বোনেরা চাইছে মুক্তি|| কমলা ভাসিনের বাজনার বোল থেকে কবিতার বোলচাল

Kamala Bhasin Poetry: ছোটখাটো চেহারার মহিলা ডাফলি হাতে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন করিডরে। 'আজাদি' স্লোগান দিতে দিতে বলছেন, এটাই তাঁর পেপার।

গত শতাব্দীর নয়ের দশকে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওম্যান স্টাডিজ বিভাগগুলির সেমিনারে একটা দৃশ্য খুব পরিচিত ছিল। রাশভারী সব পেপার পড়া হচ্ছে। সবাই খুব গুরুগম্ভীর মুখে বসে আছেন। হঠাৎ করিডর থেকে রাজস্থানি ঢোল ডাফলির আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করত।  এক ছোটোখাটো চেহারার মহিলা ডাফলি হাতে স্লোগান দিয়ে  যাচ্ছেন করিডরে। 'আজাদি'  স্লোগান  দিতে  দিতে বলছেন যে এটাই তার পেপার। স্বভাবরসিক এই মহিলা নারীবাদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাই বলে বসেন," আমি ফেমনিস্ট। আমাকে ভয় পাবেন না। আমি হাসি। আমি পুরুষদের ঘেন্না করি না। পুরুষদের নারীবাদের পরিসরে স্বাগত জানাই"।  মুখে লেগে থাকা হাসি নিয়েই সারাজীবন তিনি ভারতীয় নারীবাদের মুখ হয়ে রইলেন। তিনি কমলা ভাসিন। আধা-গ্রামীণ রাজস্থানে বেড়ে ওঠা একজন মহিলা, যার শিক্ষাগত যোগ্যতা অসাধারণ ছিল না, যাঁর ব্যক্তিগত জীবন বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে ভারাক্রান্ত,  তিনি কীভাবে নারীবাদ নিয়ে ক্রমাগত কথা বলে, নারীবাদী প্রোপাগান্ডা কবিতা লিখে লোকের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলেন? একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি জগৎ ঘুরে বেড়ানোর বিরল ক্ষমতা তাঁর ছিল। ব্যক্তিগত থেকে রাজনৈতিক; স্থানিক থেকে আন্তর্জাতিক; আধ্যাত্মিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষ; বাজনার বোল থেকে শব্দের বোলচাল।

ইতিহাসের তিনটি  সন্ধিক্ষণ তাঁর মনন গড়ে তুলেছে : স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশভাগের ট্রমাগ্রস্ত  ভারত,  সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজিম এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির দক্ষিণ এশিয়া। ভারত নামক একটি দেশের সাথে প্রায় একই সময়ে জন্মেছেন কমলা।তিনি এমন এক প্রজন্মের নারী ছিলেন যারা হয়তো স্বাধীনতার স্বাদ প্রথমবারের মতো পেতে শুরু করেছিল।  রাজস্থানের একটি ছোট শহরে পাঁচ ভাইবোনের পরিবারে বেড়ে ওঠার কথা বলার সময় কমলা বারবার আকাশে বাতাসে টাটকা দেশপ্রেমের ঘ্রাণের উল্লেখ বারবার করেছেন। তার বাবা রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে কর্মরত সরকারি ডাক্তার। বাবার পেশার সূত্রে কমলার বড় হয়ে ওঠা রাজস্থানের গ্রামগুলিতে। এই মেয়েবেলা তাঁকে ভারতীয় গ্রামীণ নারীকে বুঝতে অনেক সাহায্য করেছিল। তাঁর মা প্রথাগত শিক্ষিত ছিলেন না, তবুও  আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। এতটাই যে কমলা ভাসিন ইয়ার্কি করে প্রায়শ বলতেন মা স্কুলে গেলে সেই স্কুলের মাস্টারমশাইরা নিশ্চিত স্কুল ছেড়ে পালিয়ে যেতেন।  নিজের স্কুল নিয়েও মশকরা করেছেন সারাজীবন। ভাসিনের ভাষ্যে তাঁর পড়াশুনা শুরু ‘টাঙ্গে কে আড্ডেওয়ালি পন্ডিতজি কি পাঠশাল’, যেখানে একটি  ঘর, একটি বারান্দা  এবং আকাশভর্তি স্বপ্ন ছিল। রাজস্থান থেকে স্নাতকোত্তর পড়াশুনার শেষে কমলা পশ্চিম জার্মানির মুন্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উন্নয়নের সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা শুরু করেন।  পরবর্তীতে, ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে, জার্মানি থেকে  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পরে, এক বছরের মধ্যে গ্রামীণ রাজস্থানকে ঋণ মেটাতেই যেন ফিরে আসেন।‘সেবা মন্দির’ সংস্থার হয়ে নারীর সমাজ কল্যাণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

ইউরোপীয় ধাঁচায় সমাজবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমলা কিন্তু টিপিক্যাল ইউরোপীয় ধাঁচায় ভারতকে বিশ্লেষণ করতে একেবারেই উৎসাহিত ছিলেন না। ‘কাস্ট’কে ভারতীয় নারীবাদের অন্যতম প্রেক্ষিত হিসাবে চিহ্নিত করে এগোয় কমলা ভাসিনের নারীবাদ।নিজে “সাবর্ণ” হয়েও  তিনি এখানেই সাবর্ণ নারীবাদীদের তুলনায় আলাদা।  ‘সেবা মন্দির’-এর হয়ে কাজ করতে করতেই তাঁর আলাপ হয় বলজিৎ মালিকের সঙ্গে। স্বঘোষিত নারীবাদী বলজিৎ কমলার প্রেমে পড়েন, বিয়ে হয় এবং সন্তানদের পদবি রাখা হয় মা-বাবা দুইজনের তরফ থেকেই। কিন্তু এই বিয়ে স্থায়ী ভাবে সুখের হয়নি কমলার পক্ষে। গৃহহিংসা ও  বিশ্বাসহীনতার হেতু দীর্ঘদিন পরে বিয়ে ভেঙে যায় । জাতিসংঘের খাদ্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের হয়ে  দীর্ঘদিন কাজ করেন কমলা। ১৯৮৪ সাল থেকে চালু করেন ‘সঙ্গত’। ‘সঙ্গত’ সেই বিরল নারীবাদী সংগঠনগুলির একটি যারা নারীদের নারী অধিকার, লিঙ্গ সাম্য, নারীবাদ, সামাজিক ন্যায়, গণতান্ত্রিক অধিকার, নারীবাদী লেখা ইত্যাদি অতি জরুরি বিষয় নিয়ে এক মাসের সংক্ষিপ্ত পাঠক্রমের কোর্স করিয়ে আসছে চল্লিশ বছর ধরে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আরেকটি সংগঠন ‘জাগরী’তেও কমলা ভাসিনের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।নারীবাদের উপর কমলা ভাসিনের তাত্ত্বিক কাজগুলি ভারতবর্ষের নারীবাদের ক্ষেত্রে ক্লাসিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।

 ১৯৭০-এর  সময়ের কমলার একটি  ফটোগ্রাফে আমরা দেখতে পাই  তার পাশে  রাজস্থানী ঢোল ‘ডাফলি’  এবং  রাজস্থানি ফোক শিল্পীরা তার চারাপাশে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছেন। এই ফোটোগ্রাফ যেন কমলা ভাসিনের শিল্প ও রাজনীতির প্রতীক হয়ে রয়েছে।  রাজস্থানী লোকগান , তার উচ্চকিত মেজাজ, তার তথাকথিত  চড়া দাগের মজা এসব কিছু নিয়ে  যেন  তৎকালীন ভারতের ইউরোপ কেন্দ্রিক মননের ভারতীয় নারীবাদীদের বিপ্রতীপ এক মেরু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কমলা ভাসিন।  অতি সাধারণ জীবনচর্যার ভারতীয় নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার ফলে  জাত, শ্রেণি এবং সামন্তবাদ আসলে ঠিক কেমন তা অনেক সহজে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ভাসিন। তবে সবচেয়ে বেশি করে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে নির্যাতিতদের মধ্যে মহিলারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, এমনকি প্রান্তিক নির্যাতিতরাও মহিলাদের উপর নির্যাতন করে।

কমলা নিজের জীবন থেকে,  নিজের চারপাশ থেকে নারীবাদের রাজনীতি খুঁজেছেন বরাবর।   রাজস্থানের পশ্চিমাঞ্চলে তাঁর মোটরসাইকেল চালানো তাই র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ হিসাবেই আমরা দেখব। সেই রাজস্থান যেখানে নারীরা ঘোমটা দিয়েই কাটিয়ে দেয় পুরো একটা জীবন।  কমলা ভাসিনের জন্য, নারীবাদ কখনোই মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।  শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় আটকে থাকার জন্য বা শুধুমাত্র নারীকেন্দ্রিক ঘটনা হয়ে ওঠার দায়ও ছিল না তাঁর নারীবাদের । তাঁর মতে সংবেদনশীল পুরুষরাও  পিতৃতন্ত্র দ্বারা নির্যাতিত।  তার জন্য নারীবাদ ছিল বাতাসের মতো—যে বাতাস  মানুষ সর্বত্র  অনায়াসে বুক ভরে  নিতে পারে।  ভাসিনের কাছে নারীবাদ তাই একটা  উদযাপন এবং এই উদযাপন  এই উপমহাদেশে হাসি-গান ছাড়া হতেই  পারে না। কমলা ভাসিন তাই যখন কবিতা লেখার সচেতন সিধান্ত নিয়েছিলেন, সেই দিন থেকেই সেই কবিতা চর্চার মূল সুরটি গাঁথা হয়ে গিয়েছিল: নারীর অধিকারের জন্য সোচ্চারিত প্রোপাগাণ্ডা। সেই প্রোপাগান্ডারই অংশ  হিসাবে আমরা যখন কোনো কবিতাই দেখি সন্তানের পায়খানা পেচ্ছাপ মাখামাখি হয়ে থাকা ‘ল্যাঙ্গোট’ খুলিয়ে পরিস্কার ‘ল্যাঙ্গোট’ পরাচ্ছে এক অপ্রস্তুত বাবা, আমরা হেসে উঠি এবং হাসতে গিয়ে আবিষ্কার করি হাসিটা আসলে কান্না।

 তিনি কবিতাচর্চা করেছেন মেয়েদের এই হাসি-কান্না মিশে থাকা প্রেক্ষিত থেকেই। তার কবিতা্র সোচ্চারে প্রোপাগান্ডা আসলে খুব সাধারণ মেয়ের গলার স্বর । যে গলার স্বরকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চেপে রাখা হয়েছে। যে স্বর নির্ভার এক স্বাধীনতা চায়। চায় স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার। তাই গত শতাব্দীর আটের দশকে পাকিস্তানি নারীবাদীরা যে ‘আজাদি’ স্লোগান দিয়ে জিয়া-উল-হকের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছিল সেই স্লোগানে কমলা যখন নিজের দুই-তিনটি লাইন জুড়ে  দেন সেই তিনটি লাইনই নারীমুক্তির মহাকাব্য হয়ে ওঠে। কমলা ভাসিন সেই প্রোপাগান্ডা কবিতা লিখেছেন যা না লিখলে একটি মেয়ে তার শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তার জীবনের স্বাধীনতার পরিধি কমে আসে, গৃহস্থালি কাজকর্মে কেবল তার নিজেকে উৎসর্গ করার পিতৃতান্ত্রিক অভ্যাস গড়ে ওঠে। কমলা ভাসিনের কবিতা জীবনের নিয়মেই, প্রতিবাদের নিয়মেই, পরিবর্তনের নিয়মেই কাব্য।

 

আজাদি’ ( ‘মুক্তি’) স্লোগানে কমলা ভাসিনের সংযোজন

 

আমার বোনেরা চাইছে মুক্তি 

প্যাট্রিয়ার্কি থেকে মুক্তি

ফ্যামিলি থেকে মুক্তি  

সব বন্ধন টুটে ওই দেখো

বোনেরা আসছে… 

 

আমরা, মেয়েরা

 

আমরা, মেয়েরা, শিকড়বাকড়ের মতো

 নিজস্ব শিকড়বাকড়ও আছে আমাদের

 এইসব শিকড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকি সোজা

তাদের জন্যই, এত লড়েছি আর

নিঃশব্দে এগিয়ে এসেছি

ওরা আমাদের উপরটা কেটে দেয়

আমরা আরো বাড়ি আর ছড়িয়ে পড়ি নrচ থেকে। 

যেসব শিকড়বাকড়ের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা

তাদের সাথে জুড়তেই থাকব 

নড়িয়ে দেব ভিত আর

শোষনের ইমারত ।

 

বাড়ন্ত মেয়েরা

 

মেয়েরা বাতাসের মতো হয়ে যাচ্ছে,

তারা খোলা মনে তিড়িংবিড়িং ভেসে আনন্দ পায়। 

বিনা কারণে আটকে দেওয়া, মানতে পারে না।  

মেয়েরা হয়ে যাচ্ছে ফুলের মতো,

আনন্দ পায়  সুঘ্রাণ ছড়িয়ে। 

নিষ্ঠুর ভাবে দুমড়ে দেওয়া,

তারা মানতে পারে না। 

 

মেয়েরা হয়ে যাচ্ছে পাখির মত,

আনন্দ পায় মুক্ত আকাশে উড়ে।

ডানা আটকে দেওয়া, 

তারা মানতে পারে না। 

 

মেয়েরা সূর্যের মতো হয়ে যাচ্ছে, 

তারা আলো ছড়িয়ে আনন্দ পায়। 

পর্দা দিয়ে দমবন্ধ করা,

তারা মানতে পারে না। 

     আর…

মেয়েরা হয়ে যাচ্ছে পর্বতদের মতো,

তারা মাথা উঁচু রেখে আনন্দ পায়।

 তাদের মাথা ঝুঁকিয়ে বাঁচা , 

 তারা মানতে পারে না। 

 

কারণ আমি একজন মেয়ে, আমি পড়বই

 বাবা তার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে:

পড়বে? তুমি কেন পড়বে? 

পড়াশুনা করার জন্য আমার ছেলেরা আছে, তুমি কেন পড়বে?

 

মেয়ে তার বাবাকে বলে: 

যেহেতু তুমি জিজ্ঞেস করলে, তাহলে এই রইলো খতিয়ান কেন আমি পড়বই।

কারণ আমি একজন মেয়ে, আমি পড়বই। 

 

দীর্ঘকাল এই অধিকার অস্বীকৃত থেকেছে, আমি পড়বই

আমার স্বপ্নের উড়ানের জন্য, আমি পড়বই

জ্ঞান নতুন আলো আনে, তাই আমি পড়বই

কারণ আমি একজন মেয়ে, আমি পড়বই। 

 

 রিক্ততা এড়াতে, আমি পড়বই

 স্বাধীনতা পেতে, আমি পড়বই

 হতাশার সাথে লড়তে, আমি পড়বই

 অনুপ্রেরণা পেতে, আমি পড়বই

 কারণ আমি একজন মেয়ে, আমি পড়বই। 

 

পুরুষের হিংস্রতার সাথে লড়তে, আমি পড়বোই

আমার নৈঃশব্দের সমাপ্তি ঘটাতে, আমি পড়বোই

পিতৃতান্ত্রিকতাকে প্রতিস্পর্ধা দেখাতে, আমি পড়বোই

সমস্ত উচ্চনীচ বিভাজন  গুঁড়িয়ে দিতে, আমি পড়বই

কারণ আমি একজন মেয়ে, আমি পড়বই। 

 

একটা বিশ্বাসের,আমার ভরসার  ছাঁচ  গড়তে, আমি পড়বই

ন্যায়সঙ্গত আইন বানাতে, আমি পড়বই

শতাব্দী পর শতাব্দীর ধূলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে, আমি পড়বই

 প্রতিস্পর্ধা দেখাতে আমি যা করবোই, আমি পড়বই

কারণ আমি একজন মেয়ে, আমি পড়বই। 

 

ঠিক ভুল জানতে, আমি পড়বই

দৃঢ় স্বর খুঁজে পেতে, আমি পড়বই

নারীবাদী গান লিখতে, আমি পড়বই

মেয়েদের দুনিয়াদারির দুনিয়া গড়তে, আমি পড়বই

কারণ আমি একজন মেয়ে, আমি পড়বই।

More Articles