোচনা করছিলাম।
আরও পড়ুন- ফুটপাতের মেয়েটির জন্যেও আমরা গলা ফাটাবো কবে?
২০১৭ এবং ২০১৮ সাল নাগাদ বাংলায় এবং অন্যত্রও গৃহহিংসার অনেক ঘটনা উঠে আসে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম জায়গাগুলিতে পৌঁছতে। নির্যাতিতাদের কথা শুনতে। আর, ২০১৯ সালে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটেছিল তখন থেকে রাতদখল শুরু। তাতে মহিলা এবং পুরুষ মিলিয়ে ৭০ থেকে ১০০ জন মানুষ এসেছিলেন। রাত্রিবেলা আমরা ছোট একটি মিছিল করেছিলাম যাদবপুর ৮বি থেকে বাঘাযতীন পর্যন্ত। সেদিন India's Daughter ডকুমেন্টারির স্ক্রিনিং হয়েছিল। আমার ভূমিকা এসবে একজন অংশ্রগ্রহণকারীর। আমি চাই সকলেই এই ভূমিকা নিক, যে যার সাধ্যমতো 'না' বলাটুকু চালিয়ে যাক।
প্রান্তিক মহিলারা অনেকেই জানেন না, হিংসা এবং অত্যাচার আসলে কোনটা? কোনটা চিহ্নিত করা উচিত। আমাদের কাছে ইন্টারনেটের সুবিধে রয়েছে, কোনও আইনি ব্যাপারে না জানলে কোনওভাবে জেনে নিতে পারব। কিন্তু সত্যিই প্রত্যন্ত এলাকায় একজন মহিলা, যাকে ছোটবেলা থেকে বোঝানো হচ্ছে- তোমার বর তোমাকে মারবে, সেটাই খুব স্বাভাবিক, এটা তোমার দাম্পত্য জীবনেরই অংশ সেটা যে আসলে যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এটা জানান দিতে হবে তাঁকে।
সরকারের তরফে শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের কাছে নানা ধরনের তথ্য নিয়ে যাওয়াই হয় না। তাঁদেরকে এই অজ্ঞতার জায়গায় রাখাটা সরকারি সিস্টেমের জন্য কোথাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কয়েকটি জায়গায় কথা বলার কারণে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আসলে নাগরিকরা জানেন তাঁরা তাঁদের 'না' টা কীভাবে বলতে চান কিন্তু নাগরিক আন্দোলন সব সময় কোনও পার্টি হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছে বা আন্দোলনের অভিমুখ ভোট রাজনীতির দিকেই ঘুরে গেছে। তার জন্য তাঁদের স্বর কোথাও আটকে গিয়েছে। এবার আর সেই প্রতিকূলতা নেই।