সংখ্যার রাজনীতিতে জাভেদ আখতাররাই চিরশত্রু

মুসলিম মৌলবাদকে যাকে এভাবে তোল্লাই দিতে হয়, হিন্দু মৌলবাদের বিরোধিতা করার এক্তিয়ার কি তার আছে? যে মোল্লাতন্ত্রের হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় না, হিন্দুত্ববাদের বিপদ থেকে সে সেকুলার-নাস্তিককে বাঁচাতে বাড়তি দায়-দরদ দেখাবে?

কারণ সে বিশ্বাসী নয়। এমনকি, বিশ্বাসার্থীও নয়। যুক্তি ছাড়া তার আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ঈশ্বরের অনুগ্রহ সে অস্বীকার করে। তাই, ঘরে-বাইরে তাকে মারা হবে। ফেসবুকে ট্রোল করা হবে, একা করে দেওয়া হবে। হুমকিতে কাজ না হলে ঢাকায় প্রকাশ্য রাস্তায় চাপাতি চালাবে বিশ্বাসের প্ল্যাকার্ডবয়রা। ভারতেও অপমান করবে, ঘাড়ধাক্কা দেবে, মারবে। এসব ঘটনা হঠাৎ ঘটে না। ঘটে রোজ। প্রচার পায় ধর্মোন্মাদের বড়শিতে বড় মাছ উঠলে। বইমেলা থেকে ফেরার পথে আততায়ীর হাতে নিহত ব্লগার এমন হেডলাইন চোখে পড়লে একটু শোরগোল হয়। জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান কট্টর মুসলিম মৌলবাদী  পণ্ড করার পণ নিলে অবাক ক'জন বলে, এমনটাও হয়! হয়। আকছার হয়। এমনটাই হয়। আসল কথা হলো, নাস্তিকরা এ সমাজে সবচেয়ে প্রান্তিক। তাদের অস্তিত্বের কোনো দাম নেই। ঈশ্বর নেই বললে তুমিও নেই, তোমার জন্যে কোনো শ্রদ্ধা অবশিষ্ট নেই। সহমানুষ, সহনাগরিক তো বটেই, তোমার অবস্থানকে রাষ্ট্রও বিন্দুমাত্র পাত্তা দেবে না। রাজানুগ্রহ, নৈব নৈব চ। 

খাস কলকাতায় জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ার কথা কানে আসা ইস্তক বারবার মনে পড়ছিল তসলিমা নাসরিনকে তাড়ানোর দিনগুলির কথা। জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ ছাড়তে হয় তসলিমা নাসরিনকে। বহুদেশ ঘুরে ক্লান্তপ্রাণ তরুণী ঠাঁই নিয়েছিলেন কলকাতায়। এ শহরেই তার মাথার দাম ধার্য করেন মৌলবাদীরা। দাঙ্গাবাজদের মাথা ভেঙে দেওয়ার কথা বুকবাজিয়ে বললেও সেদিন শাসক আসলে তসলিমাকে রক্ষা করতে পারেনি। সত্যটা হলো, লেখার জন্যেই তাঁকে বহুমাত্রিক রিফিউজি হতে হয়েছে। প্রথমে দেশ, তারপর ভাষাপৃথিবীতে জুটেছে তিরস্কার। বিশ্ব ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল নয়, তবে গর্বের শহরের মুখ ম্লান করার জন্যে যথেষ্ট।

 আরও পড়ুন- হিন্দিও এক ‘বাংলাদেশি’ ভাষা

তসলিমাকে তাড়ানোর আগে পশ্চিমবঙ্গে দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধ করার পক্ষে লেখা বয়ানে ২৪জন লেখক শিল্পী সাক্ষর করেছিলেন এই শহরে বসেই। তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন ঘোষিত মুক্তমনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নাকি লিখেছিলেন, এই বইটায় এমন কিছু আছে যা সম্প্রীতির পক্ষে খারাপ। জনান্তিকে এক প্রবীণ প্রতক্ষ্যদর্শী বলছিলেন, এমনকি দেশ পত্রিকায় এই সেনসরশিপের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখতেও রাজি হননি তিনি। বরং একটি দৈনিক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে গর্ব করে বলেছিলেন, "আমরা আগেই অনুমান করেছিলাম, তাই স্ফূলিঙ্গকে বারুদের কাছ পর্যন্ত আমরা পৌঁছতে দিইনি।" এই 'আমরা' আর কোনো লেখক থাকেন না, দল হয়ে যান।

কিন্তু বই পুড়িয়ে কি অক্ষরের মৃত্যু ঘটানো যায়? কেন সেদিন গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা তসলিমার সঙ্গে বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি? কেন সম্মুখসমরে কূটতর্কে তাঁকে হারাতে পারেনি কেউ? কারণ সমাজ মনে করে মৌলবাদীর চেয়েও নাস্তিক খারাপ? নাস্তিক ঈশ্বরকে মানে না অর্থাৎ হৃদয়ে অবাধ্য, সামনের লোকটাকেও মানবে না। এমন লোককে কে চায়! তাকে একা করে দিতে হবে, চুপ করিয়ে দিতে হবে, পুড়িয়ে দিতে হবে তার বই। লেলিয়ে দিতে হবে গেস্টাপো। ধর্মোন্মাদ তো বটেই, আপাত ভাবে ধর্মে নিস্পৃহ সেকুলারকেও তাই পাশে পান না তসলিমারা। অশান্তি হতে পারে, মৌলবাদীদের একঘরে করার বদলে একা নাস্তিককে গ্রামছাড়া করার জন্যে যথেষ্ট এই অজুহাত। আজ তসলিমার সমস্ত অবস্থান আসলে এই শহরের দমন পীড়নের ইতিহাসেরই ফলাফল। 

জাভেদ আখতারকে আমন্ত্রণ করেও তা প্রত্যাহার আসলে আরও একবার সেই মৌলবাদের চরণেই সমর্পণ। জাভেদ আখতার ঘোষিত নাস্তিক। মুসলিম মৌলবাদ আর হিন্দু মৌলবাদ দুইই তাঁর যুক্তির পৃথিবীতে খতরনাক। সমস্বরেই তাই দুইয়েরই বিরোধিতা করেন। তাঁর এই বিরোধিতাও যে সাংবিধানিক, বেএক্তিয়ার নয়, সে কথা বলার লোক কম। ইতিহাস প্রমাণ, সেকুলারদেরও দায় নেই। আজ যারা বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, তারা তসলিমা বিতাড়নের সেদিনের মতোই হাতেগোনা। তবে দু'টি ঘটনাকে সরলরৈখিক ধারাবাহিকতায় দেখলে হবে না। ‘হিন্দি সিনেমায় উর্দু’ শীর্ষক একটি আলোচনায় তাঁকে যোগদানের অনুরোধ জানায় পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অ্যাকাডেমি। সরকারি প্রতিষ্ঠান। মিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ (কলকাতা শাখা) এবং ওয়াহইন ফাউন্ডেশন আখতারের চাপে সেই আমন্ত্রণ তুলে নিতে হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। সরকার চাইলে কঠোর অবস্থান নিতে পারত। মান্য অতিথিকে মান দিয়ে নিজের মান রাখতে পারত। কিন্তু ঢোক গিলতে হলো কারণ সর্ষের ভিতরেই ভূত। অনুষ্ঠানে আপত্তি আসে সরকারের ভিতর থেকেই। এই আপত্তিকে মেনে নেওয়া সরকারের দলীয়করণের সবচেয়ে বড় নজির।

আরও পড়ুন- মুক্তমনা বলেই বাতিল করতে হলো জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান?

আসলে গোঁড়া মৌলবাদীদের সঙ্গে কথোপকথনের ক্ষমতা, সামর্থ্য, ইচ্ছে কোনোটাই এ রাজ্যে প্রায় বিরোধীশূন্য সরকারের থাকার কথা নয়। তৃণমূল প্রতিনিধিদের কাছে কট্টর মৌলবাদী সংগঠনগুলিও অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের হাতে আছে সংখ্যার রিমোটকন্ট্রোল। এই সমস্ত সংগঠনের মাথারাই ধর্মের আফিমে যুক্তিবুদ্ধি হারানো মানুষকে বুথে নিয়ে যাবে, প্রশ্নহীন ভোটার কে না চায়। চিরকাল ক্ষমতায় টিকে থাকার আহ্লাদের চেয়ে একজন নাস্তিকের মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার বড় হতে পারে না কোনো শর্তেই।

প্রশ্ন হলো, মুসলিম মৌলবাদকে যাকে এভাবে তোল্লাই দিতে হয়, হিন্দু মৌলবাদের বিরোধিতা করার এক্তিয়ার কি তার আছে? যে মোল্লাতন্ত্রের হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় না, হিন্দুত্ববাদের বিপদ থেকে সে সেকুলার-নাস্তিককে বাঁচাতে বাড়তি দায়-দরদ দেখাবে? জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিলের আবদার দিয়ে যে তালিকা শুরু, তার শেষ কোথায়? এই সব তুষ্টিকরণ তুকের সঙ্গে সভ্যতার, আলোর কোনো সম্পর্কই নেই, তা কে বোঝাবে, কাকেই বা বোঝাবে, সংখ্যার তো বোধ থাকে না। 

More Articles