মন চলো নিজ নিকেতনে
গভীর নির্জনতায় আমি পুরুষও নই নারী ও নই। আমি তবে কি? আমি আত্মস্থিত একটি বিন্দু।
একটি কবিতার বই হাতে এসেছে। শর্মিষ্ঠা মোহান্তির লেখা কাব্যগ্রন্থ। বইটির নাম: বুক ওয়ান। ক'দিন যাবৎ এই বইটি পড়ছি। বইটির প্রথম কবিতার নাম: Solitude. বাংলায় বললে-নির্জনতা। আমি বলব-আধ্যাত্মিক নির্জনতা। সজ্ঞানে সানন্দে সমাজবিচ্ছিন্ন একক হয়ে থাকার দার্শনিক অবস্থান। শর্মিষ্ঠা মোহান্তি লিখছেন,
"...They teach, they study,
they marry. I have done some of these things, not others
Why should I move? I feel little need to take my body and
myself out of this room, this house and out into
the world."
আমার স্বজনবন্ধুরা হাজার রকমের কাজ করে। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। পড়ে, পড়ায়, প্রেম করে, আরও কত কী করে, আমিও এসব জুতোয় পা গলিয়েছি কখনওসখনও। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে আমি আর এসবে জড়াতে চাইছি না। আমার শরীরটাকে, আমার মনটাকে আমি আমার ঘরের ভিতর থেকে বের করার প্রয়োজন অনুভব করতে পারছি না। শর্মিষ্ঠা মোহান্তির কবিতার এই মর্মার্থে ঘুরতে ঘুরতে চকিতে আমার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গান,
"দিনে মোর যা প্রয়োজন বেড়াই তারি খোঁজ করে,
মেটে বা নাই মেটে তা ভাবব না আর তার তরে"
কখন মন এমন একটা অবস্থানে পৌঁছয়? যখন সামাজিক সম্পর্কগুলি থেকে প্রত্যাশা ফুরোয়। যখন জীবনের চাওয়াগুলির বোঝা নামানোর আন্তরিক শক্তি আমরা পাই। যখন শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করার তাগিদ আর থাকে না। এই গানটির পরের অংশ তো সবারই জানা,
সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে
এসেছি সকল চাওয়ার বাহির-দেশে,
যে ঘরটির কথা শর্মিষ্ঠা মোহান্তি কবিতায় আনছেন তা সকল চাওয়ার বাহির দেশ। নিজের সঙ্গে সংলাপের সুব্যবস্থা। এখানে কিন্তু কোথাও একা হয়ে যাওয়ার ভয় নেই, একাকিত্বের যন্ত্রণা নেই, আছে 'একক' হওয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত, এবং তার মধ্যে দিয়েই মুক্তির সংকল্প। এই ঘরটা কেমন দেখতে? শর্মিষ্ঠা cave ( গুহা), Cell (কুঠুরি)- এই শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন। এই কুঠুরিতে কেমন কাটবে নিজের সঙ্গে নিজের দিন? শর্মিষ্ঠা লিখছেন-
"The evening comes, emptying out of me even the small
movements of heat and Harsh light. I seat alone. I lie alone.
There is only inside landscape. It has its own laws,
not that of the man made world, not even that of nature.
Perhaps I should not call it a landscape. it is more like
something that flies over and away from the dead earth of
circumstance and narrative of birth today."
এমন এক ঘর যেখানে বিকেলের পর আলো আর উত্তাপের ক্রমবদলটুকু নিয়েও মাথা ঘামাতে হয় না। এখানে একা বসার, একা শোয়ার অবকাশ আছে। প্রকৃতি আর মনুষ্যজীবনের নিয়ম এখানে খাটে না। জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে এই ঘর। আসলে আমরা সারাজীবন অন্যের মধ্যে নিজেকে সহস্র খণ্ডে বিলিয়ে দিই। কিন্তু তারপর সেই ভাঙা কাচ জুড়ে একক আমিটাকে খুঁজে পাওয়া হয় না। বাইরে তাকাই। অন্তর্গত যে আমি, যে এক, একক যে সমস্ত প্রথার বাইরে, তাকে খুঁজে পাই না। শর্মিষ্ঠার এই কবিতার ক্লান্তপ্রাণ দিনমানের সমস্ত বাজারসফর সেরে সেই একক আমিকেই খুঁজছে। খুঁজছে নিজের মুখোমুখি বসার অফুরান সময়। খুঁজছে মুক্তি। এই খোঁজেই সে ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। অন্তর্গত হচ্ছে। নিজের অনেক টুকরোগুলি জুড়ে এক হওয়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে রবীন্দ্রনাথের বহুশ্রুত গান অন্য মানে নিয়ে ধরা দেয় ফের।
"যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে--এই নিরালায় রব আপন কোণে।
যাব না এই মাতাল সমীরণে ॥
আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে"
আমি নিজের ঘরটি ছেড়ে আর কোথাও যাব না। ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করে রাখব এই ঘর। এই নিরালা পরিসর। যদি সে আসে? কে এই সে?। চোখ চলে যায় বইটির প্রচ্ছদে বা পুস্তানি পেরিয়ে ছেড়ে রাখা দুটো পাতায়। একই ছবি দু'জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু পাতায় ছবিটি আরও বেশি জায়গা পেয়ছে। ছবিটি আপাত ভাবে দেখে মনে হয় যেন একটা মেঝে। তার এক কোণে একটি অংশে লেখা গ্রন্থনাম (ছোট হরফে-book one)।
দেখলে মনে হবে যে প্রশস্ত মেঝে তবু এক কোণে কেউ শুয়ে আছে, নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে। অপ্রকাশেই যেন তার প্রকাশ। হঠাৎ মাথায় আসে চৈতন্য গম্ভীরার কথা। সমুদ্র থেকে পুরীর মন্দিরের রাস্তায় যেতে রাস্তার ডান দিকে পড়বে। প্রশস্ত দালান। ঠিক এমনই ছককাটা মেঝে। কিন্তু চৈতন্য তার শেষ জীবনে পড়ে থাকতেন এই বিরাট দালানকোঠার এক কোণে। নিরালায়। একটি অতি ছোট প্রকোষ্ঠে। যে ঘরে কোনো জানলা নেই। এমনকী সূর্যালোকও প্রবেশ করে না। যে মানুষ একদিন নিজের মতপ্রতিষ্ঠায় লোকলস্কর জুটিয়ে নীলাম্বর বেশ পরে চোখে কাজল লাগিয়ে কীর্তনে বিভোর হয়ে কাজীর বাড়ি গিয়েছিলেন, সেই মানুষই এই গম্ভীরায় থাকাকালীন, শেষ দিনগুলিতে প্রায় কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। দিনে একবার বেরোতেন স্নানের জন্যে। খেতেন অতি সামান্য। এভাবে থাকতে তাকে কেউ বাধ্য করেনি। স্বয়ং পুরীর মহারাজ তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন। তিনি নিরাসক্ত, একটিই ধ্যানে মগ্ন, সারাদিন বলছেন- হা কৃষ্ণ। অন্তর তার রাধা, কায়মনোবাক্যে সেই অন্তর খুঁজছে কৃষ্ণকে। তার আর কিছু প্রমাণের দায় নেই। কাউকে তর্কে হারানোর নেই। সামাজিকতা লোকলজ্জার ভয় নেই। অর্ধেক সময় পোশাক গায়ে থাকে না। তিনি শুধু নিজের অন্তরের ডাক শুনতে চান। এবং এ পথে ক্রমমুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে চান। তার ঘর এই ছোট প্রকোষ্ঠ। ঘরের ভিতর ঘর তার মন। সেদিকেই চেয়ে আছে তার বাহ্যশরীর। কবীর বলছেন-
"মোকো কাহা ঢুন্ডে রে বন্দে ম্যায় তো তেরে পাস রে"
যে সত্য আমার কাছে আছে তার দিকে তাকানোর সময় আমার নেই। আমি তাকে খুঁজছি বাজারে। একবার যদি অন্তরে তাকাতাম তবে দেখতে পেতাম সেই পদ্মজাকে। আজও, সত্যিই যদি তাকে পেতে চাই, আমাকে ফিরে আসতে হবে আমার ঘরে। লোকলজ্জা, সামাজিক নিয়মকানুনের বেড়াজাল ভেঙে, একান্ত আমির কাছে। শর্মিষ্ঠার গোটা কাব্যগ্রন্থটিতে এই আমি (I) ফিরে ফিরে আসে। আমি একই কবিতা ঘুরেফিরে পড়ি। বুঁদ হয়ে বসে থাকি ভাবনা-সংক্রমিত হয়ে।
শর্মিষ্ঠা মোহান্তির এই কাব্যগ্রন্থে একটি দু'লাইনের কবিতা আছে। নাম-Somewhere.কবিতাটি এই রকম-
Wherever I May be now only love and solitude remain.
they take on each others dimension.
শর্মিষ্ঠা মোহান্তির চোখে ভালোবাসা আর নির্জনতা একে অন্যের পরিপূরক। আমরা বাজারে ভিড়ের মধ্যে ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারি। কিন্তু ভালবাসতে কি পারি? ভালোবাসার যে গভীর অনুভব তাতে কি পৌঁছতে পারি? বোধহয় পারি না। সারা জীবন জনারণ্যে কৃষ্ণনাম প্রচার করে তাই প্রেমাস্পদকে চৈতন্য খুঁজছেন একটি অন্ধকার কুঠুরিতে। আবার রবীন্দ্রনাথের লেখায় ফিরতে হবে।
নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা,
ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার-- আজ লব তাঁর দেখা॥
সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে,
সন্ধ্যাবেলার আরতি হয় নি আমার শেখা॥
এই গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ১৯১০ সালে। আর আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে গানটি লেখা ১৯১৪ সালে। অর্থাৎ চার বছর একটিই ভাবনা বীজ লালন করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিচ্ছিন্ন হতে চাইছেন। মন সরিয়ে নিতে চাইছেন। নিজের মুখোমুখি হতে চাইছেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজের সঙ্গে সংলাপে জড়াবে সে কি পুরুষ না মহিলা? চৈতন্য কি পুরুষ না নারী? নির্জন, মগ্ন রবীন্দ্রনাথ পুরুষ না নারী? শর্মিষ্ঠা মোহান্তি লেখেন,
In my solitude I am neither man nor woman
গভীর নির্জনতায় আমি পুরুষও নই নারী ও নই। আমি তবে কি? আমি আত্মস্থিত একটি বিন্দু। আমি কেউ নই। আমি আমার স্রেফ চৈতন্য। আমি একটি নক্ষত্র। যা নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে হারিয়ে যাবে। সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে ওই বিরাট দালান। মহাসময়।