আলিপুর চিড়িয়াখানায় দুপুর কাটাতেন জীবনানন্দ

Jibanananda Das & Alipore Zoo: মৃগ, চিতা, বনহংস, সিংহ, সমুদ্র সারস, ঘোড়া, চিল, পেঁচা, উট, বাঘিনী- এত বন্য পশুপাখি আর কোনও কবির রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় না।

আলিপুর চিড়িয়াখানায় দুপুর কাটাতেন জীবনানন্দ। এই তথ্য মনটাকে এলোমেলো করে দেয়। ঠিক কী দেখতে যেতেন জীবনানন্দ? কোনও সন্দেহ নেই, নগর শহর বা সিটির পরের উচ্চতর আয়তন হলো মেট্রোপলিস। এই মেট্রোপলিসের নানা বৈশিষ্ট্য। শব্দটির গ্রিক উৎসের দিকে তাকালে খানিকটা হয়তো বোঝা যেতে পারে। গ্রিক ভাষায় মেটের্ হলো মা। আর ‘পোলিস’ হলো শহর। যে কোনও শহরই নয়, মেট্রোপলিস অতিকায় সেই মহানগর, যে অনেক শহরাঞ্চলকে একাই ধারণ করে আছে। মায়ের মতো পালন করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই, আমরা জানি, কলকাতা ক্রমশ তার আয়তন স্ফীত করছিল। নতুন নতুন এলাকায় জনবসতি স্থাপন হচ্ছিল। তার ওপর নানা জাতি-বর্ণের মানুষ ভাত-কাপড়ের টানে, যুদ্ধের কারণে, আন্তর্জাতিক ব্যবসার আকর্ষণে কলকাতায় এসে জড়ো হচ্ছিল। সে সময়ের বিখ্যাত আত্মকথা বা অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল এই তল্লাট। এমনকী কথাসাহিত্য-কবিতা-নাটকের পটভূমি হিসেবে দেখা দিচ্ছিল ভিন্ন এক শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই কলকাতায় বসবাস করছিল মার্কিনি সৈন্য, ব্রিটিশ নরনারী তো বটেই, এমনকী চিনা বা জাপানি, শ্রীলঙ্কা বা বর্মার মানুষজন। দেখা যেত জার্মান বা লাতিন আমেরিকান লোকজনকেও। আন্তর্জাতিক একটা মহানগর হয়ে উঠেছিল কলকাতা। নাগরিকতার ভালোমন্দ সব চিহ্ন স্পষ্ট দেখা দিয়েছিল তার শরীরে। জীবনানন্দের কবিতায় সেই অলিগলি, রাজপথ, ট্রামের শব্দ, বাস-গাড়ি-লরি-ট্রাকের কলকাতা, রহস্যময়, কুয়াশা, ল্যাম্পপোস্ট আর ভিখিরির কলকাতা একটা কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে ফুটে উঠেছিল। এই মহানগরীরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো চিড়িয়াখানা। শহর কলকাতায় চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৭৬ সালে। আলিপুরে এই চিড়িয়াখানা স্থাপনের আর্জি জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’! যদিও গালভরা নাম ‘জুলজিকাল গার্ডেন’ – কিন্তু প্রধান উদ্দেশ্য মহানগরের জনবৃত্তের মনোরঞ্জন। গ্রামাঞ্চল এবং প্রকৃতির ওপর প্রভুত্বের প্রতীক শহুরে চিড়িয়াখানা। এখানে অসহায়, বন্দি প্রাণীরা পণ্যের মতো ঘরে-ঘরে সাজানো। আমরা নাগরিক ব্যক্তিবর্গ টিকিট কেটে, অর্থের বিনিময়ে তাদের দেখতে ঢুকি। চিড়িয়াখানা তো সেই অর্থে প্রতীক। কীসের? প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের। কৃত্রিম পরিবেশে খাঁচায় প্রতাপান্বিত বাঘ-সিংহ-গণ্ডার-জিরাফ পুরে তাকে দেখার আনন্দ স্বাভাবিক কি? উল্টোদিকে আমার তো চিড়িয়াখানার হরিণ থেকে ধনেশপাখি, কুমির কিংবা চিতাবাঘ বা জেব্রাদের দেখে ওদের জন্য খুব কষ্ট হয়। সার্কাসে এবং রাস্তায় খেলা দেখানোর জন্য যদি কোনও পশুকে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হয়, যেমন সাম্প্রতিককালে হয়েছে, তাহলে চিড়িয়াখানার পশুদের ক্ষেত্রেও হবে না কেন? শহুরে মানব শিশুর আনন্দের এবং উত্তেজনার মাশুল দেয় ওইসব বন্দি পশুপাখি। মাফ করবেন, আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয়, জারোয়াদের এক দ্বীপে রেখে, ‘সভ্য’, ‘অর্থবান’, ‘উচ্চবর্গ’ পর্যটকদের তাদের দূর থেকে দেখানোও একধরনের ‘চিড়িয়াখানা’ বানানোর প্রক্রিয়া। এ অবশ্য পাশাত্যের অনেক দেশেই আছে। শুধু এক্ষেত্রে পশুপাখির বদলে ‘আদিবাসী’। আমরা আবার মানবমুক্তি, শোষণমুক্তি, সাম্য, মানবাধিকার নিয়ে বাংলা-ইংরেজি নানা ভাষায় নিবন্ধ, ভাষণ, গ্রন্থ লিখি, পরিবেশন করি! চোখের সামনে এমন ঘটনায় প্রতিবাদ করি না। কখনও কখনও ট্যুরিস্ট হিসেবে দেখতে যাই। এ কত বড় অমানবিকতা, সেটা ভেবেও দেখি না।

আরও পড়ুন- জীবনানন্দ তৃতীয় নয়নে দেখেন বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা

ফিরে যাই জীবনানন্দের কাছে। আমার অনুমান, জীবনানন্দ ওইসব বন্দি পশুপাখিদের সান্নিধ্যে হয়তো নিজস্ব অস্তিত্বের বেদনা অনুভব এবং ভাগাভাগি করতেন। আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে জীবনানন্দের কবিতায় এবং বেশ বড় করে কথাসাহিত্যে, প্রকৃতি আর গ্রামজীবনের ফেলে আসা স্মৃতি বারংবার দীর্ঘকাল মেঘে ঢুকে পড়ে। অথচ, একথাও সত্যি যে, কলকাতা শহরের নেশাও জীবনানন্দ ছাড়তে পারেন না।

চিড়িয়াখানায় আরও এক গভীর আকর্ষণ হলো, পশু পাখিদের গর্জন, সুরেলা গান বা হাঁকডাক। একদা ধর্মতলা থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি যাওয়ার পথে ব্রিজের মুখ থেকে শোনা যেত হাতির ডাক, দেখাও যেত তাদের। আমি নিজেই দেখেছি, শুনেছি। সেই শব্দ এবং দৃশ্যকে একটি বিশেষ শব্দ দিয়েই বোঝানো যায়, পরাবাস্তব বা স্যুররিয়াল! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘কেকাধ্বনি’-র কথা। ১৯০২ সালে লেখা সেই প্রবন্ধ শুরুই হচ্ছে ‘গৃহপালিত’ ময়ূরের ডাক নিয়ে আলোচনায়। ওই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলতে চাইলেন, ‘গৃহপালিত’ ময়ূরের ডাক কর্কশ লাগে, কেননা তার পরিপ্রেক্ষিত কৃত্রিম। প্রকৃতির সঙ্গে ময়ূর এবং অন্যান্য পশুপাখির সম্পর্ক স্বাভাবিক। সুতরাং, বিচ্ছিন্নভাবে কোনও পশুপাখির ডাক মোটেই শ্রুতিমধুর বা আচ্ছন্ন করার মতো নয়। সে এক স্থান-কালের পশ্চাৎভূমিতেই সুন্দর। কোনও রিজার্ভ ফরেস্ট বা জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্যেও মানুষ জিপ বা অন্য গাড়ি নিয়ে পশুর পশ্চাদ্ধাবন করে। সেও খুব ভালো কথা নয়। তবু পশুপাখি সেখানে মুক্ত। কিন্তু, চিড়িয়াখানায় পশুপাখি দ্রষ্টব্য বস্তু। তাঁরা লোহার খাঁচায় বন্দি। ইতিহাসের দিকে তাকালে অবশ্য বোঝা যায় ইওরোপের দীপায়ন যুগ বা এনলাইটমেন্ট যুগের ‘অবদান’ এই চিড়িয়াখানা। রাষ্ট্রশক্তি প্রযোজিত, শহরের মানুষের উপভোগের জিনিস হিসেবে চিড়িয়াখানা, শ্বেতকায় মানুষের ক্ষমতা প্রদর্শনেরই একটা ফিকির। বিশ শতকের গোড়ার দশকগুলিতে ইওরোপ এবং আমেরিকায় ‘হিউম্যান জু’ তৈরি করা হয়েছিল। বিশেষত, আফ্রিকা থেকে, এছাড়া অন্যান্য পরাধীন দেশ থেকেও আদিবাসীদের এনে জনসমক্ষে দেখানো হতো। এমনকী বাঁদর থেকে ‘শ্বেতাঙ্গ’ মানবে পৌঁছনোর ‘মিসিং লিঙ্ক’ হিসেবে প্রদর্শন করা হতো কালা মানুষদের। হাজার-হাজার ‘শিক্ষিত’ ব্রিটিশ-বেলজিয়ান-আমেরিকান-জার্মান মানুষ সেই অর্ধোলঙ্গ ক্ষুধাতুর মানুষকে দেখতে আসতো। একেই হয়তো বলে ‘বীভৎস মজা’।

জীবনানন্দের কবিতা জুড়ে প্রথম থেকে অন্তিম যুগ পর্যন্ত এত মৃগ, চিতা, বনহংস, সিংহ, সমুদ্র সারস, ঘোড়া, চিল, পেঁচা, উট, বাঘিনী – মৃত্যু, অসহায়তা আর হিংস্রতার রক্তদাগ। এসব কি তাঁর চিড়িয়াখানার অভিজ্ঞতার প্রভাব? ‘মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়!’ অথবা ‘হায়, সোনালি বাঘ-প্রেত,/ তোমাদের জন্য শুয়োরের মাংস/ শুয়োরের মাংস শুধু,/ মৃত্যু তোমাদের ফেলে দিয়েছে/ অন্ধকারের অচল অভ্যাসের ভিতর।’ এত বন্য পশুপাখি আর কোনও কবির রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় না।

অনুমান করি, জীবনানন্দ হয়তো জানতেন জার্মান কবি রাইনের মারিয়া রিলকের অভিজ্ঞতার কথা। রিলকের কবিতা জীবনানন্দের বিশেষ প্রিয় ছিল। তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের সঙ্গে তুলনীয় হিসেবে রিলকের নাম। ‘হোমারও কবিতা লিখেছিলেন, মালার্মে র‍্যাঁবোও রিলকেও’।

রিলকে কবিতা লিখতে একবার যেতে বাধ্য হলেন চিড়িয়াখানায়। রিলকের তখন বন্ধ্যা সময় যাচ্ছে। লিখতে পারছেন না কবিতা। তাঁর শ্রদ্ধেয় এবং উপদেষ্টা অগুপ্ত রোদ্যাঁ, খ্যাতকীর্তি ফরাসি ভাস্কর এবং শিল্পী, তাঁকে নির্দেশ দিলেন – ‘রিলকে, যাও চিড়িয়াখানায়। খাঁচার সামনে গিয়ে তাকিয়ে থাকো জন্তু জানোয়ারের দিকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দৃষ্টি রাখো ওদের ওপর’। কবি রিলকে তখন গেলেন চিড়িয়াখানায়। তারপর, লিখলেন সেই অবিস্মরণীয় কবিতা ‘দ্য প্যান্থার’। যে কবিতার গোড়াতেই বলা আছে, স্থান-নাম – ‘চিড়িয়াখানা, প্যারিস’। ‘চিতাবাঘ’ নামে তাকে অনুবাদ করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘সারি সারি শিং শুধু – দৃষ্টি তার যখনই যেদিকে,/ তাই ক্লান্ত, কিন্তু ধরা দেয় না সেখানে আর। ...’ এই কবিতার সঙ্গে একটা কথোপকথন লিখেছিলেন কবি টেড হিউজেস। অনুজ কবি তিনি। ব্রিটিশ। তাঁর চিড়িয়াখানা অভিজ্ঞতা থেকে লেখা কবিতাটির নাম ছিল ‘দ্য জাগুয়ার’। এখানেও বিষয় হিসেবে এল, বন্দিত্ব আর মুক্ত জীবনের সংখ্যাও। পশুদের বিবাদ। পশুদের শক্তি। মানুষের অন্যায়।

আরও পড়ুন- ‘ঘড়ির সময়’ আর ‘মহাকাল’ আমাদের বিস্ময়ে নির্বাক করে উড়ে যাচ্ছে

জীবনানন্দের ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর চিড়িয়াখানায় দিনের পর দিন সফর কোনও একটি বিশেষ কবিতার জন্ম দেয়নি। বরং তার অভিঘাত পড়েছিল অনেক দিন ধরে। ‘নীল দারুময়ী বাঘিনী/ অন্ধকার রাত্রি ঘিরে/ নিরাকুল সমুদ্রের মতো/ পাহাড়ের গুহায় গুহায় আবেগে স্ফীত হয়ে উঠছে’। অপার্থিব এইসব চিত্রকল্পের আলোয়-আঁধারে নতুন স্বরে কথা বলছিলেন কবি জীবনানন্দ।

শহর কলকাতা জীবনানন্দকে অদ্ভুত এক নেশায় পাকে পাকে বেঁধে ফেলেছিল। একথাও তিনি বুঝতেন, ধোঁয়া আর অপেয়ে ভরা মৃতনগরী থেকে তিনি পালাতে চান প্রকৃতির সমারোহে। তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে আরোও এক বিস্তীর্ণ বিস্ময়। এই মহাকাশ, এই নক্ষত্রমণ্ডলী, এই সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নীহারিকা। আবার, কলকাতার ভাঙাচোরা ইট-কংক্রিটে তিনি দেখেন সমকালকে। কলকাতা যেন জীবন্ত ব্যক্তির মতো দেখা দেয় জীবনানন্দের কবিতায়। তাঁর কবিতার পদক্ষেপে কলকাতা শহর, মেট্রোপলিস আর দমচাপা ভ্রূকুটি।

‘... অথবা ট্রামের/ রাঙা-নীল-আলো-ঈপ্সা/ রাত এগারোটা এলে শহরের/ নিরুত্তর-নিবিড়-বিদেশী মুখ/ পড়ে পাওয়া পথগুলো – খড়ির স্বাক্ষরহীন/ সুদীর্ঘ জানালা সব – (কোনো ক্রুশচিহ্নহীন)/ নিরুদ্ধ দরজাগুলো – (অননু মেয়ের মতো)/ অন্ধকার গলি - / গ্যাসের স্বর্গীয় আলো...’ (এই ঘর অবিকল)।

ফলে তিনি মেতে ওঠেন শহরের সঙ্গে গূঢ় সব সংলাপে –

‘অনেকক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে দেখি আমি/ চারদিকে পাখনা পালক/ পালক আর পাখনা/ কলেজের উঁচু উঁচু দেবদারু গাছের ভিতর ঘুরে যাচ্ছে;/ দেবদারু পাতার ফাঁক দিয়ে সোনার ডিমের মতো সূর্য/ রূপোর ডিমের মতো চাঁদ/ শিশির ঝরছে;/ কলকাতা?/ কলকাতা!’

একেবারে সংলাপের ভঙ্গিতে, প্রথমে আহ্বান তারপর শহর কলকাতার প্রতি বিস্ময়! এত আদরে, এত যত্নে, এত অনুভূতিরঞ্জিত কণ্ঠে আর কেই বা শহরকে ডাকতে পারেন কাছে, ঠেলে দিতে পারেন দূরে – জীবনানন্দ ছাড়া? শহর কলকাতার বিষামৃত বাংলা কবিতার শিরাধমনীতে ছড়াতে শুরু করলো দ্রুত। জীবনানন্দের প্রয়াণের পরেও। শহরের ওতপ্রোতে মনে পড়ল ভাস্কর চক্রবর্তীকে। তাঁর কবিতা কলকাতার অস্তিত্বে ছায়া ফেলেছিল। ভাস্করদার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। অলৌকিক একটা ট্রফি তাঁর জন্য বয়ে নিয়ে চলেছি সঙ্গোপনে।

(চলবে)

More Articles