অনুবাদ না করা মানে জানলা বন্ধ ঘরের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরা
World of Translation : অনুবাদ না করলে আমাদের শিরা, ধমনীতে রক্ত শুকিয়ে যাবে, আমরা কর্কট রোগে ভুগব, মরে শুকিয়ে পড়ে থাকব গাছের নীচে
অনুবাদ একটা জীবনযাপন, অনুবাদ এক দর্শন। অনুবাদ হচ্ছে বেঁচে থাকার উপায়। অনুবাদ না হলে আমরা কেউ গ্রিক সাহিত্য পড়তে পারতাম না, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সক্রেটিসকে চিনতাম না। আমরা সফোক্লিসের নাটক জানতাম না, ইউরিপিডিস পড়তাম না। যা পড়েছি, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, ফ্লব্যেয়ার, বালজাখ, সেরভান্সেস, কাফকা, মহাভারত, রামায়ণ সবটাই অনুবাদের মাধ্যমে পড়েছি। এই বিষয়টা যতক্ষণ না বুঝছি, ততক্ষণ এর গুরুত্বও বুঝতে পারব না। অনুবাদকে জীবনের গভীরে প্রোথিত এক সত্য হিসেবে অনুভব করতে হবে। কারণ, বাঁচার জন্য আমাদের প্রসারিত হতে হবে। প্রসারিত না হলে মানবজাতি বেঁচেই রইত না। রনেসাঁস কেন ইওরোপে হয়েছিল? রনেসাঁস মানে তো নতুন করে জন্ম নেওয়া। নতুন করে জন্ম কখন নেব? যখন আমি অন্যের সঙ্গে মিশে, অন্যের ভাবনাকে সমন্বিত করে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করব। মানুষকে বোঝার চেষ্টা করব। নবজাগরণ যখন হয় তখনই কিন্তু গ্রিক সাহিত্য অনূদিত হয়েছিল। তখনই হলিনশেড'স ক্রনিকাল ইতিহাস থেকে নতুন করে রচিত হয় যা শেক্সপিয়রকে বিপুল মূলধন জোগায়। তিনি ওই অসামান্য ঐতিহাসিক নাটকগুলি লিখতে পেরেছিলেন। মনে রাখতে হবে, এই বিকাশ ও প্রসারণ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। জানলা না খুলে আমরা বাঁচতে পারব না। অনুবাদ না করা, অনুবাদ না পড়া মানে জানলা বন্ধ একটা ঘরের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরে যাওয়া।
বাঙালিরা অনুবাদের কাজটা প্রথম থেকেই করেছে। রামমোহন তো প্রথমত একজন অনুবাদক। ভুললে চলবে না উইলিয়াম কেরি একজন অনুবাদক, ডিরোজিও বিশ্বচেতনাকে তাঁর শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন। অনুবাদ হলো পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া। আমরা একটা কথা প্রায়শই বলি, অমুক শহরটা খুব কসমোপলিটান। বলি, মানে না বুঝেই। কসমোপলিটাস কথাটা গ্রিসের। এর তিনটি অর্থ ছিল। বোর্হেস বলেছিলেন সমস্ত শব্দেরই উৎস গ্রিসে। ওঁরা সব কিছু নিয়েই ভেবেছিলেন। গণতন্ত্র কথাটাও গ্রিস থেকেই এসেছে, ডেমোক্রেসি। অনুবাদের মূল্য আমরা ততক্ষণ বুঝব না যতক্ষণ না তাদের তর্ক বিতর্কগুলো আমাদের সামনে আসছে। কেউ যদি বলেন, আমি কার্ল মার্ক্স পড়েছি, ফুকো, দেরিদা পড়েছি- তিনি একেবারেই ভুল বলছেন। তিনি আসলে অনুবাদ পড়েছেন। অনুবাদকের ভাষ্য পড়েছেন। তাতে কিছু বদলে যায়, কিছু সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে। সেটাতে কিছু করার থাকে না, তাহলে তো অনুবাদ বাদই দিতে হয়। অনুবাদ বাঁচার আবেদন। যা বলছিলাম, কসমোপলিটান শব্দ এসেছে কসমোপলিতেস থেকে। যার অর্থ বিশ্বের নাগরিক। রিওজেনাস কথাটা প্রথম ব্যবহার করেন। বিশ্বনাগরিক কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, সিটিজেন অফ ইউনিভার্স, সিটিজেন অফ ওয়ার্ল্ড নয় কিন্তু। কসমোপলিটান শব্দের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশের সংস্কৃতিকে বুঝতে পারেন যিনি, এবং জাতীয়তাবাদ বিরোধী। এই যে আজ চারদিকে জাতীয়তাবাদের নৃত্য চলছে এর কারণ হলো, পৃথিবীকে না বোঝা। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা কবি। শুধু ১৯২৬ সালেই রবীন্দ্রনাথ ১২টি দেশে গিয়েছেন। সারা পৃথিবী কেন ঘুরছেন তিনি? চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, পৃথিবী ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না। পৃথিবী আমার চাই! পৃথিবীকে জানতে হলে কূপমণ্ডুকতা পরিহার করে বিশ্বে বিকশিত হতে হবে। অনুবাদ করতেই হবে।
আরও পড়ুন- দুই বাংলার বানান-ভাবনা: মিল ও অমিল
১৯ শতক ছিল অনুবাদের শতাব্দী। বিদ্যাসাগরের প্রথম কাজ বেতাল পঞ্চবিংশতির হিন্দি থেকে অনুবাদ। ধীরে ধীরে ঈশপস ফেবলসের অনুবাদ কথামালা, উত্তর রামচরিত এবং রামায়ণের অংশ থেকে সীতার বনবাস, কালিদাস থেকে অভিজ্ঞান শকুন্তলা, শেক্সপিয়রের কমেডি অব এররস থেকে ভ্রান্তিবিলাস। পাশাপাশি সংস্কৃত গ্রন্থের সম্পাদনাও করছেন। মনে রাখতে হবে, অনুবাদ মানেই কেবল হাতে হাতে অনুবাদ হচ্ছে তা নয়। বই পড়াও তো অনুবাদ একধরনের। যেমন জন স্টুয়ার্ট মিল পড়ছেন বঙ্কিম, তিনি পড়ছেন রুশোর সাম্য। বিশ্ব চরাচরে বাঙালির ছড়িয়ে পড়ার মূলে ছিল অনুবাদ। স্বামী বিবেকানন্দও কিন্তু ফরাসি ভাষা জানতেন। প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও পরিব্রাজক পড়লে দেখা যাবে, বিবেকানন্দ ফ্রান্সকে ফ্রাঁস বলছেন, প্যারিসকে প্যারি বলছেন। নিজেই বলছেন, তিনি ফরাসিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। আসলে সমাজে সৈয়দ মুজতবা আলি বা প্রমথ চৌধুরী, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়দের মতো বাতিঘর লাগে যারা আমাদের সমাজজীবনে আলো দিতে পারেন। অনুবাদ না করলে যে আমাদের শিরা, ধমনীতে রক্ত শুকিয়ে যাবে, আমরা যে কর্কট রোগে ভুগব, মরে শুকিয়ে পড়ে থাকব গাছের নীচে তা আজ অনেকেই বুঝতে পারছেন না।
লজ্জা বলে বাঙালির একটা শব্দ ছিল। এখন লজ্জা শব্দটি পাশের বাড়ির ছাদের গাছের ডালে শুকোচ্ছে। লজ্জা বা বিবেক শব্দটি বিস্মৃত। এই শব্দগুলি আবার তখনই ফিরে আসবে যখন আমরা বাকি বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হব। আমরা বহুদিন অনুবাদ করছি না। অরুণ মিত্রের পরে বুদ্ধদেব বসু করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে। মূল ভাষা জানতেন না বলে খানিক সমস্যা হলেও তিনি কাজটা করেছিলেন। সংস্কৃত জানতেন হয়তো, তাই কালিদাসের মেঘদূতের অনুবাদ একেবারেই অন্যরকম হয়েছিল। রিলকের অনুবাদ করেছিলেন, বোদলেয়ার অনুবাদ করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ শতকে বাল গঙ্গাধর তিলক অনুবাদ করেছিলেন, পিয়ের লোটির 'ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ' অনুবাদ করছিলেন। মলিয়ার থেকে ফরাসি নাটক অনুবাদ করেছিলেন। এখন কিছু হচ্ছে না তার কারণ কেউ কিছু পড়াশোনা করছেন না। কবিদের অনেককেই আমি প্রশ্ন করি, প্রিয় কবি কে? উত্তরে জীবনানন্দ বললে আমি প্রশ্ন করি আদিম দেবতারা, সিন্ধু সারস পড়েছেন কিনা! তাঁরা মনে করতে পারেন না। না-পড়া একটা জাতি ক্রমশ উচ্ছন্নে যাচ্ছে। অনুবাদ হয়তো এদের বাঁচাতে পারত। কিন্তু বিদেশে গিয়ে যে জার্মান ভাষা শিখে আমি অনুবাদ করব সেই ধৈর্যও এই গোলকায়িত পৃথিবীতে আর নেই বোধহয়। বিশ্বায়নের পরে সব কিছুই শর্টকাট। এভাবে হবে না। আমি যখন ফরাসি শিখেছি, তখন সত্যিই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাড়ে ২৩ ঘণ্টা পড়েছি। ডিকশনারির মধ্যে শুয়ে থাকতাম। এখনও প্রায় ৩৬ থেকে ৩৮ টি ফরাসি ডিকশনারি আছে আমার। অর্থাৎ শ্রম লাগে, নিষ্ঠা লাগে, দায়বদ্ধতা লাগে। এই কোনওটাই প্রায় নেই এখন।
ঢাকায় অনুবাদ নিয়ে বড় কাজ করছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। অনেক বেশি অনুবাদ সেখানে হচ্ছে। আমি জানি না সেসবের গুণগত মান কেমন। কিন্তু বাংলাদেশ বুঝেছে এর গুরুত্ব, তাঁরা আমাদের কাজটা করে দিচ্ছেন। আমাদের এখানে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পর জার্মান অনুবাদের ধারা শুকিয়ে গেছে। সুব্রত সাহা চেষ্টা করছেন। ফরাসিতে অরুণ মিত্র, পুষ্কর দাসগুপ্ত, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের পর শুকিয়ে গেছে ধারা। আমি চেষ্টা করেছি। এখন কেউ কেউ চেষ্টা করছেন যেমন চিরঞ্জন চক্রবর্তী বা পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়। স্প্যানিশ থেকে মানবেন্দ্রবাবু বহুবছর অনুবাদ করেছেন যদিও তা মূল ভাষা থেকে নয় বলেন অনেকেই। মূল ভাষা থেকে না হলে তা আর অনুবাদ থাকে না, অনুকথন হয়ে যায়। অসামান্য কাজ করেছেন শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ ঘটক। কাজ একেবারে হচ্ছে না তা নয় কিন্তু ইংরাজির মাধ্যমে অনুবাদ হবে না।
আমি মাঝে কিছু হাইকু অনুবাদের চেষ্টা করেছিলাম যেহেতু জাপানি জানি না তাই ওই তিনটি বাক্যের অনুরণন প্রাণপণে ধরার চেষ্টা করলেও মনে হয় না তা সার্থক। তাই অনুবাদের দায় যতক্ষণ না আসছে বানিয়ে বানিয়ে হবে না। অন্নদাশঙ্কর রায় একবার বলেছিলেন লেখনী হচ্ছে লেখকের রক্ত। লেখনীকে তৈরির জন্য সারা বিশ্বের সঙ্গে যেভাবে যুক্ত হতে হবে সেই পদ্ধতিটার নাম অনুবাদ।
তবে আরেকটি বিষয়ও বলতে হবে। অনুবাদ হচ্ছে না তার আরেকটা কারণ অনুবাদকের কোনও সম্মান নেই। অনুবাদকের কোনও পারিশ্রমিক নেই। কীভাবে সম্ভব দিনের পর দিন বিনা পারিশ্রমিকে পরিশ্রম করার? এ তো অনুচিত। একটা বই কোনওভাবে করা গেলেও দ্বিতীয় বই করা সম্ভব না। এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি কেউ ভাবেন না। কেউ বোঝেন না দেরিদার একটি বই অনুবাদ করতে গিয়ে যে পরিশ্রম করতে হবে, নিজে একটি বই লিখতে তত পরিশ্রম করতে হয় না। বাংলাভাষায় শব্দের অভাব আছে, স্বীকার করতেই হবে। ফরাসিতে যেমন, আমি ক্লান্ত- এই কথাটা চল্লিশভাবে বলা সম্ভব। কিন্তু এগুলো বাংলায় আনা সম্ভবই না। বাংলায় শব্দ নেই, শব্দ নির্মাণ করতে হবে। বাংলায় কয়েকজন নতুন শব্দ নির্মাণ করছেন। আমিও করছি। কিছুকাল আগে বাংলাদেশে গেছিলাম, একজন আমাকে বললেন, তিনি দ্বন্দ্বরক্তিম শব্দটা আমার থেকে ধার নিয়েছেন। শব্দকে রক্তদীপময় করার জন্য একটা সংবেদনশীলতা লাগে। আর লাগে শব্দ। সমার্থক শব্দকোষ অশোক মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য কাজ। কিন্তু যদি উল্টে দেখি, অনেক শব্দই আমরা ব্যবহারই করতে পারব না। ভাষার তো নানার ধরন, কোনও ভাষা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষা, কোনও ভাষা কথ্যভাষা, কোনওটা চলতি, কোনওটা অপভাষা। কিছুদিন আগে লোক্লেসিওর একটি উপন্যাস অনুবাদ করতে গিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। ৮০ পাতার পর অনুবাদ করতেই পারছি না। এত শক্ত! এত দীর্ঘ বাক্য যেন আমার গলা টিপে মারতে আসছে। অনুবাদ ছাড়া বাঁচব না, ডন কুইকজোট না পড়লে আমরা কত কিছুই জানতাম না। ফরাসিরা তো শেক্সপিয়র ফরাসিতেই পড়েছে, আমাদের মতো ইংরাজিতে না, জার্মানরাও তাই। কিন্তু পাশাপাশি এই সমস্যাগুলির কথাও ভাবতে হবে। অনুবাদের আর্থিক দিকটিও ভাবতে হবে। কয়েকটি কাজের পরে নাহলে কোনও কাজই করা যাবে না। সারাদিনের অধ্যাপনা করার পর, খাতা দেখার পর ভোরবেলা অবধি অনুবাদের কাজ আমি করেছি। রোমা র্যঁলার চিঠি অনুবাদ করতে করতে যক্ষারোগে আক্রান্ত হই। না খেয়ে কাজ করছিলাম। এভাবে সম্ভব নয়।
ভাষা শেখার পরিশ্রমও করে না কেউ। অনুবাদ এক দীর্ঘ সাধনা। "আমার পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে" এই বাক্যটা ফরাসিতে অনুবাদ করতে গেলে কতটা ফরাসি জানতে হবে! ট্রান্সলেটিং ইন অর্থাৎ বিদেশি ভাষা থেকে ভারতের ভাষায় অনুবাদ করা সহজ। দুই ভাষাতেই পারঙ্গম হতে হবে ঠিকই, তবু মাতৃভাষায় অনুবাদ সহজ। কিন্তু ট্রান্সলেটিং আউট অর্থাৎ বিদেশি ভাষাতে অনুবাদ করা অনেক শক্ত। আমি নিজে ভালো ফরাসি বলি বলে একটা খ্যাতি আছে। স্বয়ং দেরিদাও বলেছেন আমি ঈশ্বরের মতো ফরাসি বলি ইত্যাদি, কিন্তু আমিও ফরাসিতে অনুবাদ করতে সাহস পাই না। তার কারণ হচ্ছে, ভাষার মধ্যে কিছু অবচেতন উপাদান থাকে যেটা একজন বিদেশের মাটিতে বহুকাল বাস করা মানুষ ছাড়া ছুঁতে পারা সম্ভব নয়। তাই দেখা যায়, অলোকরঞ্জন দাসগুপ্তই হোক, অরুণ মিত্রই হোক এরা কেউই ট্রান্সলেটিং আউট করেননি। অলোকরঞ্জন এতদিন জার্মানিতে থাকলেও সেই ভাষায় অনুবাদ করতে সেই আরাম পাননি। আমিও চেষ্টা করলে বিদেশিদের অনুবাদে খুশি করতে পারব না। সেটা তাঁদের মাতৃভাষা। একজন বাঙালি যেভাবে 'ও কেটে পড়ল' কথাটার অর্থ জানে একজন ফরাসি মানুষ সেই প্রকৃত অর্থ ধরতে পারবেন না।
আরও পড়ুন- বাংলা ভাষা বাঁচাতে বাংলাপক্ষ আদৌ প্রয়োজনীয়?
অনেকেই প্রশংসা করে বলেন, "কী ভালো অনুবাদ করেছো একদম অনুবাদ বলে মনেই হচ্ছে না"। এই কথাটার কোনও মানেই নেই। অনুবাদ বলে মনে হচ্ছে না যেটাকে সেটা অনুবাদই নয়। ইতালিয়ান রিসার্তো তো ইতালিয়ান রিসার্তোর মতোই খেতে হবে, সে তো ছেঁচকির মতো হবে না। সুতরাং কথাটা ভুল। আমরা ভুলে যাই আমরা অন্য সংস্কৃতির এক লেখাকে আরেক ভিন্নভাষায়, ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। প্রচণ্ড শক্ত কাজ। তা করতে গিয়ে যদি বাংলা ভাষার মতোই হয়ে যায় তাহলে ক্ষতি হবে প্রচুর। বিদ্যাসাগর নাম পাল্টে ভ্রান্তিবিলাস করে দিয়েছিলেন ঠিকই তখন, তবে আর তা করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, পৃথিবীর কোনও দেশে মূল ভাষা না জেনে অনুবাদ করা নিষিদ্ধ, একমাত্র কলেজস্ট্রিট ছাড়া! সেখানে না জেনেই সব করা যায়। একটা উদাহরণ দিই। এক রাজনৈতিক মহাসম্মেলনে এক ইংরেজ বলেছিলেন, “আই অ্যাম অন আ স্টিকি উইকেট"। ওরা ক্রিকেট খেলে, ফরাসিরা তো ক্রিকেট খেলে না। তাহলে সে কী বলবে? “আমি সমস্যায় পড়েছি", "আমি খুব খারাপ বিছানার চাদরের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি" - এবার এর অনুবাদ যে করবে বিছানার চাদর হিসেবে সে তো আর জানবেই না যে আসল কথাটা ছিল 'স্টিকি উইকেট'! অন্যভাষার মাধ্যমে অনুবাদ নৈব নৈব চ!
বাংলাদেশে অনুবাদ হচ্ছে অনেক বেশি। আমাদের এখানে কিছু দূতাবাস অনুবাদে সাহায্য করে। তামিল, তেলগু, মালয়ালম, হিন্দি প্রচুর এগিয়ে গিয়েছে। আমি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক রম্যাঁ রল্যাঁ অনুবাদ পুরস্কারের জুরি সদস্য, তাই আমি জানি বাংলা এখন হিন্দির কাছে কিছুই না। মণিকা সিং অনুবাদ করেছেন প্যাত্রিক মদিয়ানো, যার ধারেকাছে বাংলার কোনও অনুবাদ আসতেই পারবে না। তাহার বেনজেলুন অনুবাদ হচ্ছে তামিলে! ভাবা যায়! আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রদেশ। অনুবাদের অর্থনীতি লাগে, পড়াশোনা লাগে। পড়াশোনা সত্যিই গোল্লায় গেছে। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে বলার মতো লোক কলকাতায় ক'জন আছে? কতজন মূলভাষা পড়ে বলতে পারবেন, লাতিন আমেরিকায়, চিলিতে কী হচ্ছে। আমাকে দিল্লিতে শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে যেতে হবে বা বাংলাদেশে রাজু আলাউদ্দিনের কাছে। লোকের সংখ্যা কমছে। ২০-২১ বছরে আমরা ইংরাজি শিখতে পারি না, পাঁচ বছরে কীভাবে, জার্মানি, ফরাসি, মালয়ালম শিখব? দেরিদা বলেছিলেন, অনুবাদককে দোষ দেওয়া অন্যায় কারণ তিনি সবসময়ই ভুল করবেন। কারণ কোনও কিছুই অনুবাদনীয় নয়, এক একটা বাক্য এক এক ভাষায় এক এক ভাবে অনুরণিত হয়। অনুবাদ আমাদের বেঁচে থাকার প্রার্থনা, বেঁচে থাকার আবেদন।